তুর্কিদের সাফল্যের কারণ:
ভারতের বিরুদ্ধে মুসলমান আক্রমণকারীদের, বিশেষত তুর্কি যোদ্ধাদের সাফল্য তথা সামরিক ঐতিহ্যের অধিকারী ভারতীয় হিন্দুদের পরাজয় বাস্তব হলেও কিছুটা আশ্চর্যজনক। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারক, বিশালায়তন ও জনবহুল এমন একটি দেশের নবোধিত তুর্কিজাতির হাতে দ্রুত পতন সত্যই অভূতপূর্ব একটি ঘটনা। ঐতিহাসিক মহম্মদ হাবিবের ভাষায় : “Seldom is human history has a country so large, so populous and, according to the academic standards of the age, so cultured and civilised as far as the upper classes were concerned, been conquered so easily, and by such common place men (as the Turks)।” নিজেদের দেশে এবং পরিচিত পরিবেশে যুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় রাজন্যবর্গ এবং সেনাবাহিনী বহিরাগত মুসলমানদের বিরুদ্ধে কখনোই কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। মহম্মদ-বিন্-কাশিম কিংবা সুলতান মামুদের বিরুদ্ধে ভারতীয় প্রতিরোধ ছিল শূন্য। মহম্মদ ঘুরির বিরুদ্ধে দু-একটি রণক্ষেত্রে ভারতীয় বাহিনী সাফল্য পেলেও, তা এত ক্ষণস্থায়ী ও নিষ্ফলা ছিল যে, ইতিহাসের ঘটনা পরম্পরায় তা মূল্যহীন। যাই হোক্, ঐতিহাসিকেরা এই বিচিত্র পরিণতির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে একাধিক তথ্য ও তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। তবে লক্ষণীয় যে, মধ্যযুগীয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে কেউই মুসলমানদের সাফল্য বা হিন্দুদের ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কে আলোচনা করেননি। সমসাময়িক তিনজন লেখক হাসান নিজামী, মিনহাজউদ্দিন এবং ফকর মুদাব্বির যুদ্ধের বিবরণ লিপিবদ্ধ করলেও ফলাফলের বিশ্লেষণ করেনি।
প্রাথমিক বিচারে তুর্কিদের অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধা মনে করার কারণ নেই। মহম্মদ ঘুরি ১১৭৮ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের রাই’র কাছে এবং ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে তরাইনে রাই পিথোরার কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১১৯২ নীতি-বিগর্হিত ভাবে ভোরবেলা ঘুমন্ত ও অপ্রস্তুত রাজপুত সেনাদের আক্রমণ করে সফল হতে পেরেছিলেন। চান্দোয়ার যুদ্ধেও (১১৯৪ খ্রিঃ) প্রধান ঘুরি বাহিনী সরাসরি যুদ্ধে সাফল্য পায়নি। কুতুবউদ্দিন আইবক তাঁর উন্নত রক্ষীবাহিনীর সাহায্যে কনৌজে সফল হয়েছিলেন। আবার বাংলা-বিহার বিজয়ী ইখতিয়ারউদ্দিনও যথেষ্ট উন্নতমানের সেনাপতি ছিলেন না। সাধারণ সৈনিক পদে যোগ্যতার পরীক্ষায় তিনি দু’বার ব্যর্থ হয়েছিলেন। অথচ মাত্র দু-হাজারের মতো সৈন্য নিয়ে তিনি বাংলা ও বিহারের প্রায় অর্ধেক অংশ দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তী বারো তেরো বছরের মধ্যেই সমগ্র উত্তর ভারত, ইরাবতীর একতীর থেকে ব্রহ্মপুত্রের অন্য তীর পর্যন্ত ভূ ভাগ তুর্কীদের দখলে চলে গিয়েছিল। এহেন অস্বাভাবিক পরিণতির কারণ কেবল সামরিক শক্তি বা যুদ্ধ পদ্ধতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা সম্ভব নয়।
ইরফান হাবিব মন্তব্য করেছেন যে, ‘এত বিশাল একটি দেশ, যার বিপুল জনসংখ্যা এবং শিক্ষা সংস্কৃতির বিচারে অগ্রণী উচ্চতর শ্রেণির অধিকারী, সমকালের বিচারে যার জ্ঞান-বিজ্ঞানের মান যথেষ্ট উন্নত—একটি অতি সাধারণ মানের আক্রমণকারীর হাতে সে-দেশের এত সহজে পরাজিত হওয়ার ঘটনা মানব সভ্যতার ইতিহাসে কদাচিৎ ঘটেছে। অধ্যাপক হাবিব মনে করেন যে, ভারতবর্ষের পরাজয়ের ব্যাখ্যা সামরিক উপাদানের মধ্যে নয়, বরং সামাজিক উপাদানের মধ্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এই প্রসঙ্গে তিনি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ভারতীয় নগর-শ্রমিকদের ভূমিকা ও নগর-বিপ্লবের ধারাবাহিক অবদানের উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, ভারতীয় সমাজ ছিল এক অচলায়তন। স্মৃতিশাস্ত্রের নির্দেশিত বর্ণবৈষম্য ব্যবস্থা মানব প্রতিভার বিকাশের পথে ছিল বাধাস্বরূপ। শাসক, অভিজাত সহ উচ্চবর্ণের সীমিত সংখ্যক মানুষ বাস করতেন নগর-প্রাকারের মধ্যে। আর যুদ্ধ করতে সক্ষম শ্রমজীবী মানুষের স্থান ছিল প্রকারের বাইরে। তারা ছিল অবহেলা আর হেনস্থার প্রতীক। তুর্কীদের নেতৃত্বে এরাই মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রবল পরাক্রম দেখিয়েছিল, অথচ হিন্দু রাজাদের আমলে তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর কোন সুযোগ ছিল না। আসলে বর্ণব্যবস্থাভিত্তিক সমাজে দাসত্বের জীবনযাপনে বাধ্য এই শ্রমজীবী শ্রেণি স্বাভাবিক ভাবেই ছিল নিষ্ক্রিয় ও নিস্পৃহ। তুর্কীদের আগমনের পরে ‘স্মৃতিশাস্ত্র’ আর ‘শরিয়ত’-এর মধ্যে দ্বিতীয়টিই শ্রমজীবী ভারতবাসীকে আকৃষ্ট করেছিল। তাই ড. হাবিব লিখেছেন যে, ‘সঠিক বৈজ্ঞানিক ও অ-সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বিশ্ব-ইতিহাস ও ভবিষ্যতের ভারতীয় ইতিহাসের নিরিখে, ভারতে এই তথাকথিত ঘুরি-বিজয় ছিল প্রকৃতপক্ষে ঘুরি-তুর্কিদের নেতৃত্বে ভারতীয় নগর-শ্রমিকদের সংঘঠিত এক বিপ্লব।’
সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুর্কি-যোদ্ধাদের সাফল্য অনিবার্য করেছিল। আপাতভাবে এমন ধারণা অমূলক নয়। বস্তুত, নবম-দশম শতকে ভারতের রাজনীতির দৈন্য কেবল তুর্কি নয়, যে-কোনো বহিরাগত আক্রমণকারীর সাফল্য সূচিত করার উপযোগী ছিল। উত্তর ভারতে হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর আক্ষরিক অর্থে কোনো শক্তিশালী রাজ্য গড়ে উঠেনি। উত্তর ভারতে পাল ও সেন রাজাদের নেতৃত্বে যে আঞ্চলিক রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়, বহিরাগত আক্রমণ প্রতিহত করার পক্ষে তা আদৌ যোগ্য ছিল না। দক্ষিণ ভারতের শক্তিগুলি আঞ্চলিকভাবে হলেও শক্তিশালী ছিল। কিন্তু সর্বভারতীয় রাজ্য স্থাপনের ইচ্ছা বা উদ্যোগ তাদের ছিল না। উপরন্তু আঞ্চলিক ক্ষেত্রে তারা নিরন্তর যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থেকে নিজেদের শক্তি ক্ষয় করছিল। পাল-প্রতিহার ও রাষ্ট্রকুটরা দীর্ঘ দুশো বছর যুদ্ধে লিপ্ত থেকে কেবল নিজেদের শক্তি ক্ষয় করেছিল। এই সময় উত্তর ভারতে অনেকগুলি রাজপুত গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। এদের মধ্যে কয়েকটি গোষ্ঠী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্যেরও পরিচয় দেয়। যোদ্ধা ও দেশপ্রেমিক হিসেবে এদের গুণাবলি ছিল সন্দেহের ঊর্ধ্বে। কিন্তু রাজপুতদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ছিল প্রবল। বস্তুত, সংকীর্ণ গোষ্ঠীবিরোধ ও দ্বন্দ্ব রাজপুতদের সমস্ত উদ্যম ও গৌরবকে ম্লান করে রেখেছিল। ফলে কোনো বহিরাগত আক্রমণের বিরুদ্ধে এরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। উত্তর ভারতের রাজনীতির এই সংকট ও দুর্বলতা তুর্কিদের সাফল্য সহজতর করে তোলে।
তবে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক অনৈক্যই তুর্কিদের সাফল্যের একমাত্র বা প্রধান কারণ ছিল না। সমকালীন ভারতের সমাজ, অর্থনীতি, ধর্ম, ইত্যাদি নানা কারণে তুর্কিদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের প্রতিরোধ দুর্বল হয়েছিল। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক এল্ফিনস্টোন, লেপুল, ভিন্সেন্ট স্মিথ প্রমুখ মুসলমানদের সাফল্যের কারণ হিসেবে হিন্দুদের তুলনায় তাদের সবল দেহ, অসীম সাহস ও অদম্য মনোবলের কথা উল্লেখ করেছেন। এঁরা মনে করেন, শীতপ্রধান দেশ থেকে আগত এবং মাংসাশী তুর্কি-আফগান, পারসিক সেনারা গ্রীষ্মপ্রধান ভারতবর্ষের নিরামিষাশী ভারতীয় সৈন্যদের থেকে দেহে ও মনোবলে অনেকটাই এগিয়েছিল। এলফিন্স্টোন লিখেছেন : “দুর্ধর্ষ সেল্জুক-তুর্কি এবং তাতারদের বিরুদ্ধে বিজয়ী মুসলমান সৈনিকদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভদ্র ও নম্রমনা হিন্দুদের পরাজয় ছিল স্বাভাবিক পরিণতি।”কিন্তু ঐতিহাসিক নিজামী, ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ, শ্রীবাস্তব প্রমুখ ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের যুক্তি মানতে পারেননি। নিজামী লিখেছেন, “মোঙ্গলদের হাতে মুসলমানদের পরাজয়ের ঘটনা ইংরেজ ঐতিহাসিকদের এই তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে। ঠান্ডা আবহাওয়ার মানুষ মাত্রেই দক্ষ যোদ্ধা হবে কিংবা আমিষ ভক্ষণকারীরা সবাই উন্নত যোদ্ধা হবে—এ ধারণা বিজ্ঞানসম্মত নয়।” শ্রীবাস্তব লিখেছেনঃ “The theory that makes the people of a cold climate fighters or that which seeks to show that non-vegetarian are necessarily better fighters does not stand the test of sientific examination.” ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ যোদ্ধা হিসেবে রাজপুতজাতির প্রশংসা করে লিখেছেনঃ “The Rajputs were the finest soldiers, scarcely inferior in the qualities, in courage, valour and endurance of ment of any other country.” তাছাড়া, মুসলমান আক্রমণকালে ভারতীয় সৈনিকদের সবাই নিরামিষাশীও ছিল না। তাই ইংরাজ ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যাকে ভারতীয়দের পরাজয়ের কারণ বলে মেনে নেওয়া যায় না।
কেউ কেউ মনে করেন, মুসলমান সৈনিকদের ধর্মীয় প্রেরণা তাদের সাফল্যের সহায়ক হয়েছিল। বিধর্মী ও পৌত্তলিক হিন্দুদের ধ্বংস করে গাজি হওয়ার একান্ত ইচ্ছা তাদের জীবনপণ লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মুসলমান সৈনিকেরা ইসলামের প্রসারকে তাদের অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করার ফলে, তাদের যুদ্ধোন্মাদনা নতুন মাত্রা পেয়েছিল। কিন্তু ঐতিহাসিক নিজামী এই মতের বিরোধিতা করেছেন। মহম্মদ সাদি’র কবিতা উল্লেখ করে নিজামী লিখেছেন যে, “লস্কর (সৈন্য) তার প্রাপ্য বেতনের জন্যই যুদ্ধ করে ; রাজা, দেশ বা ধর্মের জন্য যুদ্ধ করে না।” তিনি আরও লিখেছেন যে, আরব-আক্রমণকারীদের সময় (অষ্টম শতকে) যে ধর্মীয় প্রেরণা ছিল, পরবর্তীকালে তা আদৌ ছিল না। তুর্কি উপজাতিভুক্ত সৈন্যদের অনেকেই তখন পুরোপুরি ইসলামে ধর্মান্তরিত ছিল না। এমনকি তুর্কি সেনাপতিদের অনেকেই তখন ধর্ম সম্পর্কে সম্যক সচেতনও ছিলেন না। তাই ধর্মীয় প্রেরণা কোনোভাবেই তাদের যুদ্ধপ্রেরণা বৃদ্ধি করেনি। নিজামী লিখেছেন : “This could only have been a mere passing mood’ and not a permanent objective or inspiring motive of their campaigns.” সুতরাং জলবায়ু, দৈহিক গঠন কিংবা ধর্মীয় প্রেরণা নয়, মুসলমানদের সাফল্যের কারণ অন্য কোথাও খুঁজতে হবে।
অধ্যাপক নিজামী তৎকালীন ভারতবর্ষের ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থাকে ভারতীয়দের পরাজয়ের প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, কঠোর জাতিভেদ ও বর্ণবৈষম্য ভারতের সামাজিক জীবনে ভেদাভেদের যে প্রাচীর তুলেছিল, তা সমগ্র সামরিক ব্যবস্থাটাকেই রুগ্ন ও দুর্বল করেছিল। জাতিভেদ ও সামাজিক বৈষম্য জন্ম দিয়েছিল রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার। নিজামীর ভাষায়: “… the invidious caste distinctions, which rendered the whole military organisation rick ety and weak, Caste taboos and discriminations killed all sense of unity-social or political.” ধর্মাচরণে ছিল ব্রাহ্মণদের একচ্ছত্র আধিপত্য; আর রাজ্যশাসনে রাজপুত বা ক্ষত্রিয়দের। সাধারণ মানুষের সাথে সমাজের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত ব্রাহ্মণদের বা রাজপুতদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। ধর্মে বা রাজনীতিতে সাধারণ জনসমাজকে মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী মানুষ কর্তৃক অপাংক্তেয় করে রাখার ফলে ভারতীয় সমাজে যে অবক্ষয় এসেছিল, তাতে লাভবান হয়েছিল আক্রমণকারী মুসলমানেরা। যুদ্ধের পরিণতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ছিল উদাসীন। তাই বিপদের মুহূর্তে গণশক্তি সংগ্রহ করার কোনো সুযোগ ভারতীয়দের ছিল না। যুদ্ধবিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রেও নিম্নবর্ণের মানুষের কোনো স্থান ছিল না। এমনকি অস্পৃশ্যতার নীতি অনুসরণ করার ফলে নিম্নবর্ণের মানুষ সেনাবাহিনীর সাহায্যকারী হিসেবেও কাজ করতে পারত না। তাই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ‘শ্রম বিভাজন’ ব্যবস্থার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সেক্ষেত্রে একজন সৈনিককে যুদ্ধও যেমন করতে হত, তেমনি নিজের পানীয় জলও সংগ্রহ করতে হত। যোদ্ধার সর্বোচ্চ সেবা আদায়ের পক্ষে এই ব্যবস্থা ছিল বিপজ্জনক। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার, স্যার যদুনাথ সরকার, কে. এস. নাল প্রমুখও নিজামীর সাথে একমত হয়ে ভারতের পচনশীল সমাজব্যবস্থাকে হিন্দুদের দুর্বলতার মূল কারণ বলে উল্লেখ করেছেন।
পক্ষান্তরে, মুসলমানদের মধ্যে ছিল সামাজিক সাম্য ও ধর্মীয় ঐক্য, যা তাদের এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত করেছিল। আচার্য সরকার লিখেছেন : “Islam gave to its followers…. complete equality and social solidarity, as regards legal status and religious privileges.” আইন ও ধর্মের চোখে এই সাম্যবোধ ইসলামের মধ্যে জাতিগত ভেদাভেদ সম্পূর্ণ নির্মূল করে দিয়েছে এবং সমগ্র ইসলাম সম্প্রদায় এক অভিন্ন পরিবারের সদস্য হিসেবে অগ্রসর হয়েছে নিজেদের লক্ষ্যপথে। তাই ইসলামের শক্তি হয়েছে অপ্রতিরোধ্য। এই প্রসঙ্গে কে. এস. লাল বলেছেন যে, “ভারতীয় সম বর্ণবৈষম্য বর্ণসংঘাতের জন্ম দিয়েছিল। এর ফলে মুসলমানদের পক্ষে বিশ্বাসঘাতক সংগ্রহ করা সহজ হয়েছিল, যাদের সাহায্যে আক্রমণকারীরা ভারতীয়দের শক্তিসামর্থ্য ও দুর্বলতা সম্পর্কে বহু গোপন ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে নিজেদের রণকৌশল স্থির করতে পেরেছিল।”
ভারতের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এবং প্রতিরক্ষা-সম্পর্কিত সচেতনতার অভাবও মুসলমানদের সাফল্যকে ত্বরান্বিত করেছিল। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যবর্তীকালে ভারতে কোনো কেন্দ্রীয় শক্তির অস্তিত্ব ছিল না। গোটা দেশ জুড়ে ছিল অসংখ্য ছোটো ছোটো রাজ্য,—যাদের মধ্যে না ছিল ঐক্য, না ছিল স্বদেশচেতনা। যে রাজপুতজাতি শৌর্যবীর্যের প্রতীক হিসেবে বন্দিত, তাদের গোষ্ঠীবিরোধ এবং সংকীর্ণ গোষ্ঠীচিন্তা বিচক্ষণ ও দূরদর্শী মুসলমান আক্রমণকারীদের উৎসাহবর্ধন করেছে। এমনকি উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপথ দিয়ে আরবদের আক্রমণ ঘটে যাওয়ার তিনশো বছর পরেও তারা সীমান্ত সম্পর্কে উদাসীন থেকেছেন। প্রতিরক্ষা বলতে ভারতীয় নৃপতিরা বুঝতেন তাৎক্ষণিক আত্মরক্ষা এবং কোনোক্রমে নিজের রাজ্যটুকুকে রক্ষা করা। এরা সবাই ‘ভারতের রাজা ছিলেন; কিন্তু কেউই ‘ভারতীয় রাজা’ হয়ে উঠতে পারেননি। তাই আরও দুশো বছর পরে যখন মহম্মদ ঘুরি আক্রমণ করেন, তখনও সীমান্তদেশ ছিল অরক্ষিত এবং অবাধ।
ভারতীয়দের পরাজয়ের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল তাদের পশ্চাৎপদ সামরিক ব্যবস্থা। তুর্কিদের সামরিক বাহিনীর সংগঠন, যুদ্ধকৌশল, যুদ্ধের সরঞ্জাম এবং অস্ত্রাদি সবই ছিল ভারতীয়দের তুলনায় উন্নত। নিজামী লিখেছেন : “…. There were basic differences in the principles on which the Indian and Turkish forces were organised, maintained and fought in the battlefield.” তুর্কিবাহিনীর মর্মকথা ছিল ক্ষিপ্রতা। দ্রুতগামী অশ্বপৃষ্ঠে বসে হালকা ধনুক থেকে তারা অল্প সময়ে অজস্র তির নিক্ষেপ করতে পারত। অশ্বারোহী সৈন্যরা দ্রুত অগ্রসর হতে বা পশ্চাদগামী হতে পারত। লৌহ-রেকার ব্যবহার করার ফলে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে স্থিরলক্ষ্যে তির নিক্ষেপ করা তাদের পক্ষে সহজসাধ্য হয়েছিল। পক্ষান্তরে, ভারতীয় সামরিক ব্যবস্থায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত হাতিকে। মন্থরগতি হাতির পক্ষে দ্রুতগামী অশ্বের সাথে পাল্লা দেওয়া সম্ভব ছিল না। রাজপুতরা যুদ্ধকৌশল হিসেবে ঘনবিন্যস্ত ব্যূহ রচনা করে শত্রুপক্ষের ওপর একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ধ্বংস করতে চেষ্টা করত। কিন্তু মহাভারতের যুগের যুদ্ধপদ্ধতি যে মধ্য-এশিয়ার ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন অশ্বারোহী তিরন্দাজ বাহিনীর কাছে অকেজো হয়ে যাবে, এ সত্য রাজপুতরা উপলব্ধি করতে পারেনি। আসলে মধ্য-এশিয়ার যুদ্ধপদ্ধতিতে দ্রুতগতি এবং হালকা অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার ও কার্যকারিতা সম্পর্কে ভারতীয় নৃপতিবর্গ উদাসীন থেকে নিজেদের ব্যর্থতা ডেকে এনেছিলেন। স্যার যদুনাথ সরকার তুর্কিদের অশ্ববাহিনীর অধিক কার্যকারিতার পাশাপাশি তাদের রসদ ও যুদ্ধসরঞ্জামের বাহক হিসেবে উটের ব্যবহারের উপযোগিতার কথা উল্লেখ করেছেন। ভারতীয়রা এই কাজে ব্যবহার করত বলদ। বলদের তুলনায় উট ছিল দ্রুতগামী এবং বলদের খাদ্যসংগ্রহের জন্য সমস্যায় পড়তে হত, উটের ক্ষেত্রে তা ছিল না। কারণ উট সাধারণত গমনপথের পার্শ্ববর্তী গাছপাতা থেকেই নিজখাদ্য সংগ্রহ করে নিতে পারত। ড. সরকার লিখেছেন : “Banjara pack-oxen of the Hindu commissarial were slow and burdensome.” R. C. Smile তাঁর ‘Crusading Warfare, A Contribution to Medieval Military History’ নামক প্রবন্ধে বলেছেন যে, অশ্বপৃষ্ঠে ধাবমান অবস্থায় তুর্কি সৈন্য ধনুকে তির সংযোজন ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিক্ষিপ্ত করতে পারত। ফলে ঘনবিন্যস্ত এবং শ্লথগতিসম্পন্ন ভারতীয় বাহিনী পরাভূত হয়েছিল অনিবার্যভাবে। শ্রীবাস্তব লিখেছেন : “Our military leaders did not keep themselves in touch with the development of tacts….. we were therefore outclassed in weapons and out-manoeuvred in tactics.”
যুদ্ধ সম্পর্কে রাজপুত এবং তুর্কিদের দৃষ্টিভঙ্গিরও পার্থক্য ছিল। মুসলিম তুর্কি সৈন্য যুদ্ধ করেছিল রাজ্য-সম্পদ ও বিজয়ীর গৌরব অর্জনের জন্য। যে-কোনো উপায়ে যুদ্ধে সাফল্য অর্জন করতে তারা দ্বিধা করত না। কিন্তু রাজপুতদের কাছে যুদ্ধ ছিল এক ধরনের খেলা – যেখানে কিছু নিয়ম ও নীতি অনুসরণ করাকে তারা নৈতিক কর্তব্য বলে মনে করত। যুদ্ধক্ষেত্রে সততা প্রদর্শন ভারতীয় ঐতিহ্যের সাথে জড়িত ছিল। শত্রুকে দুর্বল করার জন্য কিংবা বিচ্ছিন্ন করার জন্য কোনো গোপন পরিকল্পনা বা মিথ্যাচার কাপুরুষতার লক্ষণ বলে নিন্দিত হত। তাই পানীয় জলে বিষ মিশ্রিত করে কিংবা বিশ্বাসঘাতকের সহায়তায় শত্রুকে আঘাত হানার কোনো চেষ্টা তারা করেনি। ড. রোমিলা থাপার লিখেছেন : “ ছোটোখাটো যুদ্ধে সেরকম নিয়ম মেনে বীরধর্ম প্রদর্শন করা সম্ভব হলেও আফগানদের সঙ্গে যুদ্ধে এসবের অবকাশ ছিল না।” তাই U. N. Ghosal লিখেছেন : “They (Rajputs) were inspired by a high sense of chivalry and military honour which made them unfit even for practical success in warfare.”
অধ্যাপক সতীশচন্দ্র ও ড. আর. সি. দত্ত প্রমুখ মনে করেন, সামন্ত-প্রথার বিকাশের ফলে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সংগঠন দুর্বল হয়েছিল। ভারতীয় নৃপতিরা সরাসরি বিশাল বাহিনী পোষণ বা নিয়ন্ত্রণ করতেন না। সামরিক শক্তির জন্য তাঁরা একান্তভাবে নির্ভরশীল ছিলেন সামন্ত নায়কদের ওপর। ফলে ভারতীয় বাহিনীর মধ্যে একাত্মতা বা সমন্বয়ের যথেষ্ট অভাব ছিল। পক্ষান্তরে তুর্কি বাহিনী কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা সংগৃহীত হত এবং প্রয়োজন অনুসারে তাদের যুদ্ধে নিয়োজিত করা যেত। সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতার কারণে রাজপুতরা কখনোই পূর্ণশক্তি নিয়ে শত্রুর মুখোমুখি হতে পারেনি।
অধ্যপক হবিবউল্লাহ ভারতীয়দের সামরিক কৌশলগত ত্রুটিকে তাদের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রাজপুতরা রক্ষণাত্মক যুদ্ধনীতিতে আস্থাশীল ছিল। হবিবউল্লাহ মনে করেন, আক্রমণাত্মক যুদ্ধরীতি অনুসরণ করলে রাজপুতরা অধিক সাফল্য পেতে পারত। সামরিক শক্তির বিন্যাসের দিক থেকেও তুর্কিরা এগিয়ে ছিল। রাজপুতরা যখন তাদের সামরিক বাহিনীকে দক্ষিণ, বাম ও মধ্যবর্তী—এই তিনটি দলে বিভক্ত করে যুদ্ধে এগিয়ে যেত, তখন তুর্কি বাহিনী যুদ্ধ করত পাঁচটি ভাগে বিভক্ত থেকে। রাজপুতদের মতোই তিনটি বাহিনীর সাথে তারা যুদ্ধ করেছিল অগ্রবর্তী-বাহিনী এবং সংরক্ষিত বাহিনী (Advanced force and Reserve force) দ্বারা। অগ্রবর্তী বাহিনী শত্রুর ক্ষমতা যাচাই করতে পারত এবং সংরক্ষিত বাহিনী যুদ্ধের শেষ পর্বে নতুন উদ্যমে যুদ্ধে যোগ দিয়ে শ্রান্ত-ক্লান্ত শত্রু-বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে দিত। তাই ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ লিখেছেন : “Hindu kings though fully equal to their assailants in courage and contempt of death, were distinctly inferior in art of war and for that reason lost their independence.”
অধ্যাপক পানিক্কর (K.M. Panikkar) মনে করেন, নবম-দশম শতকে ভারতে তান্ত্রিক দর্শনের প্রসার এবং মন্দির ও মঠগুলিতে অনৈতিক জীবনচর্চার প্রাবল্য ভারতবাসীর মানসিক দৃঢ়তা শিথিল করেছিল, যা তাদের ব্যর্থতা ডেকে এনেছিল। আচার্য সরকারও মনে করেন, ‘অদৃষ্টবাদ’ হিন্দুদের কর্মপ্রেরণা হ্রাস করেছিল; কিন্তু মুসলমানদের কর্মোদ্যোগ বৃদ্ধি করেছিল। হিন্দুরা যখন বিশ্বাস করত যে, কলিযুগে ‘ম্লেচ্ছদের’ হাতে তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী; তখন মুসলমানরা বিশ্বাস করত যে, আল্লা তাদের ভাগ্যের পরিণতি নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। তাই প্রাণপণ যুদ্ধ করে সেই পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কোনো দ্বিধা ছিল না। অর্থাৎ অদৃষ্টবাদ ‘দ্বিমুখী তরবারির’ মতো হিন্দুদের আঘাত করেছিল। অবশ্য ইউ. এন. ঘোষাল নৈতিক অবক্ষয়ের তত্ত্বকে ভারতবাসীর পরাজয়ের অন্যতম কারণ বলতে রাজি নন। তাঁর মতে, যে-কোনো উন্নয়নশীল জাতির ক্ষেত্রে আংশিক নৈতিক অনাচার থাকা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। তা ছাড়া, একাদশ-দ্বাদশ শতকে ভারতীয় সমাজের নৈতিক অবক্ষয় এমন পর্যায়ে ছিল না যে, এইজন্য তারা প্রতিরোধ শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। আসলে বিশেষ কোনো একটি কারণ নয়, একাধিক কারণের সমন্বয়ে হিন্দুদের দুর্বলতা প্রকট হয়েছিল এবং পতন ডেকে এনেছিল। হিন্দুদের দুর্বলতা কেবল সামরিক ক্ষেত্রে ছিল না। হিন্দুদের সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে যে পশ্চাদপদতা ও বৈষম্য প্রবেশ করেছিল, তাতে শিথিল হয়েছিল মানসিক ও সামরিক শক্তি। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা রাজনৈতিক অনৈক্য এবং অবক্ষয় সামরিক সংগঠনের দুর্বলতা ভারতীয়দের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এমন দুর্বল করে তুলেছিল যে, সংগঠিত তুর্কিদের আধুনিক যুদ্ধকৌশলের সাথে পাল্লা দেওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এ. এল. শ্রীবাস্তবের ভাষায় বলা যায় : “…. the absence of political unity, social divisions, rise of Brahmanism, moral degeneration and the superiority of the Turks in militaray skill, organisation and resources were responsible for the success of the Turks.”
ভারতে তুর্কি-বিজয়ের প্রভাব :
ভারতে তুর্কি-বিজয়ের ফলে এদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল।
প্রথমত, হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর উত্তর ভারতে যে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার বীজ রোপিত হয়েছিল, তুর্কিদের আগমনে তার অবসান ঘটে। একাদশ দ্বাদশ শতকে অঞ্চলভিত্তিক এবং গোষ্ঠীনিয়ন্ত্রিত ছোটো ছোটো রাজ্য প্রতিষ্ঠা উত্তর ভারতীয় রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল। ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, সমুদ্রগুপ্ত বা হর্ষবর্ধনের ঐতিহ্যের উত্তরসূরি কোনো শাসকের আদর্শ বা লক্ষ্যে জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে তোলার সামান্যতম প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়নি।
দ্বিতীয়ত, তুর্কিরা বিজয়ী হবার ফলে একাদশ-দ্বাদশ শতকের বিচ্ছিন্নতাবাদের অবসান ঘটে। রাজতান্ত্রিক আদর্শ হিসেবে তুর্কিরা শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। ফলে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার দুটি মূল উপাদান আঞ্চলিকতাবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ দ্রুত অপসারিত হয়। ‘ইকৃতা’ ব্যবস্থার প্রবর্তন করে সামন্ততান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থার অবসান ঘটানো হয় এবং দূরবর্তী প্রদেশের ওপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বলবৎ করার চেষ্টা করা হয়।
তৃতীয়ত, তুর্কি-বিজয়ের ফলে ভারতবর্ষ আবার কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার স্বাদগ্রহণে সমর্থ হয়। হর্ষের পরবর্তী কোনো শাসকই একক কেন্দ্রের অধীনে বিস্তীর্ণ ভারত-ভূখণ্ডকে ঐক্যবদ্ধ করতে সচেষ্ট হননি। উত্তর ভারতের রাজন্যবর্গ নিরন্তর যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকতেন; তবে তাদের লক্ষ্য ছিল অন্যকে পরাজিত ও হত্যা করে নিজগোষ্ঠীর গৌরব বৃদ্ধি করা, কিংবা নিজে মৃত্যুবরণ করে বীরের মর্যাদা অর্জন করা। তবে তাদের উদ্দেশ্য ছিল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। দিল্লিকে কেন্দ্র করে তারা ভারত সাম্রাজ্য গঠনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে। এদের উদ্যোগেই গড়ে ওঠে সর্বভারতীয় শাসনতান্ত্রিক ঐতিহ্য।
চতুর্থত, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রতিবাদী ধর্মসমূহের, বিশেষত বৌদ্ধধর্মের উত্থান ও প্রসারের ফলে ভারতবর্ষের সাথে এশিয়ার অন্যান্য দেশসমূহের মধ্যে যে যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল, অষ্টম শতকে তা অন্তর্হিত হয়। ব্রাহ্মণ্যবাদের কর্তৃত্বের যুগে ভারতবর্ষ আবার বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম—সবকিছুই আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল তার ভৌগোলিক সীমার গণ্ডিতে। কিন্তু তুর্কিদের বিজয় অভিযানের ফলে আবার ভারতবর্ষের সাথে বহির্ভারতের যোগসূত্র স্থাপিত হয়। আচার্য যদুনাথ সরকারের ভাষায় : “This touch with the rest of Asia and the nearest part of Africa was restored by the Muslim couquest at the end of the 12th century …”
পঞ্চমত, তুর্কিদের সাফল্য ভারতের প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রে গভীরতর পরিবর্তনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। আপাতভাবে বর্ণভিত্তিক হিন্দুসমাজ ও জীবনধারার ওপর তুর্কি-বিজয়ের প্রত্যক্ষ প্রভাব বিশেষ ছিল না। কিন্তু ইসলাম সংস্কৃতির প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হিন্দু সমাজব্যবস্থার মধ্যে আরও কঠোরতর নিয়মবিধি প্রবর্তিত হয়। অন্যদিকে উদারতাবাদী ভক্তি-আন্দোলনের মাধ্যমে সামাজিক সাম্য ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার এক নতুন প্রয়াস শুরু হয়। রক্ষণশীল গোষ্ঠী কর্তৃক স্মৃতিশাস্ত্রের নববিধানের মাধ্যমে সামাজিক রক্ষা-প্রাচীর তৈরির পাশাপাশি ভক্তিবাদী গোষ্ঠী সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার অভূতপূর্ব প্রয়াস চালিয়ে যান। ক্রমে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সংস্কৃতির সহনশীলতা প্রসারিত হলে সংস্কৃতি-সমন্বয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়।
ষষ্ঠত, মুসলমান বিজয়ের ফলে ভারতের সামরিক সংগঠন ও যুদ্ধরীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। ইতিপূর্বে সামরিক কাজে একমাত্র রাজপুত বা ক্ষত্রিয় ইত্যাদি উচ্চবর্ণের লোকদের একাধিপত্য ছিল। যুদ্ধরীতি ছিল অবৈজ্ঞানিক এবং প্রাচীনপন্থী। এখন সামরিক বাহিনীতে নিযুক্তির মাপকাঠি হিসেবে বংশকৌলীন্যের পরিবর্তে দক্ষতা ও যোগ্যতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সামন্ত প্রভুদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী গড়ে তোলা হয়। পদাতিক বাহিনীর (পাইক) সংখ্যা হ্রাস করে বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী গঠন করা হয়। মধ্য এশিয়ার যুদ্ধকৌশলে শিক্ষিত এবং হালকা ও কার্যকরী অস্ত্রে সুসজ্জিত কেন্দ্রীয় বাহিনী পরবর্তীকালে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে এবং নিরাপত্তাবিধানে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
সপ্তমত, তুর্কি শাসনে প্রাচীন বর্ণভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ভাঙনের অনিবার্য ফলস্বরূপ সর্বজনভিত্তিক শহরের অভ্যুত্থান ঘটে। আগের জাতিভিত্তিক শহরের স্থান দখল করে ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ, হিন্দু-মুসলমান, ছুত-অচ্ছুত নির্বিশেষে শিল্পী, কারিগর, বণিক, ব্যবসায়ী, কর্মী-অধ্যুষিত আধুনিক শহর। অধ্যাপক হাবিব এই ঘটনাকে ‘শহর-বিপ্লব’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। এইসব শহর জাতিভেদের বেড়া ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নতুন সূর্যোদয় ঘটায়। নরোখিত শ্রমজীবী মানুষ-অধ্যুষিত শহরকে কেন্দ্র করে ব্যবসাবাণিজ্যের দ্রুত প্রসার সম্ভব হয়। বাণিজ্য আইন, শুল্ক-আইন, মুদ্রাব্যবস্থা ইত্যাদির সমতা ও স্থিরতার ফলে অন্তর্দেশীয় ও বহির্দেশীয় বাণিজ্য প্রসারলাভ করে। ইতিপূর্বে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভাষায় তারতম্য এবং কোনো সর্বভারতীয় ভাষার অভাব রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ঐক্যের পথে যে বাধার সৃষ্টি করেছিল, মুসলমানরা প্রশাসনিক কাজে ফারসি ভাষায় প্রচলন করলে তা অন্তর্হিত হয়।
Leave a comment