ভূমিদান: ‘অগ্রহার ব্যবস্থা’ :
সাধারণভাবে গুপ্ত সাম্রাজ্যকে উত্তর ভারতের শেষ সংগঠিত সাম্রাজ্যিক ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অবশ্য দক্ষিণ ভারতে গুপ্তদের প্রায় সমকক্ষ ছিলেন বকাটক-বংশীয় শাসকগণ। লক্ষণীয় যে, উত্তর ভারত ও দাক্ষিণাত্যের এই দুই বৃহৎ শক্তির পতনের পর উভয় অঞ্চলেই একাধিক রাজবংশের নেতৃত্বে রাজ্য প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু গুপ্ত রাজাদের সময়কালের বৈশিষ্ট্যগুলিকে কেবল গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে আবদ্ধ রাখা সঠিক নয়। গুপ্তযুগের সাংস্কৃতিক বিকাশের ধারা সার্বিক ভাবেই ভারতের আর্থসামাজিক জীবনকেও প্রভাবিত করেছিল। প্রায় সমগ্র গুপ্ত আমল জুড়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের যে বৈশিষ্ট্যটি সমকালের আর্থসামাজিক জীবনে রূপান্তর ঘটানোর সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সমাজ ও অর্থনীতির ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল, তা হল ‘অগ্রহার’ বা ‘ভূমিদান ব্যবস্থা।
ভূমি হস্তান্তরের বৃত্তান্ত জানার ক্ষেত্রে প্রধান উপাদান হল অসংখ্য তাম্রশাসন। তামার ফলকে রাজকীয় ‘শাসন’ হিসেবে ভূমি হস্তান্তরের ঘটনাগুলি উৎকীর্ণ করা হয়েছে। এই তাম্রপট্ট বা তাম্রশাসন থেকে দাতা ও দানগ্রহীতার নাম, প্রদত্ত জমির বিবরণ, দানের উপলক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিষয়ে জানা যায়। সমকালীন মুদ্রা ও অন্যান্য পুরাতাত্ত্বিক অবশেষ থেকেও কিছু তথ্য সূত্র পাওয়া যায়। সমকালীন সাহিত্যাবলিও সেকালের আর্থসামাজিক জীবনের নানা তথ্যের সরবরাহ করে। এদের মধ্যে বাণভট্টের ‘হর্ষচরিত’, দণ্ডীনের ‘দশকুমার চরিত’এর নাম উল্লেখযোগ্য। ধর্মশাস্ত্রগুলির মধ্যে ‘নারদ স্মৃতি’ ও বৃহস্পতি স্মৃতি’ উল্লেখযোগ্য। একই ধরনের গুরুত্বসম্পন্ন কিছু বিদেশি পর্যটকের বিবরণও তথ্যসূত্র হিসেবে স্মরণীয়। যেমন—চিনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েনের বিবরণ, হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ, কসমাস ইন্ডিকো-প্লয়েস্টেস-এর খ্রিশ্চিয়ান টপোগ্রাফী (ষষ্ঠ শতক) ইত্যাদি।
খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের সূচনা থেকে ব্রাহ্মণ বা ধর্মস্থানের উদ্দেশ্যে ভূমিদান প্রথার প্রচলন ঘটে। ব্রাহ্মণ পুরোহিত বা ধর্মস্থানের উদ্দেশ্যে করমুক্ত গ্রাম বা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডদানের এই রীতি ‘অগ্রহার’ নামে পরিচিত হয়। সাতবাহন রাজাদের আমলে এমন ভূমিদানের ঘটনা প্রথম দেখা যায়। তবে ৩০০ খ্রিস্টাব্দের পরেই অগ্রহার দানব্যবস্থা ব্যাপকতা পায়। প্রাথমিক পর্বে শক, কুষাণ বা সাতবাহন রাজারা বৌদ্ধ সংঘকে ভূমিদান করেন। তবে বণিক, কারিগর ইত্যাদি সম্পদশালী বৃত্তিজীবী ব্যক্তিরাও ব্যক্তিগত পুণ্যসঞ্চয়ের বাসনায় ব্রাহ্মণ বা ধর্মপ্রতিষ্ঠানকে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি দান করতে শুরু করেন। কিন্তু খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের সূচনা থেকে এই ভূমিদানব্যবস্থায় একটা মৌলিক পরিবর্তন সূচিত হয়। এখন থেকে ব্রাহ্মণ ও ধর্মপ্রতিষ্ঠানকে দানের জন্য মূলত ভূমিদান করা হয় এবং দাতা হিসেবে প্রধান ভূমিকা নেন স্বয়ং রাজা। গুপ্তযুগে উৎকীর্ণ বাংলার তাম্রশাসনগুলি থেকে এই ভূমিদানের বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করা যায়। গুপ্তরাজা কুমারগুপ্ত, বুধগুপ্ত এবং সম্ভবত বিষ্ণুগুপ্তের আমলের মোট পাঁচটি (২ + ২ + ১) দামোদরপুর তাম্রপট্ট থেকে জানা যায় যে, এই সকল দান ছিল ‘নিষ্কর’ (অগ্রহার), স্থায়ী (অক্ষয়নীবি) এবং পতিত জমি (ভূমিচ্ছিদ্র ন্যায়)। সমাজের ধনী বা অভিজাতরা রাজার কাছে জমি ক্রয় করে তা ব্রাহ্মণ বা কোনো ধর্মস্থানকে দান করতেন। দানকার্য সম্পাদনের পর জমির চতুঃসীমা চিহ্নিত করা হত। জমির সীমা নির্ধারণের সময় গ্রামবাসী উপস্থিত থেকে তা অবহিত হতেন। গুপ্ত পরবর্তী যুগে ঘুঁটি বসিয়ে জমির চিহ্নিতকরণ হত।
প্রাচীন রীতি অনুযায়ী সকল পতিত অনাবাদী জমির মালিক ছিল রাষ্ট্র বা রাজা। তাই রাজার কাছে জমি ক্রয় করে দানকার্য সম্পন্ন করতে হত। তবে এইভাবে দুবার জমি হস্তান্তরের দৃষ্টান্ত বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। মধ্য ভারত, পশ্চিম ভারত, এমনকি দাক্ষিণাত্যে প্রাপ্ত তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, ওই সকল এলাকায় ব্রহ্মদেয় দানের মূল কর্তা ছিলেন রাজা স্বয়ং। বাংলাদেশের দুবার হস্তান্তরিত জমির মতো অবশিষ্ট ভারতের দানকৃত জমিগুলি সম্পূর্ণ পতিত বা অনাবাদী ছিল না। রাজকীয় দান হিসেবে ভূমিখণ্ডের পাশাপাশি গ্রামও দান করা হত। প্রশাসনিক আধিকারিক, কৃষক বা কুটুম্বী এবং স্থানীয় সম্ভ্রান্ত মানুষদের উপস্থিতিতে দানপত্র ঘোষণা করা হত। গ্রাম ও ভূমিদানের শর্তাবলি এক ছিল না। রাজা দানকৃত ভূখণ্ডের ওপর দানগ্রহীতার মালিকানাস্বত্ব স্বীকার করতেন। কিন্তু গ্রামের ক্ষেত্রে মালিকানা পূর্ববৎ রাজার হাতেই থাকত। তবে দানগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান উক্ত গ্রামের রাজস্ব ভোগ করার অধিকার পেতেন। উত্তর ভারতের তুলনায় দক্ষিণ ভারতে রাজকীয় অগ্রহারে দানের ঘটনা ছিল বেশি। অধ্যাপক কৃষ্ণমোহন শ্রীমালী তাঁর ‘Agrarian Structure in Central India and The Northern Deccan’ (Delhi 1987) শীর্ষক গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, দাক্ষিণাত্যের বকাটক শাসকদের আমলেই পঁয়ত্রিশটি গ্রাম অগ্রহার হিসেবে দান করা হয়েছিল। ঋদ্ধপুর তাম্রশাসন, পৌনি তাম্রশাসন এবং যাবৎমল তাম্রলেখ থেকে জানা যায় যে, ভূমিদানের সঙ্গে সঙ্গে বহুক্ষেত্রেই ভূমির চতুষ্পার্শ্বস্থ বাসগৃহগুলির অধিকারও দানগ্রহীতাকে হস্তান্তর করা হত। একজন ব্রাহ্মণ একাধিক গ্রাম দান হিসেবে পেতেন এমন দৃষ্টান্তও আছে। কেবল ব্রাহ্মণ নয়, বৌদ্ধ বিহারগুলিও অগ্রহার দানলাভে সক্ষম হয়েছিল। চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন পঞ্চম শতকের প্রথমদিকে ভারতে আসেন এবং হিউয়েন সাঙ ভারতে কাটান ৬২৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এঁদের বিবরণ থেকে বৌদ্ধ বিহারগুলির অধীনে নিষ্কর ভূমির অবস্থান জানা যায়। এই জমি তারা ‘অগ্রহার’ দান হিসেবেই পেয়েছিল।
‘অগ্রহার’ ব্যবস্থা আদি-মধ্যযুগের অব্যবহিত প্রাক্পর্বে ভারতের আর্থসামাজিক সম্পর্ক এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় কোনো সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সূচনা করেছিল কিনা, তা বিচার করা জরুরি। কারণ, ভারত-ইতিহাসের কাল-বিভাজনের সাম্প্রতিক ধারায় আদি-মধ্যযুগ পর্বটির সংযোজন গুরুত্বপূর্ণ। এই নবতম সংযোজনে এদেশের ভূমি-সম্পর্কের পরিবর্তনের ধারাটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইউরোপে মধ্যযুগের আবির্ভাবের প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য বা বৈসাদৃশ্যের ভিত্তিতে পণ্ডিতেরা কাল বিভাজনের বিষয়টির ব্যাখ্যা করেছেন। স্বভাবতই তৃতীয় শতকের পরবর্তীকালে ‘অগ্রহার’ ব্যবস্থার প্রচলন এই বিশ্লেষণে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে অনিবার্যভাবেই। এ বিষয়ে পণ্ডিত রামশরণ শর্মা তাঁর গবেষণায় দুটি দিকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এগুলি হল – (১) অগ্রহার ব্যবস্থার কালে কোনো দ্বিতীয় শক্তিশালী সামাজিক গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছিল কিনা এবং (২) এই ব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগী শোষকশ্রেণির অস্তিত্বের বীজ বপন হয়েছিল কিনা। অধ্যাপক শর্মার মতে, গ্রাম বা ভূমিখণ্ডের ওপর স্থায়ী মালিকানা বা ভোগাধিকার পাওয়ার সূত্রে ব্রাহ্মণদের হাতে অধিক সুবিধা কেন্দ্রীভূত হয়। একইভাবে দানপ্রাপ্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতেও ক্ষমতার কেন্দ্র গড়ে ওঠে। আর্থিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি কিছু কিছু শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতাও দানগ্রহীতাদের হস্তগত হয়। সমকালীন লেখমালায় গ্রাম বা ভূমিদান সংক্রান্ত অনুশাসনের ‘অচাটভাট প্রবেশ্য’ বা ‘চাট-ভাট অপ্রবেশ্য’ কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘চাট’ও ‘ভাট’ ছিল স্থায়ী ও অস্থায়ী সরকারি কর্মী। সম্ভবত এরা গ্রাম থেকে রাজস্ব আদায়ের কাজে প্রশাসনকে সাহায্য করত। অধ্যাপক শর্মার মতে, দানকৃত গ্রামে এই সকল সরকারি কর্মীর প্রবেশে বিধিনিষেধ জারি করায় ওই সকল গ্রামের শাসন ও আইনশৃঙ্খলার ওপর দানগ্রহীতা ব্রাহ্মণ বা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। এইভাবে দানগ্রহীতা আঞ্চলিক ভিত্তিতে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। দ্বিতীয় প্রশ্নটির সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী। ড. শর্মার অভিমতের ভিত্তিতে তিনি দেখিয়েছেন যে, আপাতভাবে ‘অগ্রহার’ ব্যবস্থার ফলে একটি অন্তর্বর্তী সামাজিক শ্রেণির উদ্ভব অবশদ্ভাবী হয়েছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে কৃষি-উৎপাদনের জগতে কেবল রাজা ও কৃষক—এই দুটি উপাদানের অস্তিত্ব উল্লেখ আছে। এখানে কোনো তৃতীয় শক্তির অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু চতুর্থ শতকের ‘নারদ স্মৃতি, ‘কাত্যায়ন স্মৃতি’ ইত্যাদিতে তিনটি স্তরের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলি হল—(১) মহীপতি, (২) স্বামীন, (৩) কর্ষক। এখানে ‘মহীপতি’ অর্থে রাজা, ‘স্বামী’ অর্থে জমির মালিক বা দানগ্রহীতা এবং ‘কর্ষক’ অর্থে চাষিকে বোঝানো হয়েছে। এই ব্যাখ্যার সমর্থন পাওয়া যায় সমকালীন সামাজিক বিধানে। সেকালের বিধান অনুযায়ী ব্রাহ্মণ বা ধর্মগুরুরা স্বহস্তে হলকর্ষণ বা কৃষিকাজ করতে পারতেন না। বৌদ্ধভিক্ষুদের ক্ষেত্রেও এই বিধান প্রযোজ্য ছিল। স্বভাবতই, প্রাপ্ত জমি থেকে উৎপাদনজাত আয় ভোগের জন্য চাষ-আবাদ করা আবশ্যিক ছিল। তাই কর্ষক বা কৃষক চাষি নিয়োগ করে তাঁরা এই কাজ সম্পন্ন করতেন। এইভাবে অগ্রহার ব্যবস্থা ব্রাহ্মণ ও ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলিকে মধ্যবর্তী ভূম্যধিকারী শ্রেণিতে পরিণত করে।
ক্ষমতাবান ভূম্যধিকারী শ্রেণির আবির্ভাব চতুর্থ-পঞ্চম শতকেই রাজতন্ত্রকে আর্থিক বা প্রশাসনিক ক্ষমতার দিক থেকে দুর্বল করেছিল কিনা কিংবা কতটা করেছিল, তা বলা কঠিন। বাণভট্ট ‘হর্ষচরিত’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, হর্ষবর্ধনের মোট ব্যয়ের পঁচিশ শতাংশ চলে যেত দানধ্যানমূলক কর্মসূচি রূপায়ণে। এই মন্তব্যের ভিত্তিতে ড. শর্মা মনে করেন যে, অগ্রহার ব্যবস্থা পরিণামে রাজশক্তির আর্থিক ভিত্তি দুর্বল করেছিল। কিন্তু এই অভিমত যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য নয়। ড. চক্রবর্তী লিখেছেন যে, চম্মক তাম্রশাসনে ভূমিদান করার পর রাজা প্রবর সেন দানগ্রহীতার উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন যে, রাজদ্রোহসমেত কিছু গর্হিত কর্ম যদি দানগ্রহীতা করেন, তাহলে তার জমি কেড়ে নেওয়া হবে এবং কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। এই ঘোষণাটি রাজার রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ইঙ্গিত দেয়। অন্যদিকে অগ্রহার দানের বহু জমি ছিল পতিত ও অনুর্বর। হস্তান্তরিত হওয়ার পর দানগ্রহীতারা ওই সকল জমিকে কৃষিযোগ্য করে তোলেন। এর ফলে রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধি পায়। এই আয় সরাসরি রাজকোষে জমা না-হলেও ; কৃষি-অর্থনীতির বিকাশ দ্বারা এই ব্যবস্থা রাষ্ট্রের ভিত্তি অবশ্যই দূর করেছিল।
Leave a comment