লিঙ্গ সম্পর্ক: ভারতীয় সমাজে নারীর স্থান

আবহমানকাল ধরেই ভারতীয় সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে স্তরবিন্যাসের প্রবণতা চলে আসছে। দীর্ঘকাল প্রচলিত থাকার কারণে এমন একটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাও ভারতীয় সমাজে প্রায় স্বাভাবিক ও অনিবার্যরূপেই গৃহীত হয়েছে। এককথায়, ভারতীয় সমাজ মূলত পিতৃতান্ত্রিক। প্রাচীন স্মৃতিসাহিত্যে নারীজাতির প্রতি অবহেলা ও অনুকম্পা প্রদর্শনের ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে। এমনকি, নারীদের অবদমন করে সামাজিক মর্যাদাবান হওয়া পুরুষের কাম্য বলে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। ধর্মশাস্ত্রীয় বিধানগুলিতে ব্যক্তিগত ভূসম্পত্তির ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজকে ‘কর্তৃত্ব ও গৌরবের প্রতীক’ বলে প্রশংসা করা হয়েছে। পুরুষ এই সম্পত্তির অধিকারী ছিল। তাই উত্তরাধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য পুরুষ বংশধারার ওপর জোর দেওয়া হত। আদিম উপজাতীয় সমাজে জীবন ও জীবিকার অনিশ্চিয়তার প্রেক্ষিতে নারী-পুরুষের সামাজিক ভেদাভেদ তীব্র হতে পারেনি। কালক্রমে কৃষিভিত্তিক স্থায়ী সমাজ গড়ে-ওঠার প্রক্রিয়ার সাথে তাল রেখে ধীরে ধীরে নারীর ওপর পুরুষজাতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার কাজটিও এগিয়ে চলতে থাকে। আদিম মানবসমাজের লিঙ্গ-সাম্যতার ধারা বৈদিকযুগে এসে হোঁচট খায়। আবার আর্যজাতির পূর্বমুখী সম্প্রসারণের সূত্রে স্থায়ী ও সুদৃঢ় কৃষি-নির্ভর সমাজব্যবস্থার পত্তন হলে আদি বৈদিকযুগের উদারতা খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার অব্দের পরবর্তীকালে সংকুচিত হতে থাকে। খ্রিস্টীয় তিনশো শতকে ভূমিদানব্যবস্থার সূচনা হলে ভূমিভিত্তিক আভিজাত্য প্রবল হয়। সেই আভিজাত্যের ধারক ও বাহক রূপে পুরুষ উত্তরাধিকারী অধিক কাম্য হয়। এই ধারার অনিবার্য ফলস্বরূপ ভারতীয় সমাজে নারী অনাকাঙ্ক্ষিত ও অবহেলিত হতে থাকে। সাম্প্রতিককালে নারীবাদী আন্দোলনের ফলে আধুনিক ভারতে মহিলাদের জীবনধারার কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। এতদসত্ত্বেও সনাতন হিন্দুসমাজের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার পূর্ণ সংস্কার এখনো ঘটেনি। অধ্যাপক দুবে (S. C. Dube) তাঁর Indian Society’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে “সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ একটি দীর্ঘ ও শ্লথগতির প্রক্রিয়া হিসেবেই কার্যকর হবে” (“The social and political system appears geared to continue gender inequality. It seems that march to equality will be long and tortuous.”)

হরপ্পা সভ্যতার আমলে (প্রাক্ খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ) ধর্মাচারের ক্ষেত্রে মাতৃতান্ত্রিকতার প্রাধান্য দেখা যায়। সৃষ্টি ও সমৃদ্ধির প্রতীক রূপে দেবীদের গ্রহণ করার এই মানসিকতা থেকে সেকালে নারীজাতিকে মহিমান্বিত করার প্রবণতা ছিল বলে অনুমান করা যায়। ঋগ্‌বৈদিক যুগের সমাজে আইনত নারীজাতির স্বাধীনতা ছিল না। তবে গৃহের অভ্যন্তরে মর্যাদার নিরিখে নারীর অবস্থা খুব খারাপ ছিল না। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে স্বামীর সাথে স্ত্রীও অংশ নিতেন। শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রেও নারীদের সুযোগ দেওয়া হত। পরবর্তী বৈদিকযুগে নারীর সামাজিক মর্যাদা কিছুটা হ্রাস পায়। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে পড়ে। তবে শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রটি পূর্ববৎ উন্মুক্ত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রতিবাদী ধর্ম-আন্দোলনসমূহের উদ্ভব সামাজিক ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসে। গৌতম বুদ্ধ সামাজিক ক্ষেত্রে নারীজাতির মর্যাদাবৃদ্ধির আবশ্যিকতা প্রচার করেন। বজ্জি প্রজাতন্ত্রের সংবিধান রচনা প্রসঙ্গে তিনি নারীর মর্যাদা রক্ষা করাকে অন্যতম রাজকর্তব্য বলে অভিহিত করেন। বারবণিতা ‘আম্রপালি’কে সম্মানিত করে তিনি নারীজাতির মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। তবে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন তখনই ঘটে যায়নি। বুদ্ধ নারীদের জন্য স্বতন্ত্র ভিক্ষুণীসংঘ গঠন ও বিশেষ শর্তাধীনে নারীদের সংঘে যোগদানের নির্দেশ দিয়ে পুরুষের তুলনায় নারীদের অধিকারের ক্ষেত্রে কিছু প্রভেদ রেখেছেন।

ঋগ্‌বৈদিক যুগের সমাজব্যবস্থায় নারীগণ যথেষ্ট মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী ছিলেন। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুত্রের জন্মকামনাই স্বাভাবিক ঘটনা হলেও কন্যাসন্তান অবহেলিত হত না। স্ত্রী-শিক্ষার সুযোগ ছিল ব্যাপক। বৈদিকযুগের নারী ঘোষা, অপালা, বিশ্ববারা প্রমুখ ছিলেন উচ্চশিক্ষিতা। সমাজে বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল না। সাধারণভাবে পিতামাতা কর্তৃক বিবাহ স্থির হলেও স্ব-নির্বাচনকেও মূল্য দেওয়া হত। বহুবিবাহের প্রচলন তেমন ছিল না। স্বামীর মৃত্যুর পর তার ছোটো ভাই-এর সাথে বিধবা স্ত্রীর পুনর্বিবাহের রেওয়াজ ছিল। সতীদাহ মূলত অভিজাতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। মেয়েরা বহির্জগতে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল থাকলেও গৃহের অভ্যন্তরে তাদের স্থান পুরুষের তুলনায় কোনো অংশে হীন ছিল না। স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। পর্দাপ্রথা প্রায় ছিল না। পরবর্তী বৈদিকযুগে নারীর সামাজিক মর্যাদা হ্রাস পেয়েছিল। পূর্বে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডে স্ত্রীজাতির অংশগ্রহণের অধিকার ছিল। কিন্তু এই যুগে উভয়ক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে পড়ে। অবশ্য শিক্ষাগ্রহণের অধিকার অব্যাহত ছিল।

মহাকাব্য দুটিতে চিত্রিত নারীচরিত্রগুলি থেকে অনুমিত হয় যে, তেজস্বিতা, চারিত্রিক পবিত্রতা, দৃঢ়তা, নম্রতা, সত্যবাদিতা, পাতিব্রত্য ইত্যাদি গুণ নারীর সহজাত ছিল অথবা এগুলির বিপরীতধর্মী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নারীগণ নিন্দিত হতেন। মহাকাব্য ও পুরাণে নারী ও সম্পত্তির সহ-উল্লেখ থেকে মনে হয় যে, ওই সময়ে নারীকেও সম্পত্তি বলে মনে করা হত। নারী ও সম্পত্তি উভয়েরই সুরক্ষা বিধান করা ছিল রাজার কর্তব্য। রামায়ণে এবং মহাভারতের ‘শান্তিপর্বে’ বলা হয়েছে, যে রাজ্যে রাজা নেই সেখানে প্রজাদের সম্পত্তির ওপর অধিকার বজায় থাকে না ও একইভাবে স্ত্রীও বশে থাকে না। মনুকে যখন রাজপদে অভিষিক্ত করা হয়েছিল, তখন তাঁকে সম্পত্তি ও সুন্দরী নারী স্ত্রী হিসেবে দেওয়া হয়েছিল—সম্ভবত এই কারণেই যে, সম্পত্তি ও স্ত্রী থাকলে রাজা প্রজাদেরও সম্পত্তি ও স্ত্রীর সুরক্ষার ব্যবস্থা করবেন। অপরের সম্পত্তি ও পরস্ত্রীর প্রতি দৃষ্টিদান ছিল নিন্দনীয় কাজ। কোনো কোনো পুরাণে দেখা যায় যে, নারীকে পশুর পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছে। ‘অগ্নিপুরাণে বলা হয়েছে, নারী ও পশুকে বন্দক রাখা যেতে পারে। সুতরাং বোঝা যায় যে, নারীকে একধরনের সম্পত্তি বলে মনে করা হত। নিজ ইচ্ছানুসারে চলার উপায় তার ছিল না। এই কারণেই স্থাবর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার স্বীকৃত ছিল না।

বুদ্ধদেব বৌদ্ধসংঘে নারীদের প্রবেশাধিকার দান করেছিলেন। তবে তাদের জন্য স্বতন্ত্র সংঘ স্থাপন ছিল বাধ্যতামূলক। সংঘের নারীদের জন্য বুদ্ধদেব কতকগুলি আচরণবিধিও স্থির করে দেন। বারবণিতা আম্রপালিকে তিনি সম্মানের আসন দেন। বৌদ্ধধর্ম এইভাবে সমগ্র নারীসমাজকেই সম্মানের আসন দান করা হয়েছিল।

মৌর্য ও মৌর্যোত্তর যুগে নারীর অবস্থা সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের গ্রিক রচনা, অর্থশাস্ত্র, অশোকের লেখ, স্মৃতিশাস্ত্র ইত্যাদির ওপর নির্ভর করতে হয়। জানা যায়, এ সময় নারীরা সামরিক দায়িত্ব পালন করতেন। মেগাস্থেনিস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নারী-রক্ষীবাহিনীর উল্লেখ করেছেন। অর্থশাস্ত্রের বর্ণনা অনুযায়ী নারীরা গুপ্তচরবৃত্তিতে নিয়োজিত হতেন। এ থেকে মনে হয়, সামরিক ও রাজনৈতিক কাজেও নারীগণ অংশ নিতেন। মেগাস্থেনিসের বিবরণ অনুযায়ী বিবাহ নিজ জাতির মধ্যেই সম্পন্ন হত। বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল। অভিজাত পরিবারে পর্দা-প্রথার প্রচলন ছিল, শিক্ষার প্রচলনও ছিল। অশোকের একটি লেখায় উল্লিখিত রানি কারুবাকির দানের উল্লেখ থেকে বা সংঘমিত্র কর্তৃক ধর্মপ্রচারে অংশগ্রহণ করা থেকে বোঝা যায় যে, নারীগণ ধর্মকাজেও বিশেষ ভূমিকা নিতে পারতেন। তবে স্মৃতিশাস্ত্রগুলি অনুসরণ করে নারীদের ওপর বিধিনিষেধও চাপানো হচ্ছিল। এযুগের নারীদের শিক্ষা-সংস্কৃতির যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে সম্পূর্ণ সমাজের নারীদের অবস্থান চিত্র প্রতিফলিত হয় না। কারণ প্রাপ্ত উপাদানগুলিতে সমাজের বিত্তবান শ্রেণির চিত্রটিই প্রতিফলিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে নারীদের অতটা স্বাধীনতা বা সম্মান ছিল না। বৈদিকযুগে নারীরও উপনয়ন হত। কিন্তু মনু বিধান দেন যে, বিবাহই নারীর উপনয়নতুল্য, স্বামীসেবা গুরুগৃহে বাসতুল্য আর গার্হস্থ্যকর্ম অগ্নি উপাসনাতুল্য। যাজ্ঞবল্ক্যও মেয়েদের উপনয়ন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছেন। বৈদিকযুগে নারী স্বামীর সঙ্গে যজ্ঞানুষ্ঠানে অংশ নিত। কিন্তু পরবর্তীকালে তার সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। নারীকে কখনোই স্বাতন্ত্র্য মর্যাদা বা স্বাধিকার প্রদান করা হত না। মনুতে বলা হয়েছে, নারী বাল্যে পিতা, যৌবনে স্বামী ও বার্ধক্যে পুত্রের দ্বারা রক্ষিত হবে। অর্থাৎ সর্বদাই তাকে পুরুষের পদানত থাকতে হবে। মনুস্মৃতি ও মহাভারতে বলা হয়েছে, নারী বিবাহিতা বা অবিবাহিতা—কোনো অবস্থাতেই অগ্নিতে আহুতি দেবার অধিকার পাবে না। একমাত্র বিবাহ ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রেই বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারবে না। নারীর ক্ষেত্রে দণ্ডবিধি প্রয়োগেরও বিধান দেওয়া হয়েছে স্মৃতিশাস্ত্রে। যেসব অপরাধের জন্য নারী প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারত, তার মধ্যে ছিল ব্যভিচার, স্বামী ও শিশুহত্যা, জলাধার বিনষ্ট করা ইত্যাদি। ব্যভিচারী নারীকে গৃহবন্দি অবস্থায় দিনাতিপাত করে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। অবশ্য পাশাপাশি নির্দোষ মাতা বা স্ত্রীকে ত্যাগ করা বা তাদের নিন্দা করাও ছিল দণ্ডনীয় অপরাধ। স্মৃতিশাস্ত্রে এবং মহাভারতে একথাও বারবার বলা হয়েছে যে, মাতা সর্বশ্রেষ্ঠ গুরুজন।

গুপ্তযুগের বিভিন্ন সাহিত্যিক উপাদান ও লেখগুলি থেকে নারীদের অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। এ যুগে উচ্চবংশীয়া নারীরা রাজনৈতিক কাজকর্মে অংশ নিতেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কন্যা ও বকটিক মহিষী প্রভাবতী গুপ্তা বকাটক রাজ্যের শাসন পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বাৎস্যায়নের রচনায় আদর্শ স্ত্রী বা কুলবধূর গুণাবলির এবং কর্তব্য-অকর্তব্যের বিবরণ পাওয়া যায়। বলা হয়েছে, দাম্পত্যজীবনের ভিত্তি দৃঢ় হয় স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আনুগত্য দ্বারা। আদর্শ স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর সুখসুবিধার দিকে দৃষ্টি রাখা, স্বামীর বিনা অনুমতিতে কোনো সমাজে, উৎসবে বা যজ্ঞানুষ্ঠানে যোগ না দেওয়া, অসচ্চরিত্রা কোনো নারীর সঙ্গে মেলামেশা না করা, নির্জন স্থানে সময় অতিবাহিত না-করা ইত্যাদি। তাঁর আরও কর্তব্য শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা, স্বামীর বন্ধুবান্ধবকে আপ্যায়ন করা, দাসদাসীদের দিয়ে কাজ করানো, গৃহদেবতার পুজোর জোগাড় করা, সংসারের আয়ব্যয়ের হিসাব রাখা, স্বামীকে মিতব্যয়ী হতে পরামর্শ দেওয়া ইত্যাদি। স্বামী প্রবাসে থাকলে স্ত্রীকে সংযত জীবনযাপন করতে হত। মহাকাব্যেও বারবার বলা হয়েছে যে, পতিই নারীর একমাত্র দেবতা এবং তাঁর সেবা করলেই স্বর্গলাভ করা যায়। গুপ্তযুগে নারীর বিবাহের বয়স সম্পর্কে বলা যায় যে, এই সময় প্রাপ্তবয়স্কা হলে যেমন তার বিবাহ দেওয়া হত, অপ্রাপ্তবয়স্কাদেরও বিবাহের দৃষ্টান্ত রয়েছে। নারীর সতীত্বকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হত। নারদ ও পরাশর স্মৃতিতে বিধবাদের পুনরায় বিবাহের অধিকার দেওয়া হয়েছে, অবশ্য মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য তা স্বীকার করেননি। পুরুষের বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল।

আদি-মধ্যযুগে নারীজাতির অধিকার কিংবা নারী-পুরুষের সামাজিক অবস্থানের লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেনি। ইতিপূর্বে রচিত স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে রক্ষণশীলতা বৃদ্ধির যে প্রকাশ দেখা যায়, স্বাভাবিকভাবেই নারীর অধিকারের ওপরেও তার প্রভাব পড়ে। কিশোরী কন্যাকে বিবাহদান করা পিতামাতার প্রাথমিক কর্তব্য বলেই বিবেচিত হত। প্রেমমূলক বিবাহ বা অপেক্ষাকৃত বয়স্কা রমণীর বিবাহ সামাজিকভাবে স্বীকৃত ছিল। নারীর পত্নীত্বের অধিকার কিছুটা সুদৃঢ় করা হয়েছিল। কয়েকটি বিশেষ কারণ ছাড়া পত্নীকে পরিত্যাগ করা যেত না। এমনকি, ব্যভিচারিণী পত্নীকেও শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠান দ্বারা পত্নীর মর্যাদায় আসীন রাখা যেত। স্মৃতিচন্দ্রিকা শীর্ষক গ্রন্থে নারীর সামাজিক অধিকারের বিষয়গুলি উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, পত্নী স্থায়ীভাবে অসুস্থ হলে, সন্তান ধারণে অক্ষম হলে কিংবা শুধুমাত্র কন্যাসন্তানের জন্ম দিলে—স্বামী দ্বিতীয়া পত্নী গ্রহণ করতে পারতেন। তবে সেক্ষেত্রে প্রথমা পত্নীর ভরণপোষণ এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে স্বামী বাধ্য থাকতেন। পতি অকারণে পত্নীকে আর্থিক ও সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে রাজদরবারে পতিকে অভিযুক্ত করা যেত। তবে বিজ্ঞানেশ্বর, অপরাক প্রমুখ লেখকের বর্ণনা থেকে সেকালে পুরুষের বহুবিবাহের প্রচলন সম্পর্কে জানা যায়। অবশ্য শুধুমাত্র অনুলোম পর্যায়ে বহুবিবাহ স্বীকৃত ছিল।

আদি-মধ্যযুগে সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর অবস্থা প্রায় অপরিবর্তিত থাকলেও, রাজনীতিতে নারীজাতির কর্তৃত্বকারী ভূমিকার অস্তিত্ব ছিল। সমসাময়িক রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এবং সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে দক্ষতার সাথে রাজ্য পরিচালনার দৃষ্টান্ত নিঃসন্দেহে আদি-মধ্যকালীন ভারতে নারী–অধিকারের নতুন বার্তাবহনকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হবে। ভেনেসীয় পর্যটক মার্কো ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে জানা যায় যে, কাকতীয় রাজ্যের জনৈকা রানি রুদ্রাবা দীর্ঘ চল্লিশ বছর পোলো’র কৃতিত্বের সাথে শাসন পরিচালনা করেছিলেন। কল্যাণের চালুক্যবংশীয় রাজকন্যারাও শাসনকাজে যুক্ত থেকে প্রশংসা অর্জন করেছেন। চালুক্যরাজ প্রথম সোমেশ্বরের মহিষী এবং কল্যাণীর চালুক্য শাখায় শ্রেষ্ঠ রাজা ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের মহিষী দক্ষ প্রশাসিকা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। চালুক্যদের অধীন সামন্ত-শাসকদের কোনো কোনো পত্নীও রাজনীতিতে অংশ নিয়ে দক্ষতা দেখিয়েছেন। ত্রয়োদশ শতকে দক্ষিণ কানাড়া জেলায় আঙুপ রাজবংশের রানি বল্লমহাদেবী দীর্ঘ চৌদ্দ বছর রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। সাহসিকতা ও রাজনৈতিক কৃতিত্বের জন্য তিনি মহারাজাধিরাজ, পরমাবলসাধক প্রভৃতি রাজকীয় উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। আদি-মধ্যযুগে কাশ্মীরের আঞ্চলিক শাসিকা হিসেবে রানি দিচ্ছা’র নাম স্মরণীয়।

রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও সাফল্যের ঘটনাগুলিকে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্তরূপে গণ্য করাই ইতিহাসম্মত হবে। সার্বিকভাবে মধ্যযুগে নারীর মর্যাদা কখনোই স্থিতিশীল বা একইরকম ছিল না। রোমিলা থাপার Indian Women (1975)-এ মন্তব্য করেছেন যে, নারী একদিকে যথেষ্ট কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতার অধিকারিণী আবার কখনও সমানভাবে পরাধীন। নারীদের গৃহকোণে গৃহস্থালির কাজে সীমাবদ্ধ করে রাখার প্রবণতা আদি ও মধ্যযুগে পূর্ববৎ বহাল ছিল।

ভারতে মুসলমানদের অভিযান (অষ্টম / দ্বাদশ শতক) এবং এদেশে মুসলিম শাসনের সূচনা হিন্দুর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হ্রাস করতে পারলেও, সামাজিক জীবনধারা ও নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। বরং ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব থেকে সনাতন হিন্দু ধর্ম ও সমাজধারাকে রক্ষা করার জন্য স্মৃতিশাস্ত্রসমূহের বিধানগুলি কঠোরভাবে প্রয়োগ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবল দাপটের যুগে প্রতিবাদী ধর্ম-আন্দোলনে যেমন সামাজিক ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণে কিছু তৎপরতা দেখায়, তেমনি গুপ্তোত্তর যুগে হিন্দু পুনর্জাগরণের মাঝে ভক্তিবাদী আন্দোলন সামাজিক ক্ষেত্রে সহনশীলতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে সেক্ষেত্রেও অগ্রগতির খতিয়ান যথেষ্ট উজ্জ্বল নয়। সাধিকা মীরাবাঈ-এর জীবনসংগ্রাম নারী-পরাধীনতার অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মরণীয়।

সম্পত্তিতে নারীর অধিকার :

নারীর সামাজিক স্বাধীনতা বা অধিকারের মতোই তাদের অর্থনৈতিক অধিকারের বিষয়টিও অসাম্য ও পুরুষতান্ত্রিকতার আধিপত্যে সংকুচিত হয়েছিল। প্রাচীনকালের প্রচলিত ধারা অকিঞ্চিৎকর পরিবর্তন ছাড়া মধ্যযুগেও প্রায় অব্যাহতই ছিল। মনু ও যাজ্ঞবল্ক সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। নারীর বিশেষ অধিকার হিসেবে ‘স্ত্রীধন’ ভোগের বিধান উভয়েই স্বীকার করেন। বিবাহকালে আত্মীয় পরিজন-বন্ধুবান্ধব প্রদত্ত উপহারাদি, পিতার দান (পিতৃদত্ত), ভায়ের সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ দান (ভাতৃদত্ত) ইত্যাদির ওপর নারীর অধিকার এবং পরবর্তীকালে সেই সম্পদের ওপর অবিবাহিতা কন্যার অধিকার প্রাচীনকালে প্রচলিত ছিল।

স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর সরাসরি কোনো অধিকার ছিল না। স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রী পতির সম্পত্তির অংশীদারিত্ব পেতেন না। তবে স্বামীর জীবদ্দশায় সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা হলে পুত্রসন্তানদের অনুরূপ পত্নীও অংশ পেতেন। স্বামীপরিত্যক্তা নারী অবশ্য স্বামীর সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ পাবার অধিকারী ছিলেন। অপুত্রক অবস্থায় স্বামী মারা গেলে, তার সম্পত্তির ওপর বিধবা পত্নীর অধিকার বর্তাত বলে যাজ্ঞবল্ক্য উল্লেখ করেছেন। মৌর্যযুগের নারীর সম্পত্তির অধিকারের হ্রাসবৃদ্ধি প্রায় ঘটেনি। কৌটিলোর অর্থশাস্ত্রেও স্ত্রীধনের কথা বলা হয়েছে, যার শর্তাবলি প্রাক্-মৌর্যযুগের থেকে খুব বেশি নতুন কিছু ছিল না। গুপ্তযুগে রচিত ‘নারদস্মৃতি’, ‘কাত্যায়নস্মৃতি’ ও ‘বৃহস্পতিস্মৃতি’ সমূহে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এঁরাও প্রচলিত স্ত্রীধনের ওপর নারীর অধিকার স্বীকার করেছেন। মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য বর্ণিত ছয় প্রকার (অধ্যগ্নি, অধ্যবাহনিক, প্রীতিদত্ত, পিতৃদত্ত, মাতৃদত্ত, ভ্রাতৃদত্ত) স্ত্রীধন-এর সঙ্গে আরও তিন প্রকার সম্পত্তিকে স্ত্রীধনের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এগুলি হল: শুল্ক, অন্বাধেয় এবং সৌদায়িক। গুপ্ত-পরবর্তী যুগের স্মৃতিকাররাও নারীর সম্পত্তি বলতে মূলত স্ত্রীধনের উল্লেখ করেছেন। মেধাতিথি’র বর্ণনা থেকে একালের নারীর সম্পত্তিগত অধিকারের কথা জানা যায়। তাঁর মতে, নারী অনুঢ়া অবস্থায়, বিবাহের সময় এবং বিবাহের পরে পিতামাতা, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে যে সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও দ্রব্যসামগ্রী লাভ করে, তা সবই স্ত্রীধন হিসেবে পরিগণিত হয়। স্ত্রীধনের ওপর মূলত অনূঢ়া কন্যার অধিকার থাকে। নারী অন্যান্য সৎপথেও অর্থ উপার্জন করতে পারতেন। তবে স্বামীর জীবিতাবস্থায় উক্ত সম্পদ বা সম্পত্তি বিক্রয়ের অধিকার নারীর থাকত না। এই সময় শর্তসাপেক্ষে পতির সম্পত্তিতে পত্নীর অধিকার স্বীকার করা হত। যেমন, স্বামী তার জীবদ্দশায় সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করলে স্ত্রীকে একটা অংশ দিতে পারতেন। স্বামীর মৃত্যুকালে স্ত্রী সন্তানসম্ভবা থাকলে, সেই বিধবা নারী পতির সম্পত্তির ভাগীদার হতে পারতেন। আবার কন্যা যদি ‘পুত্রিকা’ হয়, অর্থাৎ পুত্রের দায়িত্ব গ্রহণ করে পিতৃপুরুষের যাবতীয় পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করে, তাহলে সে পিতার সম্পত্তির অধিকারী হবে।

আদি-মধ্যযুগে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় সমকালীন শাস্ত্রকারদের রচনায়। আদি-মধ্যযুগের আর্থসামাজিক অধিকার সম্পর্কিত বিধি প্রণেতা হিসেবে জীমূতবাহন ও বিজ্ঞানেশ্বরের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ্য। জীমূতবাহনের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থটি হল ‘দায়ভাগ’। বিজ্ঞানেশ্বর হলেন যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতির ‘মিতাক্ষরা’ ভাষ্যকার। মধ্যযুগে সম্পত্তির বিভাজন এবং উত্তরাধিকার-সম্পর্কিত নির্দেশমূলক দুটি গ্রন্থ হিসেবে ‘দায়ভাগ’ ও ‘মিতাক্ষরা’র নাম সর্বস্বীকৃত। বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের অধিকাংশ অংশে ‘মিতাক্ষরা’ আইন অনুযায়ী সম্পত্তির অধিকার স্থিরীকৃত হত। বাংলাদেশে মূলত জীমূতবাহনের ‘দায়ভাগ’ প্রথা অনুসৃত হত। এ ছাড়া অপরার্ক রচিত ‘যাজ্ঞবল্ক্য ধর্মশাস্ত্র নিবন্ধ’ এবং দেবন্নভট্ট’র ‘স্মৃতিচন্দ্রিকা’ গ্রন্থ দুটি থেকেও মধ্যযুগে নারীর সম্পত্তির ওপর অধিকার সম্পর্কে আলোচনা স্থান পেয়েছে। জীমুতবাহনের ‘দায়ভাগ’ বিধান অনুযায়ী পরিবারের প্রধান ছিলেন সকল সম্পত্তির একক মালিক। তবে তিনি ইচ্ছা করলে সেই সম্পত্তি দান বা বিক্রি করতে পারতেন। এর ফলে উপস্বত্বভোগীর সৃষ্টি হয় এবং একক ভূসম্পত্তির পরিমাণ হ্রাস পেত। অন্যদিকে, বিজ্ঞানেশ্বর একাদশ শতকে যাজ্ঞবন্ধ্যের ব্যবহারশাস্ত্রের ওপর ‘মিতাক্ষরা’ নামে যে ভাষা লেখেন, সেখানে পরিবারের প্রধান তাঁর জীবদ্দশায় পুত্রদের ইচ্ছানুসারে সম্পত্তি ভাগ করে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি বিক্রি বা দানের মাধ্যমে জমি বণ্টন করতে পারতেন না।