প্রথম পর্বের তুর্কি সুলতানগণ (দাসবংশ):

মহম্মদ ঘুরির মৃত্যুকালে তাঁর অধিকৃত ভারতীয় ভূখণ্ডের শাসক ছিলেন তাঁর অন্যতম তুর্কি ক্রীতদাস কুতুবউদ্দিন আইবক। অপুত্রক মহম্মদ ঘুরির মৃত্যু ঘটেছিল আকস্মিক। তাই মধ্য-এশিয়া বা ভারতে তাঁর অধিকৃত ভূখণ্ডের উত্তরাধিকারী মনোনয়নের সুযোগ তিনি পাননি। তবে তাঁর সংগৃহীত তুর্কি-ক্রীতদাসদের ওপরে যে তাঁর অগাধ আস্থা ছিল এবং তাদের যে তিনি পুত্রবৎ মনে করতেন, একথা মিনহাজ-উস্-সিরাজের লেখা থেকে বোঝা যায়। তাঁর ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী সম্পর্কে এক সভাসদ প্রশ্ন করলে মহম্মদ ঘুরি নাকি বলেছিলেন: “অনেক রাজার এক বা দুজন পুত্র থাকে। আমার রয়েছে কয়েক সহস্র পুত্রবৎ তুর্কি ক্রীতদাস, যারা আমার মৃত্যুর পরে আমার সাম্রাজ্য রক্ষা করবে এবং তাদের খুৎবায় আমার নাম স্মরণীয় করে রাখবে।”

যাই হোক, রাজনৈতিক ক্ষমতায় উত্তরণের প্রথম পর্বে মহম্মদ ঘুরি গুরুত্বপূর্ণ পদে তাঁর নিজের পরিবার-পরিজনদের কিংবা ঘুর অঞ্চলের বিশ্বস্ত উপজাতি সর্দারদের নিযুক্ত করতেন। কিন্তু এদের কর্মদক্ষতার ওপর ক্রমে তিনি আস্থাহীন হয়ে পড়েন এবং তুর্কি ক্রীতদাসদের ওপর নির্ভর করতে শুরু করেন। মহম্মদ ঘুরির তুর্কি ক্রীতদাসদের মধ্যে কুতুবউদ্দিন আইবক, তাজউদ্দিন ইলদুজ, নাসিরউদ্দিন কুবাচা, ইতিয়ারউদ্দিন প্রমুখ ছিলেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘুরির জীবিতকালেই এঁরা প্রত্যেকে নানাধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হয়েছিলেন এবং প্রভুর প্রতি অনুগত থেকে প্রায় স্বাধীনভাবে কর্মসূচি গ্রহণের অধিকারী ছিলেন। মহম্মদ ঘুরির আকস্মিক মৃত্যুর ফলে ইলদুজ যেমন গজনির শাসক নিযুক্ত হন, তেমনি কুতুবউদ্দিন আইবক ঘুরির ভারতীয় রাজ্যের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন (১২০৬ খ্রিঃ)। গজনির নবনিযুক্ত শাসক তথা মহম্মদ ঘুরির ভ্রাতুষ্পুত্র গিয়াসউদ্দিন মহম্মদ এক সনদ দ্বারা ভারতীয় ভূখণ্ডে কুতুবউদ্দিনকে শাসক-পদে মনোনীত করেন।

সাধারণভাবে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি-সুলতানির শাসন শুরু হয়েছে এবং মুঘলদের আগমন পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল বলে মনে করা হয়। কারণ একমাত্র খিজির খাঁ ছাড়া সবাই ‘সুলতান’ উপাধি ধারণ করেছিলেন। ‘সুলতান’ বলতে সাধারণভাবে স্বাধীন নৃপতিকেই বোঝায়। আলোচ্যকালে খলিফার অস্তিত্ব থাকলেও, অন্তত ভারতীয় শাসকদের ওপর তাঁর কার্যকরী কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তাই এঁদের ‘সুলতান’ উপাধি গ্রহণ যথার্থ ছিল। অবশ্য ‘সুলতান’ উপাধি ধারণ করলেও খলিফার অনুমোদনলাভের জন্য এঁদের কারও কারও চেষ্টা এবং সেই অনুমোদন গ্রহণ করার ঘটনাটিকে জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটা পরিবর্তন হিসেবেই ব্যাখ্যা করা যায়।

১২০৬ থেকে ১২৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লিতে যেসব বংশ রাজত্ব করত, তাদের পারসিক ইতিহাসবিদরা মুইজি, কুতবি, সামসি, বলবনী ইত্যাদি গোষ্ঠীভুক্ত বলে অভিহিত করেছেন। আধুনিক ইতিহাসবিদরা এদের পাঠান, দাস, আদি তুর্কি সুলতান, তুর্কি মামেলুক, ইলবেরি তুর্কি প্রভৃতি নামে অভিহিত করেছেন। অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে, এইসব শাসককে ‘দাসবংশ’ বলা অযৌক্তিক। কারণ জন্মসূত্রে এদের কেউই ক্রীতদাস ছিলেন না, এবং সিংহাসন আরোহণের মুহূর্তে একমাত্র কতুবউদ্দিন ছাড়া সবাই নিয়মানুগভাবে দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। এঁদের কেউই পাঠান ছিলেন না। তাই পাঠান শাসক বলাও যুক্তিহীন। কেউ কেউ এঁদের ‘মামেলুক সুলতান’ বলা বেশি যুক্তিসংগত বলে মনে করেন। আরবি শব্দ ‘মামেলুক’ মানে ‘স্বীয় অধিকারভুক্ত’। সাধারণ ক্রীতদাসদের থেকে সেনাবাহিনীর উচ্চপদে নিযুক্ত তুর্কি-ক্রীতদাসদের বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহৃত হত বলে অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মনে করেন। অবশ্য নিজামী এই বিতর্কের পরিবর্তে এঁদের প্রথম পর্বের তুর্কি সুলতান’ বলা শ্রেয় বলে মনে করেন।