আলাউদ্দিন খলজির শেষজীবন ও মৃত্যু: মালিক কাফুরের ক্ষমতাদখল :

সুলতান আলাউদ্দিনের কর্মময়তা এবং কর্তৃত্বের চূড়ান্ত কাল ছিল ১৩১২ খ্রিস্টাব্দ। এর পর থেকেই শারীরিক ও মানসিকভাবে তিনি ভেঙে পড়েন এবং অসহায়ভাবে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান। জীবনের শেষ তিনটা বছর তাঁর জীবন ছিল অভিশাপের নামান্তর। দীর্ঘ পরিশ্রম আর উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের অনিবার্য ফলস্বরূপ এই সময় তাঁর শরীর খুব ভেঙে পড়ে। বারাণীর মতে, সুলতান এই সময় শোথরোগে (ইস্তিস্কা— Dropsy) আক্রান্ত হন। আমির খসরুর মতে, সুলতান যকৃতের রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ইসামী লিখেছেন : “অসুখটা যাই হোক্, সুলতান মাঝে মাঝে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতর হতেন, তাঁকে পাণ্ডুর ও দুর্বল দেখাত। একই সঙ্গে জীবনের শেষলগ্নে আলাউদ্দিনের মানসিক যন্ত্রণাটাও কম ছিল না।” খসরু, ফেরিস্তা প্রমুখ স্বীকার করেছেন যে, সুলতানের অসুস্থতার মুহূর্তে তাঁর পুত্র তথা ভাবী সুলতান খিজির খাঁ এবং পত্নী মালিকা জাহান নিরন্তর আমোদ-আহ্লাদ, পান-ভোজন ইত্যাদি কাজেই ব্যস্ত থাকতেন। সুলতানের সেবা বিষয় ছিল তাঁদের কল্পনার অতীত। এই পরিণতি সুলতানকে যুগপৎ ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে। তিনি ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা চূড়ান্ত করার জন্য দাক্ষিণাত্য থেকে মালিক কাফুর এবং গুজরাট থেকে আলপ খাঁ’কে ডেকে পাঠান।

নুসরৎ খাঁ ও জাফর খাঁ’র মৃত্যুর পরে মালিক কাফুর এবং আলপ খাঁ-ই ছিলেন আলাউদ্দিনের সর্বাধিক কাছের মানুষ। সুলতানের বিশ্বাসভাজন হওয়ার জন্য কাফুর ভোগ করছিলেন ‘মালিক নায়েব এর গুরুত্বপূর্ণ পদ। আর আলপ খাঁ নিযুক্ত হয়েছিলেন গুজরাটের গভর্নর। সুলতানের প্রধানা মহিষীর ভাই এবং সুলতানের দুই পুত্র খিজির খাঁ ও সাদি খাঁ-র শ্বশুর হিসেবে রাজপরিবারের ওপর আলপ খাঁ একটা বিশেষ দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উচ্চাকাঙ্ক্ষী মালিক কাফুর আলপ খাঁ-র হাতে অধিক কর্তৃত্ব ছেড়ে দিতে আদৌ রাজি ছিলেন না। তাই সুলতানের অসুস্থতার সুযোগে তিনি ধীরে এবং সন্তর্পণে ক্ষমতাদখলের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ‘মালিক নায়েব’ হিসেবে সুলতানের সহকারী রূপে শাসনকার্য পরিচালনা করার বৈধ অধিকার কাফুরের লক্ষ্যপুরণে সহায়ক হয়েছিল। কাফুর আলপ খাঁ, খিজির খাঁ এবং প্রধানা মহিষীর বিরুদ্ধে সুলতানকে নানাভাবে উত্তেজিত করেন। বারাণী লিখেছেন : “সুলতানের আদেশক্রমে কাফুর আকস্মিক আলপ খাঁকে হত্যা করেন।” ইসামীর মতে, আলাউদ্দিন নিজে এই হত্যার আদেশ দেননি; তবে সিদ্ধান্তগ্রহণের দায়িত্ব কাফুরের ওপর ন্যস্ত করেছিলেন। অতঃপর খিজির খাঁকে সমস্ত রাজকীয় উপাধি ও প্রতীক প্রত্যর্পণ করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং তাঁকে আমরোহায় অবস্থান করতে বলা হয়। প্রথমে এই আদেশ মেনে নিয়েও খিজির বিনা অনুমতিতে দিল্লি ফিরে এলে আলাউদ্দিনের নির্দেশে তাঁকে বন্দি করে গোয়ালিয়র দুর্গে নিক্ষেপ করা হয়। অবশ্য কাফুর ঈশ্বর, নবি, শরিয়ত, অস্ত্র’ ইত্যাদির নামে শপথ নেন যে, তাঁর ওপর কোনো শারীরিক নিপীড়ন করা হবে না। মালিকা জাহানকেও দিল্লির ‘লালপ্রাসাদে গৃহবন্দি’ করা হয়।

ইসামী লিখেছেন : “এই সময় কাফুর সুলতানের রোগশয্যার পাশে উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের এক সভা আহ্বান করেন। এখানে আলাউদ্দিন তাঁর পুত্র শিহাবউদ্দিন ওমরকে (জাঠ্যাপল্লির গর্ভজাত সন্তান) উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। ১৩১৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারি ভোররাতে সুলতান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।”

আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পরদিন কাফুর আমিরও মালিকদের এক সভা আহ্বান করেন। এখানে তিনি আলাউদ্দিনের এক উইল পাঠ করে জানান যে, মৃত সুলতান খিজির খাঁ-র পরিবর্তে শিহাবউদ্দিনকে তাঁর পরবর্তী সুলতান মনোনীত করে গেছেন। তদনুযায়ী তিনি শিহাবউদ্দিনকে সিংহাসনে বসিয়ে নিজে তার অভিভাবক হিসেবে শাসন শুরু করেন।

মালিক কাফুর যোদ্ধা হিসেবে ছিলেন মহান কিন্তু বন্ধু হিসেবে ছিলেন ঘৃণ্য। সামান্য মানবিকতাবোধ তাঁর ছিল না। দক্ষিণ ভারতের একাধিক যুদ্ধে তিনি আলাউদ্দিনের নামে বিজয়পতাকা উড্ডীন করে সামরিক দক্ষতার পরিচয় দেন। তাই পুরস্কার হিসেবে আলাউদ্দিন কাফুরকে দশ বছর প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের আগেই ‘মালিক-নায়েব’ পদে মনোনীত করেন। আলাউদ্দিন অসুস্থ অবস্থায় পরম মিত্র হিসেবে দাক্ষিণাত্য থেকে দিল্লিতে কাফুরকে ডেকে আনেন সৎপরামর্শ ও সাহায্যের জন্য। কিন্তু ক্ষমতার মোহে কাফুর ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে লিপ্ত হন ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে! সুলতানের কানে মিথ্যা মন্ত্রণা দিয়ে তাঁকে উত্তেজিত করেন পুত্র-পত্নী ও আত্মীয়দের বিরুদ্ধে। ‘ঈশ্বর-নবি-শরিয়ত’-এর নামে শপথ নিয়েও নির্দ্বিধায় চক্ষু উৎপাটিত করেন বন্দি খিজির খাঁ-র। শিহাবউদ্দিনকে সামনে রেখে শুরু করেন। সুলতানির সর্বময় কর্তৃত্ব দখলের জঘন্য খেলা। শাহজাদা শাদি খাঁকে অন্ধ করে, মুবারক খাঁকে বন্দি করে এবং মালিকা জাহানকে সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে কাফুর তাঁর অন্নদাতার ঋণ পরিশোধ করেন। অবশেষে খোজা হয়েও আলাউদ্দিনের বিধবা পত্নী জাঠ্যাপল্লিকে বিবাহ করে কাফুর নিজের দাবিকে একটা আইনগত ভিত্তি দেবারও চেষ্টা করেন।

কাফুরের বেইমানি ও নৃশংসতা সুলতানের দেহরক্ষী বাহিনী (পাইক)-কে শেষ পর্যন্ত চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। মুবাসিরের নেতৃত্বে কয়েকজন পাইক কাফুরের মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁর ৩৫ দিনের অপশাসনের অবসান ঘটায়। ড. বেনারসীপ্রসাদ সাক্সেনা মনে করেন, কাফুরের দক্ষতা ও যোগ্যতার অভাব ছিল না। তিনি যদি দুটি আদর্শ অনুসরণ করতেন অর্থাৎ, 

  • (১) প্রভুর পরিবারের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতেন এবং 

  • (২) মালিকদের সহযোগিতায় দেশের প্রশাসনকে সচল রাখতেন, তাহলে তাঁর জীবনের হয়তো এমন করুণ পরিণতি হত না।

আলাউদ্দিন খলজির কৃতিত্বের মূল্যায়ন :

সুলতান হিসেবে আলাউদ্দিনের কর্মময় জীবনের দৈর্ঘ্য ছিল কুড়ি বছর। অবশ্য শেষ তিন বছর তিনি নামেমাত্র সুলতান ছিলেন। ওই পর্বে প্রকৃত প্রশাসনিক কর্তৃত্ব ছিল মালিক কাফুরের হস্তগত। যাই হোক্, দীর্ঘ দু-দশক কাল আলাউদ্দিনের পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণ এবং রাষ্ট্রনৈতিক বিবর্তনে তাঁর অবদান সম্পর্কে ইতিহাসবিদ ও পণ্ডিতদের মধ্যে ভিন্ন মত লক্ষ্য করা যায়। হ্যাভেল, এলফিনস্টোন, কে. এস. লাল প্রমুখ আলাউদ্দিনকে ‘সুলতানি যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান’ বলে মনে করেন। এঁরা স্বীকার করেন যে, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আলাউদ্দিন একাধিক মৌলিক পরিবর্তনের জন্য কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। এলফিন্‌স্টোনের মতে, আলাউদ্দিন ছিলেন একজন সফল শাসক, যিনি ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করার কাজে ছিলেন পারদর্শী। আগা মেহদি হুসেন মনে করেন, “শের শাহ্ শুর এবং আকবরের মতোই আলাউদ্দিন ছিলেন ভারতের একজন মহান শাসক।” আলাউদ্দিনের অগ্রণী চিন্তাশক্তির প্রশংসা করে হ্যাভেল (Havell) লিখেছেন: “Alauddin was far advanced of his age. In his reign of twenty years there are many parallels with the events of our own times.” পর্যটক ইবন বতুতাও মনে করেন, “তিনি ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসক।”

পক্ষান্তরে, ভি. স্মিথ প্রমুখ মনে করেন, মানুষ ও শাসক হিসেবে আলাউদ্দিনের কৃতিত্ব এমন কিছু ছিল না—যা তাঁর রাজত্বকালকে গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত করতে পারে। আলাউদ্দিনকে একজন ‘অসভ্য স্বৈরাচারী’ আখ্যায়িত করে স্মিথ লিখেছেন: “facts do not warrent the assertion that he exhibited a just exercise of his own powers and that his reign was glorious.” গবেষক সুকুমার রায় লিখেছেন : “রাজা হিসেবে আলাউদ্দিন ছিলেন নিষ্ঠুর ও স্বেচ্ছাচারী এবং মানুষ হিসেবে বিশ্বাসঘাতক ও অকৃতজ্ঞ।” এই গোষ্ঠী মনে করেন, আলাউদ্দিনের রাজত্বকাল ছিল ‘ভীতি ও সন্দেহের’ ওপর প্রতিষ্ঠিত। এর চালিকাশক্তি ছিল তাঁর গুপ্তচরবাহিনী ও সামরিক শক্তি। তাই তিনি তাঁর অর্জিত সাফল্যকে স্থায়িত্ব দিতে পারেননি। এই কারণে ড. কে. কে. দত্ত লিখেছেন যে, “আলাউদ্দিনের সাম্রাজ্য ছিল চোরাবালির ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তাই ভঙ্গুর।”

সাধারণভাবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভারতে মুসলমান শাসকদের মধ্যে আলাউদ্দিন সর্বপ্রথম প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষে দিল্লির আধিপত্য সম্প্রসারিত করেছিলেন। উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারিকা এবং পূর্বে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমে গুজরাট ও সিন্ধু পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। তাঁর পূর্ববর্তী দুই বিখ্যাত শাসক ইলতুৎমিস ও বলবন মহম্মদ ঘুরি-অধিকৃত ভূখণ্ডের নিরাপত্তা বিধান করতেই সমস্ত উদ্যম ও সময় ব্যয় করেছিলেন। কিন্তু আলাউদ্দিন বিপজ্জনক মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের কাজেও আত্মনিয়োগ করেন এবং সফল হন। দক্ষিণ ভারতের দিকে দিল্লির দৃষ্টি নিবদ্ধ করার কৃতিত্ব তাঁরই। দক্ষিণ ভারতের অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং ভারতরাষ্ট্র হিসেবে উত্তর-দক্ষিণের মেলবন্ধনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি দূরদর্শিতা ও রাষ্টপ্রজ্ঞার পরিচয় দেন। উত্তর ভারতের বিজিত রাজ্যকে সরাসরি দিল্লির অধীনস্থ করলেও, দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে তিনি আনুগত্য ও বার্ষিক কর লাভের শর্তে স্থানীয় রাজাদের স্বরাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। কেউ কেউ বলেন, আলাউদ্দিনের সামরিক সাফল্যের প্রধান কৃতিত্ব প্রাপ্য তাঁর চার প্রধান সেনাপতির। একথা ঠিক—জাফর খাঁ, আলপ খাঁ, নুসরৎ খাঁ এবং মালিক কাফুর বিভিন্ন রণক্ষেত্রে আলাউদ্দিনের বিজয়পতাকা বহন করে নিয়ে গেছেন। কিন্তু এই কারণে আলাউদ্দিনের সামরিক কৃতিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। ব্যক্তিগতভাবে তিনি যে সুযোদ্ধা ও সংগঠক ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় মোঙ্গল ও রাজপুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা ভিলসার বিরুদ্ধে অর্জিত সাফল্যে। একই সাথে উত্তর ও দক্ষিণে রাজ্য-সম্প্রসারণ, বহিরাগত সীমান্তদস্যু মোঙ্গলদের প্রতিরোধ এবং অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করার জন্য যে সংগঠনী প্রতিভা, মানসিক দৃঢ়তা, লক্ষ্যের একাগ্রতা প্রয়োজন, তা আলাউদ্দিনের চরিত্রে বর্তমান ছিল। তাই ড. শ্রীবাস্তব স্বীকার করেছেন যে, “আলাউদ্দিন ছিলেন একজন সাহসী সৈনিক ও সফল সেনাপতি।”

রণক্ষেত্রের সফল নায়ক আলাউদ্দিন সাম্রাজ্যের সংগঠক হিসেবেও ছিলেন অনবদ্য। ড. এস. রায় লিখেছেন : “Alauddin was the first Muslim imperialist and the first great Muslim administrator of India.” ড. রায়ের মতে, “রাজা হিসেবে আলাউদ্দিন ছিলেন দয়াহীন, স্বৈরাচারী এবং মানুষ হিসেবে বিশ্বাসঘাতক এবং অকৃতজ্ঞ; কিন্তু শাসক হিসেবে ছিলেন তেজস্বী ও দক্ষ এবং সংস্কারক হিসেবে দৃঢ়চেতা ও সৃজনশীল।” আলাউদ্দিনই প্রথম ধর্মীয় প্রভাব থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেন। উলেমাদের কাজ ও ক্ষমতার সীমারেখা নির্দিষ্ট করার দৃঢ়তা তিনিই প্রথম দেখান। ধর্মীয় প্রভাব থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে আলাউদ্দিন বেশ কিছু মৌলিক সংস্কার সাধন করেন। অধ্যাপক এস. আর. শর্মা আলাউদ্দিনকে শাসনক্ষেত্রে একজন ‘উদ্ভাবক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। মুসলমান শাসকদের মধ্যে তিনিই প্রথম ভূমিসংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করেন। জমি জরিপ করে রাজস্ব নির্ধারণের নীতি তিনিই প্রথম প্রয়োগ করেন। উৎপাদক যাতে সরকারি কর্মচারী বা মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে শোষিত ও নিপীড়িত না হয়, সেজন্য আলাউদ্দিন সরাসরি কৃষকদের সাথে বন্দোবস্ত করেন। রাজস্ব আদায়কারী গ্রামীণ অভিজাতশ্রেণির ক্ষমতা খর্ব করে আলাউদ্দিন ‘সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলকে রক্ষা’ করার আদর্শ স্থাপন করেন। আলাউদ্দিনের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাকে ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে শের শাহ ভূমিসংস্কারের কাজে মহান কৃতিত্বের অধিকারী হন। তাই ড. শর্মা লিখেছেন : “…his administrative system supplied the foundation on which all later Muslim rulers in India built. “..

শাসনক্ষেত্রে তাঁর আর একটি মৌলিক পরিকল্পনা ছিল বাজার-নিয়ন্ত্রণ বা মূল্য-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এর দ্বারা তিনি ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়ের নিশ্চয়তা এবং আপৎকালীন পরিস্থিতিতে সরকারি ভাণ্ডার থেকে অনুদানলাভের নিরাপত্তা বিধান করেন। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে প্রজাসাধারণের প্রতি কর্তব্যপালনের নৈতিক দায়িত্ব তিনি অস্বীকার করেননি। খয়ের-উল মসলিস’, ‘খাজাইন-উল-ফুতুহ’ গ্রন্থে তাঁর এই নৈতিক মূল্যবোধের কথা প্রকাশ করা হয়েছে। রাষ্ট্রের স্বার্থে যা মঙ্গলজনক তা করতে তিনি ছিলেন ‘দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’—এ কথা আলাউদ্দিন ঘোষণা করেছেন যথেষ্ট জোরের সঙ্গেই। অধ্যাপক লাল তাই মনে করেন, “সংগঠক হিসেবে আলাউদ্দিনের সাফল্যের কাছে যোদ্ধা হিসেবে সাফল্য ছিল খুবই কিঞ্চিৎ।” ড. লাল লিখেছেন : “It is as administrator than anything else that Ala-ud-din stands head and shoulders above his predecessors. His accomplishments as a warrior were dwarfed by his achievements as an organiser” আলাউদ্দিনের বাজার-নিযন্ত্রণ ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব। এই ব্যবস্থার ফলাফল সম্পর্কে দ্বিমত অবশ্যই আছে। কিন্তু এই কর্মসূচির জন্য ঐতিহাসিক লেনপুল তাঁকে ‘Political economist’ উপাধিতে ভূষিত করে সত্যকেই স্বীকার করেছেন। মধ্যযুগীয় শাসকদের সীমাবদ্ধতার মাঝে আলাউদ্দিনের এই পরিকল্পনা অবশ্য প্রশংসার যোগ্য। তাই ঈশ্বরীপ্রসাদ লিখেছেন : “He possessed the qualities of a born military commander and a civil administrator……a rare combination in medieval history.”

আলাউদ্দিন ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষিত ছিলেন না, কিন্তু তাঁর শিক্ষানুরাগ ছিল যথেষ্ট। বারাণী লিখেছেন, তাঁর দরবারে বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির সমাবেশ ঘটেছিল। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ভারতের তোতাপাখি নামে খ্যাত আমির খসরু, ভারতের সাজি নামে খ্যাত আমির হাসান। এ ছাড়া আরসালন কোহী, কবিরুদ্দিন, শেখ নিজামউদ্দিন, শেখ রুকনউদ্দিন প্রমুখ আলাউদ্দিনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। স্থাপত্যশিল্পের প্রতিও তাঁর যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। আলাউদ্দিনের স্মরণীয় স্থাপত্যকর্ম হিসেবে ‘আলাই দরওয়াজা’ আজও ভারতের গৌরব বৃদ্ধি করে। কুতুবমিনারের প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতাসম্পন্ন একটি নতুন মিনার তৈরির কাজও তিনি শুরু করেন। অবশ্য এই প্রকল্প তিনি বাস্তবায়িত করতে পারেননি। একাধিক সুদৃশ্য ও সুরক্ষিত দুর্গও তাঁর আমলে নির্মিত হয়। এগুলির মধ্যে সিরি দুর্গ এবং হাজার স্তম্ভের প্রাসাদ বা হাজারসিতান-এর নাম স্মরণীয়।

আলাউদ্দিন কীর্তিমান ছিলেন; কিন্তু তাঁর কৃতিত্ব গ্লানিমুক্ত ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ এবং বিবেকহীন। স্নেহশীল পিতৃব্যকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করতে তাঁর হাত কাঁপেনি কিংবা জালালী অভিজাতদের তোষণ করে সিংহাসন দখল করার অব্যবহিত করেই তাঁদের ছিন্নবস্ত্রের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিতেও দ্বিধা করেননি। কয়েকজন নবমুসলমানের ষড়যন্ত্রের অজুহাতে তিনি একই দিনে ২০ থেকে ৩০ হাজার নবমুসলমানকে হত্যা করে নৃশংসতার এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। বারাণী লিখেছেন যে, রাষ্ট্রের স্বার্থে আলাউদ্দিন আত্মীয়তা বা ধর্মবিশ্বাসকেও বিসর্জন দিতে দ্বিধা করতেন না। কিন্তু আলাউদ্দিনের কল্পিত রাষ্ট্র এবং আধুনিক কালের ‘কল্যাণকর রাষ্ট্রের’ ধারণা এক ছিল না। আলাউদ্দিনের রাষ্ট্র ছিল সুলতানের স্বৈরাচারী কর্তৃত্বের প্রশ্নহীন একাধিপত্য। আলাউদ্দিনের রাষ্ট্র এবং প্রশাসন দাঁড়িয়েছিল কঠোর শাসন এবং পুলিশি নজরদারির ওপর। তাঁর গুপ্তচর-ব্যবস্থার ব্যাপকতা সারা দেশে প্রতিটি মুহূর্তের জন্য যে আতঙ্ক ও আশঙ্কার পরিমণ্ডল গড়ে তুলেছিল, তাতে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-শান্তি অন্তর্হিত হয়েছিল। হিন্দুদের প্রতি তাঁর আচরণ ছিল অস্বাভাবিকভাবে কঠোর এবং সংকীর্ণ মানসিকতার জঘন্য প্রতিফলন। তাঁর বাজার-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কিছু লোকের কাছে স্বল্পমূল্যে জিনিস পৌঁছে দিতে পারলেও এই ব্যবস্থা শিল্পবাণিজ্যের স্বাভাবিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করেছিল। ব্যবসায়ীদের ন্যূনতম বাণিজ্যিক স্বাধীনতা না থাকার ফলে তাদের উৎসাহ শিথিল হয়েছিল। আলাউদ্দিন ক্রেতাদের স্বার্থ দেখেছিলেন, কিন্তু উৎপাদকের স্বার্থ সম্বন্ধে ছিলেন উদাসীন। দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে তিনি কী নীতি গ্রহণ করেছিলেন সে বিষয়ে বারাণী বা খসরু যা বলেছেন তা তত্ত্বকথামাত্র; অর্থনীতির মূল সত্যের সাথে তার সম্পর্ক সম্ভবত ছিল ক্ষীণ। ড. পি. শরণ মনে করেন, আলাউদ্দিনের শাসন পরিকল্পনা রচিত হয়েছিল একন্তভাবে শাসকশ্রেণির স্বার্থের দিকে তাকিয়ে। তবে এর দ্বারা যদি কোনো সাধারণ নাগরিক উপকৃত হয়ে থাকে, তবে তা ছিল দুর্ঘটনামাত্র। ড. শরণের ভাষায় : “….if any good acrued to the people, it was only accidental, a by-product of their measures and not an outcome of any deliberate steps for such purposes.” উৎপাদনের ৫০ শতাংশ করধার্যের ব্যবস্থাকে অনেকেই অর্থনীতির বিরোধী বলে মনে করেন।

ড. আর. পি. ত্রিপাঠী, ড. কে. এস লাল প্রমুখ আলাউদ্দিনের চারিত্রিক বা প্রশাসনিক ত্রুটিগুলিকে স্বাভাবিক ও গুরুত্বহীন বলে মনে করেন। এঁদের মতে, আলাউদ্দিন দিল্লির একটা ছোটো রাজ্যকে বিশাল ভারতীয় সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত করে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ড. শ্রীবাস্তব ও স্বীকার করেছেন যে, “তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহে দিল্লির সুলতানদের মধ্যে যোগ্যতম। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা এবং লক্ষ্যের ব্যাপকতার সাথে একমাত্র মহম্মদ-বিন-তুঘলকের তুলনা করা চলে। তবে মহম্মদ তুঘলক তাঁর অধিকাংশ পরিকল্পনা রূপায়ণে ব্যর্থ হয়েছিলেন, কিন্তু আলাউদ্দিন প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিলেন সফল রূপকার। অধ্যাপক এস. রায় আলাউদ্দিনকে মহান শের শাহ এবং আকবরের পূর্বসূরি হিসেবে চিহ্নিত করে যথার্থই বলেছেন: “Ala-ud-din, Sher Shah and Akbar each marks a distinctive step in the evolution of Indo-Muslim history.”