মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের রাজতান্ত্রিক (নরপতিত্বের) আদর্শ:

মহম্মদ-বিন্-তুঘলক উত্তরাধিকার সূত্রে যে বিশাল সাম্রাজ্য ও অতিসমৃদ্ধ রাজকোষ পেয়েছিলেন, সম্ভবত দিল্লির অন্য কোনো মুসলমান শাসক তা পাননি। কাশ্মীর, আফগানিস্তান ও বালুচিস্তান ছাড়া সমগ্র ভারত ছিল দিল্লির অধীনস্থ। সুলতানি রাজ্যের সীমানা প্রসারিত ছিল উত্তর-পূর্বে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে উত্তর-পশ্চিমে সিন্ধু পর্যন্ত। পূর্ব-পশ্চিমে এর বিস্তৃতি ছিল সমুদ্র থেকে সমুদ্র। সাম্রাজ্য বিভক্ত ছিল প্রায় ২৪টি প্রদেশে। অবশ্য প্রদেশের সংখ্যা সম্পর্কে বারাণী কিছুই লেখেননি। ইবন বতুতা কেবল আংশিক উল্লেখ করেছেন। তবে সাম্রাজ্যের পরিধি ছিল বিশাল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু চিরাচরিত অর্থে মহম্মদ তাঁর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে রক্ষা করতে উৎসাহী ছিলেন না। তাঁর মস্তিষ্ক ছিল উর্বর। কল্পনাপ্রবণ ছিল তাঁর মন। যুক্তি, তর্ক ও দর্শনের সমন্বয়ে তিনি একদিকে ভারতীয় সীমারেখার মধ্যে জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে তুলতে এবং অন্যদিকে দেশের সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিকতার আদর্শ প্রচার করতে উদ্যত হয়েছিলেন। রাজনৈতিক এবং ধর্মনৈতিক চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে মহম্মদ তুঘলক যে অসাধারণ এবং অস্বাভাবিক মৌলিকত্বের অধিকারী ছিলেন, তা বোঝাতেই বারাণী ‘ইকৃতিরাহ্’, ‘তহকিমত্-ই-মুজাদ্দিদ’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করেছেন।

মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের রাজনৈতিক আদর্শের মূল কথা ছিল ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক ঐক্য। তাঁর সিংহাসনারোহণের কালে ভারত-রাষ্ট্রের ধারণা ছিল অসম্পূর্ণ। কারণ উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারত রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক বিচারে একই ধারার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। উত্তর ভারতে ছিল সুলতানির প্রত্যক্ষ শাসন, কিন্তু দক্ষিণ ভারতে ছিল স্থানীয় রাজাদের আনুগত্যমূলক স্বশাসন। উত্তর ভারতে ছিল হিন্দু-মুসলিম মিশ্র সংস্কৃতির অবস্থান, কিন্তু দক্ষিণে ছিল হিন্দু সংস্কৃতির প্রাধান্য। সুলতান মহম্মদ দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করে দক্ষিণ ভারতের সাংস্কৃতিক রূপান্তরের সূচনা করেন। দিল্লি থেকে দৌলতাবাদ হয়ে মুলতান কিংবা বাংলাদেশ থেকে গুজরাট পর্যন্ত সুলতানি-বাহিনীর পদচারণার সাথে সাথে বণিক, পণ্ডিত, মরমিয়া সাধক, কবি, ছাত্র ইত্যাদি সমাজের নানাত্তরের মানুষের যাতায়াতের সুবাদে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন সম্ভাবনাপূর্ণ হয়। মহম্মদ তুঘলকের কর্তৃত্বে এই সংহত ভারতরাষ্ট্র গঠনের প্রয়াসের প্রশংসা করে ড. কে. এ. নিজামী লিখেছেন : “Perhaps no ruler after Asoka had visualised India as a political and administrative unit in the same way as Muhammad bin Tughluq.”

সমসাময়িক এশিয়ার রাজনৈতিক শূন্যতার পরিপ্রেক্ষিতে সুলতানের মনে মধ্য-এশিয়ার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপনের (রিকল্পনা দানা বাঁধে। ইল খাঁ-দের ক্ষমতা তখন অন্তর্হিত, তৈমুরের তখনও জন্ম হয়নি। এমতাবস্থায় মহম্মদের রাজনৈতিক উচ্চাশা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় ছিল না। খোরাসান বিজয়ের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির মধ্যে সুলতানের এই ইচ্ছার প্রমাণ পাওয়া যায়। অধ্যাপক নিজামী একেই উচ্চ সাম্রাজ্যবাদ’ বলে অভিহিত করেছেন। বারাণীর বিবরণ থেকেও মহম্মদ তুঘলকের বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদী অভীপ্সার আভাস পাওয়া যায়। বারাণী লিখেছেন: “সুলতানের তুলনাবিহীন ব্যক্তিত্বের মধ্যে তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা এত গভীরভাবে প্রোথিত যে, বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ বাসভূমি (তখন মনে করা হত বাকি তিন-চতুর্থাংশ জল এবং বাসযোগ্য নয়) যদি তাঁর ক্রীতদাসদের অধীনে থাকত, পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণে প্রসারিত ভূখণ্ডের সমস্ত মানুষ যদি তাঁকে কর প্রদান করত এবং তাঁর নিয়ন্ত্রণে স্থাপিত হত,…….এবং তার পরেও যদি সুলতান কারও কাছে জানতে পারতেন যে, কোনো দ্বীপের সামান্যতম অংশ কিংবা কোনো দেশের একটা ঘরের সমপরিমাণ ভূখণ্ড তাঁর অধীনস্থ হয়নি, তাহলে সেই স্থানটি দখল না করা পর্যন্ত তাঁর নদী-সদৃশ হৃদয় এবং তাঁর বিশ্বজয়ের উদ্দীপনা শান্ত হত না।” সাম্রাজ্যবাদী মনস্কতার দিক থেকে মহম্মদ তুঘলক গ্রিকবীর আলেকজান্ডারকেও অতিক্রম করেছিলেন বলে বারাণী উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, আলেকজান্ডারের মর্যাদায় উন্নীত হয়েও সুলতান সন্তুষ্ট হতেন না। তিনি ডেভিডের পুত্র সলোমনের মতো মানুষ ও অদৃশ্য জিন—উভয়ের ওপর কর্তৃত্ব করতে ইচ্ছুক ছিলেন। নবি এবং সুলতানি, ধর্মপ্রচারক এবং শাসকের দ্বৈত-ক্ষমতা ভোগ করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য।

ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা সুলতান মহম্মদকে ব্যথিত করত। তিনি বহির্বিশ্বের সাথে কূটনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক যোগস্থাপনের পক্ষপাতী ছিলেন। এই কারণে ১৩৪০ ‘৪১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বহু জিনিসের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক তুলে দেন। চিন, মিশর, ইরাক, ইরান, সিরিয়া প্রভৃতি দেশের সাথে দূত বিনিময় এবং উপঢৌকন বিনিময়ের মাধ্যমে সুলতান মহম্মদ-বিন্ তুঘলক ভারতবর্ষের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিকতার প্রবেশ ঘটান। ড. নিজামী এটিকে ‘ভারতের রাজনীতির এক নতুন অধ্যায়’ বলে অভিহিত করেছেন।

সুলতানের কর্তৃত্ব ও সাম্রাজ্যের সংহতির পরিপন্থী উপাদান হিসেবে মুসলিম অভিজাতশ্রেণির স্বাধীনতাবোধ ও কর্তৃত্ববোধের বিপদ সম্পর্কে সুলতান মহম্মদ তুঘলক সচেতন ছিলেন। তাই বংশানুক্রমিক অভিজাতবর্গের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ঔদ্ধত্যকে দমন করার জন্য তিনি যোগ্যতার ভিত্তিতে উচ্চরাজপদে কর্মী নিয়োগ শুরু করেন। এইভাবে বংশকৌলীন্যহীন একদল নতুন অভিজাত তৈরি করে তিনি অভিজাত বংশগুলির আমলাতান্ত্রিক একাধিপত্য বিনষ্ট করেন। এ প্রসঙ্গে ড. ত্রিপাঠী (R.P.Tripathy) লিখেছেন : “পুরাতন, উন্নাসিক এবং সংশোধনের অতীত অভিজাতদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি সুবিধাহীন ও নিম্নশ্রেণির মানুষের মধ্য থেকে এক নতুন আমলাতন্ত্র সৃষ্টি করেন” (“To get rid of the high browed nobility which was old and incorrigible he began to gradually raise a new class of official from among the lower and non privileged class.”)। মহম্মদের এই নীতির ফলে ধর্মান্তরিত মুসলমান এবং অনুগত হিন্দুদের মধ্য থেকে বহু যোগ্য ব্যক্তি উচ্চরাজপদে নিযুক্ত হবার সুযোগ পায়। ড. নিজামীর মতে, মহম্মদ তুঘলক তাঁর গভীর জ্ঞান ও রাষ্ট্রপ্রজ্ঞা দ্বারা উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারত সাম্রাজ্যকে স্থায়িত্ব ও বিস্তৃতি দিতে গেলে সমস্ত শ্রেণির মুসলমানকে যেমন প্রশাসনের সাথে যুক্ত করতে হবে, তেমনি যোগ্যতাসম্পন্ন হিন্দুদেরও সরকারের দায়িত্বশীল পদে নিযুক্ত করতে হবে। তাঁর মতে, বারাণী ছিলেন প্রাচীনপন্থী এবং গোঁড়া। তাই মহম্মদ তুঘলকের দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থতা তিনি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। কায়েমী স্বাৰ্থবোধে অন্ধ প্রাচীন অভিজাতদের সম্পর্কে সুলতানের কঠোর মনোভাব ছিল বাস্তব অভিজ্ঞতার ফল। গুরুসাস্প, বাহাউদ্দিন প্রমুখের বিদ্রোহ সুলতানকে কঠোর হাতে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করতে এবং বিকল্প হিসেবে যোগ্যতার ভিত্তিতে নতুন আমলাতন্ত্র গড়ে তুলতে বাধ্য করেছিল।

মহম্মদ তুঘলকের ধর্মীয় আদর্শ :

মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের ধর্মীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠিত ছিল প্রখর যুক্তিবাদের ওপর। মোঙ্গলগণ কর্তৃক ইসলামের সার্বিক প্রসার রুদ্ধ হবার পরবর্তী পর্যায়ে ইসলামের মধ্যে দু-ধরনের প্রতিক্রিয়া জন্ম নেয়। একদিকে উত্থান ঘটে অতিন্দ্রীয়বাদী বা মরমিয়া সাধকগোষ্ঠীর, যাঁরা সবৈবরূপে রাজনীতিমুক্ত থেকে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে মুসলমান সমাজের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে উদ্যোগী হন। অন্য দিকে ইমাম ইবন তিমিয়া’র নেতৃত্বে মৌলবাদী গোষ্ঠী সাধারণ মুসলমান উলেমা, শাসকশ্রেণি এবং মরমিয়া প্রভৃতি সমস্ত শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুসলমান সমাজকে নবজাগরিত করার কথা প্রচার করেন। অবশ্য এঁরা মনে করতেন, মরমিয়া সাধকগণ হতাশাবাদী এবং অসম্পূর্ণ একটি ধারণার অনুসারী। সুলতান মহম্মদ-বিন্-তুঘলকের সাথে এই দুটি ধারারই গভীর সম্পর্ক ছিল। তিমিয়ার শিষ্য মৌলানা আব্দুল আজিজ কিংবা সুফি সাধক শেখ রুকনউদ্দিন মুলতানির পদচুম্বন করে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতেও সুলতান দ্বিধা করেননি। মহম্মদ তুঘলকই দিল্লির প্রথম সুলতান যিনি আজমিরে শেখ নিজামউদ্দিনের সমাধিতে উপস্থিত হয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। কিন্তু এদের কোনো পক্ষের বক্তব্যই সুলতান পুরোপুরি গ্রহণ করতেন না। মহম্মদ তাঁর ধর্মীয় ধ্যানধারণা গড়ে তুলেছিলেন যুক্তি, তর্ক, বিশ্বাস আর দর্শনের সমন্বয়ে।

ধর্ম ও দর্শনের গভীর তত্ত্ব জানার ব্যাপারে মহম্মদ তুঘলকের আগ্রহ ছিল গভীর ও আন্তরিক। অজ্ঞেয়বাদ, নিরীশ্বরবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন তত্ত্ব সম্পর্কে তিনি ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা করেন। আল-উমারি লিখেছেন : “সুলতান প্রায় সন্ধ্যাকালে উলেমাদের সাথে মিলিত হয়ে ইসলাম ধর্মের নানা দিক সম্পর্কে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করতেন।” ইবন বতুতা এবং ইসামী লিখেছেন যে, প্রতিদিন সকালের প্রার্থনার পর সুলতান নানা ধর্মের দার্শনিকদের সাথে দর্শনতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করতেন। হিন্দুযোগী বা জৈনদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎকার এবং ধর্মালোচনার কথা সমকালীন সব ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন। জৈন পণ্ডিত রাজশেখর এবং জিনপ্রভা সুরি মহম্মদ তুঘলকের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। জিমার (Zimmer)-এর মতে, সুলতানের ওপর যোগীদের প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আগা মেহদী হোসেন লিখেছেন : “মহম্মদ-বিন্-তুঘলক গভীর রাতে ঘরের আলো নির্বাপিত করে যোগাভ্যাস করতেন। এবং এর দ্বারা যে আত্মবল অর্জন করতেন, তা তাঁকে বিপদে অচঞ্চল এবং লক্ষ্যে অটল থাকার শক্তি জোগাত।”

অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি মহম্মদ তুঘলক কেবল সহনশীল ছিলেন না, সহযোগীও ছিলেন। সম্ভবত, তিনি প্রথম সুলতান যিনি হিন্দুদের দোল উৎসবে হোলী খেলায় যোগ দিতেন। তিনি গিরনার হিন্দুমন্দির এবং পালাটিনার জৈনমন্দির পরিদর্শন করেন। জৈন সন্ন্যাসীদের জন্য আশ্রম নির্মাণ এবং একটি গো-মঠ নির্মাণের জন্য সরকারি অর্থও ব্যয় করেন। ড. নিজামীর মতে “মহম্মদ-বিন্-তুঘলক এক উদার ধর্মীয় পরিমণ্ডল গড়ে তুলেছিলেন বলেই তাঁর রাজত্বকালে হিন্দুযোগীদের সাথে মুসলমান শিষ্য ঘুরতে পারত, কিংবা শান্তিপূর্ণভাবে নানা ধর্মমত বিরাজ করতে পারত।”

গোঁড়া ধর্মভাবাপন্ন বারাণী বা ইসামীর বিবেচনায় ধর্ম বিষয়ে মহম্মদ-বিন-তুঘলকের যুক্তিবাদ ছিল ধর্মদ্রোহিতার নামান্তর। বারাণীর মতে, বাল্যকাল থেকেই মহম্মদের সাথে তর্কবিদ সাদ, নাস্তিক্যবাদী উবাইদ, দার্শনিক নাজম প্রমুখের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী ও কট্টর সমালোচক। এঁদের সাথে নিরন্তর দর্শন আলোচনা করার ফলে মহম্মদ তুঘলকের মনে ইসলামের আদর্শ ও ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে গভীর সন্দেহ ও অনীহারোধ জন্মেছিল। এদের যুক্তিবাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত না হলে সুলতান ইসলাম ধর্মপ্রাণ উলেমাদের রক্তে হাত রাঙাতে সাহস করতেন না। ইসামীও মহম্মদ-বিন-তুঘলককে ‘হিন্দু-মনোভাবাপন্ন পৌত্তলিক সুলতান’ বলে ব্যঙ্গ করেছেন।

বারাণী বা ইসামী উভয়েই ছিলেন মহম্মদের বিরোধী। তাই তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী মহম্মদ-বিন তুঘলককে এক কথায় ধর্মদ্রোহী বা ইসলাম-বিরোধী বলা অযৌক্তিক। ইবন বতুতা’র বিবরণ থেকে জানা যায় যে, মহম্মদ-বিন-তুঘলক ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী প্রতিদিন নামাজ পড়তেন এবং যাতে প্রতিটি মুসলমান নিয়মানুযায়ী প্রার্থনা করে সেদিকে কড়া নজর রাখতেন। প্রার্থনার সময় কোনো মুসলমান ঘুরে বেড়ালে তাকে শাস্তিভোগ করতে হত। বারাণীর শেষের দিকে, রচনাতেও ইসলামীয় আইনের প্রতি সুলতানের আগ্রহের কথা লেখা হয়েছে। এ বিষয়ে একটা নতুন বিশ্লেষণ দিয়েছেন আগা মেহদী হোসেন। তাঁর মতে, মহম্মদ তুঘলক শাসনদায়িত্ব গ্রহণ করার অব্যবহিত পরে রাষ্ট্র ও ধর্ম সম্পর্কে একটা নতুন দার্শনিক-তত্ত্ব দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর গভীর তত্ত্বজিজ্ঞাসা ও জ্ঞানের সাথে কোরানের ব্যাখ্যাকার বা বিচারকদের একটা অমিল দেখা দিত। তাই তিনি সুলতান হিসেবেই তাদের ক্ষমতা কেড়ে নিতেন বা হ্রাস করতেন। সুলতান নিজেই ধর্ম ও রাজনীতিকে যমজ বলে বর্ণনা করেছেন এবং সুলতান হিসেবেই নিজের বিবেচনা দ্বারা তাকে রক্ষা করতে চেয়েছেন। ইসলামকে বর্জন করার কোনো ইচ্ছা তাঁর ছিল না। তাই ১৩২৬-‘২৭ খ্রিস্টাব্দের একটি মুদ্রায় তিনি নিজেকে ‘শেষ নবির ঐতিহ্যের রক্ষক’ (মুহি-ই-সুনম-ই-খাতিন-উন-নবিন) বলে ঘোষণা করেছেন। বারাণী যুক্তিবাদী দার্শনিক এবং ইসলামের রক্ষক উভয় ভূমিকাতেই মহম্মদ তুঘলকের চূড়ান্ত প্রকাশ লক্ষ্য করেছেন। তাই তাঁর কাছে মহম্মদের চরিত্র ‘পরস্পরবিরোধী উপাদানের সমন্বয়’ (Mixture of opposits) বলে প্রতিভাত হয়েছে। ড. আগা মেহদী হোসেনের মতে, মহম্মদ বিন্-তুঘলক ছিলেন ধৈর্যহীনতা ও সীমাহীন ক্রোধের বশীভূত। তাই তাঁর কাজগুলি কাঙ্ক্ষিত পরিণতি লাভে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনীতি বা ধর্মনীতি উভয়ক্ষেত্রেই এই বিপত্তি তাঁকে গ্রাস করেছে।