প্রাচীন ধারণা: প্রাচীনকালে গ্রীক দার্শনিকগণ রাষ্ট্র ও সমাজকে অভিন্ন বলে মনে করতেন। প্লেটো অ্যারিস্টটলের আমলে রাষ্ট্র ছিল নগর-রাষ্ট্র। রাষ্ট্র ছিল একাধারে রাষ্ট্র ও সমাজ। রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সাদৃশ্য সম্পর্কে বার্ক (Edmund Burke) ও সমমত পোষণ করেন। তিনি বলেছেন: “Society is indeed a contract…but the state ought not be considered nothing better than a partnership agreement in a trade.” বর্তমানকালে সামগ্রিকতাবাদ (Totalitarianism)-এ বিশ্বাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণও রাষ্ট্র ও সমাজের পার্থক্যকে স্বীকার করেন না। সামগ্রিকতাবাদে বা একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সীমারেখাকে অস্বীকার করা হয় এবং সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের কথা বলা হয়। সাম্প্রতিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকে ‘রাষ্ট্র’ শব্দটির পরিবর্তে ‘রাজনীতিক ব্যবস্থা’ (Political system) কথাটি প্রয়োগ করার পক্ষপাতী। এই ধারণার সমর্থকদের মতানুসারে রাজনীতিক ব্যবস্থা হল বৃহত্তর সামাজিক ব্যবস্থার একটি অংশবিশেষ। এই কারণে এখন রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্যের কথা বলা হয়ে থাকে।

রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ক ধারণার বিবর্তন: রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনাটিও বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এ নিয়ে চিরকাল একই কথা বলা হয়নি। ঐতিহাসিক অবস্থার পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সম্পর্ক সংক্রান্ত আলোচনাও ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। প্লেটো-অ্যারিস্টটল রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য করেননি। তাঁদের আমলে অর্থাৎ প্রাচীন গ্রীসে রাষ্ট্র ও সমাজ ছিল সমার্থক। এই দুটি ধারণা ছিল এক ও অভিন্ন। সামগ্রিকভাবে সমাজের উপর রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত ছিল। রাষ্ট্র সম্পর্কিত একত্ববাদী এবং ভাববাদী চিন্তাধারার মধ্যে উপরিউক্ত গ্রীক্ চিন্তাধারার প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়। যুক্তিবাদী ইংরাজ দার্শনিক হব্‌সের রাষ্ট্রদর্শনেও সমাজকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দেওয়া হয়নি। চুক্তিবাদী ফরাসী দার্শনিক রুশোও সমাজের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে স্বীকার করেননি। এডমণ্ড বার্কও রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সাদৃশ্যের কথা বলেছেন। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্যমূলক আলোচনার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

সমাজের ও রাষ্ট্রের ধারণা: সমাজ ও রাষ্ট্রের ধারণা ব্যাখ্যার ভিত্তিতে এই দু-এর মধ্যে সম্পর্ক পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। সমাজ কাকে বলে এ প্রসঙ্গে সমাজতত্ত্ববিদ এবং অন্যান্য চিন্তাবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তবে সমাজ বলতে বর্তমানে বোঝায় জাতির অন্তর্গত স্বেচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত সংঘের সমষ্টিকে। বার্কার বলেছেন: “By society we mean the whole sum of voluntary bodies or associations, contained in the nation…with all their various purposes and with all their institutions.” তিনি আরও বলেছেন: “Taken together, and regarded as a whole, these associations from the social substance which goes by the general and comprehensive name of society.” বস্তুত সমাজের উদ্দেশ্য এবং এর মধ্যে গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠানসমূহ বিভিন্ন রকমের হতে পারে। আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি যাবতীয় সংগঠনকে নিয়েই একটি জাতীয় সমাজের সৃষ্টি হয়। আবার মার্কসবাদীদের মতানুসারে ‘আপন আপন ক্রিয়ার দ্বারা পরস্পরের উপর প্রভাববিস্তারকারী মানুষের বিস্তৃত সংগঠনের নাম হল সমাজ।’…সমাজ প্রকৃতপক্ষে মানুষের পরিশ্রম অর্থাৎ ক্রিয়ার পারস্পরিক সম্পর্কের উপর স্থাপিত (“People with their activity and mutual relations comprise a society.”)। অপরদিকে বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রতিষ্ঠিত এক আবশ্যিক সংগঠনকে রাষ্ট্র বলা হয়। বার্কার মূলত আইনের দৃষ্টিভঙ্গিতে রাষ্ট্রের ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে রাষ্ট্র হল এক বিশেষ ধরনের বৈধ সমিতি। আইন বলবৎকরণ ও শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্র আবশ্যিক কাজকর্ম সম্পাদন করে এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখে।

একত্ববাদী ধারণা: রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে সম্পর্ক প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য বর্তমান। এ বিষয়ে একত্ববাদী ও বহুত্ববাদীদের বক্তব্য ব্যাখ্যা করা দরকার। একত্ববাদীদের মধ্যে একদল আছেন যাঁরা বিমূর্ত একত্ববাদ (Abstract Monism)-এর কথা বলেন। এঁদের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রই হল একমাত্র সংগঠন। রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে অন্য কোন সংগঠন স্বাধীনভাবে থাকতে পারে না বা নিজের দায় দায়িত্ব সম্পাদন করতে পারে না। চুক্তিবাদী ইংরাজ দার্শনিক হবস সমাজের দিক থেকে সমিতির অস্তিত্বকে ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেছেন। আর একজন চুক্তিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অনুরূপ অভিমত পোষণ করেন। ইনি হলেন ফরাসী দার্শনিক রুশো। তাঁর মতানুসারে সমাজের মধ্যে যদি বিভিন্ন সমিতি গড়ে উঠে তা হলে এই সমিতিগুলির ইচ্ছা (Will)-র প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে। তারফলে সাধারণের ইচ্ছা (General Will) বিপন্ন হয়ে পড়বে। একত্ববাদী বক্তব্যের আর একটি ধারা আছে। একত্ববাদের এই ধারাকে বলে বাস্তব একত্ববাদ (Concrete Monism)। এই শ্রেণীর একত্ববাদীদের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের ভিতরে সমিতির অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়। কিন্তু বলা হয় যে সমিতিগুলি রাষ্ট্রের অধীনতা স্বীকার করে নেবে। এ ধরনের একত্ববাদে সমিতির স্বাধীনতাকে স্বীকার করা হয়নি। এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্র হল আইনের মাধ্যমে সম্মিলিত এক সংস্থা বা ‘করপোরেট রাষ্ট্র’ (Corporate State)। এই রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব সকল ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হবে। সমিতিগুলি কেবলমাত্র এই রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত স্বাধীনতাই ভোগ করার সুযোগ পাবে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে নাৎসীবাদ ও ফ্যাসীবাদের কথা বলা যায়।

বহুত্ববাদী ধারণা: অপরদিকে বহুত্ববাদী তত্ত্বে সামাজিক সংঘসমূহের স্বাধিকার ও স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করা হয়। এবং এই কারণে এই মতবাদে সার্বভৌম ক্ষমতার উপর রাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্যকে অস্বীকার করা হয়। বহুত্ববাদে সামাজিক সংঘগুলির কাজকর্মকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। মানবসমাজে এই সমস্ত সংগঠনের ভূমিকার গুরুত্বকে স্বীকার করা হয়। বলা হয় যে, ব্যক্তির বহুমুখী প্রতিভার যথাযথ বিকাশের ক্ষেত্রে সামাজিক সংগঠনগুলির ভূমিকা অপরিহার্য এবং তাৎপর্যপূর্ণ। বহুত্ববাদে আরও বলা হয় যে, সমাজের ক্রিয়াশীল (functional) সমিতি বা সংগঠনগুলি স্বাধীনভাবে তাদের কাজকর্ম সম্পাদন করবে। বহুত্ববাদীদের আরও অভিমত হল যে রাষ্ট্র ব্যক্তির সার্বিক আনুগত্য দাবি করতে পারে না।

আবার ভাববাদী চিন্তাধারায় ভিন্ন কথা বলা হয়। ভাববাদী ধারণা অনুসারে সামাজিক সংঘ-সমিতির স্বাধিকার বা স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করা হয় না। এই মতবাদ অনুসারে মানবজীবনের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অধিকারী হল রাষ্ট্র।

মার্কসীয় ধারণা: মার্কসীয় চিন্তাধারায় রাষ্ট্র ও সমাজের সম্পর্কটিকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার বিশ্লেষণ করা হয়। মার্কসবাদীদের মতানুসারে মানবসমাজের ইতিহাসের আদিম অবস্থায় রাষ্ট্র ছিল না। রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে সমাজের বিকাশের ধারায় একটি বিশেষ পর্যায়ে। এই পর্যায়ে সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সৃষ্টি হয়। এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি সংরক্ষণের স্বার্থে একটি বিশেষ যন্ত্র বা হাতিয়ারের প্রয়োজন অনুভূত হয়। তখনই ব্যক্তিগত সম্পত্তি সংরক্ষণের হাতিয়ার হিসাবে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। রাষ্ট্র মানেই শোষণ। এই শোষণ হল সম্পত্তিবান শ্রেণীর স্বার্থে এবং সম্পত্তিহীন শ্রেণীর বিরুদ্ধে। মার্কসবাদীদের মতানুসারে শ্রেণী বৈষম্যমূলক সমাজে রাষ্ট্রের কাজ হল শোষক শ্রেণীর স্বার্থে এবং শোষিত শ্রেণীর বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করা। সাম্যবাদী সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি, অসাম্য ও শোষণ থাকবে না। তাই তখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে রাষ্ট্রের অবসান ঘটবে।

অত্যাধুনিক গোষ্ঠীকেন্দ্রিক তত্ত্বে বিশ্বাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ভিন্ন কথা বলেন। মানুষের রাজনীতিক জীবনের পরিচয় প্রদানের ক্ষেত্রে এই রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তারা কেবলমাত্র গোষ্ঠীর উপবই গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। এক্ষেত্রে এই শ্রেণীর চিন্তাবিরা রাষ্ট্রের আলোচনাকে বাতিল করার পক্ষপাতী।

রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য

আধুনিক আলোচনায় রাষ্ট্র ও সমাজকে অভিন্ন মনে করা হয় না। ম্যাকাইভার, বার্কার, ল্যাস্কি প্রমুখ প্রখ্যাত আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্যমূলক আলোচনা করেছেন। মার্কসীয় মতবাদ অনুসারেও রাষ্ট্র এবং সমাজ সমার্থক নয়। বর্তমানে সমাজ বলতে জাতির অন্তর্গত স্বেচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত সংঘের সমষ্টিকে বোঝায়। বার্কার (Barker) বলেছেন: By society we mean the whole sum of voluntary bodies or associations contained in the nation.” অর্থাৎ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থনীতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি সমূহ সংগঠনকে নিয়েই বর্তমানের জাতীয় সমাজের ধারণা গঠিত। পক্ষান্তরে রাষ্ট্র বলতে আমরা বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনের জন্য প্রতিষ্ঠিত এক আবশ্যিক সংগঠনকে বুঝে থাকি। এই ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে কতকগুলি পার্থক্য নির্দেশ করা যায়।

(১) রাষ্ট্র সৃষ্টির অনেক আগে থেকেই সমাজের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। বস্তুত সমাজবিবর্তনের ধারায় একটি বিশেষ পর্যায়ে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে।

(২) বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে সমাজের সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র হল এই সংগঠনসমূহের মধ্যে অন্যতম। এই কারণে সমাজ রাষ্ট্র অপেক্ষা অনেক ব্যাপক।

(৩) রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির আনুগত্য কেন্দ্রীভূত: আইনগত বিচারে রাষ্ট্র হল একমাত্র সংগঠিত প্রতিষ্ঠান। দেশের শাসনব্যবস্থাকে কার্যকর করার বৈধ ও পরিপূর্ণ দায়িত্ব এই রাষ্ট্রের উপরই ন্যস্ত আছে। তাই জাতির সকলে এর সদস্য। এবং একটি রাষ্ট্রেরই সদস্য হওয়া যায়। একই ব্যক্তি একই সঙ্গে একাধিক রাষ্ট্রের সদস্য হতে পারে না। তাই রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির আনুগত্য বিভক্ত হয় না। কিন্তু সমাজ হল বহু সংগঠনের সমষ্টি। যে-কোন ব্যক্তি বিভিন্ন সামাজিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য একই সঙ্গে এরকম একাধিক সংগঠনের সদস্য হতে পারে এবং হয়ও। পৃথক পৃথক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যক্তি ভিন্ন ভিন্ন সমিতির সদস্যপদ গ্রহণ করে। এই ভাবে সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের আনুগত্য একাধিক সমিতির প্রতি প্রসারিত হয় বা বিভক্ত হয়।

(৪) সমাজের উদ্দেশ্য ব্যাপকতর: আইনগত উদ্দেশ্য সাধনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র হল একমাত্র প্রতিষ্ঠান। একমাত্র রাষ্ট্রই আইন প্রণয়ন ও বলবৎকরণের কাজ সম্পাদন করে থাকে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য মূলত আইন বিষয়ক। বস্তুত রাষ্ট্র আইন, শাসন ও শৃঙ্খলার এক পরিকাঠামো গড়ে তোলে। বার্কারের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের মুখ্য লক্ষ্য হল এই বৈধ উদ্দেশ্য সাধন। পক্ষান্তরে সমাজের উদ্দেশ্য হল বহু ও বিভিন্ন। সমাজের আর্থিক, নৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি বহু উদ্দেশ্য বর্তমান। বিভিন্ন সমিতি বা সংগঠনের মাধ্যমে সমাজে এই সমস্ত দায়িত্ব সম্পাদিত হয়।

(৫) সমাজের পরিধি ব্যাপকতর: সমাজের পরিধি রাষ্ট্রের পরিধি অপেক্ষা অনেক ব্যাপক। সমাজ মানুষের সমগ্র জীবনকেই পরিচালিত করে। অর্থাৎ মানবজীবনের সকল দিকই সমাজের পরিধিভুক্ত। মানুষের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধনই হল সমাজের উদ্দেশ্য। কিন্তু রাষ্ট্র কেবল মানুষের রাষ্ট্রনীতিক জীবনকেই নিয়ন্ত্রণ করে। বস্তুত সমাজের অন্তর্গত বহুবিধ সংগঠনের মধ্যে রাষ্ট্র হল অন্যতম একটি রাজনীতিক সংগঠন। বার্কার বলেছেন: “The state exists for one great but single purpose, society exists for a number of purposes…”.

(৬) রাষ্ট্রের জন্য একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড এবং একটি সুনিয়ন্ত্রিত সরকার আবশ্যক। পক্ষান্তরে সমাজ গঠনের জন্য এই উভয় উপাদানের কোনটিই আবশ্যিক বিবেচিত হয় না।

(৭) কেবল রাষ্ট্রেরই সার্বভৌম ক্ষমতা আছে: সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে গণ্য হয়। কিন্তু সমাজের ক্ষেত্রে সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় না। সার্বভৌম রাষ্ট্রের আইন-কানুন মেনে চলতে ব্যক্তি বাধ্য। রাষ্ট্রীয় আইন অমান্য করলে যে-কোন ধরনের শাস্তি ভোগ করতে হতে পারে। কিন্তু সামাজিক প্রথা ও রীতিনীতির ক্ষেত্রে এরকম বাধ্যবাধকতা নেই। সামাজিক নিয়ম-নীতি অমান্য করলে সামাজিক সমালোচনা বা ধিক্কার সহ্য করতে হয় মাত্র।

(৮) কাঠামো ও কার্যপদ্ধতির পরিপ্রেক্ষিতেও পার্থক্য বর্তমান। রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে এবং আইনের মাধ্যমে বল প্রয়োগের পন্থা গ্রহণ করে। অর্থাৎ রাষ্ট্র হল একটি পীড়নমূলক শক্তির আধার বিশেষ। উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য রাষ্ট্র পীড়নমূলক শক্তি প্রয়োগ করতে পারে। সমাজ কিন্তু স্বতঃ-প্রবৃত্ত সহযোগিতা ও শুভেচ্ছার পথে তার উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা করে। সমাজের গঠনকাঠামো এবং যাবতীয় কাজকর্ম সহযোগিতার উপর ভিত্তিশীল। স্বেচ্ছাধীন সংগঠনসমূহকে নিয়ে সমাজের সৃষ্টি হয়। সমাজ বলপ্রয়োগ করতে পারে না। পীড়নমূলক কোন শক্তি সমাজের হাতে নেই। বার্কার বলেছেন : Society use the method of voluntary action and the process of persuasion.” এ প্রসঙ্গে হবহাউস (L. T. Hobhouse) এর তও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর Social Evolution and Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন : “The social life is essentially of co-operation in the working out of common objectives…”.

ম্যাকাইভার ও ল্যাস্কির মত: এইভাবে উদ্দেশ্য, গঠন পদ্ধতি, ক্রিয়াকলাপ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে বৈসাদৃশ্য বর্তমান। এই কারণে ম্যাকাইভারের অভিমত হল যে, সমাজ ও রাষ্ট্রকে অভিন্ন মনে করলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়; রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায় না। ম্যাকাইভার (R. M. MacIver) বলেছেন: “To identify the social with the political is to be guilty of the grossest of all confusions, which completely bars any understanding of either Society or the State.” অধ্যাপক ল্যাস্কি (H. Laski)-র মতানুসারে সমাজজীবনের মূল সূত্রগুলি রাষ্ট্র নির্ধারণ করে বটে, কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজ এক ও অভিন্ন হতে পারে না। ল্যাস্কি বলেছেন: “The state may set the key-note of the social order, but it is not identical with it.”

সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক বর্তমান:

সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে উপরিউল্লিখিত পার্থক্যের অস্তিত্ব সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে গভীর সম্পর্কের উল্লেখ না করলে বিশেষ ভুল হবে। সমাজ এবং রাষ্ট্র অভিন্ন নয়। এ কথা ঠিক। কিন্তু উভয়ে আবার সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে অবস্থান করতেও পারে না। এ ক্ষেত্রে কতকগুলি বিষয় বিচার-বিবেচনা করা দরকার।

(ক) সমাজের অন্তর্ভুক্ত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থনীতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি সকল সংগঠনের অস্তিত্ব ও কার্যকলাপ বহুলাংশে রাষ্ট্রের ইচ্ছা ও নির্দেশের উপর নির্ভরশীল।

(খ) সমাজজীবনে মানুষের বহুমুখী ক্রিয়াকলাপ সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও নীতির বিরোধী হতে পারে না। বস্তুত সমাজজীবন সংগঠন ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে রাষ্ট্র এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। 

(গ) আবার রাষ্ট্রকেও সমাজজীবনের মৌলিক প্রথা, রীতিনীতি প্রভৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে চলতে হয়। সমাজজীবনের মূলনীতিগুলোকে উপেক্ষা করলে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। 

(ঘ) সমাজ এবং রাষ্ট্র উভয়েরই উদ্দেশ্য হল সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি করা এবং ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি বা আত্মবিকাশের পথ সুগম করা। উদ্দেশ্যগত এই মৌলিক সাদৃশ্যের জন্য উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বর্তমান। 

(ঙ) সামাজিক প্রথা, রীতি-নীতি, ধর্মীয় ও আর্থনীতিক উপাদান প্রভৃতি মানুষের রাজনীতিক জীবন ও কার্যকলাপকে প্রভাবিত করে।

(চ) মার্কসীয় দর্শন অনুসারে বলা হয় যে, সমাজপ্রকৃতি আর্থনীতিকব্যবস্থা বা উৎপাদন ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। এই সমাজপ্রকৃতি রাষ্ট্রপ্রকৃতির গঠনকে প্রভাবিত করে। এই কারণে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য সত্ত্বেও সমাজ-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতে পারে না।