মূল বক্তব্য: সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত ‘একত্ববাদ’ বা ‘পরম্পরাগত’ মতবাদ বলতে আইনসঙ্গত মতবাদকে বোঝায়। একত্ববাদের মূল কথা হল এই যে, সার্বভৌমিকতা চরম, অবাধ ও অসীম। সার্বভৌমিকতা এক ও অবিভাজ্য। এই মতবাদে সার্বভৌমিকতার কেন্দ্রীকরণ ও রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতার কথা বলা হয়। রাষ্ট্র তার এলাকার মধ্যে সকল ব্যক্তি ও ব্যক্তি-সংঘের উপর অপ্রতিহত ও চরম ক্ষমতা প্রয়োগ করে। রাষ্ট্র হল সার্বভৌম। রাষ্ট্রের আদেশই হল আইন। এই আইন অমান্য করলে রাষ্ট্র আইন অমান্যকারীর উপর আইনানুসারে বলপ্রয়োগ করতে পারে। একত্ববাদ অনুসারে রাষ্ট্র হল আইন প্রণয়নের সংগঠন। এ দিক থেকে একত্ববাদের মূল উদ্দেশ্য হল সামাজিক জীবনের উপর রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা এবং সামাজিক জীবনের সংহতি সাধনকারী হিসাবে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব কায়েম করা।

তত্ত্বগত একত্ববাদ: প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, রাষ্ট্র ও তার সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে একত্ববাদীদের বক্তব্যের মধ্যে কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এই পার্থক্যের ভিত্তিতে একত্ববাদকে তত্ত্বগত (abstract) ও বাস্তব (concrete)—এই দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। তত্ত্বগত একত্ববাদ (Abstract Monism) অনুযায়ী সার্বভৌমিকতা একমাত্র রাষ্ট্রের হাতেই কেন্দ্রীভূত থাকে। রাষ্ট্র হল এক ও অদ্বিতীয়। রাষ্ট্রের এলাকার মধ্যে অন্য কোন সংঘের অস্তিত্ব অস্বীকৃত। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের মতানুসারে রাষ্ট্রের ভূখণ্ডের ভিতরে অন্য কোন সংঘ থাকলে অনৈক্যের সৃষ্টি হবে। এই কারণে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের স্বার্থে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সকল প্রকার সংঘের অস্তিত্বের অবলুপ্তি বাঞ্ছনীয়।

বাস্তব একত্ববাদ: বাস্তব একত্ববাদে (Concrete Monism) কিন্তু রাষ্ট্রের ভিতরে বিভিন্ন ধরনের সংঘের অস্তিত্ব ও তাদের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এই সমস্ত সংঘের উপর রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বের অস্তিত্ব এবং তার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। একমাত্র রাষ্ট্রেরই সার্বভৌমিকতা আছে; অন্য কোন সংঘের নেই। রাষ্ট্রের এই সার্বভৌমিকতা হল অভিন্ন, অবিভাজ্য ও চরম। সেইজন্য রাষ্ট্র তার এলাকার ভিতরে চরম ও অপ্রতিহত কর্তৃত্বসম্পন্ন। রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে সকল ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংঘ তার সিদ্ধান্ত মেনে চলতে বাধ্য থাকে।

ল্যাস্কির বিশ্লেষণ: ল্যাস্কি (H. Laski) সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী বক্তব্যের সার কথা স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতানুসারে আধুনিক রাষ্ট্র মাত্রেই সার্বভৌম। তাই সকল লোকসমাজ থেকে রাষ্ট্র হল স্বাধীন। রাষ্ট্রের ইচ্ছা হল সকল ইচ্ছার ঊর্ধ্বে। রাষ্ট্রের ইচ্ছার উপর কোন রকম সীমাবদ্ধতা নেই। রাষ্ট্র আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সকলের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারে। সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের তিনটি দিকের প্রতি ল্যাস্কি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ল্যাস্কির মতানুসারে একত্ববাদের তিনটি দিক হলঃ 

  • (ক) সুদীর্ঘ বিবর্তনের মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্র বর্তমানে সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে। 

  • (২) সার্বভৌম শক্তির প্রকাশই হল আইন। এই আইন কেউ লঙ্ঘন করতে পারে না। 

  • (৩) সকল সমস্যার সমাধান বা যাবতীয় বিরোধের মীমাংসার জন্য সকল সামাজিক ব্যবস্থাতেই থাকবে মাত্র একটি কেন্দ্র।

বদ্যা: একত্ববাদের প্রধান প্রবক্তা হিসাবে বদ্যা, হস, বেন্থাম এবং অস্টিনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ফরাসী চিন্তানায়ক বদ্যা তাঁর Six Books on the Republic গ্রন্থে সার্বভৌমিকতার প্রকৃতি সম্পর্কে পর্যালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন: ‘সার্বভৌমিকতা হল নাগরিক ও জনগণের উপর প্রযুক্ত আইনের দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত চূড়ান্ত ক্ষমতা” (“Sovereignty is supreme power over citizens and subjects, unrestrained by law.)। অর্থাৎ সার্বভৌমিকতা হল আইনের দ্বারা অনিয়ন্ত্রিত এবং চরম ও চিরস্থায়ী। আইনের উৎস হিসাবে তিনি সার্বভৌম কর্তৃত্বের কথা বলেছেন। ষোড়শ শতাব্দীর দার্শনিক বদ্যা পোপের বিরুদ্ধে রাজার কর্তৃত্বকে সমর্থন করেছেন। যাজক শক্তি ও রাজ-শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বে বদ্যা রাজশক্তিকেই সমর্থন করেছেন এবং রাজাকেই চরম ক্ষমতাবান বলে ঘোষণা করেছেন। এই পথে বদ্যা একটি দীর্ঘকালীন সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন। বস্তুত রাষ্ট্রের ভিতরে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বদ্যা চরম সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব বা একত্ববাদ প্রচার করেছেন। বদ্যা বিশ্বাস করতেন যে রাষ্ট্রকে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বিবাদের হাত থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে সার্বভৌমিকতার একত্ববাদ সক্ষম হবে। এই রকম অবস্থায় তিনি রাষ্ট্রের বদলে রাজাকেই সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন বলে ঘোষণা করেছেন। এ হল বদ্যার এক মস্ত বড় সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি। আইনকে তিনি বলেছেন ‘শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির নির্দেশ।

হবস: সপ্তদশ শতাব্দীর বিখ্যাত ইংরাজ দার্শনিক টমাস হবস ১৬৫১ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লেভিয়াথান’ (Leviathan)-এ তাঁর সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত ধারণা ব্যক্ত করেছেন। হব্স চুক্তিবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিত। হবুস ছিলেন ইংল্যাণ্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের গৃহশিক্ষক। হস তৎকালীন ভীত ও ত্রস্ত রাজতন্ত্রকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে তাঁর চুক্তিবাদ ও সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত তত্ত্ব প্রচার করেছেন। হবসের মতানুসারে প্রাকৃতিক পরিবেশের দুর্বিষহ ও ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্য মানুষ চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। চুক্তি হয়েছিল সকলের সঙ্গে প্রত্যেকের বা প্রত্যেকের সঙ্গে সকলের। এই পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে আদিম মানুষ সকলে নিজেদের সমস্ত ক্ষমতা কোন বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তি-সংসদের হাতে নিঃশর্ত এবং চূড়ান্তভাবে সমর্পণ করল। এইভাবে সমস্ত ক্ষমতা সমর্পণ করায় এক সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন কর্তৃপক্ষের সৃষ্টি হল। এরূপ নিঃশর্তভাবে প্রাপ্ত চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তি বা ব্যক্তি-সংসদ হল সার্বভৌম। প্রাকৃতিক পরিবেশের আদিম মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে সকল ক্ষমতা রাজার হাতে তুলে দিয়েছে। রাজা চুক্তির কোন পক্ষ নন। তিনি চুক্তির ঊর্ধ্বে। সুতরাং চুক্তির কোন শর্ত পালনে রাজার কোন দায় নেই। রাজা সর্বশক্তিমান এবং অবাধ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি সার্বভৌম। তাঁর আদেশই হল আইন। প্রজাসাধারণ অবাধ স্বাধীনতার অধিকারী নয়। সার্বভৌমের আইনের দ্বারা তাদের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ। চুক্তির বন্ধন মানুষের উপর অনন্তকালব্যাপী বজায় থাকবে। রাজার বিরুদ্ধে প্রজাদের বিদ্রোহ করার অধিকার নেই। রাজার ক্ষমতাকে অস্বীকার করলে মানুষকে পুনরায় প্রাকৃতিক অবস্থার অনিশ্চয়তার মধ্যে ফিরে যেতে হবে। স্যাবাইন মন্তব্য করেছেন: “For Hobbes there is no choice except between absolute power and complete anarchy, between an omnipotent sovereign and no society whatever.” হবসের মতানুসারে সার্বভৌম শক্তির অধিকারী রাজাই প্রজাদের স্বাধীনতার স্রষ্টা ও রক্ষক। এইভাবে বদ্যার মত হস আইনগত সার্বভৌমিকতার তত্ত্ব প্রচার করেছেন।

বেন্থাম: হিতবাদী দার্শনিক বেছামও সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে একত্ববাদী বক্তব্য ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে রাষ্ট্র সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন। রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা চরম, চূড়ান্ত ও অসীম। এই কারণে রাষ্ট্রের কোন কাজই বে-আইনী নয়। আইনকে তিনি সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী বলে স্বীকার করেন। তবে এই সার্বভৌম কর্তৃত্বের পিছনে জনসাধারণের স্বাভাবিক আনুগত্য থাকা দরকার। এ কথাও তিনি স্বীকার করেছেন যে, কেবল প্রজারাই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্রকে বাধা দিতে পারে। তবে বেহাম সার্বভৌম শক্তির উপর প্রাকৃতিক আইন বা প্রাকৃতিক অধিকারের কোন নিয়ন্ত্রণকে স্বীকার করেননি।

একত্ববাদের আইনগত দিক: আইন হল সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আইন হল সার্বভৌম শক্তির নির্দেশ। এবং এই কারণে আইন হল অলঙ্ঘনীয়। প্রকৃত প্রস্তাবে আইন হল সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের মূল ভিত্তি। সার্বভৌমের নির্দেশ আইনকে জনসাধারণ কিভাবে দেখে তার পরিপ্রেক্ষিতে সার্বভৌমিকতার আসল রূপ অনুধাবন করা যায়। জনগণ যদি আইন অমান্য করে তা হলে সার্বভৌম শক্তির চরমতা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হবে এবং সার্বভৌমিকতার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। এই কারণে অস্টিন সার্বভৌমের আদেশ আইনকে অলঙ্ঘনীয় করেছেন এবং সার্বভৌমত্বকে সকলের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বস্তুত সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের আইনানুগ দিকটি অস্টিনের ব্যাখ্যায় সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে অস্টিনের একত্ববাদ সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে যুক্তিগ্রাহ্য। তিনি তাঁর A Grammar of Politics গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Within the narrow field that it covers, the Austinian view is correct analysis of what flows from certain deffinite assumptions.”

রাজনীতিক সংগঠন ও সার্বভৌমিকতা: সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের আর একটি দিক উল্লেখ করা দরকার। এই তত্ত্বে রাষ্ট্রকে একটি রাজনীতিক সংগঠন হিসাবে গণ্য করা হয়। এই রাজনীতিক সংগঠনের কেন্দ্রে সার্বভৌম শক্তি বর্তমান। এই শক্তির নির্দেশ মান্য করে চলা বাধ্যতামূলক। রাষ্ট্র হল সর্বোচ্চ রাজনীতিক সংগঠন বা সমিতি। একত্ববাদী তত্ত্বে অন্য কোন সমান্তরাল সংগঠনকে স্বীকার করা হয়নি। কারণ রাষ্ট্রের সমান্তরাল সংগঠনের অস্তিত্ব স্বীকৃত হলে রাষ্ট্রের চরমতা ক্ষুণ্ন হবে। রাষ্ট্র এই রাজনীতিক সংগঠনের সমান্তরাল অন্য সংগঠন গড়ে তুললে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা খণ্ডিত হবে। কিন্তু সার্বভৌমিকতা হল এক ও অখণ্ড। তা না হলে সার্বভৌমিকতা অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। সার্বভৌম শক্তি একটি মাত্র কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত থাকবে। রাজনীতিক সংগঠনের আইনসম্মত এক্তিয়ারের মধ্যে এই শক্তি যাবতীয় বিরোধের নিষ্পত্তি করবে।

একত্ববাদের সমালোচনা

ল্যাস্কির যুক্তি: ল্যাস্কি সার্বভৌমিকতার একত্ববাদের এক কঠোর সমালোচক হিসাবে পরিচিত। তিনি একত্ববাদী ধারণাকে বর্জন করার পক্ষপাতী ছিলেন। ল্যাস্কি একত্ববাদী তত্ত্বের তীব্র সমালোচনা করেছেন। বিভিন্ন দিক থেকে তিনি একত্ববাদের অসারতা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। 

(১) একত্ববাদ অনুসারে রাষ্ট্র হল সর্বশক্তিমান। এই তত্ত্বে সমাজ ও সমিতির অস্তিত্ব ও অবদানকে অস্বীকার করা হয়। অথচ ব্যক্তি ও সমাজের অস্তিত্ব এবং ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে সমাজ ও সমিতির সহায়ক ভূমিকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। 

(২) রাষ্ট্রের চরম সার্বভৌমিকতার ধারণা হল এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক বিবর্তনের ফল। অনুরূপভাবে ইতিহাসের ধারাতেই চরম সার্বভৌমিকতার উপর সীমাবদ্ধতার ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। মানবজাতির ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ রাজশক্তি বা সার্বভৌম শক্তিকে সীমাবদ্ধ করার আন্দোলনের সামিল হয়েছে। এই উদ্দেশ্যে বহু গণ-আন্দোলন, গৃহযুদ্ধ, বিপ্লব-বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে। 

(৩) ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে সার্বভৌমিকতার একত্ববাদী তত্ত্বের বিরুদ্ধে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। চরম সার্বভৌমিকতার ধারণা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খায় না। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সার্বভৌমিকতার একত্ববাদ অচল। 

(৪) আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল ক্ষমতার বিভাজন। অথচ একত্ববাদে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের কথা বলা হয়। তা ছাড়া বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতির ভিত্তিতে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কার্যাবলী পরিচালিত হয়ে থাকে। শাসন-বিভাগ, আইন-বিভাগ ও বিচার বিভাগ সরকারের এই তিনটি বিভাগের কোনটিই চরম ক্ষমতার অধিকারী নয়। 

(৫) সার্বভৌম রাষ্ট্রের ইচ্ছা চরম ও অসীম এবং অন্য সকল ইচ্ছার ঊর্ধ্বে— ল্যাস্কি এ কথা স্বীকার করেননি। তাঁর মতানুসারে জনগণ রাষ্ট্রের ইচ্ছাকে যাচাই করে নেবে। নিজেদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তি রাষ্ট্রের ইচ্ছাকে গ্রহণ করা বা না করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। 

(৬) নাগরিকের অধিকার রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতাকে সীমায়িত করে। নাগরিকের অধিকার ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাষ্ট্র তার ইচ্ছামত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা কাজ করতে পারে না। নাগরিকের অধিকারের অর্থ হল নাগরিকের চাহিদা বা দাবি। দায়িত্বশীল রাষ্ট্রমাত্রেই এই দাবি পূরণ করতে বাধ্য। 

(৭) একত্ববাদে রাষ্ট্রকে একমাত্র রাজনীতি সংগঠন হিসাবে স্বীকার করা হয়েছে। অন্য কোন সমান্তরাল সংগঠনের কথা স্বীকার করা হয়নি। কিন্তু ব্যক্তির কাছে সামাজিক সংঘ-সমিতিগুলিও অপরিহার্য। ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

(৮) আন্তর্জাতিক সমাজের দিক থেকেও ল্যাস্কি একত্ববাদী ধারণার বিরূপ সমালোচনা করেছেন। আন্তর্জাতিক সমাজে অভিন্ন ইচ্ছাই হল গুরুত্বপূর্ণ এবং এই ইচ্ছাই কার্যকরী হয়। এ ক্ষেত্রে কোন রাষ্ট্রের একক ইচ্ছাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না। বস্তুত আন্তর্জাতিক সমাজে সকলকে চলতে হয় অভিন্ন ইচ্ছার অনুকূলে।