বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রতিকূল প্রভাব রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণার উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। বিষয়টি বিশ্বায়ন বনাম রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী এক নতুন ধরনের আর্থনীতিক ও রাজনীতিক কাঠামো গড়ে উঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণা সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।
বিশ্বায়নের আর্থনীতিক ব্যাখ্যা: বিশ্বায়নের আর্থনীতিক ব্যাখ্যা হিসাবে বেশ কিছু সংস্কারমূলক বিধিব্যবস্থাকে বোঝায়। এই সমস্ত বিধি-ব্যবস্থার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: আমদানির ক্ষেত্রে উদারিকরণ নীতি, বিনিময় হারের সামঞ্জস্য সাধন, আর্থনীতিক ক্ষেত্রে বহুজাতিক সংস্থাসমূহের প্রবেশ পথকে উন্মুক্ত করা, বিদেশী সহযোগিতায় শিল্প গড়ে তোলা প্রভৃতি। আর্থনীতিক বিচারে বিশ্বায়ন হল বিশ্ব আর্থনীতিক ব্যবস্থার সঙ্গে কোন দেশের আর্থনীতিক সংযোগ সাধন। বিশ্বায়ন মুক্ত অর্থনীতির দ্যোতক। এ হল একটি দেশের আর্থনীতিক বিষয়াদির উপর আরোপিত নিয়ন্ত্রণমূলক বিধি-ব্যবস্থাগুলিকে অপসারিত করা এবং দেশীয় অর্থনীতিকে বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া। বিশ্বায়নের ফলে সমগ্র বিশ্বই হল একটি বাজার। দেশীয় বাজারগুলি এ বিশ্ববাজারেই অঙ্গীভূত।
স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়: এই বিশ্ববাজারে বৃহৎ শক্তিসমূহের মদতপুষ্ট বহুজাতিক সংস্থাসমূহের একচ্ছত্র আধিপত্য সুনিশ্চিতভাবে কায়েম হবে। ক্ষুদ্রাকৃতির, অনুন্নত এবং দরিদ্র-দুর্বল দেশগুলির শিল্প বাণিজ্য বিশ্বের বাজারে বহুজাতিক সংস্থাসমূহের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারবে না; অবধারিতভাবে অচিরেই অন্তর্হিত হয়ে যাবে। বিশ্বব্যাপী বৃহৎ আর্থনীতিক শক্তিসমূহের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে। এ ধরনের নয়া ঔপনিবেশিকতাবাদী কার্যকলাপের পরিণামে জাতি-রাষ্ট্রসমূহের আর্থনীতিক স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়বে। সমগ্র বিশ্বের শিল্প-বাণিজ্য, উৎপাদন ব্যবস্থা, বিক্রয়বাজার গুটিকয়েক বৃহৎ আর্থনীতিক শক্তির হাতের মুঠোয় এসে যাবে। জাতি রাষ্ট্রসমূহের শ্রম, মূলধন প্রভৃতি আর্থনীতিক উপাদানসমূহের চলাচল নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হবে বাজারী শক্তিসমূহের অনিয়ন্ত্রিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে। এই অবস্থায় আর্থনীতিক ক্ষেত্রে জাতি-রাষ্ট্রসমূহের স্বাধীনতা-সার্বভৌমিকতা বিপন্ন হয়ে পড়ে।
বিশ্বায়নের সাংস্কৃতিক ফলাফল: বিশ্বায়নের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া আর্থনীতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনীতিক প্রভৃতি জনজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সাংস্কৃতিক ফলাফলও গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। সংস্কৃতি বলতে সমগ্র জীবনধারাকে বোঝায়। বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কৃতি কথাটির অর্থ হল যে, বিশ্বব্যাপী এক সাধারণ সংস্কৃতি বা জীবনধারার সৃষ্টি হয়েছে। এই সাধারণ জীবনধারার মধ্যে সামাজিক, অর্থনীতিক, রাজনীতিক বিষয়াদির সঙ্গে সঙ্গে ভোগ, বিনোদন প্রভৃতি বিষয়াদিও বর্তমান। বস্তুত আর্থনীতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারের বিকাশ ও বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রত্যক্ষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বের আর্থিক বাজারের প্রধান অংশগ্রহণকারীরা ব্যবসা বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে জীবনধারাগত মূল্যবোধ, রীতিনীতি, আচার-আচরণ, খাদ্যাভাস, পোষাক-পরিচ্ছদ, আমোদ-প্রমোদ, বিলাস-ব্যসন প্রভৃতি জনজীবনের বিভিন্ন বিষয়ের অংশীদার হয়ে পড়ে।
বিশ্বায়নের রাজনীতিক প্রভাব: রাজনীতিক ক্ষেত্রেও বিশ্বায়নের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার কারণে বর্তমানে জাতি-রাষ্ট্রসমূহের প্রভাব-প্রতিপত্তির অবক্ষয় ঘটেছে। সাম্প্রতিককালে জনজীবনের কোন কোন সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে জাতি-রাষ্ট্রসমূহের সীমাবদ্ধতা ও ক্ষুদ্রত্ব প্রবলভাবে প্রকট হয়ে পড়ে। এ রকম ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী কোন সাধারণ প্রকৃতির বৃহৎ স্যার সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য বিশ্বজনীন একটি সত্তার প্রয়োজনীয়তা বা অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। বিশ্বের এই সাধারণ সত্তার কাছে জাতি রাষ্ট্রগুলিকে তাদের সার্বভৌমত্বের অংশবিশেষকে সমর্পণ করতে হয়। এইভাবে বিশ্ব রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান সমূহের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। এবং এই পথে এক অতি জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা বিকশিত হচ্ছে।
ডেভিড হেলড-য়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্ব-ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সার্বভৌমিকতা: ডেভিড হেল্ড (David Held) তাঁর Political Theory and the Modern State শীর্ষক গ্রন্থে বিশ্ব-ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সার্বভৌমিকতার বিষয়টি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। হেল্ডের অভিমত অনুযায়ী সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রকর্ণধাররা প্রায়শই মন্তব্য করেন যে, জাতি-রাষ্ট্রের স্বার্থ বহু ও বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। জাতি-রাষ্ট্রের ভাগ্য এই সমস্ত বিষয়াদির দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। এই সমস্ত উপাদানের অনেকগুলিই রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণের অতীত। জাতি-রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে সমস্ত বিকল্পকে হাতের কাছে পায় তার অনেকগুলিই আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা সীমাবদ্ধ। তারফলে জাতীয় নীতি নির্ধারণ ও অনুসরণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের খুব বেশী স্বাধীনতা থাকে না। অধ্যাপক হেল্ড এ বিষয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে আইনানুগ (dejure) এবং বাস্তব (de facto) বা সাবভৌমিকতা ও স্বায়ত্তশাসনের মধ্যে পার্থক্যের কথা বলেছেন। আইনানুগ সার্বভৌমিকতার হানি জনিত সমস্যাদি এবং রাজনীতিক ও আর্থনীতিক স্বায়ত্তশাসনের হানি সম্ভৃত সমস্যাদির মধ্যে পার্থক্য প্রতিপন্ন করার জন্য এই স্বাতন্ত্র্যমূলক আলোচনা আবশ্যক।
কুপার (R.N. Cooper) তাঁর Economic Policy in an Independent World শীর্ষক গ্রন্থে এই অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, নীতি নির্ধারণমূলক সার্বভৌমিকতার উপাদানসমূহের উপর জাতি-রাষ্ট্রসমূহের আইনানুগ ও বাস্তব নিয়ন্ত্রণ বহাল থাকে। এতদসত্ত্বেও সমস্যার সৃষ্টি হয় কারণ সার্বভৌমিকতার সংশ্লিষ্ট উপাদান বা হাতিয়ারসমূহের কার্যকারিতা বা ফলপ্রদ ক্ষমতা থাকে না। এই অবস্থায় জাতি-রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের উদ্দেশ্য অনুসারে নীতি নির্ধারণ ও অনুসরণ করতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্য সাধনে বা সাফল্য লাভে সমর্থ হয় না। হেল্ড বলেছেন: “…it may be what underpins politicians anxiety about a loss of control’ is not a diminution of legal and actual control over the process of determining policy directions, but rather a diminution of their capacity to achieve these policies once they have been set.”
হেল্ড বিংশ শতাব্দীর বিশ্ব-ব্যবস্থার প্রকৃতি এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাজনীতিক মতবাদের মধ্যে মৌলিক কিছু ব্যবধানের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাজনীতিক মতবাদের ব্যাখ্যামূলক পরিধি ও বিচার্য বিষয়ের সঙ্গে বাস্তবে রাষ্ট্রের কাঠামো ও প্রায়োগিক দিক এবং আন্তর্জাতিক স্তরের আর্থনীতিক ব্যবস্থার তারতম্য আলোচ্য ব্যবধানসমূহের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। অধ্যাপক হেল্ড এ রকম পাঁচটি ব্যবধান সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
ব্যবধান এক : বিশ্ব অর্থনীতি: বর্তমানে অধিকাংশ দেশের বিনিয়োগ, নিয়োগ ও রাজস্ব ব্যবস্থার গতি-প্রকৃতি প্রভাবিত হচ্ছে বহুজাতিক সংস্থাসমূহের (Multi-National Corporation) সিদ্ধান্তের দ্বারা। বিশ্ব বাজার ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতি জাতি-রাষ্ট্রসমূহের বাণিজ্যিক ও আর্থিক নীতিকে প্রভাবিত করছে। স্বভাবতই জাতীয় আর্থিক কর্মসূচীর নিয়ন্ত্রণ হীনবল হয়ে পড়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রতিবন্ধকতার কারণে স্বয়ংক্রিয় জাতীয় অর্থনীতি অবলম্বন ও অনুসরণ কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিককালে ক্রমবর্ধমানভাবে বিভিন্ন পথে আর্থনীতিক প্রক্রিয়ার আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটেছে। এই বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় শক্তি হিসাবে সক্রিয় হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, মূলধন এবং বিভিন্ন বিষয়ে আর্থনীতিক সহযোগিতা। এর সঙ্গে নতুন প্রযুক্তি আর্থনীতিক এককসমূহের সচলতাকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে এবং বিভিন্ন বাজার ও সমাজের পারস্পরিক প্রতিক্রিয়াশীলতাকে বৃদ্ধি করেছে। যোগাযোগ ও পরিবহনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাজারের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যের সীমারেখাকে অনেকাংশে অস্পষ্ট করে দিয়েছে। অথচ বিভিন্ন বাজারের মধ্যে সীমারেখার এই স্বাতন্ত্র্য স্বশাসনিক জাতীয় নীতির জন্য অপরিহার্য শর্ত হিসাবে বিবেচিত হয়। স্বভাবতই জাতীয় আর্থিক নীতির সম্ভাবনাও হ্রাস পাচ্ছে। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের উপর নানা রকম চাপ, সত্তরের ও আশির দশকে ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহের সরকারী নীতির উপর মুদ্রাস্ফীতি ও অনগ্রসরতার আর্থিক চাপ, বিশ্ব অর্থনীতির পরিধিতে শিল্প পুঁজির প্রভাব বিস্তার প্রভৃতি বিষয় বিশ্ব-ব্যবস্থা ও জাতি রাষ্ট্রের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান সৃষ্টি করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে রাজনীতিক কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্র এবং উৎপাদন, বণ্টন ও বিনিময়ের প্রকৃত অর্থনীতিক ব্যবস্থার মধ্যে ব্যবধান বর্তমান। এই ব্যবধান জাতীয় রাজনীতিক কর্তৃপক্ষসমূহের প্রকৃত ক্ষমতা ও সুযোগের উপর সীমাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। হেল্ড বলেছেন: “There is a gap between the formal domain of political authority and the actual economic system of production, distribution and exchange which in many ways serves to limit or undermined the actual power or scope of national political authorities.”
তবে জাতীয় আর্থনীতিক কর্মসূচীর উপর নিয়ন্ত্রণহীনতার বিষয়টি সাধারণভাবে সকল দেশের আর্থনীতিক ব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে সমভাবে সত্য নয়। কিছু দেশ তার বাজার ও আর্থনীতিকে পরিবর্তনশীল আর্থনীতিক পরিকাঠামোর থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারে। এবং এই বিচ্ছিন্নকরণের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশ বিভিন্ন উপায়-পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, দেশীয় বাজারের স্বাতন্ত্র্য বা সীমানা সংরক্ষণ; আন্তর্জাতিকভাবে সঞ্চরণশীল উপাদানসমূহের ব্যাপারে জাতীয় আইনের পরিধিকে প্রসারিত করা; নীতিগত ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমবায়িক নীতি গ্রহণ করা প্রভৃতি। পরিশেষে অধ্যাপক হেল্ডের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “At the very least, there appears to be a deminution of state autonomy, and a disjuncture between the premises of the theory of the sovereign state and the conditions of modern economics.”
ব্যবধান দুই : কৰ্তৃত্বমূলক শক্তিসমূহ ও শক্তি-জোটসমূহ: আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন শক্তি-জোট বর্তমান। উদাহরণ হিসাবে ন্যাটো (NATO-North Atlantic Treaty Organization), ওয়ারশ চুক্তি (Warsaw Pact) প্রভৃতির কথা বলা যায়। তা ছাড়া আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মত শক্তিধর রাষ্ট্র। তারফলে জাতি-রাষ্ট্রসমূহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল হতে পারে না। বিভিন্ন শক্তি-জোট ও পরাক্রমশালী রাষ্ট্রসমূহের প্রতিপত্তির কারণে রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিষয়ক ও সামরিক ক্ষমতার উপর বাধার সৃষ্টি হয়। ন্যাটো (NATO) হল পুঁজিবাদী ও বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের এক সামরিক জোট। এই সামরিক জোট নিরাপত্তা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের সৃষ্টি করেছে। তারফলে রাষ্ট্রসমূহের রাজনীতিক সার্বভৌমিকতার উপর প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সদস্য রাষ্ট্রসমূহের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও ন্যাটোর প্রভাব-প্রতিপত্তি অনস্বীকার্য। এই সামরিক জোটের প্রাধান্যকে উপেক্ষা করার মত দুঃসাহস সদস্য রাষ্ট্রগুলি দেখাতে পারে না। কারণ এ রকম বিরুদ্ধাচরণের প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার মোকাবিলা করার মত শক্তি-সামর্থ্য সদস্য রাষ্ট্রসমূহের নেই। হেল্ড বলেছেন: “…..there is a gap between the idea of the state as an autonomous strategic, military actor and the development of the global system of states, character ized by the existence of hegemonic powers and power blocs, which sometimes operate to undercut a states’s authority and integrity.’ তিনি আর বলেছেন: “Membership of NATO does not eliminate sovereignty; rather, for each state, in different ways, membership…qualifies sovereignty.’ Aspects of sovereignty are negotiated and renegotiated in the NATO aliance.”
ব্যবধান তিন : আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহ: আধুনিককালে আন্তর্জতিক সংগঠনসমূহের কর্মক্ষেত্র ও কর্তৃত্বের পরিধি ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে জাতি-রাষ্ট্রসমূহের এলাকা-এক্তিয়ার সংকুচিত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (IMF— International Monetary Fund)-এর কথা বলা যায়। এই আন্তর্জাতিক সংগঠনটি বিশেষ ধরনের আর্থিক নীতি অনুসরণ করে। কোন দেশের সরকারকে ঋণপ্রদানের ক্ষেত্রে পূর্বশর্ত হিসাবে আই. এম. এফ. সরকারী ব্যয় হ্রাস; দেশীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন; ভরতুকী ভিত্তিক জনকল্যাণমূলক কর্মসূচী ছাঁটাই প্রভৃতি কার্যকর করার ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করে। এরকম নতুন ধরনের রাজনীতিক ও আর্থনীতিক সংস্থাসমূহের উদ্ভব ও বিকাশের মাধ্যমে অতিজাতীয় সংযোগ-সম্পর্ককেই সূচীত করে। আন্তর্জাতিক ও অতিজাতিক সংগঠনসমূহের বিকাশ ও বিস্তারের ফলে বিশ্ব-রাজনীতির সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাঠামোতে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। নতুন ধরনের বহুজাতিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। বহুজাতিক রাজনীতির সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে নতুন ধরনের সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে জাতি রাষ্ট্রসমূহ, আস্ত-সরকারী সংগঠনসমূহ এবং বিভিন্ন ধরনের অতিজাতিক চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠীসমূহ। হেল্ড বলেছেন: “A third major area of disjuncture between the political theory of the sovereign state and the contemporary global system lies in the vast array of international regimes and organizations have been established to manage whole areas of transnational activity.”
এ প্রসঙ্গে ‘ইউরোপীয় রাষ্ট্র সংস্থা’ (EC— European Community)-র ভূমিকার কথা বলা দরকার। এই সংস্থা সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সম্পদ বণ্টন ব্যবস্থা, বাজারের অংশ প্রভৃতি অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। সদস্য রাষ্ট্রসমূহের উপর বিবিধ ক্ষেত্রে সীমা নির্ধারণের ব্যাপারে এই সংস্থা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে এবং আদেশ-নির্দেশ জারি করতে পারে। এ প্রসঙ্গে যে সমস্ত আইন আছে তা অভিনব প্রকৃতির। হেল্ড মন্তব্য করেছেন: “However, within the Community sovereignty is now also clearly divided: any conception of sovereignty which assumes that it is an indivisible, illimitable, exclusive and perpetual form of public power is defunct.”
ব্যবধান চার : আন্তর্জাতিক আইন: আন্তর্জাতিক আইন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রসমূহের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে নির্দেশ আছে। আন্তর্জাত্তিক আইনের এই সমস্ত নির্দেশ জাতি-রাষ্ট্রসমূহের এক্তিয়ার ও দাবিকে ছাড়িয়ে যায়। বস্তুত সদস্য রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। জাতি-রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের নাগরিকদের সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। রাষ্ট্রের আইন ও সার্বভৌমিকতা আন্তর্জাতিক সামরিক শৃঙ্খলার দ্বারা বহুলাংশে হীনবল হয়ে পড়েছে বা অবলুপ্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল (Nuremberg Tribunal)-এর ব্যবস্থা অনুযায়ী মানবিক মূল্যবোধ সংরক্ষণের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় আইনের অসামঞ্জস্য বা বিরোধিতার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে। হেল্ড বলেছেন: “There is a fourth significant gap to note-a gap between the idea of membership of a national political community, that is, citizenship, which bestows upon individuals both rights and duties, and the development of international law, which subjects indi viduals, governments and non-governmental organization to new system of regulation.”
ব্যবধান পাঁচ : আভ্যন্তরীণ নীতির লক্ষ্য: নীতিগতভাবে জাতি-রাষ্ট্রসমূহ হল আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সরকারী নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে তার নাগরিকদের প্রতিনিধি। তা ছাড়া বহির্বিশ্বে তার নাগরিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারেও রাষ্ট্র নীতিগতভাবে দায়বদ্ধ। জাতি-রাষ্ট্রসমূহের এই সমস্ত দিকের সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতিক ব্যবস্থার ব্যবধান বর্তমান। বিশ্বরাজনীতিক ব্যবস্থা স্বরাষ্ট্র নীতি ও পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে পার্থক্যকে ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলছে। হেল্ড মন্তব্য করেছেন: “Finally there is a gap between states as in principle representative of their citizens in the determination of public policy at home and in the protection of their interests overseas, and the global political system which makes the distinction between domestic and foreign policy harder and harder to sustain.” উপরিউক্ত বক্তব্যের সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত সমগ্র ক্ষেত্র জুড়ে। সাধারণ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার থেকে ন্যাটোর মত জোট সংগঠনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অধিক মনোগ্রাহী। জাতি-রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা রাজনীতিক ব্যবস্থা আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে স্থায়িত্ব সংরক্ষণের ব্যাপারে নিরাপদ পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি। জাতি-রাষ্ট্রের ভূমিকা সর্বক্ষেত্রে সর্বাংশে সন্তোষজনক নয়। এই সমস্ত ক্ষেত্রের মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, বিনিয়োগ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। আবার অনেক ক্ষেত্রেই জাতি-রাষ্ট্র জাতীয় স্বার্থের অজুহাতে বিতর্কিত বিভিন্ন জাতীয় সমস্যাকে আন্তর্জাতিক স্তরের আলোচনার বাইরে রাখতে চেষ্টা করে।
আধুনিককালে সার্বভৌমিকতার ধারণা: আধুনিককালে তাত্ত্বিক আলোচনায় সার্বভৌম রাষ্ট্র বলতে জাতীয় জনসম্প্রদায়ের ধারণাকে বোঝায়। এই জনসম্প্রদায় সঠিক ভাবেই নিজেদের শাসন করে এবং নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করে। সার্বভৌমিকতার এই ধারণা বর্তমানের বিশ্বজনীন সংযোগ-সম্পর্কের কাঠামো বা প্রকৃতির দ্বারা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। তাছাড়া আজকাল রাষ্ট্রকে বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়াদির মোকাবিলা করতে হয়। এই সমস্ত বিষয়ও সার্বভৌমিকতার ধারণাকে সংকটের সম্মুখীন করে। সাম্প্রতিককালে সার্বভৌমিকতার ধারণার উপর বিশ্বায়নের প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। হেল্ড মন্তব্য করেছেন: “There is little doubt that there has been in recent times a further ‘multinationalization of previously domestic activities and an intensification of the ‘intermeshing of decision making in multinational frameworks’. The evidence that transitional relations have eroded the powers of the modern sovereign state is certainly strong…some observers have concluded that sovereignty is fundamentally weakened…a national system of accountability and control risks obsolescence in the face of international forces and relations.”
তবে এই প্রতিকূল প্রভাব সকল রাষ্ট্রের উপর সমভাবে পড়েনি। শক্তিধর ও উন্নত রাষ্ট্রসমূহের উপর এই প্রভাব বড় একটা অনুভূত হয় না। অনগ্রসর ও উন্নয়নশীল দেশগুলি বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রতিকূল প্রভাবে পর্যুদস্ত বা পর্যুদস্ত হওয়ার আশঙ্কায় আতঙ্কিত। তবে আশাবাদী চিন্তাবিদদের অভিমত হল আগামী দিনের আন্তর্জাতিক সমাজে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা ও আন্তর্জাতিকতার মধ্যে ভারসাম্যের সৃষ্টি হবে। জাতীয় জনমত ও বিশ্বজনমতের চাপে তা সম্ভব হবে।
প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার রাজনীতিক তত্ত্ব এবং বিংশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধের রাজনীতিক বিশ্বের উপরিউক্ত ব্যবধানের কারণে কিছু নবজাত শক্তির আবির্ভাব ঘটে। এই শক্তিসমূহ সম্মিলিতভাবে এমন কিছু কাজ করে যার ফলশ্রুতি হিসাবে জাতি-রাষ্ট্রসমূহের এবং তাদের সরকারসমূহের কাজকর্মের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়। সংশ্লিষ্ট নবজাত শক্তিসমূহের সম্মিলিত সক্রিয়তার ফলে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার ধারণার বিরুদ্ধে যে সমস্ত ঘটনা ঘটে তারমধ্যে কতকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগুলি হল: রাজনীতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের অবস্থাগত বা পরিস্থিতিগত পরিবর্তন ঘটে; আভ্যন্তরীণ রাজনীতির সীমানা অস্পষ্ট হয়ে যায়; সরকারসমূহের আইনগত কাঠামো ও প্রশাসনিক কার্যধারার পরিবর্তন ঘটে; জাতীয় রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক পটভূমি বা প্রাসঙ্গিকতার পরিবর্তন ঘটে; এবং জাতীয় রাষ্ট্রসমূহের দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বশীলতার ধারাকে অস্বচ্ছ করে দেয়।
অপরপক্ষে আর একটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রসমূহকে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বিবাদ-বিসংবাদের ক্ষেত্রে বিষয়টিকে ঊর্ধ্বতন কোন কর্তৃপক্ষের দ্বারা সালিশীর ব্যাপারে বড় একটা আগ্রহী দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ, আন্তর্জাতিক আদালত ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে বোঝায়। এই অনাগ্রহের কারণ হিসাবে অনেকে চিহ্নিত করেন যুদ্ধের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে রাষ্ট্রসমূহের অধিকার সংরক্ষণের আগ্রহ।
আজকের দুনিয়া হল আন্তর্জাতিক রাজনীতিক অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক আইন, পরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহ, সামরিক জোটসমূহ প্রভৃতি। জাতি-রাষ্ট্রসমূহকে এ রকম এক আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের মধ্যে কাজ করতে হয়। এতদ্সত্ত্বেও আধুনিক রাষ্ট্র জনসাধারণের জীবন-মৃত্যুর মত গুরুত্বপূর্ণ এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক্তিয়ার ভোগ করে। বর্তমান বিশ্বে জাতি-রাষ্ট্রসমূহ পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। আজকের এই দুনিয়া অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির। এতদ্সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার কর্তৃত্বমূলক এক্তিয়ার অনস্বীকার্য। তা ছাড়া বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহ অংশগ্রহণ করে। এই সমস্ত সংগঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহ তাদের নিয়ন্ত্রণের অতীত পরিবর্তনশীল শক্তিসমূহকে এবং সম্পর্কসমূহকে অধিকতর কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে পারে। তবে এই সমস্ত সংগঠনগুলিও জাতি-রাষ্ট্রসমূহের উপর নতুন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। আবার সংশ্লিষ্ট সংগঠনসমূহ নতুন ধরনের রাজনীতিক অংশগ্রহণ ও হস্তক্ষেপ সৃষ্টি করে। বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মধ্যে ও মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহের অধিকার ও দায়-দায়িত্বের সক্রিয়ভাবে পুনর্নবীকরণ প্রয়োজন।
মূল্যায়ন (Evaluation): বিশেষ কোন একটি রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কাজকর্মের স্বাধীনতা হ্রাস পেয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এর থেকে এ রকম কোন সিদ্ধান্তে আসা উচিত হবে না যে, সার্বভৌমত্বের ধারণা সামগ্রিকভাবে অবলুপ্ত হয়েছে বা সার্বভৌমিকতা হীনবল হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রসমূহের নিজেদের মর্জিমাফিক কাজ করার স্বাধীনতাকে সার্বভৌমিকতা হিসাবে গণ্য করা যায় না; বরং সার্বভৌমিকতা হল রাষ্ট্রের উপরে অন্য কোন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতি। সাধারণভাবে রাজনীতিকরা এমন এক আন্তর্জাতিক রাজনীতিক ব্যবস্থাকে সমর্থন করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন যেখানে খেয়াল খুশীমত কাজকর্ম করা যাবে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে রাজনীতিকরা স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, জাতি-রাষ্ট্রসমূহ আজকাল আর বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করে না। আধুনিককালে আন্তর্জাতিক স্তরে রাষ্ট্রসমূহের যে ব্যবস্থা বর্তমান, সেখানে ক্ষমতার ব্যবস্থা হল অনন্য প্রকৃতির।
রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার উপর বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রতিকূল প্রভাব আছে। এ কথা একেবারে অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক জাতীয় পরিস্থিতির পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রভাব প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এই সমস্ত পরিস্থিতি বা বিষয়গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: বিশেষ কোন শক্তি-জোটে রাষ্ট্রটির অবস্থান; আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের অবস্থান; মুখ্য আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহের সঙ্গে রাষ্ট্রটির সম্পর্কের ধারা; আন্তর্জাতিক আইন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রটির অবস্থান প্রভৃতি। বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সকল রাষ্ট্র সমভাবে সংযুক্ত নয়। কোন কোন দেশের জাতীয় রাজনীতির উপর বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রভাব হবে পর্যাপ্ত; আবার কোন কোন দেশে জাতীয় ও আঞ্চলিক শক্তিসমূহের আধিপত্য অব্যাহত থাকবে।
বর্তমান বিশ্বকে যদি একটি মানব বসতি বলা হয়, তা হলে জাতি-রাষ্ট্রগুলি পরস্পর নির্ভরশীল প্রতিবেশীর মত সহাবস্থান করে। এদের মধ্যে ব্যাপকভাবে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া বর্তমান। জাতীয় রাজনীতির বিশ্বায়ন এবং বিশ্ব অর্থনীতির উদ্ভবের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহৎ সমস্যার জন্য জাতিরাষ্ট্র অতি ক্ষুদ্র প্রতিপন্ন হয় এবং ক্ষুদ্র সমস্যাদির জন্য অতি বৃহৎ প্রতিপন্ন হয়। আজকের দিনের সমস্যার প্রকৃতি পৃথক। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতি দেখা দিয়েছে; অথচ রাজনীতিক বিন্যাসের মূল রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতার মধ্যেই নিহিত আছে।
বর্তমানে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতাকে বিশ্ব সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে হবে। সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহ প্রায়শই ক্ষমতার অপব্যবহার করে। শক্তিধর সার্বভৌমগুলি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিশালী করতে চায় না। তাদের যুক্তি হল আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ভাল কাজ করে না। কারণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলি কোন নীতির দ্বারা পরিচালিত হয় না; একমাত্র স্বার্থ হল নিজেদের নিরাপত্তা। তাছাড়া আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের আর একটি সীমাবদ্ধতা আন্তর্জাতিক আমলাতন্ত্র। জাতীয় আমলাতন্ত্রের ত্রুটিবিচ্যুতিগুলি আন্তর্জাতিক আমলাতন্ত্রে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার সংরক্ষণের মত সর্বজনীন নীতিসমূহের সংরক্ষণ ও বিকাশের ক্ষেত্রে সন্তোষজনক ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সাফল্যের জন্য প্রয়োজন হল আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে সাফল্যের সঙ্গে ভুমিকা পালন করতে হবে। এবং এটা তখনই সম্ভব হবে, যখন একটি দায়িত্বশীল আন্তর্জাতিক নাগরিক সমাজ (Civil society) গড়ে উঠবে। জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে নাগরিক সমাজের শক্তিসমূহের দ্বারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই নাগরিক সমাজই বিশ্বায়নের প্রক্রিয়াকে প্রয়োজনমত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তারজন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে মৈত্রীবন্ধন গড়ে উঠা দরকার। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি কেবল স্বার্থের জন্য নয়, নীতির জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হবে। সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক সমাজের সক্রিয় হস্তক্ষেপ থাকবে।
পরিশেষে অধ্যাপক হেল্ডের পর্যালোচনা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর অভিমত অনুযায়ী আইনানুগ (dejure) সার্বভৌমিকতার ধারণার বাধ্যবাধকতা অব্যাহত আছে। কারণ রাষ্ট্র বলপ্রয়োগের ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পারে। তবে অধুনা অধিকতর জটিল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মধ্যে রাষ্ট্রকে কাজ করতে হয়। তারফলে রাষ্ট্রের স্বাধিকার সীমাবদ্ধ হয় এবং সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হয়। এবং সার্বভৌমিকতার সাবেকি ধারণা হীনবল হয়ে পড়ে; হবস্-রুশোর আলোচনায় সার্বভৌমিকতা বলতে অবাধ-অসীম ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে, তা আর থাকে না। আধুনিককালের পরিবর্তিত পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের পরিপ্রেক্ষিতে সার্বভৌমিকতাকে বেশ কিছু সংস্থার মধ্যে বিভক্ত বলে ধরে নিতে হবে। এবং এই বহুত্ববাদী প্রকৃতির জন্যই সার্বভৌমিকতা সীমাবদ্ধ। সার্বভৌমিকতা সম্পর্কিত এই ধারণার পরিচয় পাওয়া যায় লকের রাজনীতিক জনসম্প্রদায়ের ধারণার মধ্যে।
Leave a comment