ভাববাদী তত্ত্বে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিপূর্ণরূপে পরিহার করা হয়েছে। কেবল ভাব ও কল্পনার ভিত্তিতে ভাববাদীরা রাষ্ট্রের প্রকৃতি পর্যালোচনা করেছেন। তারফলে এই মতাদর্শটি বিভিন্ন দিক থেকে বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত ভাববাদ হল এক চরম ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রদর্শন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক আলোচনায় এ রকম রাষ্ট্র-চিন্তার বিরুদ্ধে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। এই প্রতিক্রিয়া রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেই বিতর্কের সূচনা করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জোড় তাঁর Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে ভাববাদী তত্ত্বের সমালোচনা প্রসঙ্গে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এই সমালোচনা সম্পর্কিত যুক্তিগুলিকে তিনি তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক এই দু’টি ভাগে বিভক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন: “It is denounced as unsound in theory, untrue to fact….” তাঁর মতানুসারে ভাববাদ তত্ত্বগত বিচারে অযৌক্তিক বা অবাস্তব এবং প্রায়োগিক বিচারে ঘটনা বা পরিস্থিতির সঙ্গে সাযুজ্যহীন। যাইহোক ভাববাদের বিরুদ্ধে প্রদর্শিত তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক যুক্তিগুলিকে নিম্নলিখিতভাবে বিন্যস্ত করা যায়।
(১) নৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকে রাষ্ট্র মুক্ত নয়: ‘রাষ্ট্রের ক্ষমতা সর্বাত্মক বা রাষ্ট্র সর্বশক্তিমান’–এ কথার অর্থ রাষ্ট্র যাবতীয় বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত। অর্থাৎ রাষ্ট্রের উপর নৈতিক বাধ্যবাধকতাও নেই। কিন্তু এ কথা ঠিক নয়। অনৈতিক কাজকর্মের জন্য রাষ্ট্র অব্যাহতি পেতে পারে না। নৈতিকতা ব্যক্তিগত আচার আচরণের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণকারী নীতি হিসাবে কার্যকর হয়। সুতরাং নৈতিক অপরাধের জন্য রাষ্ট্র নিষ্কৃতি পেতে পারে না। রাষ্ট্রও নৈতিক অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ও অপরাধী সাব্যস্ত হতে পারে।
(২) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সর্বশক্তিমান নয়: আবার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রকে সর্বশক্তিমান বলা যায় না। কারণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সকল রাষ্ট্রই হল অভিন্ন মর্যাদার অধিকারী। কোন রাষ্ট্র অপর কোন রাষ্ট্রের অধীনে থাকে না। কোন রাষ্ট্র অন্য কোন রাষ্ট্রের উপর কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারে না। কোন অমিত শক্তিধর রাষ্ট্রও হীনবল কোন রাষ্ট্রের উপর সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। কোন রাষ্ট্রই পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসাবে নিজেকে প্রতিপন্ন করতে পারে না। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের ধারণা অচল।
(৩) অবাস্তব: বিরুদ্ধবাদীদের মতে বাস্তবকে অগ্রাহ্য করে কেবল আদর্শ ও ভাবের সমাহার হিসাবে দেখলে রাষ্ট্রের সঠিক স্বরূপ উপলব্ধি করা অসম্ভব। বাস্তব উপাদানকে অস্বীকার করে ভাববাদ রাষ্ট্রকে বাস্তবতাবর্জিত আদর্শের দৃষ্টিতে দেখেছে। ভাববাদীরা কল্পনায় বসবাস করেন। ভাববাদী তত্ত্বে যে রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে তা বিমূর্ত ও অধিবিদ্যক। এই কারণে রাষ্ট্র সম্পর্কিত ভাববাদী তত্ত্বটি অবাস্তব প্রতিপন্ন হয়। এ প্রসঙ্গে বার্কার (Earnest Barker) -এর অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “ভাববাদে যে রাষ্ট্রের কল্পনা করা হয় স্বর্গরাজ্যে তা সম্ভব হতে পারে, কিন্তু মাটির পৃথিবীতে তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।” তাঁর কথায়: “The state of which it conceives may be laid up in heaven, but it is not established on earth.”
(৪) রাষ্ট্র ও সমাজ এক নয়: আদর্শবাদ অনুসারে রাষ্ট্র ও সমাজ অভিন্ন। এই ধারণাও ভ্রান্ত। সমাজ রাষ্ট্র অপেক্ষা অনেক বেশী ব্যাপক। রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের বাইরে যে বিস্তৃত সক্রিয় সামাজিক কর্মক্ষেত্র আছে এই মতবাদে তা স্বীকৃতি পায়নি। মানুষের সামগ্রিক সমাজজীবনের সঙ্গে রাষ্ট্র সংযুক্ত থাকে না। তবে সমাজের সুস্থ অস্তিত্বের স্বার্থে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এতদ্সত্ত্বেও রাষ্ট্র ও সমাজ সমার্থক হতে পারে না। আবার বহুত্ববাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মানব সমাজের উপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে স্বীকার করেন না।
(৫) স্বেচ্ছামূলক সংঘগুলিকে উপেক্ষা: ভাববাদী তাত্ত্বিকগণ সমাজের স্বেচ্ছামূলক সংঘ-সমিতিসমূহের ভূমিকার গুরুত্বকে স্বীকার করেননি। সমাজবদ্ধ মানুষের আর্থ-সামাজিক, নৈতিক, ধর্মীয় প্রভৃতি বিভিন্ন প্রয়োজন আছে। এই সমস্ত প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে সমাজে বহু ও বিভিন্ন স্বেচ্ছামূলক সংঘ-সমিতি আছে। মানুষের সমাজবদ্ধতা ও সচেতনতা ক্রমশ বেড়েছে। তারফলে বিভিন্ন স্বেচ্ছামূলক সংঘের সঙ্গে মানুষের সংযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে এই সমস্ত সংগঠনের সংযোগ এখন ব্যাপক, গভীর ও আন্তরিক। ব্যক্তি জীবনের সুখ-সমৃদ্ধি বর্তমানে বহুলাংশে এই সমস্ত সংঘের উপর নির্ভরশীল। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের থেকে এই সংগঠনগুলির ভূমিকা অধিকতর প্রয়োজনীয় প্রতিপন্ন হয়। আবার অনেকের মতে যে-কোন দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থায় স্নায়ুতন্ত্র গঠিত হয় এই সমস্ত সংগঠনকে নিয়ে। এগুলিকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্র-ব্যবস্থার সামগ্রিক পরিচয় বা রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তিবর্গের সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে অনুধাবন করা অসম্ভব। ভাববাদী রাষ্ট্র-দার্শনিকরা এ বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেননি। অর্থনীতিক প্রয়োজন এবং নৈতিক প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে জোড সমাজের স্বেচ্ছামূলক সংঘগুলিকে দু’ভাবে বিভক্ত করেছেন। আবার আর্থ-রাজনীতিক প্রয়োজনের মত নৈতিক প্রয়োজনেও ব্যক্তি সংঘ-সমিতি গঠন করে। নৈতিক প্রয়োজন পূরণ বা নৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে এই সমস্ত সংঘের ভূমিকা অনস্বীকার্য। জোডের অভিমত অনুসারে আধুনিক জীবনের জটিলতা ও সমস্যা ক্রমবর্ধমান। এই অবস্থায় ধর্মীয় প্রয়োজনের ক্ষেত্রেও জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র এই জটিলতার নিরসন বা সমস্যার সমাধান করতে পারে না। মানুষের নৈতিক ও ধর্মীয় চাহিদা মেটানোর জন্য বহু ও বিভিন্ন সংঘ-সমিতির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এই সংঘগুলি নির্দিষ্ট কোন রাষ্ট্রীয় এলাকার মধ্যে কেন্দ্রীভূত থাকে না। জোড়ের মতানুসারে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কার্যাবলী আগের থেকে অনেক বেড়েছে। এবং সমাজের স্বেচ্ছামূলক সংঘ-সমিতিগুলিরও ক্ষমতা ও দায়িত্ব ক্রমবর্ধমান। ভাববাদী তাত্ত্বিকরা এই বাস্তব অবস্থাটিকে অনুধাবন করতে পারেননি।
(৬) অগণতান্ত্রিক: সমালোচকদের মতানুসারে ভাববাদী রাষ্ট্রতত্ত্ব গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরোধী। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তির স্বাধিকারের ধারণার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। অথচ ভাববাদে ব্যক্তির স্বাধিকারকে স্বীকার করা হয় না। প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত ভাববাদী তত্ত্ব হল স্বেচ্ছাচারমূলক এবং একনায়কতান্ত্রিক।
(৭) ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী: আদর্শবাদ ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পরিপন্থী। জোড় তাঁর Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “The Absolute theory of the State is in fact inimical to individual freedom, because, whenever a conflict occurs between an individual and the state, it takes that the latter must inevitably be right.” জোডের অভিমত অনুসারে ভাববাদীরা রাষ্ট্রকে সর্বশক্তিমান বলে প্রতিপন্ন করেছেন এবং রাষ্ট্রের উপর দেবত্ব আরোপ করেছেন। ভাববাদীরা কার্যত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের বেদীমূলে সমর্পণ করেছেন; রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতার কাছে ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে বলি দিয়েছেন। রাষ্ট্রের চরম ক্ষমতার তত্ত্ব হল ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিরোধী। হবহাউসও যথার্থই বলেছেন যে, আদর্শবাদে যাকে প্রকৃত স্বাধীনতা বলে অভিহিত করা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তা স্বাধীনতার অস্বীকার মাত্র। ভাববাদে ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের হাতে ক্রীড়নকে পরিণত করা হয়েছে। তার ফলে রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারের পথ প্রশস্ত হয়েছে।
(৮) মানুষের প্রবৃত্তিকে উপেক্ষা: আদর্শবাদে মানুষের প্রবৃত্তিকে অগ্রাহ্য করে কেবল চেতনা ও বিচারবোধের উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অথচ মানুষ চেতনা ও বিচারশক্তির ন্যায় প্রবৃত্তির দ্বারাও প্রভাবিত হয়। সুতরাং এই আদর্শবাদ আংশিক ও ত্রুটিপূর্ণ।
(৯) রাষ্ট্র মানুষেরই সৃষ্টি: আদর্শবাদে একমাত্র রাষ্ট্রের স্বতন্ত্র ইচ্ছা ও ব্যক্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্রের বাইরে ব্যক্তির কোন স্বতন্ত্র সত্তা স্বীকার করা হয়নি। তত্ত্বগত বিচারে এই ধারণা ভ্রান্ত। মানুষের সার্বিক উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্র মনুষ্যসৃষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানমাত্র। রাষ্ট্র যাদের নিয়ে গঠিত তাদের কল্যাণ ব্যতিরেকে রাষ্ট্রের কল্যাণ অর্থহীন প্রতিপন্ন হয়। মানুষের জন্যই রাষ্ট্রের সৃষ্টি; রাষ্ট্রের জন্য মানুষ সৃষ্টি হয়নি। জোড়ের অভিমত অনুসারে: “The State exists for individuals; individuals do not exist for the State…the state has neither meaning nor value unless it carries with it the welfare of the individuals who compose it.” এক সার্থক ও সম্পূর্ণ মানবজীবনের সহযোগী হল রাষ্ট্র। সমাজবদ্ধ মানুষের কল্যাণ সাধনেরই একটি মাধ্যম হল রাষ্ট্র। অথচ ভাববাদী তাত্ত্বিকরা রাষ্ট্রের মধ্যেই রাষ্ট্রের সার্থকতার কথা বলেছেন। অর্থাৎ রাষ্ট্র নিজের মধ্যেই সার্থক। কিন্তু ইংরেজ ভাববাদী দার্শনিক টমাস হিল গ্রীন রাষ্ট্রের মধ্যেই রাষ্ট্রের সার্থকতার ধারণাকে স্বীকার করেননি।
(১০) প্রকৃত ও অপ্রকৃত ইচ্ছার বিভাজন অযৌক্তিক: আদর্শবাদীরা ব্যক্তির ‘প্রকৃত ইচ্ছা’ (Real Will) ও ‘অপ্রকৃত ইচ্ছা’ (Unreal Will)-র মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তার ফলে বাস্তবে ব্যক্তিত্বকে দ্বি খণ্ডিত করা হয়েছে। মনোবিজ্ঞানিগণের দৃষ্টিতে এই ধারণা ভ্রান্ত। বাস্তবে ব্যক্তির তথাকথিত ‘প্রকৃত ইচ্ছা’ সম্পর্কে সজ্ঞান নাও থাকতে পারে। বিপরীতক্রমে তথাকথিত ‘অপ্রকৃত ইচ্ছা’ সম্পর্কে ব্যক্তি অবহিত থাকতে পারে। এরকম ক্ষেত্রে প্রকৃত ইচ্ছার নামে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাকেই ব্যক্তির উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়। একে সমর্থন করা যায় না। এই কারণে জোড প্রকৃত ও অপ্রকৃত ইচ্ছার বিভাজনকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়েছেন।
(১১) আইন ও স্বাধীনতা এক নয়: আদর্শবাদ ব্যক্তির প্রকৃত ইচ্ছা ও অপ্রকৃত ইচ্ছার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে আইন ও স্বাধীনতাকে অভিন্ন প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন। এও ঠিক নয়। আইন ও স্বাধীনতা কখনই অভিন্ন নয়।
(১২) যুদ্ধবাদী মতবাদ: আদর্শবাদ চরম পরিণতিতে যুদ্ধের নৈতিক মূল্য স্বীকার করেছে। এই মতবাদ জার্মানীতে সমরোম্মাদ, ইটালীতে সর্বনাশ এবং বিশ্বজুড়ে দুটি মহাযুদ্ধ ডেকে এনেছে। নীতিগতভাবে এই যুদ্ধবাদী মতবাদ পরিত্যজ্য। এই মতবাদ বিশ্বশান্তির বিরোধী। ভাববাদীরা সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের ধারণা প্রচার করেছেন। তারফলে জার্মানীতে নাৎসীবাদের উদ্ভব ঘটে এবং সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব সম্প্রসারিত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে ভাববাদী তত্ত্ব সামরিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের প্রসারের উপযোগী তাত্ত্বিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার ব্যাপারে সাহায্য করেছে। বস্তুত আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের আচরণ যদি অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত হয়, তা হলে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা বিপন্ন হতে বাধ্য।
(১৩) রক্ষণশীল মতবাদ: এই তত্ত্বের ভিত্তিতে অ্যারিস্টটল ক্রীতদাস প্রথাকে, হেগেল রাজতন্ত্রকে এবং গ্রীন ধনতন্ত্রকে আদর্শ বলে প্রচার করেছেন। ভাববাদী রাষ্ট্র-দার্শনিকদের প্রত্যেকেই যে যার সমকালীন সমাজব্যবস্থা সংরক্ষণের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এই মতবাদের মুখ্য লক্ষ্য হল সমাজ-সভ্যতার স্থিতাবস্থা সংরক্ষণ। সমাজ-সভ্যতার রূপান্তরের প্রক্রিয়া এবং সামাজিক অগ্রগতির ধারাকে প্রতিহত করার জন্য এই মতবাদকে ব্যবহার করা হয়েছে। বস্তুত ভাববাদী তত্ত্ব হল রক্ষণশীলতা ও স্থিতাবস্থার সহায়ক এক মতবাদ। সুতরাং আদর্শবাদ হল রক্ষণশীলতা দোষে দুষ্ট। এই মতবাদ প্রগতি বিরোধী এবং একটি বিপজ্জনক মতবাদ।
(১৪) আদর্শবাদীরা রাষ্ট্রকে এক আত্মোপলব্ধিকারী ব্যক্তি হিসাবে চিত্রিত করেছেন। কিন্তু জৈব মতবাদীদের মতে রাষ্ট্রের সঙ্গে জীবদেহের তুলনা ভ্রান্ত।
(১৫) আইন ও নীতির মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি: ভাববাদী রাষ্ট্র দার্শনিকগণ আইনকে রাষ্ট্রীয় আদেশ হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন এবং রাষ্ট্রের মধ্যেই চরম নীতিবোধের অস্তিত্বের কথা বলেছেন। অর্থাৎ আইন ও নীতির মধ্যে কোনরকম পার্থক্যের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু তা ঠিক নয়। আইনসঙ্গত বিষয় নীতিসম্মত হবেই এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। অনুরূপভাবে নীতিসম্মত বিষয় আইনসঙ্গত হবেই, তাও জোর দিয়ে বলা যায় না। তা ছাড়া ব্যক্তির আইনানুগ ও নৈতিক আনুগত্যের মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা ভাববাদী তত্ত্বে ধরা পড়েনি।
(১৬) মার্কসীয় সমালোচনা: আদর্শবাদের বক্তব্য অনুসারে রাষ্ট্র হল সমাজবিবর্তনের সর্বশ্রেষ্ঠ স্তর বা সর্বশেষ পর্যায়। কিন্তু মার্কসবাদীরা মনে করেন সমাজবিবর্তনের এক বিশেষ পর্যায়ে শ্রেণী-শোষণের হাতিয়ার হিসাবে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। এবং সমাজবিকাশের ধারায় যখন শ্রেণী-দ্বন্দ্বের সমাপ্তি ঘটবে ও সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থার সৃষ্টি হবে তখন অপ্রয়োজনীয় হয়ে রাষ্ট্র বিলুপ্ত হবে। রাষ্ট্র কোন শাশ্বত বা চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠান নয়।
দ্যুণ্ডই ও ম্যাকাইভারের পর্যালোচনা: দ্যুগুই (Duguit) প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতানুসারে আদর্শবাদ রাষ্ট্রের উপর দেবত্ব আরোপ করে কার্যক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদী ও নাৎসীবাদী অর্থাৎ সর্বাত্মক ও স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেছে। ম্যাকাইভার-এর মতানুসারে আদর্শবাদ হল স্বৈরতন্ত্রকে সমর্থনের এক অভিনব কৌশল।
ওয়েপার ও ল্যাস্কির সমালোচনা: ওয়েপারও ভাববাদী তত্ত্বের বিরূপ সমালোচনা করেছেন। তার মতানুসারে সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের ধারণা মানবসভ্যতার পরিপন্থী। হেগেলের ভাববাদী বক্তব্য অনুসারে স্বাধীনতা ও আনুগত্য হল অভিন্ন। অনুরূপভাবে শৃঙ্খলা ও সাম্য হল এক। কিন্তু এ কথা ঠিক নয়। এ কথা মেনে নিলে স্বাধীনতা ও সাম্য অর্থহীন প্রতিপন্ন হবে। অধ্যাপক ল্যাস্কিও ভাববাদী তত্ত্বের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মতানুসারে ভাববাদ আইনের পরমলক্ষ্যবাদ ও আইনের কার্যকারিতার বিষয়টিকে উপেক্ষা করেছে। ভাববাদ হল বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত নিছক একটি ধারণাগত বিষয়।
মূল্যায়ন (Evaluation): বহু বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আদর্শবাদের তাত্ত্বিক মূল্যকে অস্বীকার করা অসম্ভব।
(১) রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির আনুগত্যের প্রয়োজনীয়তাকে কোনক্রমে অগ্রাহ্য করা যায় না।
(২) আবার রাষ্ট্রই যে ব্যক্তির সকল অধিকারের স্রষ্টা ও রক্ষক এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। ব্যক্তির স্বার্থেই রাষ্ট্রীয় প্রাধান্যের প্রয়োজনীয়তা আছে।
(৩) গেটেলের মতানুসারে রাষ্ট্র হল আইন ও অধিকারের একমাত্র উৎস। এবং আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে শক্তির প্রয়োজন আছে, একথাও অস্বীকার করা যায় না।
(৪) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জোরদার যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছেন। তাঁদের মতানুসারে রাষ্ট্র হল বিভিন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত একটি প্রতিষ্ঠান এবং এই প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতিকারক ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের এই বিধ্বংসী প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে রক্ষার ক্ষেত্রে ভাববাদী তত্ত্বের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। সুদৃঢ় রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বার্থে নাগরিকদের শর্তহীন আনুগত্য এবং ঐক্য ও সংহতি অপরিহার্য। আবার নাগরিকদের আনুগত্য ও ঐক্যকে সুনিশ্চিত করার স্বার্থে রাষ্ট্রকে আদর্শ ঐ নৈতিকতার প্রতীক হিসাবে প্রতিপন্ন করার প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য।
(৫) ভাববাদী তত্ত্বে রাষ্ট্রের জৈবিক প্রকৃতির কথা বলা হয়েছে। তা ছাড়া ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সহায়ক ভূমিকার প্রয়োজনীয়তার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ দিক থেকেও ভাববাদী তত্ত্বের অবদানকে অস্বীকার করা যায় না।
(৬) সর্বোপরি রাষ্ট্র নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে নাগরিকদের আনুগত্য দাবি করতে পারে— ইংরেজ আদর্শবাদী গ্রীনের এই বক্তব্য অভ্রান্ত। বস্তুত আদর্শবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া তার বিকৃত ব্যাখ্যারই ফল। গার্ণার বলেছেন: “For the most part it is the perversions and unwarrantable deductions that have lately brought it into discredit.”
Leave a comment