একনায়কতন্ত্রের একটি রূপ: প্রকৃতপক্ষে ফ্যাসিবাদের পিছনে কোন সুশৃঙ্খল দার্শনিক তত্ত্ব নেই। প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে ইতালীতে গণতন্ত্রের ব্যর্থতা ও বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগে মুসোলিনীর নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট দল চরম কর্তৃত্বের অধিকারী হয়। মুসোলিনীর এই ফ্যাসিস্ট দল চূড়ান্ত কর্তৃত্বসম্পন্ন যে সর্বাত্মক রাষ্ট্রের ধারণা প্রচার করে তাই ফ্যাসিবাদ হিসাবে পরিচিত। ফ্যাসিবাদ একনায়কতন্ত্রেরই একটি বিশেষ রূপ হিসাবে বিবেচিত হয়।

ফ্যাসিবাদের স্বরূপ:

সর্বাত্মক রাষ্ট্রব্যবস্থা (Totalitarian State) বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের চরমতা সম্পর্কিত হেগেলের মতবাদই হল ফ্যাসিবাদের ভিত্তি। রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ক হেগেলীয় আদর্শবাদের ধ্যান-ধারণার দ্বারা ফ্যাসিবাদ গঠিত ও পরিপুষ্ট হয়েছে। ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রের সর্বময় শক্তি প্রয়োগের দিকটির উপর গুরুত্ব আরোপ করে। এই মতবাদ অনুসারে ব্যক্তিজীবনের যাবতীয় দায়দায়িত্ব সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র গ্রহণ করবে। রাষ্ট্রের পক্ষে রাষ্ট্রের অধিনায়কই এই দায়িত্ব পালন করবেন। আর এই একনায়কই হবেন সমুদয় ক্ষমতার অধিকারী ও প্রয়োগকর্তা। তিনি জনগণের সঙ্গে যুক্ত থেকে তাদের শিক্ষা-দীক্ষা, চিন্তা-ভাবনা, এক কথায় সমগ্র জীবনকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করবেন। রাষ্ট্রের পক্ষে এই একনায়কই ব্যক্তিজীবনের সমস্ত কিছু সম্পাদন করবেন। ব্যক্তির নিজের কিছু বলার বা করার থাকবে না। ব্যক্তির স্বার্থ রাষ্ট্রের মধ্যেই নিহিত থাকে। রাষ্ট্র-বিরোধী কোন ব্যক্তি স্বার্থ থাকতে পারে না। যদিও তেমন কোন স্বার্থের সৃষ্টি হয় তবে তা ধ্বংস করতে হবে। ফ্যাসিবাদে রাষ্ট্রের এই সর্বময় ক্ষমতা ও চরম কর্তৃত্বের কথা বলা হয়। ফ্যাসিবাদ অনুসারে রাষ্ট্র হল গণচেতনার বাস্তব প্রকাশ। মুসোলিনী বলেছেন: “…the Fascist state is itself conscious and itself a will and personality-thus it may be called the ethic’ state.” এই রাষ্ট্র কোন ধর্মীয় বা নৈতিক আদর্শের সঙ্গে আপস করার পক্ষপাতী নয়।

ফ্যাসীবাদ রাষ্ট্র: মুসোলিনী (Banito Mussolini) জেনটিল (Giovanni Gentile) নামক এক হেগেলীয় দার্শনিকের সাহায্যে তাঁর ফ্যাসীবাদী রাজনীতিক দর্শন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এতদ্সত্ত্বেও ফ্যাসিবাদী রাজনীতিক দর্শন বলে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। ফ্যাসিবাদের তাত্ত্বিক দৈন্য মুসোলিনীর একটি কথায় প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বলেছেন: “আমি বিশ্বাস করি কাজে, কথায় নয়।” যাইহোক রাষ্ট্রের প্রকৃতি, উদ্দেশ্য ও কর্তব্যকে কেন্দ্র করেই ফ্যাসিবাদী তত্ত্ব গড়ে উঠেছে। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র সম্পূর্ণ আত্মসচেতন। এই রাষ্ট্রের নিজস্ব ইচ্ছা বা ব্যক্তিত্ব আছে। প্রকৃতিগতভাবে এই রাষ্ট্র চরম সার্বভৌমিকতার অধিকারী। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র হল জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ প্রতীক ও জনগণের নৈতিকতার পূর্ণ প্রকাশ। এই রাষ্ট্রই হল জনগণের চরম লক্ষ্য। তাই প্রত্যেকের পবিত্র কর্তব্য হল রাষ্ট্রের অধীনে ব্যক্তিসত্তাকে স্থাপন করা। ব্যক্তিজীবনের সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অবিসংবাদিত প্রাধান্য বর্তমান। মুসোলিনী বলেছেন: “Everything within the state, nothing against the state, nothing outside the state.”

ফ্যাসিবাদের মার্কসীয় ব্যাখ্যা:

মার্কসবাদীদের মতানুসারে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অস্থিরতা, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দৈন্য ও অসন্তোষ, শ্রমিক শ্রেণী ও গণতান্ত্রিক শক্তির অধিকার হরণের জন্য পুঁজিবাদী শাসনযন্ত্রের অপব্যবহার এবং শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামী শক্তিকে দুর্বল করার জন্য শোধনবাদের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির মধ্যে ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব হয়। ফ্যাসিবাদ হল স্পষ্টত এক একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা। বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রণী অংশ বা সাম্যবাদীদের ধ্বংস করাই হল ফ্যাসিবাদের মূল লক্ষ্য। ডিমিটভ (G. Dimitrov)-এর মতানুসারে ফ্যাসিবাদ হল মেহনতী জনতার এক ব্যাপক অংশের উপর পুঁজির সহিংস আক্রমণ। এ হল অপ্রতিহত এক জাতীয়তাবাদ এবং লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে যুদ্ধের সমর্থক। তিনি বলেছেন: “Fascism is a most ferocious attack by capital on the working people; fascism is unbridled chauvinism and predatory war.” রজনী পাম দত্ত (R. P. Dutt)-র মতে ‘ফ্যাসিবাদ শোধনবাদের সন্তান’ (‘Fascism is the child of reformism’)। তাঁর অভিমত অনুসারে ফ্যাসিবাদ হল পুঁজিবাদের অনিবার্য পরিণতি এবং পূর্ণতা ও চরম সংকটের প্রকাশ। এ হল আধুনিক ধনতন্ত্রের এক বিশেষ ধরন। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক (১৯৩৫) [Communist International, 1935] অনুসারে “Fascism is the open terrorist dictatorship of the most imperialist element of finance capital.”


ফ্যাসিবাদের উদ্ভব

ফ্যাসিবাদের সূত্রপাত:

ফ্যাসিবাদ হল বিংশ শতাব্দীর এক স্বৈরতান্ত্রিক ফসল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে সর্বাত্মক রাষ্ট্রের ধারণা হিসাবে ফ্যাসিবাদের যেমন জন্ম হয়, তেমনি চরম রাষ্ট্রের ধারণার বিরুদ্ধে বহুত্ববাদেরও উদ্ভব হয়। ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছে ১৯১৯ সালে ইতালীতে। বেনিটো মুসোলিনী ফ্যাসিবাদের জনক হিসাবে পরিচিত। তিনি ১৯১৯ সালে মিলানে ‘Fascio di Combanttinmento’ নামে ফ্যাসিস্ত দল গড়ে তোলেন। এইভাবে ফ্যাসিবাদের সূত্রপাত ঘটে।

ইতালীতে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব:

এর আগে পোল্যাণ্ড, ফিনল্যাণ্ড, হাঙ্গেরী, জার্মানী প্রভৃতি দেশে ফ্যাসিবাদের পূর্বাভাস দেখা দিয়েছে। তবে পরিপূর্ণ অর্থে ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব ঘটে ইতালীতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহে ব্যাপক ও তীব্র অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়। ইতালীতেও এই সংকট প্রকট হয়ে উঠে। এই সময় শ্রমজীবী জনতা বিকল্পের সন্ধানে ধর্মঘট, বিক্ষোভ প্রভৃতির সামিল হতে থাকে। এই অবস্থায় জরাগ্রস্ত সমাজব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে মেহনতী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়। সর্বহারা শ্রেণীর শোষণমুক্তির ও আত্মপ্রতিষ্ঠার এই ঐতিহাসিক সুযোগকে শোধনবাদী নেতৃত্ব কাজে লাগাতে ব্যর্থ হল। ইতালীতে সোসালিস্ট পার্টির ১৯২০ সাল পর্যন্ত প্রাধান্যমূলক ভূমিকা ছিল; কিন্তু এই দল বিপ্লবী পরিস্থিতিকে কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় গঠনমূলক নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হল। এই রকম পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রতিবিপ্লবী শক্তি হিসাবে ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব ঘটে। ইতালীতে ফ্যাসিবাদের জনক মুসোলিনী এক সময় সোস্যালিস্ট পার্টির উগ্র সমর্থক ছিলেন। যাইহোক ১৯২০ সালের শেষের দিক থেকে ফ্যাসিস্ত দলের শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিক্ষোভ-বিপ্লবের চাপ প্রতিহত করার জন্য বুর্জোয়া সরকার দলকে মদত দিতে শুরু করে। গোড়ার দিকে এই দলের বিপ্লবী বাগাড়ম্বরে মানুষ বিভ্রান্ত হয়। গুরুত্বপূর্ণ কতকগুলি বিষয় যেমন কৃষকদের জন্য জমি, শিল্পকারখানায় শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ, ধর্মঘটের অধিকার, মধ্যব্যবসায়ীদের মুনাফা বাজেয়াপ্তকরণ, সরকারী দুর্নীতি ও চোরাকারবারের বিলোপ প্রভৃতি সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ শ্লোগান দেশের মানুষকে আলোড়িত করে। এইভাবে ফ্যাসিস্ত দলের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পথ সুগম হতে শুরু করে। মুসোলিনির ‘কালো কুর্তা’ (Black Shirts) বাহিনী সারা ইতালীতে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ফ্যাসিস্ত দল শ্রমিক-কৃষক প্রভৃতি মেহনতী মানুষের উপর হিংস্র আক্রমণ বাড়িয়ে যেতে থাকে। কমিউনিস্টদের আটকাবার জন্য ইতালীয় পুলিস, সৈন্যবাহিনী ও সরকারের বিচার বিভাগ ফ্যাসিবাদের সঙ্গে নানাভাবে সহযোগিতা করত। ফ্যাসিস্তরা রোম অভিযান শুরু করে ১৯২২ সালে ২৮শে অক্টোবর। মুসোলিনী রোমে হাজির হন ৩০শে অক্টোবর। ফ্যাসিস্ত দল অফিস-আদালত, রেল-টেলিগ্রাফ প্রভৃতি সবকিছু দখল করে নেয়। মুসোলিনি নবগঠিত ফ্যাসিস্ত সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হন।

ইতালীর ঘটনার পুনরাবৃত্তি জার্মানীতেও ঘটে। জার্মানীতে শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামকে অগ্রগতির পথে পরিচালিত করতে সামাজিক গণতন্ত্রী দল ব্যর্থ হয়। এর জন্য দায়ী ভ্রান্ত নেতৃত্ব ও তাদের শোধনবাদী চরিত্র। এই অবস্থায় জার্মানীতে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসী দল ক্ষমতাসীন হয়। তা ছাড়া স্পেনে ফ্যালানজিস্ট (Falangist) পার্টি, চীনে কুওমিতাং (Kuomintung) এবং আর্জেন্টিনায় পেরোনিস্টরা (Peronist) রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে।

ফ্যাসিবাদের উদ্ভবের কারণ

ফ্যাসিবাদের উদ্ভবের ক্ষেত্রে কোলের মত: ফ্যাসিবাদের উদ্ভবের ক্ষেত্রে কারণ হিসাবে কোল (G. D. H. Cole) কতকগুলি বিষয়ের কথা বলেছেন। এগুলি হল: (ক) ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত সামাজিক, রাজনীতিক ও অর্থনৈতিক সংগঠনের উপযোগিতা সম্পর্কে জনসাধারণের ক্রমবর্ধমান অংশের মধ্যে আস্থার অভাব; (খ) প্রচলিত ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা এবং নতুন মূল্যবোধের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা; (গ) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা ও নিরাপত্তার অভাববোধ; (ঘ) অপপ্রচারের মাধ্যমে সাম্যবাদী চিন্তা-চেতনা ও আদর্শের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে ভীতি ও ঘৃণার সৃষ্টি; (ঙ) জনগণের মধ্যে যাঁরা অপেক্ষাকৃত তরুণ তাঁদের মধ্যে সকলের পুরোনো রাজনীতিক দলের শক্তি ও যোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ ও অবিশ্বাস; (চ) সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসা অস্থির অর্থনৈতিক অবস্থা ও বিশৃঙ্খল রাজনীতিক পরিস্থিতি এবং (ছ) জাতীয়তাবাদের এক উগ্র পুনর্জাগরণ। অধ্যাপক কোলের মতানুসারে উপরি-উল্লিখিত কারণগুলি জনগণের মধ্যে সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রতি এক বিরাগের সৃষ্টি করে এবং জনগণ সংকটের ত্রাতা হিসাবে ফ্যাসিবাদী নেতাকে আবেগভরে আহ্বান জানায়।

ফ্যাসিবাদের উদ্ভবের ক্ষেত্রে লয়েড ও ল্যাস্কির মত: ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব ও বিকাশের ক্ষেত্রে এক অনুকূল সামাজিক পরিস্থিতির প্রয়োজন। লয়েড (Christopher Lloyd) -এর মতানুসারে সেই অনুকুল পরিস্থিতির জন্য কতকগুলি অবস্থার উপস্থিতি আবশ্যক। এই অবস্থাগুলি হল: (১) এক নামসর্বস্ব গণতন্ত্র যা জরাগ্রস্ত এক রাজনীতিক ব্যবস্থা হিসাবে বর্তমান; (২) জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা মেটাতে সক্ষম এমন এক ব্যক্তিসম্পন্ন নেতার উপস্থিতি; (৩) জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণায় উন্মত্ত এক উগ্র জাতীয় জনসমাজের অস্তিত্ব; (৪) কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে জনজীবনে কোন গভীর সংকট বা অসন্তোষ যা ভাবী একনায়ককে মিথ্যা প্রচার ও বাগাড়ম্বরের সুযোগ করে দেয়; এবং (৫) কোন তীব্র অর্থনৈতিক সংকট যার থেকে মুক্তি লাভের জন্য জনগণ কোন নতুন পরিকল্পনা অবলম্বন করতে উদগ্রীব। অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে পুঁজিবাদের সঙ্গে গণতন্ত্রের অসামঞ্জস্যের কারণেই ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয়ে থাকে। পুঁজিবাদের সংকটপূর্ণ অবস্থায় ফ্যাসিবাদ পুঁজিবাদের সহায় হিসাবে আবির্ভূত হয়। ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন: “As soon as capitalism ran into difficult weather fascism came to rescue capitalism.”


ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য

ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রের স্বরূপ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে এর কতকগুলি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে নিম্নলিখিতভাবে ব্যক্ত করা যেতে পারে :

(১) সমাজতন্ত্রের বিরোধী: ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় দর্শনকে সমর্থন করে না। হেগেলীয় আদর্শবাদের ভিত্তিতে ফ্যাসিবাদ পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের এই সর্বময় কর্তৃত্ব রাষ্ট্রের অধিনায়কের মাধ্যমে কার্যকরী হয়। এবং তাঁর নায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সাম্যবাদী ধারণা অনুসারে সর্বহারার একনায়কত্বের তত্ত্ব এখানে সমর্থন করা হয় না। অর্থনৈতিক সাম্যের ধারণাও এখানে অচল। ফ্যাসিবাদ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার সমর্থন করে। আবার সমষ্টির স্বার্থে ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলা হয়। যাইহোক, ফ্যাসিবাদ সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বিরোধী।

(২) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরোধী: ফ্যাসিবাদ আবার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদেরও বিরোধী। এ রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্বে বিশ্বাসী। ব্যক্তিজীবনের সবকিছু সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে সম্পাদিত হয়। ফ্যাসিবাদ অনুসারে বলা হয় যে, ব্যক্তির স্বার্থ রাষ্ট্রের মধ্যেই নিহিত আছে। রাষ্ট্রের বাইরে বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তিস্বার্থ স্বীকার করা হয় না। মুসোলিনী বলেছেন: “Fascism conceives of the state as an absolute, in comparison with which all individuals or groups are relative only to be conceived of in their relation to the state.” ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র হল ব্যক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ প্রতীক। কেবল রাষ্ট্রের ভিতরেই ব্যক্তিজীবনের পূর্ণতার উপলব্ধি সম্ভব হতে পারে। রাষ্ট্র হল চরম নৈতিক ও আইনগত সার্বভৌমিকতার অভিব্যক্তি। এই রাষ্ট্রের নিজস্ব চিন্তা ও চেতনা বর্তমান। ফ্যাসিবাদে সমাজ (society) বলতে জাতি (nation) এবং জাতি বলতে রাষ্ট্রকে বোঝান হয়। ফ্যাসিবাদের ভিত্তিই হল রাষ্ট্রের প্রাধান্য। লয়েড (Christopher Lloyd) বলেছেন: “The primacy of the state is the basis of Fascism.”

(৩) যুদ্ধবাজ মতবাদ: ফ্যাসিবাদ শান্তিবাদেও বিশ্বাসী নয়। ফ্যাসিবাদ শান্তির ধারণাকে ভীরুতা বলে অবজ্ঞা করে। এ যুদ্ধবাদকে স্বাভাবিক এবং সাম্রাজ্যবাদকে শাশ্বত নিয়ম হিসাবে স্বীকার করে। ফ্যাসিবাদে উগ্র জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করা হয়। ফ্যাসিবাদ স্বার্থ সাধনের জন্য হিংসা ও যুদ্ধের কথা বলে। এই মতবাদ অনুসারে জাতীয় রাষ্ট্রের সমৃদ্ধির জন্য সম্প্রসারণ অপরিহার্য। মুসোলিনী মন্তব্য করেছেন: “Fascism believes neither in the possibility nor in the utility of perpetual peace. Italian expansion is a matter of life and death. Italy must expand or perish.”

(৪) গণতন্ত্র বিরোধী ও অভিজাততান্ত্রিক: স্বাভাবিক কারণে ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রের আদর্শকেও অস্বীকার করে। ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করা হয়। সমস্ত রকম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অগ্রাহ্য করা হয়। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে নেতৃপূজা বা বীরপূজা পরিলক্ষিত হয়। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করা হয় না। এখানে ফ্যাসিস্ত দল ছাড়া অন্য কোন রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব অস্বীকৃত। একনায়ক এবং তার একমাত্র দলের প্রতিহত প্রাধান্য এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে জাতীয় স্বার্থে বাছাই করা কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে সরকার গঠিত হয়। এই অভিজাত গোষ্ঠী জাতির সর্বোচ্চ ভাগ্যনিয়ন্তা হিসাবে কাজ করেন। এদের উপরে সর্বোচ্চ নেতা হিসাবে অবস্থান করেন একনায়ক। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় বিশ্বাস করা হয় যে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের উপযোগী প্রয়োজনীয় জ্ঞান-বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা আপামর জনসাধারণের থাকে না।

(৫) জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের উপর প্রাধান্য: ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে ব্যক্তির স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রী প্রভৃতিকে উপেক্ষা করা হয় এবং ফ্যাসিবাদী নিয়মনীতি, কর্তব্য, নিষ্ঠা প্রভৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ব্যক্তির স্বাধীনতার জন্য রাষ্ট্রশক্তি ও আইনের প্রতি আনুগত্যের কথা বলা হয়। ফ্যাসিবাদী ধারণা অনুসারে জনগণের স্বাধীনতা জাতির শক্তি-সামর্থ্যের উপর নির্ভরশীল। ব্যক্তি-স্বাধীনতা ভোগের একমাত্র উপায় হল রাষ্ট্রের ইচ্ছার সঙ্গে একাত্মতা স্থাপন করা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের দাসত্বই হল স্বাধীনতা। স্বাধীনতা এখানে অধিকার নয়, কর্তব্য বিশেষ। এখানে সংকীর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে স্থায়ী ও বৃহত্তম জাতীয় স্বার্থ বড় করে দেখা হয়। এখানে সুগঠিত ও সুসংহত জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের উপর বিশেষ প্রাধান্য আরোপ করা হয়ে থাকে।

(৬) আর্থনীতিক নীতি: ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক বিষয়টি জাতীয় স্বার্থের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদ বা রাষ্ট্র-কর্তৃত্ববাদ কোনটিকেই সমর্থন করা যায় না। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার এখানে স্বীকৃত। কিন্তু এই অধিকার সবসময় জাতীয় স্বার্থের অধীন। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগ স্বীকৃত। কিন্তু জাতীয় জীবনের সমৃদ্ধি সাধনে এবং নিরাপত্তা বিধানে এই উদ্যোগ যদি ব্যর্থ হয় তাহলে সরকারী হস্তক্ষেপ অনিবার্য। এই ধরনের অর্থনীতিতে নিয়োগকর্তা বা শ্রমিক কারও কোনও স্বতন্ত্র অধিকার স্বীকার করা হয় না। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে উৎপাদন ও বণ্টনের বিষয়টি জাতিগত স্বার্থের দিক থেকে বিচার বিবেচনা করা হয়। কোকার মন্তব্য করেছেন: “They consider all economic questions from the standpoint of national utility.”

(৭) যৌথ রাষ্ট্রের ধারণা: ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় যৌথ রাষ্ট্রের (Corporate State) ধারণা প্রচার করা হয়। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অন্য সকল রাজনীতিক দলের অস্তিত্বকে বিলুপ্ত করা হয় এবং কেবলমাত্র ফ্যাসিস্ত দলের অস্তিত্ব স্বীকৃত হয় এবং প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্যাসিবাদ সর্বাত্মক একদলীয় ব্যবস্থায় আস্থাশীল। সর্বশক্তিমান এই রাষ্ট্রের কর্মপরিধি ব্যক্তিজীবনের সকল ক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। এই ফ্যাসিবাদী দলই হল রাষ্ট্রের প্রধান কর্ণধার। মুসোলিনী ফ্যাসিস্ত দলের সর্বাত্মক ও কর্তৃত্বমূলক ভূমিকার কথা যেমন বলেছেন, তেমনি জাতীয় সমস্যার অনুধাবনের ক্ষেত্রে জনগণের অক্ষমতার কথাও বলেছেন। যৌথ রাষ্ট্রের এই ধারণা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চায়। এই রাষ্ট্রে জাতীয় জীবনের নিয়ন্তা হল ফ্যাসিস্ত দল। যৌথ রাষ্ট্রের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ এবং কাজকর্মের সমন্বয় সাধনের জন্য এই ফ্যাসিস্ত দল এবং একজন একনায়কের অপরিহার্যতার কথা বলা হয়।

(৮) রাজনীতিক মতবাদ নয়: ফ্যাসীবাদ কোন বিশেষ রাজনীতিক দর্শন বা মতাদর্শ হিসাবে গণ্য হয়। না। প্রকৃত প্রস্তাবে ফ্যাসিবাদ হল একটি বিশেষ সামাজিক, রাজনীতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচী। মুসোলিনী বলেছেন: “Fascism is based on reality, we want to be definite and real, our programme is action not talk…. Fascism is not nursing of a doctrine beforehand with detailed relaboration.”


ফ্যাসিবাদের সমালোচনা

বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক ধিকৃত স্বৈরতান্ত্রিক আন্দোলন হল এই ফ্যাসিবাদ। মানবসভ্যতার ইতিহাসে ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র এক বিভীষিকাস্বরূপ। বিভিন্ন দিক থেকে ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করা হয়। মূলত উদারনীতিক ধ্যান-ধারণা ও মার্কসীয় দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে ফ্যাসিবাদী ধারণার সমালোচনা করা হয়।

(ক) সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক: ফ্যাসিবাদী বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে অগণতান্ত্রিক। জনগণের সার্বভৌমত্ব ফ্যাসিবাদে অস্বীকৃত। এখানে রাষ্ট্র হল সর্বশক্তিমান, চরম ও অভ্রান্ত। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে শাসন ক্ষমতা বাছাই করা কিছু ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে। ফ্যাসিস্ত দল ছাড়া অন্য সকল রাজনীতিক দলের অস্তিত্বকে বলপূর্বক ধ্বংস করা হয়। সব রকম বিরোধিতা ও সমালোচনাকে সন্ত্রাসমূলক পথে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। ফ্যাসিবাদের মূল মন্ত্র হল এক জাতি, এক রাষ্ট্র, এক দল ও এক নেতা। বস্তুত গণতান্ত্রিক মতাদর্শ ও শাসনব্যবস্থার বিরোধিতাই হল ফ্যাসিবাদের মূল ভিত্তি। লয়েড (Christopher Lloyd) মন্তব্য করেছেন: “Fascism rejects democracy as a system of government and as a creed.”

(খ) ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণা ভ্রান্ত: ব্যক্তির স্বাধীনতা সম্পর্কে ফ্যাসিবাদী ধারণা ভ্রান্ত। এ ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ হেগেলীয় দর্শনকে অনুসরণ করেছে। স্বাধীনতার উপলব্ধির জন্য রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ও স্বার্থের কাছে ব্যক্তিকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করেই ব্যক্তি তার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। বস্তুত ফ্যাসিবাদে রাষ্ট্রের দাসত্বকেই ব্যক্তিস্বাধীনতা হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। লয়েড যথার্থই বলেছেন: ‘‘Democratic theory regards Fascist freedom as only another name of slavery.” প্রকৃত প্রস্তাবে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে ব্যক্তি-স্বাধীনতার ধারণা স্বাধীনতার অস্বীকৃতি বই কিছু নয়।

(গ) সাম্রাজ্যবাদী মতবাদ: ফ্যাসিবাদ যুদ্ধবাজ ও সাম্রাজ্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। জাতীয় রাষ্ট্রের সম্প্রসারণের স্বার্থে যুদ্ধ হল স্বাভাবিক ও শাশ্বত নিয়ম। ফ্যাসিবাদে উগ্র জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদকে সমর্থন করা হয়। সুতরাং ফ্যাসিবাদ হল আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও মৈত্রীর আদর্শের বিরোধী এবং মানবসভ্যতার শত্রু।

(ঘ) সাম্য-বিরোধী: ফ্যাসিবাদ সাম্যের আদর্শের বিরোধী। রাজনীতিক সাম্য এবং জনজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সাম্য এখানে অস্বীকৃত। সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থনীতিক—এককথায় সকল ক্ষেত্রে সাম্যের আদর্শকে উপেক্ষা করে বীরপূজা, ব্যক্তিপূজা, আভিজাত্য, জাতিবিদ্বেষ প্রভৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

(ঙ) প্রচলিত মূল্যবোধকে অস্বীকার: ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে একনায়ক তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য মিথ্যাপ্রচার, বাগাড়ম্বর, প্রতারণা প্রভৃতির মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করেন। তা ছাড়া প্রচলিত যাবতীয় মানবিক মূল্যবোধকে উপেক্ষা ও ধ্বংস করা হয়। এই কারণে উদারনীতিক চিন্তাবিদদের কাছে ফ্যাসিবাদ হল মানবতাবিরোধী।

(চ) ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র হল সর্বাত্মক রাষ্ট্র। জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে এর সর্বব্যাপক নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত। এরফলে শিক্ষা-সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে মানুষের জীবনধারার স্বাভাবিক বিকাশ রুদ্ধ হয়। 

(ছ) মার্কসবাদীদের মতানুসারে একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থের অনুকূলে এবং শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী স্বৈরতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠিত হয়। ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক (Communist International, 1935) অনুসারে : Fascism is the open terrorist dictatorship of the most reactionary, most chauvinist and most imperialist element of finance capital.” ল্যাস্কি (Laski)-র মতানুসারে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অবক্ষয় ও সংকটের সময় পুঁজিবাদের সহায় হিসাবে ফ্যাসিবাদের নগ্ন আবির্ভাব ঘটে। প্রকৃতিগত বিচারে ফ্যাসিবাদ হল প্রতিবিপ্লবী ও প্রতিক্রিয়াশীল মতবাদ। মেহনতী জনতা যখন পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে সংগঠিত হয় সেই ঐতিহাসিক পর্বে একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ রক্ষার জন্য শ্রমজীবী জনতার আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয়। এই কারণে মার্কসীয় দর্শন অনুসারে ফ্যাসিবাদ হল ‘লগ্নী পুঁজির নগ্ন সন্ত্রাসবাদী একনায়কত্ব’ (naked terrorist dictatorship of finance capital)।

উপসংহার: বস্তুতপক্ষে, ফ্যাসিবাদ এক নিকৃষ্ট ধরনের একনায়কতন্ত্র ব্যতীত কিছুই নয়। ফ্যাসিবাদ ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধী; সমস্ত রকম গণতান্ত্রিক অধিকার, গণতান্ত্রিক সংগঠন ও ধ্যান-ধারণার পরিপন্থী। উগ্র জাতীয়তাবাদ ও যুদ্ধবাদকে ফ্যাসিবাদ প্রশ্রয় দেয় এবং সাম্রাজ্যবাদকে আহ্বান জানায়। এই তত্ত্ব মানবতা বিরোধী এবং বিশ্বশান্তির শত্রু। মানুষের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির পরিবর্তে ফ্যাসিবাদ দ্বন্দ্ব, কলহ ও সংকটকে স্বাগত জানায়। প্রকৃত বিচারে ফ্যাসিবাদকে কোন দার্শনিক তত্ত্বের মর্যাদা দেওয়া যায় না। এর পিছনে কোন ভাবাদর্শ নেই। তাই মুসোলিনীর পতনের পর ইতালীতে ফ্যাসিবাদের পতন হতে বিলম্ব হয়নি। আবার উগাণ্ডায় ইদি আমিন নিজেই নিজের ফ্যাসিবাদের পতন চাক্ষুস করেছেন। বস্তুত ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম অনুসারে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক শক্তির কাছে ফ্যাসিবাদী দানব বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য। স্পেন, চীন, জাপান ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশের ইতিহাস এই সত্যকে প্রমাণ করেছে। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমাধির উপর ফ্যাসিবাদের উগ্র জাতীয়তাবাদী উল্লাস, সাম্রাজ্যবাদী বিভীষিকা এবং সন্ত্রাসবাদী স্বৈরাচার ইতিহাসের কিছু অশুভ মুহূর্তের ঘটনা মাত্র। এ কখনই স্থায়ী হতে পারে না। গণতান্ত্রিক আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় পরিচালিত মানবগোষ্ঠীর হাতে ভবিষ্যতের বিজয় পতাকা উড্ডীন থাকবে— এ কথা অনস্বীকার্য।