রাষ্ট্রের কার্যাবলী সম্পর্কে মতানৈক্য: রাষ্ট্রের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যের সঙ্গে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। রাষ্ট্রের প্রকৃতি অনুসারে উদ্দেশ্য এবং উদ্দেশ্য অনুযায়ী ক্রিয়াকলাপ নির্ধারিত হয়। যুগে যুগে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও মৌলিক উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে মতভেদের অন্ত নেই। ফলে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি সম্বন্ধেও বিভিন্ন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রচলিত মতবাদগুলির মধ্যে দুটি যথা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদ প্রণিধানযোগ্য।
রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের সমন্বয়: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের সতর্ক পর্যালোচনার ফলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, রাষ্ট্রের কর্মপরিধি নির্ধারণের ব্যাপারে মতবাদ দুটির কোনোটিই এককভাবে যথেষ্ট নয়। ব্যক্তি-স্বাধীনতার উপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব আরোপ করে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সমষ্টিগত কল্যাণকে অবহেলা করে। এই মতবাদ রাষ্ট্রের ভূমিকাকে বিশেষভাবে সীমিত এবং অবাধ নীতি বা স্বাচ্ছন্দ্য নীতিকে প্রাধান্য দিয়ে দুর্বল ও দরিদ্র শ্রেণীকে বিত্তশালী সম্প্রদায়ের ক্রীড়নকে পরিণত করে। পক্ষান্তরে, সমাজতন্ত্রবাদ সমষ্টিগত কল্যাণের নামে ব্যক্তিজীবনের উপর রাষ্ট্রের সীমাহীন নিয়ন্ত্রণের পক্ষপাতী। সমাজতন্ত্রবাদ বিশ্বাস করে যে, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই জনগণের চরম কল্যাণ সাধিত হতে পারে। এই তত্ত্ব ও সম্পূর্ণভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। সেইজন্য আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ পরস্পর-বিরোধী এই দুই চরম মতবাদের সমন্বয় সাধনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের কর্মপরিধি নিরূপণের কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে বার্নস (Burns )-এর অভিমত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, আমরা যদি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের সমন্বয়ের ভিত্তিতে কোনো তত্ত্বের কথা ভাবতে পারি, তাহলে তা অধিকাংশ চিন্তাশীল ব্যক্তির কাছে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব হিসাবে বিবেচিত হবে। তিনি বলেছেন: If we could imagine an ideal at once individualistic and socialistic, such would be the most effective ideal for most thinking men.” এ প্রসঙ্গে বার্কার (Barker)-ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও সমষ্টিবাদের পার্থক্যকে প্রকৃত পার্থক্য হিসাবে মনে করেননি। তিনি বলেছেন: “…the current antithesis between collectivism and individualism is verbal rather than real.”
রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণবাদ বা আংশিক সমষ্টিবাদ: বস্তুত জনকল্যাণমূলক নীতিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের চরমতার মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করা হয়। জনকল্যাণের প্রয়োজনে এই তত্ত্বে ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের মধ্যে একটি সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। এই ব্যবস্থাকে অনেকে ‘রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা’ (State Regulation System) নামে অভিহিত করেন। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণবাদে ব্যক্তিগত মালিকানা, কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়। তবে জনকল্যাণের স্বার্থে যে সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও নিয়ন্ত্রণ কাম্য বলে বিবেচিত হয় কেবল সেই সকল ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের ভূমিকাকে সমর্থন করা হয়। সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপ সমর্থন করা হয় না। ম্যাক্নি (M’Kechnie) ও অনুরূপ ধারণা পোষণ করেন। তিনি বলেছেন: “…a true theory of the state must be socialistic and individualistic at once.” এই সকল রাষ্ট্র সমাজকল্যাণকর রাষ্ট্র বা আংশিক সমষ্টিবাদী রাষ্ট্র হিসাবে অভিহিত হয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে ও সমাজতন্ত্রবাদের মধ্যে বোঝাপড়া ও মীমাংসার মাধ্যমে এই রাষ্ট্রের কর্মপরিধি স্থিরীকৃত হয়। সমাজকল্যাণকর রাষ্ট্রব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজজীবনের সর্বাধিক কল্যাণ সাধন সম্ভব। সামগ্রিক বিচারে জনকল্যাণ সাধনই হল রাষ্ট্রের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ বিষয়ে কোনো মতপার্থক্য নেই।
রাষ্ট্রের সমাজকল্যাণ-মূলক ভূমিকা: এই সকল সমাজকল্যাণকর রাষ্ট্রের কার্যাবলী পর্যালোচনাই হল বর্তমান দিনের রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের চৌহদ্দি। এই তত্ত্ব অনুসারে বলা হয় যে পরিকল্পিত অর্থব্যবস্থা ব্যতিরেকে সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু এর জন্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করা দরকার হয় না। আংশিকভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প-বাণিজ্য থাকতে পারে। আবার রাষ্ট্রকে বর্তমানে প্রতিষ্ঠান বলা হয় না। রাষ্ট্রের সমাজকল্যাণমূলক ভূমিকা বর্তমানে সর্বজনস্বীকৃত। রাষ্ট্রের সক্রিয় সহযোগিতা ব্যতিরেকে সকল ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি অসম্ভব। রাষ্ট্রই মানুষের সর্বাধিক কল্যাণসাধনের নিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে। ব্যক্তি স্বাধীনতাকে বজায় রেখে সমাজ-জীবনের সার্বিক কল্যাণ সাধন করাই হল সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের নীতি ও আদর্শ।
রাষ্ট্রের অপরিহার্য ও ইচ্ছাধীন কার্য: এই সমন্বয়বাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ রাষ্ট্রের কার্যাবলীকে দু’ভাগে বিভক্ত করেন: (১) অপরিহার্য কার্য (essential function) এবং (২) ইচ্ছাধীন কার্য (optional or non essential functions)। অপরিহার্য বা অবশ্যকরণীয় কার্য বলতে সেই সকল ক্রিয়াকলাপকে বোঝায় যা সম্পাদনের উপর রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, স্থায়িত্ব এবং নিরাপত্তা নির্ভরশীল। তাই এইগুলি রাষ্ট্রের মৌলিক বা প্রাথমিক কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। এই সকল অত্যাবশ্যক কার্যাবলী বলতে, (ক) রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যান্য রাষ্ট্রের, (খ) রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির এবং (গ) ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক বিষয়ক যাবতীয় কর্তব্যকে বোঝায়। এর জন্য বৈদেশিক আক্রমণ থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা; আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য পুলিসি ব্যবস্থা; দেওয়ানি, ফৌজদারি ও অন্যান্য আইন ও বিচারব্যবস্থা প্রভৃতি করতে হয়। বর্তমানে নাগরিকদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বা অধিকার সৃষ্টি ও সংরক্ষণের দায়িত্বও রাষ্ট্রের অপরিহার্য কর্তব্যের অঙ্গীভূত বলে বিবেচিত হয়।
ইচ্ছাধীন কার্যের শ্রেণীবিভাগ: রাষ্ট্রের ইচ্ছাধীন কার্যাবলী রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, কিন্তু জনকল্যাণমূলক। ইচ্ছাধীন কার্যগুলির মূল লক্ষ্য হল জনকল্যাণ সাধন। সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সাধ্যমত ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রের ইচ্ছাধীন কার্যকলাপ আবার (ক) সমাজতান্ত্রিক (Socialistic) এবং (খ) অসমাজতান্ত্রিক (Non-socialistic) এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত।
অ-সমাজতান্ত্রিক কার্য: জনকল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে যে সকল কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে ব্যক্তি মালিকানায় হস্তক্ষেপ করতে হয় না তাদের ইচ্ছাধীন অ-সমাজতান্ত্রিক কার্যাবলী বলা হয়। এই সকল কার্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে যথাযথভাবে সম্পন্ন হতে পারে না। সেই জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। দৃষ্টান্ত হিসাবে শিক্ষা-ব্যবস্থা, জনস্বাস্থ্যমূলক ব্যবস্থা, পথঘাট, পোতাশ্রয়, জলাশয় প্রভৃতি নির্মাণ এবং অন্যান্য সেবামূলক কার্যাদি উল্লেখ করা যায়।
সমাজতান্ত্রিক কার্য: অপরপক্ষে জনকল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে যে সকল কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ব্যক্তিগত মালিকানা উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে তাদের ইচ্ছাধীন সমাজতান্ত্রিক কার্য বলে। এই সকল কার্য ব্যক্তিগত উদ্যোগের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন হয় এবং অধিকতর মঙ্গল সাধিত হয়। দৃষ্টান্ত হিসাবে শিল্প-বাণিজ্যের জাতীয়করণ, সামাজিক নিরাপত্তা ও শ্রমিক কল্যাণমূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা, রেল ও বিমানপথ পরিচালনা, বিদ্যুৎ সরবরাহ, সম্পদ ও সুযোগের ন্যায্য বণ্টন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যাও, ভারত প্রভৃতি অ-সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রও উপরিউক্ত দায়িত্বগুলি গ্রহণ করেছে এবং সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদন করছে।
সমাজতান্ত্রিক ও অ-সমাজতান্ত্রিক কার্যের পার্থক্য এখন গুরুত্বহীন: আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে রাষ্ট্রের ইচ্ছাধীন ও অত্যাবশ্যক কাজকর্মের সীমারেখা ক্রমশ সঙ্কুচিত ও অস্পষ্ট হয়ে আসছে। বর্তমানে জনসাধারণের ভালমন্দ ও সুখশান্তির সামগ্রিক দায়িত্ব রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হয়। ফলে সমাজতান্ত্রিক ও অসমাজতান্ত্রিক কার্যাবলীর মধ্যে সীমারেখার গুরুত্বও ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। সমষ্টির স্বার্থে রাষ্ট্র এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করে। সেইজন্য বর্তমানের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি ক্রমবর্ধমান ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়। তবে এই কারণে জনসাধারণকে স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হয় না। জনগণের ব্যক্তি-স্বাধীনতা যথাসম্ভব সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচী বাস্তবে রূপায়িত করার চেষ্টা করা হয়।
মার্কসীয় ধারণা: কিন্তু মার্কসবাদীদের মতানুসারে শ্রেণী-বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্র কখনই জনসাধারণের ব্যাপক কল্যাণ সাধন করতে পারে না। ধনবৈষম্যমূলক সমাজে আর্থনীতিক দিক থেকে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার হিসাবে রাষ্ট্র কাজ করে। একমাত্র শ্রেণীহীন, শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সর্বসাধারণের সর্বাধিক কল্যাণ সাধিত হতে পারে।
উপসংহার: দেশ ও কালভেদে এবং সামাজিক ও অর্থনীতিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের কার্যাবলীর পরিধি সম্পর্কিত ধারণারও পরিবর্তন হয়। তাই রাষ্ট্রের কর্মপরিধির কোনো সীমারেখা টানা সম্ভব নয়। তবে আধুনিক রাষ্ট্র প্রাচীন পুলিসি রাষ্ট্রের ধারণা পরিত্যাগ করে সমাজকল্যাণের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জনকল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
Leave a comment