সমাজতন্ত্রবাদের পক্ষে যুক্তি

সমাজতন্ত্রবাদে বিদ্যমান আর্থ-রাজনীতিক ব্যবস্থার তীব্র বিরূপ সমালোচনা করা হয়। এবং এই সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সমাধানের একমাত্র উপায় হিসাবে সমাজতন্ত্রবাদের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। জনসাধারণের দুঃখ-যন্ত্রণা ও বঞ্চনার জন্য বিদ্যমান ব্যবস্থাকে দায়ী করে সমাজতন্ত্রবাদকেই এর থেকে অব্যাহতি লাভের একমাত্র পথ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। লাভেলাই বলেছেন: “Socialism has ren dered a real service by calling attention to the evils and iniquities of the existing social order and by awakening in the hearts of all good men the desire to apply a remedy.” ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার তীব্র সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজতন্ত্রবাদিগণ সমাজতন্ত্রের সপক্ষে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেন।

(১) নৈতিক যুক্তি: অর্থনৈতিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিতে ধনতন্ত্রের সৃষ্টি হয়। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধনিক শ্রেণী ব্যক্তিগত মুনাফার উদ্দেশ্যে নানা নীতিবিরুদ্ধ পন্থা অবলম্বন করে। ধনবৈষম্য তীব্রতর হয়। দুঃখ, দারিদ্র্য ও বঞ্চনার এক বীভৎস অবস্থার সৃষ্টি হয়। এর ফলে মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ সম্ভব হয় না; নৈতিক অবনতি ঘটে এবং জাতীয় অবনতি সূচিত হয়। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে এই অমানবিক অবস্থার অবসান ঘটে এবং সমাজ হয় শোষণশূন্য। সকলের ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি হবে এবং জনগণের নৈতিক মান উন্নত হবে। গার্নার তাঁর Political Science and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “The theory of Socialism, it is argued, is founded on principles of justice and right.” The land and the mineral wealth contained therein should belong equally to all, not to few.

(২) দার্শনিক যুক্তি: মানবসমাজে ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে সমষ্টিকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। কারণ সমষ্টির কল্যাণেই ব্যক্তির কল্যাণ। কিন্তু ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যভিত্তিক ধনতন্ত্র ব্যক্তির কল্যাণের উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে ব্যক্তিস্বার্থের বেদীমূলে সমষ্টির স্বার্থকে বিসর্জন দেয়। পক্ষান্তরে, সমাজতন্ত্র সমষ্টির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি বিধানের মাধ্যমে সমষ্টির অংশ হিসাবে ব্যক্তিরও কল্যাণ সাধন করে। সুতরাং সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে সামগ্রিক কল্যাণ এবং সকলের সুষম উন্নতি সম্ভব। সমাজতন্ত্রবাদে ব্যক্তির পরিবর্তে সমাজের উপর গুরুত্ব অরোপ করা হয়। ব্যক্তি মানুষের সংকীর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থকে বেড়ে উঠার সুযোগ দেওয়া হয় না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমগ্র সমাজ এমনভাবে সংগঠিত হয় যে, অল্প সময়ের মধ্যে সর্বাধিক সুফল লাভ করা সম্ভব হয়। গার্নার তাঁর Political Science and Government শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “….that the good of all is paramount to that of a few, and that in order to secure the good of the greatest number the welfare of the individual a such must be subordinated to that of the many.”

(৩) রাজনৈতিক যুক্তি: ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ধনী-নির্ধনের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্যের সৃষ্টি হয় এবং সমানাধিকারের দাবি উপেক্ষিত হয়। এর ফলে গণতন্ত্র মিথ্যায় পর্যবসিত হয়। লেনিন বলেছেন: “In capitalist society we have a democracy that is curtailed wretched, false; a democracy only for the rich, for the minority.” সমাজতন্ত্রে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তার ফলে রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চয়তা লাভ করে। গার্নার বলেছেন: “Collective ownership and management, it is maintained, is throughly democratic; indeed, Socialism is the economic complement of democracy.” আবার এই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিতেই সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতার সৃষ্টি হয়। সমাজতন্ত্র সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতার বিরোধী এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বশান্তির পরিপোষক। 

(৪) আর্থনীতিক যুক্তি: একচেটিয়া কারবার, মুনাফাপন্থী মূলধন, শ্রমিক শোষণ প্রভৃতি ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত হয়। সেইজন্য ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধনবৈষম্য, দারিদ্র্য, বেকারী, শ্রেণী সংগ্রাম প্রভৃতি তীব্র আকার ধারণ করে। সমাজতন্ত্র ধনতন্ত্রের এই কুফলগুলি দূর করে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত করে। সমাজে শ্রেণীবৈষম্যের অবসান ঘটে এবং জনগণ শোষণমুক্ত হয়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক পরিকল্পনার উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পায়, মূল্যস্তর হ্রাস পায় এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। 

(৫) বৈজ্ঞানিক যুক্তি: ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের যোগ্যতমের উদ্‌দ্বর্তনের নীতি (survival of the fittest) মানবসমাজে অচল। এই নীতি জীবজগতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও মানবসমাজে প্রয়োগ করা যায় না। মনুষ্যত্বের বিকাশই হল মানব সভ্যতার লক্ষ্য। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সকলের মনুষ্যত্ব, বুদ্ধিবৃত্তি, নীতিবোধ প্রভৃতির পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভবপর নয়। সমাজতন্ত্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে মানুষের সহজাত সমাজচেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। মানবতার মহান আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাতেই কেবল সকল মানুষের সর্বাঙ্গীণ ও পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব।

(৬) অনিয়ন্ত্রিত প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতা: বিদ্যমান ব্যবস্থায় বর্তমান প্রতিযোগিতাকে সমর্থন করা যায় না। কারণ এ ধরনের প্রতিযোগিতার পরিণামে অন্যায়-অবিচারের সৃষ্টি হয়। এবং ক্ষুদ্র প্রতিযোগীরা ধ্বংস হয়ে যায়। শুধু তাই নয় বিদ্যমান প্রতিযোগিতার ব্যবস্থায় ব্যাপক আর্থনীতিক অপচয় ঘটে। পরিষেবামূলক কাজকর্মের ক্ষেত্রে বিকল্পের আধিক্যের কারণে অমিতব্যয়িতার সৃষ্টি হয়। বিদ্যমান প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা অনিয়ন্ত্রিত। তারফলে অতি উৎপাদন, দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য হ্রাস, মজুরী হ্রাস, শ্রমিকের নিয়োগ ছাঁটাই প্রভৃতি ঘটতে থাকে। এই অবস্থা থেকে অব্যাহতির উপায় হল প্রতিযোগিতার অবসান এবং সহযোগিতামূলক বিধি-ব্যবস্থার প্রচলন। তার ফলে সুযোগ-সুবিধার সমতা, রুজি-রোজগারের সমতা এবং উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের সুফল পাওয়া যাবে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থনীতিক ক্ষেত্রে সত্বর উন্নয়নের সুফলকে সুনিশ্চিত করা যায় এবং আর্থনীতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও পুঁজিবাদের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলিকে অপসারণ করা যায়। পরিকল্পিত অর্থনীতি হল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম অঙ্গ। আর্থনীতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বিদ্যমান সম্পদ-সামগ্রীর সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার সম্ভব হয়। সম্পদের অপচয় ও অমিতব্যয়িতা রোধ করা যায়। অপচয়-অমিতব্যয়িতা হল প্রতিযোগিতার কুফল। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতার পথ প্রশস্থ করা হয়।

(৭) উৎপাদনের উৎসসমূহের রাষ্ট্রীয় মালিকানা: বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের উৎসসমূহ মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে থাকে। তারাই সর্বসাধারণকে শোষণ করে। মালিক শ্রেণীই জমিজমা, পুঁজি ও উৎপাদনের উৎসসমূহের সর্ববিধ সুফল ভোগ করে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই অবস্থার অবসান ঘটবে। দেশের সকল ভূমি, মূলধন ও উৎপাদনের যাবতীয় উৎসের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের হাতে আসবে। স্বভাবতই জনসাধারণ এর সুফল পাবে। উৎপাদনের উৎসসমূহের রাষ্ট্রীয় মালিকানা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম অপরিহার্য উপাদান এবং শোষণমুক্তির পথ।

(৮) সংস্কারের সহায়ক: সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দর্শন সংস্কারসাধনমূলক প্রক্রিয়া ও উদ্যোগকে উজ্জীবিত করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ত্রুটি-বিচ্যুতিসমূহ প্রকট হয়ে পড়লে সংস্কারপন্থীরা বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার অপশাসনের অবসানের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে সচেতন হন। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থা সংস্কারমূলক উদ্যোগ-আয়োজনের সহায়ক বলে পরিগণিত হয়। কারণ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশেষাধিকার, স্বৈরাচার, নিষ্ঠুরতা প্রভৃতির অবসান ঘটে। বিশ্বাস করা হয় যে সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজের মৌলিক পরিবর্তন সাধন সম্ভব হবে।

(৯) উৎপাদনের মান ও পরিমাণ বৃদ্ধি: সমাজতান্ত্রিক উৎপাদনের ব্যবস্থা মুনাফামুখী নয়। এই ব্যবস্থায় উৎপাদনমূলক উদ্যোগ-আয়োজন বৃদ্ধি পায়। কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসানের পর উৎপাদনের উপাদানসমূহের সামাজিক মালিকানার সুবাদে শ্রমজীবী জনতার মধ্যে এক নতুন চেতনার সৃষ্টি হয়। মেহনতী মানুষ তখন সমাজের জন্য বা নিজেদের জন্য কাজ করে। স্বভাবতই তারা স্বতস্ফূর্তভাবে অধিক কাজ অধিকতর ভালোভাবে করে। স্বভাবতই উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদনের মানও উন্নত হয়।

(১০) রাষ্ট্রের ভূমিকার উপর গুরুত্ব আরোপ: সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং রাষ্ট্রের কার্যকলাপের পরিধিকে অতিমাত্রায় প্রসারিত করা হয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দর্শনে রাষ্ট্রের কাজকর্মের সীমানাকে অতিমাত্রায় সঙ্কুচিত করা হয়। অনেক কিছু করা থেকে রাষ্ট্রকে বিরত রাখা হয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণা অনুযায়ী রাষ্ট্র ব্যক্তিস্বার্থের বিরোধী। বিপরীতক্রমে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রকে ব্যক্তিস্বার্থ তথা মানবতার সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসাবে মর্যাদা দেওয়া হয়। গ্রণলান্ড নামে এক সমাজবিজ্ঞানী এ বিষয়ে বলেছেন: “The state is not some power outside the people but the social organism itself, and as an organism it is destined to grow until it embraces all social activities.”

(১১) সামাজিক কল্যাণ সাধন: সমাজতন্ত্রবাদ সামাজিক কল্যাণ সাধনের সহায়ক। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় জনসাধারণের দুঃখ-কষ্টের অবসানের ব্যবস্থা হয়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষের সুখ সমৃদ্ধি সুনিশ্চিত হয়। সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় সম্পাদিত অধিকাংশ রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী হল জনকল্যাণমূলক। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিভিন্ন নাগরিক পরিষেবার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সদর্থক ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকলকে সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজে রাষ্ট্রের কাজকর্ম সীমাবদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত নয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য নয় সকলের জন্য সদর্থক ও কল্যাণমূলক ভূমিকা পালন করে। এরিচ ফ্রম (Erich Fromm) এ বিষয়ে বলেছেন: “The aim of socialism is man’s emancipation, his restoration to the unalienated, uncrippled indi vidual who enters into a new, rich, spontaneous relationship with his fellowmen and with nature.”

(১২) গণতান্ত্রিক: পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটে না। সামাজিক অন্যায় অবিচার ও অসাম্যের কারণে গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা পদদলিত হয়। শ্রেণীবিভাজনের কারণে গণতান্ত্রিক মানসিকতা বিকশিত হয় না। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাম্যের আদর্শের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তার ফলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ-পরিমন্ডলের সৃষ্টি হয়। গার্নারকে অনুসরণ করে জোহারী বলেছেন: “Collective ownership and management is thoroughly democratic; indeed, socialism is the economic complement of democracy; it rests upon both ethical and altruistic principles and is the only system under which efficiency and justice in production can be secured and under which a full and harmonious development of individual character, can be realised.”


সমাজতন্ত্রবাদের বিপক্ষে যুক্তি

সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থা বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। সমালোচকরা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার প্রতি দৃষ্টি ও আকর্ষণ করেন। সমাজতন্ত্রবাদ অবিমিশ্র গুণের অধিকারী নয়। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সমর্থকরা বিভিন্ন দিক থেকে সমাজতন্ত্রবাদের সমালোচনা করেন।

ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিরোধী: সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাধীনতাকে অবহেলা করা হয়। সমষ্টিগত কল্যাণের নামে সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিজীবনের উপর যে সর্বাঙ্গীণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় তা ব্যক্তি স্বাধীনতার অস্বীকৃতি মাত্র। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার সমূহ আশংকা থাকে। কারণ এই ব্যবস্থায় ব্যক্তির ইচ্ছা রাষ্ট্রের দ্বারা অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রিত হয়। জনজীবনের সকল বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়। স্পেনসারের মতে এই অবস্থা ব্যক্তি মানুষের কাছে দাসত্ব স্বরূপ। স্পেনসার বলেছেন: “Each member of the community as an individual would be a slave of the community as an individual would be a slave of the community as a whole.” সুতরাং সমাজতন্ত্রবাদ ব্যক্তি-স্বাধীনতার পরিপন্থী। লীকও অনুরূপ মত পোষণ করেন। লী বলেছেন: “Under socialism freedom is gone.” There is nothing but the rule of the elected boss. The worker is commanded to his task and obey he must. There is nothing like it among us at the present day except within melancholy precinets of the penitentiary. There and there only the socialist system is in operation.” অথচ ব্যক্তি-স্বাধীনতা ছাড়া ব্যক্তিজীবনের স্বাভাবিক বিকাশ অসম্ভব। এ বিষয়ে স্যার আরস্কাইন মে (Sir Erskine May)-র একটি মন্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও প্রণিধানযোগ্য। Democracy in Europe শীর্ষক গ্রন্থে তিনি বলেছেন: (In a socialist state the man) is no more than a mechanical part of the whole community; he has no free will, no independence of thought or action. Every act of his life is prescribed for him. Individual liberty is surrendered to the state; everything that men pride most in life is to be taken out of their hands. Their religion, their education, the management of their families, their property, their industry, their earnings are dictated by the ruling powers. Such a scheme of government, if practicable, would create a despotism exceeding any known in the history of the world.”

গণতন্ত্রের অস্বীকার: সমাজতন্ত্রে প্রকৃতপক্ষে একনায়কতন্ত্রই কায়েম হয়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রকে অত্যধিক প্রাধান্য দেওয়া হয়। এর ফলে রাষ্ট্র অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার অধিকারী হয়। অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা স্বৈরাচারের পথ প্রশস্ত করে এবং একনায়কতন্ত্রের ভিত্তিকে দৃঢ় করে। ব্যক্তিজীবনের সকল ক্ষেত্রে সর্বাত্মক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়। ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকে না। ব্যক্তির স্বকীয়তা নষ্ট হয়, জীবনে বৈচিত্র্য থাকে না, যান্ত্রিকভাবে ব্যক্তিজীবন পরিচালিত হয়। সুতরাং সমাজতন্ত্র গণতন্ত্রের বিরোধী। গ্রে (Gray) তাঁর The Socialist Tradition শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “There may be a divinely inspired man; there may even be a heaven-sent statesmen; but there was never a divinely inspired state. In the great moments of life, man is necessarily, and perhaps lamentably, alone. For every life is a pilgrimage, and every true pilgrimage ends in solitude.”

শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়: সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। তার ফলে সরকারের কর্মকুশলতার অভাব দেখা দেয়। রাষ্ট্রের কার্যপদ্ধতি ধীরগতি সম্পন্ন ও যান্ত্রিক হয়ে পড়ে এবং নতুন উদ্যোগ ও পরীক্ষামূলক পদ্ধতি গ্রহণের সুযোগ থাকে না। উৎপাদন ব্যবস্থায়ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। সুশাসন ও জনকল্যাণ সাধন সম্ভব হয় না। আবার রাষ্ট্রের ক্ষমতা অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় দুর্নীতি, উৎকোচ, স্বজনপ্রীতি প্রভৃতি শাসন-ব্যবস্থাকে পঙ্গু ও কলঙ্কিত করে। তার ফলে সরকারের নৈতিক মান অবনমিত হয়। সকলের জন্য প্রয়োজনীয় সকল কিছু সরবরাহ করা সরকারের পক্ষে সহজে সম্ভব হবে না। সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে। বিষয়টি বহুলাংশে নির্ভর করবে তাঁদের উপর যাঁরা সরকারী যন্ত্রকে পরিচালনা করবেন। চাহিদা-যোগানের স্বাভাবিক নিয়মের বিরুদ্ধে শাসকগোষ্ঠীর মর্জিমাফিক উৎপাদন-বণ্টন পরিচালিত হবে। উৎপাদনের মান ও পরিমাণ নিম্নমুখী হওয়ার আশঙ্কাকে অস্বীকার করা যাবে না। জোহারী তাঁর Principles of Modern Political Science শীর্ষকগ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন : ‘‘On the political Side; it is said that socialism overestimates the capacity and efficiency of state. The functions of the state should be maximised to a certain extent. To say that state can manage all affairs and so it should be a total state is to vitiate the entire scope of state activity.”

নতুন শ্রেণীর সৃষ্টি: জেমস্ বার্নহ্যামের মতে সমাজতান্ত্রিক সমাজও শ্রেণীহীন নয়। পুঁজিপতি শ্রেণী সমাজতন্ত্রে বিলুপ্ত হলেও পদস্থ সরকারী কর্মচারী, ব্যবস্থাপক, পরিচালক প্রভৃতি ব্যক্তিদের নিয়ে এক নতুন পরিচালক শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এই শ্রেণীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত হিসাবে বার্নহ্যাম রাশিয়ার শাসনব্যবস্থার উল্লেখ করেছেন। বার্নহ্যাম বলেছেন: “The state will be the ‘property of the managers. And that will be quite enough to place them in the position of a ruling class.”

আমলাতান্ত্রিক: সমাজতন্ত্রে সকল কিছু রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। ফলে সরকার ক্রমেই আমলাতান্ত্রিক রূপ ধারণ করে। আমলাতন্ত্রের ক্ষমতাও অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ গণতন্ত্রের পরিপন্থী। সুতরাং এই ব্যবস্থা সমর্থনযোগ্য নয়।

দায়িত্বহীনতার কুফল: সমাজতন্ত্র মানুষের প্রকৃতি বিরুদ্ধ। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে স্বার্থপর। এই অবস্থায় সমাজতান্ত্রিক নীতি সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে না। সমষ্টির কল্যাণের দায়িত্ব সকলের বলে প্রকৃতপক্ষে এ দায়িত্ব কারও নয়। ফলে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দায়িত্বহীনতার কুফল দেখা দেয়।

ব্যক্তিগত কর্মোদ্যম বিনষ্ট হয়: ধনবিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুসারে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে উৎপাদনের বিস্ময়কর উন্নতি ঘটে। ধনতান্ত্রিক শিল্প-সভ্যতা এর দৃষ্টান্ত। সমাজতন্ত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার অবসান ঘটিয়ে অর্থনীতির ক্ষেত্রে অবনতি সূচিত করে। তা ছাড়া এতে মানুষের ব্যক্তিগত উদ্যমও নষ্ট হয়। সমাজতন্ত্রে উৎপাদন ব্যবস্থার উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। তার ফলে ব্যক্তিগত কর্মোদ্যোগ বিনষ্ট হয় এবং সামগ্রিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রম ও উৎপাদনের জন্য উৎসাহপ্রদানমূলক কোন পারিতোষিক দেওয়া হয় না। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পারস্পরিক প্রতিযোগিতা থাকে না। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার অস্বীকৃত। এ রকম অবস্থায় কাজকর্মের ব্যাপারে শ্রমিক সাধারণের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার অভাব দেখা দেওয়ার আশঙ্কা আছে। পরিবার-পরিজনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যই মানুষ উৎসাহ সহকারে কাজকর্মের সামিল হয়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ সবের সুযোগ নেই। স্বভাবতই ব্যক্তি মানুষের মধ্যে বাড়তি উদ্যোগ-উদ্দীপনা বড় একটা পরিলক্ষিত হয় না। সমাজ বা সর্বসাধারণের জন্য কাজ করার বিষয়টি মানুষের মধ্যে সাধারণভাবে তেমন কোন আগ্রহ-আন্তরিকতার সৃষ্টি করে না। মহাজন (V. V. Mahajan) তাঁর Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “It is contended that socialism will result in a ‘slackening of energy, a cessation of enteprise, a fall in inventions, a stagnation of industry, fatal alike to progress and to productivity.”

বণ্টন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা: জাতীয় সম্পদের বণ্টনের ব্যাপারে সমাজতন্ত্র কোন সন্তোষজনক উপায়-পদ্ধতির হদিশ দিতে পারেনি। সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে অনেকে সমান মজুরীর কথা বলেন। কিন্তু এই নীতি অসঙ্গত। কারণ অলস-অকর্মণ্য এবং কর্মদক্ষ ও বিচক্ষণদের পারিশ্রমিক সমান হওয়া অন্যায়। বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ ব্যক্তিবর্গের পারিতোষিক গুণগত যোগ্যতা অনুসারে নির্ধারিত হওয়া আবশ্যক। আবার সমাজতন্ত্রে বণ্টন ব্যবস্থা প্রসঙ্গে এমন কথাও বলা হয় যে, ‘সামর্থ্য অনুসারে কাজ এবং প্রয়োজন অনুসারে পারিশ্রমিক। এই নীতিও ত্রুটিপূর্ণ। ব্যক্তি মানুষের পরিমাপ করা সহজ কথা নয়। আবার প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুসারে কাজ করবে এমনও আশা করা যায় না।

ধর্মবিরোধী: সমাজতন্ত্রে ধর্মের বিরোধিতা করা হয়। বলা হয় যে, ধর্ম পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিপোষক। আরও বলা হয় যে, ধর্ম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সহায়ক। ব্যক্তিগত সম্পত্তি প্রতিষ্ঠান হিসাবে ধর্মীয় সমর্থন পেয়ে থাকে। সমাজতন্ত্রীরা বিশ্বাস করেন যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসানের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মও অবলুপ্ত হবে। সমাজতন্ত্রীদের এই সমস্ত ধ্যান-ধারণা বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক-রহিত।

ইতিহাসের বিকৃতি ও ঘটনার অপব্যাখ্যা: সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ হিসাবে বলা হয় যে, তাঁরা ইতিহাসকে বিকৃত করেন এবং ঘটনার অপব্যাখ্যা করেন। সমাজতন্ত্রীদের ইতিহাসের আর্থনীতিক ব্যাখ্যা হল অপব্যাখ্যা। মানবসভ্যতার ইতিহাসে আর্থনীতিক উপাদানসমূহের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। এতদ্‌সত্ত্বেও এমন দাবি করা যাবে না যে, আর্থনীতিক আবেদনই হল মানুষের যাবতীয় কাজকর্মের পিছনে একমাত্র ক্রিয়াশীল শক্তি। সমাজতন্ত্রের আরও কিছু ধারণাকে স্বীকার বা সমর্থন করা যায় না। এই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক ধারণাগুলি হল: ‘শ্রমই মূল্য সৃষ্টি করে’, ‘পুঁজিপতিরা শ্রমিকের শত্রু’, ‘ধনী ও দরিদ্রদের স্বার্থের মধ্যে বিরোধ অনপনেয়’, ‘ধনী ও দরিদ্র পরস্পর বিরোধী শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত’ প্রভৃতি।

মানব প্রকৃতির ব্যাখ্যা ঠিক নয়: মানব প্রকৃতি সম্পর্কিত সমাজতন্ত্রীদের বিচার-বিশ্লেষণ সঠিক নয়। সাম্যের উদ্যোগ-আয়োজন হল একটি মহৎ আদর্শ। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু কিভাবে সাম্যের আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করা যাবে তা সম্যক ও সুনির্দিষ্টভাবে বলা মুস্কিল। আবার সর্বক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সাম্য কতটা অভিপ্রেত সে বিষয়েও দ্বিমতের অবকাশ আছে। সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন উৎপাদন ব্যবস্থা এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে অস্বীকার করা হয়। কিন্তু ব্যক্তি মানুষের মধ্যে অর্জনের বাসনা বর্তমান থাকে। এই বাসনা এক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। অনুরূপভাবে আবার সমাজতন্ত্রে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থার বিরোধিতা করা হয়। অথচ প্রত্যেক মানুষের প্রকৃতিতেই প্রতিযোগিতার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।

শিল্প-বাণিজ্যের বিকাশের পরিপন্থী: সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশের সহায়ক নয়। ব্যবসাকে সমাজতন্ত্রে ‘ব্ল্যাকমেল’ বলা হয়। বাজারের ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতাকে সমর্থন করা হয় না। আধুনিককালের ব্যবসা-বাণিজ্যের যাবতীয় বিনিময় ব্যবস্থা ও পন্থা-পদ্ধতিকে স্বীকার বা সমর্থন করা হয় না। সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার প্রচার শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শান্তি ও প্রগতির পরিপন্থী। শ্রেণীসংগ্রাম, সন্ত্রাস ও অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্ম, হরতাল-ধর্মঘট, শ্রমিক অসন্তোষ প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে দেশের শিল্প-বাণিজ্য ও আর্থনীতিক অবস্থার অগ্রগতি অসম্ভব।

ব্যক্তিগত সম্পত্তির ব্যাপারে সমাজতন্ত্রীদের বক্তব্য উদ্ভট: সমাজতন্ত্রবাদীদের বক্তব্য অনুযায়ী ব্যক্তিগত মালিকানাধীনে উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থা বিবিধ সমস্যার সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক মালিকানাধীন উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সমস্যাসমূহের সমাধান সম্ভব। অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানাধীন উৎপাদন ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে স্বীকার বা সমর্থন করা হয় না। ব্যক্তিগত সম্পত্তির ব্যাপারে সমাজতন্ত্রীদের এই অবস্থান স্বীকার বা সমর্থন করা যায় না। ব্যক্তিগত সম্পত্তি হল একটি অতি প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। মানবসভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানটির সুদীর্ঘকালের সদর্থক অবদান অনস্বীকার্য। সুতরাং সম্পত্তির ব্যক্তিগত অধিকারকে অস্বীকার করলে আর্থনীতিক বিষয়াদিতে মানবসভ্যতার বিকাশ ব্যাহত হবে। সমাজতন্ত্রবাদে আর্থনীতিক সাম্যের উপর মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিন্তু উদারনীতিক রাষ্ট্রদার্শনিকরা এই বিষয়টিকে সমর্থন করেননি। তাঁদের অভিমত অনুযায়ী আর্থনীতিক সাম্যের বিষয়টি অর্থহীন, উদ্ভট বা বহুলাংশে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক রহিত। জোশেফ স্যুমপিটার তাঁর Capitalism, Socialism and Democracy শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: First of all, we must see whether or not there is anything wrong with the pure logic of a socialist economy. For although no proof of soundness of that logic will ever convert anyone to socialism or, in fact, prove much for socialism as a practical proposition, proof of logical unsoundness would in itself suffice to convict it of inherent absurdity.”


দুর্বল ও অক্ষম ব্যক্তিদের স্বার্থে আইন প্রণয়ন করে সমাজতন্ত্র এদের প্রশ্রয় দেয়। ফলে সমাজ অযথা অকর্মণ্য ব্যক্তিদের দ্বারা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। সমাজবিজ্ঞানী লেভেলআই এ বিষয়ে বলেন: “….socialism rests on the principle that the able industrious and prudent should share with the stupid, idle and the improvident whatever they obtained as reward of their energies and virtues.”


বিশ্বে সভ্যতা-সংস্কৃতির সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে ধনতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অবদান অনস্বীকার্য। তা ছাড়া ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স প্রভৃতি ধনতান্ত্রিক দেশের শ্রমিক সাধারণের জীবনযাত্রার মান বেশ উন্নত। কারণ এই সকল দেশে শ্রমিক কল্যাণকর বহুবিধ বিধি-ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তুলনামূলক বিচারে সমাজতান্ত্রিক দেশের শ্রমিকদের জীবনযাত্রা নিম্নমানের।


সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রেণী-সংগ্রামের বিষাক্ত হাওয়া বর্তমান থাকে। সুশাসনব্যবস্থার আদর্শ, শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতার পরিবেশ নষ্ট হয়। ক্ষমতাসীন শ্রেণীর প্রতি অবিশ্বাস ও হিংসার ভাব সৃষ্টি হয়। এর ফলে ঐক্য ও সংহতি নষ্ট হয়। মহাজন মন্তব্য করেছেন: “Socialism has undesirable effects on society. It encourages class hatred…. Socialism injects into the body politic a poison which inflames every wound and turns every trivel scratch into a malignant ulcer”

সমাজতন্ত্রবাদের মূল্যায়ন

সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে উপরিউক্ত সমালোচনাসমূহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তত্ত্বসর্বস্ব, অতিরঞ্জিত ও দুর্বল। তাই ব্যাপক বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও সমাজতন্ত্রের মূল আদর্শ মোটেই দুর্বল হয়নি। বিশ্বের বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশের কল্যাণকামী নীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা, অর্থনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগতিকে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। তা ছাড়া সমাজতন্ত্র হল বর্তমান বিশ্বের যুগধর্ম এবং গণতন্ত্রের পরিপূরক। গণতন্ত্রের মূল আদর্শ হল সাম্য ও ন্যায়। আর সমাজতন্ত্র ও সাম্য, সমানাধিকার প্রভৃতি ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। রাজনীতিক সাম্য বা স্বাধীনতা গণতন্ত্রকে সার্থক করে না; অর্থনৈতিক সাম্যই গণতন্ত্রকে সফল ও সার্থক করে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই অর্থনৈতিক সাম্যের স্বীকৃতি, ব্যক্তিজীবনের পরিপূর্ণ বিকাশ ও গণতন্ত্রের সার্থক রূপায়ণ সম্ভব। এভাবেই ব্যক্তি ও সমাজের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধন সম্ভব। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সাম্যের প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। তাই গণতন্ত্র ব্যর্থ হতে বাধ্য। একমাত্র সমাজতন্ত্রবাদই উদারনৈতিক গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করতে পারে এবং এমন এক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীন বিকাশ হবে সকলের স্বাধীন বিকাশের শর্ত। ‘কমিউনিস্ট ইস্তাহার’ (Communist Manifesto) -এ মার্কস ও এঙ্গেলস্ বলেছেন: “Free development of each is the condition for the free development of all.” এ প্রসঙ্গে জোহারীর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর Principles of Modern Political Science শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “All men cannot be equalised in a way desired by the socialists and, if it were done, it would lead to social disaster. Society according to the saying of J. F. Stephen, is like a pack of cards which remain the same after any number of shuffles.”