অধিকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের স্বরূপ অনুধাবন করা হয়: ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে ‘অধিকার’ সম্পর্কে একটি অধ্যায় জুড়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাছাড়া ল্যাস্কির Author ity in Modern State গ্রন্থেও অধিকার সম্পর্কে আলোচনা আছে। A Grammar of Politics গ্রন্থের ‘অধিকার’ শীর্ষক অধ্যায়ের গোড়াতেই তিনি বলেছেন যে, নিজেদের সুখ-সমৃদ্ধির স্বার্থেই মানুষ রাষ্ট্র গঠন করেছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অধিকার স্বীকার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। এই দায়িত্ব পালনের জন্যই রাষ্ট্র আইন প্রণয়ন করে এবং প্রণীত আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা করে। এই কারণে অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত হল ব্যক্তি মানুষের অধিকার কতটুকু স্বীকার করা হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে কোন রাষ্ট্রের চরিত্র বিচার করে দেখতে হবে। স্বীকৃত অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতেই প্রত্যেক রাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্র অনুধাবন করা যায়। ল্যাস্কি বলেছেন: “Every state is known by the rights that it maintains.” অধিকারের মাধ্যমেই বোঝা যায় কোন একটি রাষ্ট্র ধনতান্ত্রিক নাকি সমাজতান্ত্রিক। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনীতিক অধিকারের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আবার সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অগ্রাধিকার পায় বিভিন্ন আর্থনীতিক অধিকার।

অধিকারের অর্থ সম্পর্কে আলোচনার আগে, অধ্যাপক ল্যাস্কি অধিকার সম্পর্কে কতকগুলি প্রচলিত ধারণার উল্লেখ করেছেন এবং সংশ্লিষ্ট ধারণাগুলিকে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করেছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা আবশ্যক। অধ্যাপক ল্যাস্কি নিম্নলিখিত প্রচলিত ধারণাসমূহের সমালোচনা করেছেন।

(ক) রাষ্ট্র অধিকারের স্রষ্টা নয়: অধিকার সম্পর্কে একটি প্রচলিত ধারণা হল যে, অধিকারসমূহের স্রষ্টা হল রাষ্ট্র। কিন্তু ল্যাস্কির মতানুসারে অধিকার রাষ্ট্র সৃষ্টি করে না; রাষ্ট্র কেবলমাত্র অধিকারসমূহকে স্বীকৃতি প্রদান করে। রাষ্ট্রের এই স্বীকৃতি প্রদানের আগেও অধিকারের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়।

(খ) হারানো উত্তরাধিকারের পুনরুজ্জীবন নয়: আর একটি প্রচলিত ধারণা অনুসারে বলা হয় যে অধিকার হল শৈশবে প্রাপ্ত কোন জাতির কতকগুলি ঐতিহাসিক শর্তের অধিকার। অর্থাৎ মানুষ শৈশবে যে সমস্ত ঐতিহাসিক শর্ত ভোগ করত, কিন্তু কালক্রমে তার অবসান ঘটে, তার পুনরুদ্ধারকে অধিকার বলা যায় না। হারিয়ে যাওয়া উত্তরাধিকারের পুনরুজ্জীবন (recovery of lost inheritance)-কে অধিকার বলা যায় না। যেমন, ধনী পিতার সন্তান পৈতৃক সম্পদ হারিয়ে দরিদ্র হয়ে পড়েছে, তাই তার ধনসম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া দরকার—এ রকম ধারণা ভ্রান্ত। ল্যাস্কির মতানুসারে অধিকার সম্পর্কিত এই ধারণা স্থূল, ভ্রান্ত এবং ক্ষতিকর।

(গ) অধিকার চিরন্তন নয়: অনেকের মতানুসারে মানুষের অধিকার হল চিরন্তন। এবং এই অধিকারের পরিবর্তন হয় না। কিন্তু এই ধারণাও যথার্থ নয়। সমাজের প্রাত্যহিক জীবনধারার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের অধিকারের বিষয়টি আলোচনা করা আবশ্যক। সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হলে মানুষের অধিকারেরও পরিবর্তন ঘটে। সব কিছু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতেই যাচাই করা দরকার। কালের পরিবর্তন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে সমাজব্যবস্থারও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এবং তার ফলে মানুষের অধিকারেরও পরিবর্তন ঘটেছে।

(ঘ) অধিকার ইচ্ছা পূরণের দাবি নয়: আর একটি ধারণা অনুসারে বলা হয় যে, আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তির দাবি হল অধিকার। ইংরেজ দার্শনিক হবস্ এই ধারণা পোষণ করতেন। এই ধারণা অনুসারে বলা হয় যে, আকাঙ্ক্ষা পূরণের অধিকার প্রত্যেক ব্যক্তিরই আছে। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতানুসারে, ব্যক্তির সকল আকাঙ্ক্ষা পুরণের দাবিকে সমর্থন করা যায় না। যেমন, মানুষ খুন করার ইচ্ছা পুরণের দাবিকে অধিকার বলা যায় না।

(ঙ) প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা অধিকার নয়: আর একটি প্রচলিত ধারণা অনুসারে অধিকার হল প্রাকৃতিক বিন্যাস বা শৃঙ্খলার প্রতিরূপ (reflection of natural order)। কোন প্রাকৃতিক অবস্থা বা প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার প্রতিফলনকে অধিকার আখ্যা দেওয়া যায় না। কারণ সময়ের পরিবর্তন এবং সামাজিক কার্যপ্রক্রিয়ার অদলবদল অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রাকৃতিক বিন্যাস বা অবস্থার পরিবর্তনও অবধারিত। সুতরাং এই প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা বা প্রাকৃতিক বিন্যাস কোন চিরন্তন অবস্থা নয়।

(চ) অধিকারের আইনানুগ মতবাদের সমালোচনা: অনেকে আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অধিকারের ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। একে অধিকারের আইনানুগ তত্ত্ব (legal theory) বলে। হস ও বেস্থান অধিকারের এই সমর্থক হিসাবে পরিচিত। আইনানুগ মতবাদ অনুসারে বলা হয় যে রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে অধিকার স্বীকার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। সুতরাং আইনের ব্যবস্থার যদি কোন পরিবর্তন ঘটে, তাহলে অধিকারের বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটবে। অধিকারের আইনানুগ মতবাদকে অধ্যাপক ল্যাস্কি আকর্ষণীয় বলেছেন, কিন্তু সমর্থন করেননি। অধিকার সম্পর্কিত এই মতবাদ রাষ্ট্রের স্বরূপ অনুধাবনের ক্ষেত্রে সাহায্য করে। কিন্তু যে সমস্ত অধিকারকে স্বীকার করা হয়েছে, সেগুলিকে স্বীকার করার প্রয়োজন ছিল তা এই তত্ত্ব থেকে জানা যায় না। আইনানুগ মতবাদ অধিকারের কেবলমাত্র অস্তিত্বটিকেই ব্যক্ত করে। অধিকারের আলোচনায় অধ্যাপক ল্যাস্কি ঔচিত্যের প্রশ্নের উপর জোর দিয়েছেন এবং অধিকারের ধারণাকে ব্যাপকতর অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। যে-কোন অধিকারকে স্বীকার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা সঙ্গত নয়। সমাজের প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকারের যথার্থতা যাচাই করা দরকার।