কর্তব্যহীন অধিকার হয় না: ল্যাস্কি তাঁর অধিকার সম্পর্কিত আলোচনায় অধিকারের কর্তব্যমূলক ধারণার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতানুসারে অধিকারের ধারণা কর্তব্যহীন হতে পারে না। কর্তব্য সম্পাদনের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত অধিকারের দাবি অর্থহীন। কর্তব্য না করে অধিকার দাবি করা যায় না। কাজ না করলে যেমন ব্যক্তির খাবার জোটে না, তেমনি কর্তব্য পালন না করে ব্যক্তি অধিকার দাবি করতে পারে না। অর্থাৎ কর্তব্যহীন দাবি অধিকার হিসাবে বিবেচিত হতে পারে না। ব্যক্তি মানুষ অধিকারের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়। তারজন্য নাগরিককে সমাজের কল্যাণের জন্য নির্দিষ্ট দায়িত্ব সম্পাদন করতে হয়। তবেই নাগরিককে অধিকার প্রদানের বিষয়টি যুক্তিগ্রাহ্য হয়। অন্যথায় অধিকারের দাবি অর্থহীন প্রতিপন্ন হয়। অর্থাৎ ল্যাস্কির মতানুসারে অধিকার ও কর্তব্য পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত।
অধিকার সমাজনির্ভর: ল্যাস্কির মতানুসারে কর্তব্য দু’ধরনের হতে পারে। কর্তব্যের এই দু’টি ধরন হল— ব্যক্তিগত কর্তব্য এবং সামাজিক কর্তব্য। ব্যক্তি মানুষের একান্তভাবে নিজস্ব স্বার্থে সম্পাদিত কর্তব্য হল ব্যক্তিগত। ব্যক্তিগত কর্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকার দাবি করা যায় না। সামাজিক কর্তব্য সম্পাদনের জন্যই অধিকারের দাবি উঠতে পারে। সমাজের কল্যাণ সাধনের স্বার্থে অধিকারের দাবি যথার্থ প্রতিপন্ন হয়। সমাজ ও রাষ্ট্র অধিকার স্বীকার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। এর উদ্দেশ্য হল অধিকারের মাধ্যমে একই সঙ্গে ব্যক্তি মানুষের ও সমাজের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। নাগরিক হল সমাজ ও রাষ্ট্রের সদস্য। এই পরিচিতির পরিপ্রেক্ষিতে সে অধিকার ভোগের সুযোগ পায়। কারণ সমাজের ভিতরেই অধিকারের অস্তিত্ব বর্তমান থাকে। অধিকার হল সমাজ-নির্ভর। সমাজ-বিচ্ছিন্নভাবে অধিকারের অস্তিত্ব অসম্ভব। আবার ব্যক্তি-মানুষও সমাজ বিচ্ছিন্নভাবে থাকতে পারে না। আবার সমাজের উপর ব্যক্তির যাবতীয় কাজকর্মের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং এর পরিপ্রেক্ষিতেও ব্যক্তির কর্তব্য সম্পাদনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে ল্যাস্কি নাগরিকের দায়িত্বহীন বা ইচ্ছামত আচরণকে নিয়ন্ত্রণের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। অধিকারের সঙ্গে কর্তব্য সম্পর্কযুক্ত। এই কারণে কেউই খেয়ালখুশিমত অধিকার দাবি করতে পারে না।
অধিকারের ভিত্তি হল সমাজ কল্যাণের সঙ্গে যুক্ত কর্তব্য: অধিকারের উৎস বা সূত্র হল সমাজকল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কর্তব্য। নাগরিকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অধিকার তখনই প্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হবে যখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি প্রয়োজনীয় সামাজিক কর্তব্য সম্পাদন করবে। ব্যক্তি মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত গুণাবলীর বা ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধনের সঙ্গে সঙ্গে অন্য সকলের কল্যাণের বিষয়েও বিচার-বিবেচনা করতে হবে। ল্যাস্কির মতানুসারে অধিকার হল ব্যক্তি মানুষের উপর ন্যস্ত এক ধরনের ক্ষমতা। এই ক্ষমতাবলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে একযোগে সকলে ল্যাণ সাধনে উদ্যোগী হতে পারে। অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তিই হল অন্য সকলের সঙ্গে সর্বজনীন কল্যাণ সাধনের অন্যতম অংশীদার। এই বোধই হল ব্যক্তির অধিকারের মূল ভিত্তি। এই অবস্থাতেই ব্যক্তি মানুষের অধিকারের দাবি স্বীকার করার কথা বলা হয়। কর্তব্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে সামর্থ্যের কথা বিচার-বিবেচনা না করে অধিকারের প্রতি স্বীকৃতি প্রদানের কথা উঠতে পারে না। অনুরূপভাবে আবার অসামাজিক কাজকর্মের ক্ষেত্রে অধিকারের প্রশ্ন উঠতে পারে না। আবার সার্বজনীন কল্যাণ বা সাধারণের কল্যাণের সঙ্গে প্রত্যেকের কল্যাণ সংযুক্ত। সর্বজনীন কল্যাণের মানদণ্ডে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের পারস্পরিক দাবি ন্যায়সঙ্গত প্রতিপন্ন হওয়া দরকার। তা ছাড়া একজনের অধিকার সংকুচিত করে রাষ্ট্র অন্যজনের অধিকারের দাবিকে স্বীকৃতি প্রদান করতে পারে না। রাষ্ট্র বা সমাজের কাছে সকলের অধিকারই সমগুরুত্বসম্পন্ন।
অধিকারের মধ্যেই কর্তব্য নিহিত: সমাজের সদস্য বলে এবং সমাজের কল্যাণের স্বার্থে ব্যক্তি মানুষের অধিকারকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। সামাজিক কল্যাণ সাধনের ক্ষেত্রে নাগরিকদের আত্মনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করাই হল অধিকারকে স্বীকার করার মূল উদ্দেশ্য। অর্থাৎ অধিকারের ধারণা সামাজিক কল্যাণবোধের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। এবং এই জন্যই অধিকার ও কর্তব্য পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কযুক্ত সমাজের স্বার্থে বা কল্যাণের বিরুদ্ধে কিছু করার অধিকার কোন নাগরিককে দেওয়া যায় না। সকল ব্যক্তি হল সমাজের অংশ। এই ধারণার ভিত্তিতে ব্যক্তির নাগরিকত্ব অর্থবহ হয়ে উঠে। সমগ্র সমাজের দিক থেকে বিচার করলে সমাজের প্রতি কর্তব্যের উপর প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রয়োজনীয়তা নির্ভরশীল। কোন ব্যক্তির অধিকারের স্বীকৃতি সমাজের কল্যাণ সাধনে তার ভূমিকা বা অবদানের উপর নির্ভরশীল। সমাজের কাছে ব্যক্তির অধিকারের দাবি স্বীকৃত হওয়া দরকার। তবে এই স্বীকৃতির কারণ হিসাবে সংশ্লিষ্ট দাবির সঙ্গে জনস্বার্থের সর্বজনীন ধারণার সংযোগ থাকা আবশ্যক। অর্থাৎ ‘কর্তব্য সম্পাদনের সহায়ক অবস্থা সৃষ্টির জন্য অধিকারের দাবি স্বীকৃত হওয়া আবশ্যক’, সমাজের কাছে পেশ করা দাবির মাধ্যমে এই ধারণা স্পষ্টত প্রতিপন্ন হওয়া দরকার। এই কারণে বলা হয় যে অধিকারের মধ্যেই কর্তব্যের ধারণা বর্তমান।
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তির এবং ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অধিকার: রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তির বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অধিকার থাকতে পারে। তবে উভয়ই সাধারণের কল্যাণ বা সর্বজনীন কল্যাণের ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া আবশ্যক। সাধারণের কল্যাণ (common good) রাষ্ট্র অস্বীকার করতে পারে। রাষ্ট্র সর্বজনীন কল্যাণের বিরোধী আচরণ করতে পারে। মানবজাতির ইতিহাসে এমন নজিরের অভাব নেই। এ রকম ভুল রাষ্ট্র করলে নাগরিকের কর্তব্য হল তার প্রতিবাদ করা। এ রকম ক্ষেত্রে সকল নাগরিক তাদের আচরণের মাধ্যমে সর্বজনীন কল্যাণের ধারণাকে তুলে ধরবে। আবার ব্যক্তির বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রের অধিকারের অস্তিত্ব সম্ভব। সর্বজনীন কল্যাণের স্বার্থে রাষ্ট্র ব্যক্তিবর্গের কাছে সেবামূলক কাজকর্ম দাবি করতে পারে। আবার রাষ্ট্র এক পক্ষের অধিকার ভোগের সহায়ক অবস্থা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অন্য পক্ষের উপর অনুকূল আচরণের দাবি চাপিয়ে দিতে পারে।
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অধিকার: ল্যাস্কি অধিকার সম্পর্কিত তাঁর কর্তব্যমূলক ধারণার সঙ্গে গ্রীণের সাধারণের কল্যাণ বা সর্বজনীন কল্যাণের ধারণাকে যুক্ত করেছেন। গ্রীণ একজন ভাববাদী দার্শনিক হিসাবে পরিচিত। Principles of Political Obligations শীর্ষক গ্রন্থে তাঁর ভাববাদী দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর মতানুসারে ব্যক্তি মানুষের চেতনার মধ্যে তার নিজের কল্যাণ-চিন্তার সঙ্গে অন্য সকলের কল্যাণ-চিন্তাও বর্তমান থাকে। ব্যক্তির দাবিকে সমাজ স্বীকৃতি জানায়। সমাজ এই স্বীকৃতি প্রদান করে তার কারণ হল সংশ্লিষ্ট দাবি সাধারণের স্বার্থের অনুপন্থী। ব্যক্তি মানুষের দাবি সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত হওয়ার ফলে তা অধিকারে পরিণত হয়। এইভাবে সমাজের বৃহত্তর স্বার্থের সঙ্গে বা সর্বজনীন কল্যাণের সঙ্গে প্রত্যেকের কল্যাণ সম্পর্কযুক্ত এই কারণে সর্বজনীন কল্যাণের বিরুদ্ধে ব্যক্তির কোন অধিকারের অস্তিত্ব অসম্ভব। সুতরাং সাধারণভাবে সমাজ বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অধিকার থাকার কথা নয়। কিন্তু সরকারের কাজকর্ম বা সিদ্ধান্ত সামাজিক স্বার্থ বা সর্বজনীন কল্যাণের বিরোধী হলে ব্যক্তি মানুষ তার প্রতিবাদ করবে। সামাজিক স্বার্থ এবং সর্বজনীন কল্যাণের উপর গ্রীণ বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অধ্যাপক ল্যাস্কির মতানুসারে সমাজের সামগ্রিক স্বার্থ বা সর্বজনীন কল্যাণ এই আদর্শটিকে কার্যকর করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র এই দায়িত্ব সম্পাদন করলে ব্যক্তি মানুষের অধিকার অর্জিত হয়। এবং ব্যক্তির দিক থেকেও বাধ্যবাধকতা (obligation)-এর সৃষ্টি হয়। অধিকারের দাবি স্বীকার করার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে সাহায্য করতে হয়। রাষ্ট্র যদি এক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে ব্যর্থ হয় তা হলে বঞ্চিত মানুষের প্রতিবাদ করার অধিকার থাকবে।
অধিকারের দাবি ও আনুগত্যের দাবি শর্তসাপেক্ষ: এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক ল্যাস্কি রাষ্ট্রের আনুগত্যের দাবি প্রসঙ্গেও আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে ব্যক্তি মানুষের অধিকারের দাবি বা রাষ্ট্রের আনুগত্যের দাবি—এই দু’টি দাবিই শর্তসাপেক্ষ এবং কোনটিই এককভাবে চরম নয়। কর্তব্য সম্পাদন ব্যতিরেকে ব্যক্তি অধিকার দাবি করতে পারে না। অনুরূপভাবে সুস্থ সমাজজীবনের জন্য ন্যূনতম অধিকারের দাবি না মিটিয়ে রাষ্ট্র ব্যক্তিবর্গের আনুগত্য দাবি করতে পারে না। ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে সাহায্য করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র যদি ব্যর্থ হয়, তা হলে আনুগত্য লাভের ব্যাপারে রাষ্ট্রের কোন নৈতিক দাবি থাকতে পারে না। ব্যক্তি মানুষের অধিকারের দাবি রাষ্ট্র যদি অস্বীকার করে তা হলে রাষ্ট্রকে আনুগত্য লাভের দাবি হারাতে হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে অধিকারের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রকাশ করা প্রয়োজন। অধ্যাপক ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের প্রতি ব্যক্তির কর্তব্য বলতে একটি বিশেষ আদর্শের প্রতি কর্তব্যকে বোঝায়। এ হল সেই আদর্শ যা কার্যকর করতে রাষ্ট্র বাধ্য। ব্যক্তি মানুষের নৈতিক বিকাশের শর্তগুলিকে অধিকার হিসাবে গণ্য করা হয়। কিন্তু ব্যক্তি মানুষের পক্ষে এককভাবে নৈতিক বিকাশের শর্তাদি পূরণ বা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভবপর নয়। এই কারণে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিহার্য বিবেচিত হয়। অর্থাৎ অধিকারের দাবিগুলিকে স্বীকার করে একমাত্র রাষ্ট্রই মানুষের নৈতিক বিকাশের ব্যবস্থা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে অধ্যাপক ল্যাস্কির উপর ভাববাদী গ্রীণের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না।
Leave a comment