রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য হেতু স্বাধীনতা সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে স্বাধীনতা শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং স্বাধীনতার বিভিন্ন রূপের উদ্ভব হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তত্ত্বগতভাবে স্বাধীনতার নিম্নলিখিত প্রকারভেদ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। বার্কার তাঁর Principles of Social and Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে তিন ধরনের স্বাধীনতার কথা বলেছেন। তাঁর মতানুসারে রাষ্ট্রের মধ্যে তিন ধরনের স্বাধীনতা বর্তমান। এই তিন ধরনের স্বাধীনতা হল:
-
(১) ব্যক্তি মানুষের পৌর স্বাধীনতা—এ হল ব্যক্তির মনের, দেহের ও সম্পত্তির স্বাধীনতা;
-
(২) নাগরিকের রাজনীতিক স্বাধীনতা এবং
-
(৩) শ্রমিকের আর্থনীতিক স্বাধীনতা।
(১) পৌর স্বাধীনতা:
পৌর স্বাধীনতার প্রকৃতি:
সমাজবদ্ধ মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ এবং সমাজজীবনের সুখ-সমৃদ্ধির স্বার্থে কতকগুলি অধিকার অপরিহার্য। এই অধিকারগুলিকে পৌর অধিকার বলে। দৃষ্টান্ত হিসাবে জীবনের অধিকার, ধর্মাচরণের স্বাধীনতা, বাক্য ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই সকল অধিকারের অস্তিত্ব ছাড়া মানুষের সমাজজীবন সার্থক হতে পারে। না। প্রকৃত প্রস্তাবে পৌর স্বাধীনতার স্বীকৃতি ছাড়া ব্যক্তির অন্তর্নিহিত সত্তার সর্বোৎকৃষ্ট বিকাশ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই কারণে এখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা পৌর স্বাধীনতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। সমাজের সদস্য হিসাবে ব্যক্তিবর্গ পৌর বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ভোগের দাবি জানায়। পৌর স্বাধীনতা জীবনের ব্যক্তিগত সম্পর্কের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাই এই স্বাধীনতাকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতাও বলা হয়। যেমন, ধর্মাচরণের স্বাধীনতা, বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার প্রভৃতি ব্যক্তিজীবনের কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্কের সঙ্গেই জড়িত। সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গ ব্যক্তিগতভাবে আইনানুমোদিত যে স্বাধীনতা ভোগ করে তাকে বলে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। সমাজের সদস্য হিসাবে প্রত্যেক ব্যক্তি পৌর স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে।
পৌর স্বাধীনতা সম্পর্কে বার্কারের মতামত:
বার্কারের মতানুসারে ব্যক্তিজীবনের পরিপূর্ণতার পক্ষে পৌর স্বাধীনতাসমূহের অনুশীলন ও সংরক্ষণ একান্তভাবে অপরিহার্য। তাঁর মতে মানুষ ব্যক্তি হিসাবে যে স্বাধীনতা ভোগ করে তা হল ব্যক্তি-স্বাধীনতা বা পৌর স্বাধীনতা। ইংরাজ আইনবিদ ব্ল্যাকস্টোন-এর মতে পৌর স্বাধীনতার মধ্যে তিনটি বিষয় বর্তমান। এই তিনটি বিষয় হল: ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, ব্যক্তির গতিবিধির স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার। অধ্যাপক বার্কার তিনটি ভিন্ন বিষয়কে পৌর স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এই তিনটি বিষয় হল:
-
(১) দৈহিক স্বাধীনতা—জীবন, স্বাস্থ্য ও দৈহিক গতিবিধির প্রতি ভীতি-প্রদর্শন থেকে অব্যাহতির দৈহিক স্বাধীনতা;
-
(২) মতামত ও বিশ্বাস ব্যক্ত করার বৌদ্ধিক স্বাধীনতা এবং
-
(৩) নিজের ইচ্ছা ও পছন্দমত অন্যের সঙ্গে চুক্তিমূলক কাজ ও সম্পর্ক স্থাপনের বাস্তব স্বাধীনতা।
পৌর স্বাধীনতা সম্পর্কে ল্যাস্কির মতামত:
ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে ব্যক্তিজীবনের প্রকৃষ্টতম বিকাশের ক্ষেত্রে ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার বিশেষভাবে জরুরী। ব্যক্তি মানুষের জীবনের কতকগুলো বিশেষ ক্ষেত্র আছে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে ব্যক্তির ক্রিয়াকলাপ বা আচার-আচরণ শুধুমাত্র ব্যক্তিকেই স্পর্শ বা প্রভাবিত করে থাকে। এর প্রভাব অন্যের উপর পড়ে না। এই সমস্ত ক্ষেত্রে স্বাধীনতাকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলে। ল্যাস্কির মতানুসারে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলতে কতকগুলো সুযোগ-সুবিধাকে বুঝায়। এই সমস্ত সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে ব্যক্তি-জীবনের সেই সমস্ত বিষয়ে নিজের পছন্দমাফিক কাজ করতে সক্ষম হয়, যেখানে স্বতন্ত্রভাবে একমাত্র তার উদ্যোগ ও স্বার্থ সম্পর্কযুক্ত। ল্যাস্কির কথায় ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলতে বোঝায়, opportunity to exercise freedom of choice in those areas of life where the results of my effort mainly affect me in that isolation by which I am always surrounded.” অর্থাৎ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হল স্বাধীনতার সেই বৈশিষ্ট্য যার বিষয়বস্তু কেবলমাত্র ব্যক্তি বিশেষের ব্যক্তিগত স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এ বিষয়ে অধ্যাপক ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
(২) রাজনীতিক স্বাধীনতা:
রাজনীতিক স্বাধীনতার প্রকৃতি:
বর্তমান দুনিয়ায় অধিকাংশ দেশেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় জনগণের ভূমিকাই প্রধান। জনগণ যাতে রাজনীতিক ক্রিয়াকর্মে সহজেই অংশগ্রহণ করতে পারে তার বিশেষ সুযোগ-সুবিধা থাকা আবশ্যক। এই সকল সুযোগ-সুবিধাকেই রাজনীতিক স্বাধীনতা বলা হয়। নাগরিক হিসাবে ব্যক্তি রাজনীতিক স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। উদাহরণ হিসাবে নির্বাচিত করার ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার, সরকারী চাকুরী লাভের অধিকার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
রাজনীতিক স্বাধীনতা সম্পর্কে বার্কারের মতামত:
বার্কার রাজনীতিক স্বাধীনতা সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে জনসাধারণের একজন সদস্য এবং আইনসঙ্গত সংগঠনের একটি অংশ হিসাবে ব্যক্তি যে স্বাধীনতার অধিকারী তাকে বলে রাজনীতিক স্বাধীনতা। এ ক্ষেত্রেও বার্কার ব্ল্যাকস্টোনের বক্তব্যের অবতারণা করেছেন। ব্ল্যাকস্টোনের মতানুসারে রাজনীতিক স্বাধীনতা হল মূলত নেতিবাচক। এই স্বাধীনতার মুখ্য উদ্দেশ্য হল, সরকারকে নিয়ন্ত্রিত বা সংকুচিত করা। অধ্যাপক বার্কার এই বক্তব্যকে সমর্থন করেননি। তাঁর অভিমত অনুসারে তার প্রকৃতির দিক থেকে রাজনীতিক স্বাধীনতা হল ইতিবাচক। এই স্বাধীনতার উদ্দেশ্য সরকারকে খর্ব করা নয়। এর উদ্দেশ্য হল সরকারের গঠন ও সরকারী কার্যাবলীর নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ রাজনীতিক স্বাধীনতা বলতে সরকার গঠন ও নিয়ন্ত্রণের স্বাধীনতাকে বোঝায়। নির্বাচনের একটি সাধারণ কার্যপ্রক্রিয়ার দ্বারা জনগণ সরকার গঠন করে। আবার সাধারণ ও অবিরাম আলোচনা পদ্ধতির মাধ্যমে জনগণ সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে।
রাজনীতিক স্বাধীনতা সম্পর্কে ল্যাস্কির মতামত:
ল্যাস্কি তাঁর A Grammar of Politics শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক স্বাধীনতা সম্পর্কেও যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের ক্ষমতাই হল রাজনীতিক স্বাধীনতা। তিনি বলেছেন: “Political liberty means the power to be active in the affairs of the state.” রাজনীতিক স্বাধীনতার ধারণা অনুসারে বলা হয় যে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন কার্যে নাগরিকের অংশগ্রহণের ব্যাপারে কোনো রকম সাধারণ বাধানিষেধ থাকবে না। প্রত্যেকে মতামত প্রকাশের ও অপরের সঙ্গে মতামত বিনিময়ের সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। এই স্বাধীনতার সার্থক রূপায়ণের স্বার্থে অধ্যাপক ল্যাস্কি দুটি শর্ত পূরণের উপর জোর দিয়েছেন। এই দুটি শর্ত হল শিক্ষার বিস্তার এবং সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা। বিভিন্ন বিষয়ে ব্যক্তির শিক্ষার বিস্তার দরকার। এই শিক্ষালাভের মাধ্যমে নাগরিক রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যবস্থা সম্পর্কে তার মতামত গঠন করতে পারবে এবং তার বক্তব্য অপরের কাছে যথাযথভাবে ব্যক্ত করতে পারবে। ল্যাস্কির মতানুসারে এই শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা দেশের সকল ব্যক্তির মধ্যে সমভাবে বণ্টিত হওয়া দরকার। তা না হলে শিক্ষার সুযোগ সমাজের প্রাধান্যকারী শ্রেণীর কুক্ষিগত হয়ে থাকবে। এবং শিক্ষার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শর্ত হিসাবে ল্যাস্কি সঠিক সংবাদ প্রকাশের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সঠিক তথ্যের অভাবে ও বিকৃত সংবাদ রাজনীতিক স্বাধীনতার পরিপন্থী। ল্যাস্কির মতানুসারে নির্ভরযোগ্য সংবাদ ব্যতিরেকে ব্যক্তির স্বাধীনতার ভিত্তি বিপন্ন হয়ে পড়ে। তিনি বলেছেন: “A people without reliable news is…a people without the basis of freedom.”
(৩) আর্থনীতিক স্বাধীনতা:
আর্থনীতিক স্বাধীনতার প্রকৃতি:
তত্ত্বগত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়, আর্থনীতিক স্বাধীনতা ব্যতীত পৌর ও রাষ্ট্রনৈতিক স্বাধীনতা নিরর্থক হতে বাধ্য। আর্থনীতিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়া সামাজিক ও রাজনীতিক অধিকারগুলি ভোগ করা যায় না। সেইজন্য আর্থনীতিক স্বাধীনতা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ হল অন্যান্য সকল অধিকারের ভিত্তিস্বরূপ। আর্থনীতিক স্বাধীনতা বলতে কর্মের অধিকার, অবকাশ বিনোদনের অধিকার, অসুস্থ ও অক্ষম অবস্থায় সরকার কর্তৃক প্রতিপালনের অধিকার, বেকার অবস্থায় ও অবসরকালীন ভাতা পাওয়ার অধিকার প্রভৃতি আর্থনীতিক সুযোগ-সুবিধাকে বোঝায়।
আর্থনীতিক স্বাধীনতা সম্পর্কে বার্কারের ধারণা:
বার্কারের মতানুসারে আর্থনীতিক স্বাধীনতার ধারণা হল অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিককালের। ব্যক্তি কর্মী বা শ্রমিক হিসাবে কোনো-না-কোনো অর্থকরী চাকরি বা পেশায় নিযুক্ত থাকে। ব্যক্তির এই শ্রম কায়িক বা মেধাগত যে-কোনো ধরনের হতে পারে। এই সূত্রে শ্রমিক যে স্বাধীনতা অর্জন করে তাকে বলে আর্থনীতিক স্বাধীনতা। অর্থাৎ ব্যক্তি মানুষ শ্রমিক হিসাবে বা মালিক হিসাবে যে স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে তা সাধারণভাবে আর্থনীতিক স্বাধীনতা হিসাবে পরিচিত। বার্কারের অভিমত অনুসারে আর্থনীতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কতকগুলি বিশেষ ধরনের সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। এই ক্ষেত্রটির সমস্যাদির সমাধানের জন্য একটি বিশেষ ও পৃথক প্রকৃতির স্বাধীনতার ধারণা অপরিহার্য প্রতিপন্ন হয়। এই বিশেষ ও স্বতন্ত্র ধরনের স্বাধীনতা হল আর্থনীতিক স্বাধীনতা।
অন্য দু’ধরনের স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্ক:
বার্কারের মতে আর্থনীতিক স্বাধীনতার সঙ্গে পৌর স্বাধীনতার নিকট সম্পর্ক বর্তমান। তাঁর মতে রাজনীতিক স্বাধীনতার সঙ্গেও আর্থনীতিক স্বাধীনতার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। তাঁর আরও অভিমত হল যে যেহেতু এই দুই ধরনের স্বাধীনতার সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে তাই আর্থনীতিক স্বাধীনতা কোনটিরই অংশ নয়। আর্থনীতিক স্বাধীনতার সঙ্গে এমন কিছু বিষয় যুক্ত যেগুলি রাজনীতিক স্বাধীনতার এলাকাভুক্ত। সুতরাং আর্থনীতিক স্বাধীনতাকে কেবলমাত্র পৌর স্বাধীনতার অংশ বলা যাবে না। আবার একে কেবল রাজনীতিক স্বাধীনতারও অংশ বলা যাবে না। তার কারণ হল আর্থনীতিক স্বাধীনতার সঙ্গে এমন কতকগুলি বিষয় সম্পর্কযুক্ত যেগুলি পৌর স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত।
রাজনীতিক ও আর্থনীতিক স্বাধীনতা:
বার্কার রাজনীতিক স্বাধীনতার সঙ্গে আর্থনীতিক স্বাধীনতার সম্পর্ক প্রসঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে গুরুত্বসহকারে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে দু’দিক থেকে রাজনীতিক ও আর্থনীতিক স্বাধীনতা সম্পর্ক বিচার-বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথমত, রাজনীতিক স্বাধীনতাকে স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া যায় এবং আর্থনীতিক স্বাধীনতাকে রাজনীতিক স্বাধীনতার অনুগামী হিসাবে বিবেচনা করা যায়। তদনুসারে নাগরিকের রাজনীতিক স্বাধীনতা সরকারকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকের আর্থনীতিক সুযোগ-সুবিধা দাবি করে। অর্থাৎ এই প্রথম দৃষ্টিভঙ্গী অনুসারে আর্থনীতিক ও রাজনীতিক স্বাধীনতার মধ্যে রাজনীতিক স্বাধীনতাই হল অগ্রবর্তী। অপরদিকে দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে আর্থনীতিক স্বাধীনতাই হল অগ্রবর্তী। কারণ হিসাবে বলা হয় আর্থনীতিক স্বাধীনতা ব্যতিরেকে রাজনীতিক স্বাধীনতা হল অর্থহীন। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতার অভাব নাগরিকের রাজনীতিক স্বাধীনতা ভোগের ক্ষেত্রে একটি বিরাট প্রতিবন্ধক হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। যাইহোক, এই দুই স্বাধীনতার মধ্যে কোন্টি অগ্রবর্তী এই বিষয়টিকে অধ্যাপক বার্কার তেমন তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেননি। তাঁর অভিমত অনুসারে এই দু’ধরনের স্বাধীনতার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ।
আর্থনীতিক স্বাধীনতা সম্পর্কে ল্যাস্কির ধারণা:
ল্যাস্কি আর্থনীতিক স্বাধীনতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতানুসারে আর্থনীতিক স্বাধীনতা হল ব্যক্তির প্রাত্যহিক রুজি-রোজগারের ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত নিরাপত্তার সুযোগ। তিনি বলেছেন: “By economic liberty I mean security and opportunity to find reasonable significance in the earning of one’s daily bread.” আর্থনীতিক স্বাধীনতার জন্য অভাব-অনটন ও বেকারত্বের আতঙ্ক থেকে মুক্তি এবং ভবিষ্যতের নিশ্চিত্ত জীবন-যাপনের নিশ্চয়তা আবশ্যক। এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কি কাজের অধিকার, অভাব-অনটন ও শোষণ থেকে মুক্তি, বার্ধক্য অবস্থায় আর্থনীতিক নিরাপত্তার আশ্বাস প্রভৃতির কথা বলেছেন।
শিল্পে গণতন্ত্র:
আর্থনীতিক স্বাধীনতার স্বার্থে শিল্পে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয় নাগরিক রাজনীতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগ করে। সংশ্লিষ্ট নাগরিক শ্রমিক হিসাবে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগ করবে। শিল্প-ব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে ভীতি বা বলপ্রয়োগের ব্যবস্থা অস্বীকৃত হবে। তা না হলে শ্রমিকের ব্যক্তিসত্তার স্বাধীন বিকাশ ব্যাহত হবে। ভীতি প্রদর্শন বা বলপ্রয়োগ ঘটলে শ্রমিকের সৃজনশীল শক্তির প্রকাশ ঘটবে না। শিল্প-ব্যবস্থা পরিচালনার সঙ্গে শ্রমিকদের সংযুক্ত করতে হবে। শিল্প সংস্থাসমূহ পরিচালিত হবে শ্রমিকদের সহযোগিতার ভিত্তিতে। মালিকদের কোনো সিদ্ধান্ত শ্রমিকদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। ল্যাস্কি আর্থনীতিক স্বাধীনতার পথে কতকগুলি অন্তরায়ের কথা বলেছেন। তাঁর মতানুসারে উৎপাদন ব্যবস্থাকে পুঁজিপতি শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে। উৎপাদনের উপাদানসমূহের উপর ব্যক্তিগত মালিকানার বিনাশ সাধন করতে হবে। তা না হলে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর স্বাধীনতা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। প্রকৃত প্রস্তাবে ব্যক্তিগত মালিকানা এবং সমাজের শ্রেণী-কাঠামোর অবসান ব্যতিরেকে শ্রমিকসহ আমজনতার আর্থনীতিক স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। সুতরাং আর্থনীতিক ক্ষেত্রে আমূল সংস্কার বা বিপ্লব অপরিহার্য। এবং এ ক্ষেত্রে যাবতীয় দায়িত্ব শ্রমিক শ্রেণীকেই সম্পাদন করতে হবে।
আর্থনীতিক স্বাধীনতার গুরুত্ব:
ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে আর্থনীতিক স্বাধীনতার উপর অন্যান্য স্বাধীনতা নির্ভরশীল। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতার অনুপস্থিতি অন্যান্য স্বাধীনতার অস্তিত্বকে অর্থহীন করে তোলে। আর্থনীতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য ও শোষণ-পীড়ন থাকলে পৌর স্বাধীনতা বা রাজনীতিক স্বাধীনতা ভোগ করার সুযোগ পাওয়া যায় না। বস্তুত আর্থনীতিক স্বাধীনতা না থাকলে অন্যান্য স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপায়িত করা অসম্ভব।
Leave a comment