আইন স্বাধীনতার বিরোধী নয়: আপাতদৃষ্টিতে আইন ও স্বাধীনতাকে পরস্পর-বিরোধী বলেই মনে হয়। স্বাধীনতা বলতে যাঁরা নিয়ন্ত্রণবিহীনতা বোঝেন তাঁদের মতে আইন ব্যক্তি-স্বাধীনতার পরিপন্থী; একটির আধিক্য ঘটলে অপরটি হ্রাস পায়। ডাইসি বলেছেন: “The more there is of the one, the less there is of the other.” জে. এস. মিল, স্পেনসার প্রমুখ দার্শনিকও আইন ও স্বাধীনতার পরস্পর বিরোধিতার কথা বলেছেন। এঁদের মতানুসারে ব্যক্তিগত কার্যকলাপের উপর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব বা আইনের অধিক নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিরোধী। প্রকৃতপক্ষে ডাইসি, ব্রাইস মিল, স্পেনসার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের আইন ও স্বাধীনতার সম্পর্ক সম্বন্ধে এ ধরনের ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। আইন ও স্বাধীনতা পরস্পরের বিরোধী নয়— পরস্পরের সম্পূরক।

আইন হল স্বাধীনতার শর্ত: রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত অধিকারের ভিত্তিতেই স্বাধীনতার সৃষ্টি হয়। আইনের মাধ্যমেই রাষ্ট্র এই অধিকার স্বীকার ও সংরক্ষণ করে। সুতরাং স্বাধীনতা আইনের উপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও আইনের উদ্দেশ্য হল ব্যক্তি-স্বাধীনতা সংরক্ষণ করা। তাই বলা হয় ‘আইন হল স্বাধীনতার শর্ত’ (“Law is the condition of liberty.”)। অনিয়ন্ত্রিত ও অপ্রতিহত ইচ্ছা যদি স্বাধীনতা হিসাবে স্বীকৃত হয় তা হলে দুর্বল ও অসহায় ব্যক্তির স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়ে। কারণ মুষ্টিমেয় ধূর্ত ও শক্তিশালী ব্যক্তি অপর সকলের স্বাধীনতা হরণ করে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে। আইনের নিয়ন্ত্রণ ব্যতিরেকে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হয়। আইন মানুষের আচার-আচরণের সীমা নির্ধারণ করে। তাই স্বাধীনতা সংরক্ষিত হতে পারে। এই অর্থে আইন স্বাধীনতার প্রধান রক্ষাকবচ।

আইনানুমোদিত স্বাধীনতা: রাষ্ট্র আইনের দ্বারা সকলের স্বাধীনতা রক্ষা করে। আইনের দ্বারা সৃষ্ট ও সংরক্ষিত স্বাধীনতা আইনানুমোদিত স্বাধীনতা হিসাবে গণ্য হয়। আর আইনানুমোদিত স্বাধীনতা অনিয়ন্ত্রিত বা অবাধ হতে পারে না। বার্কারের মতে আইনসঙ্গত স্বাধীনতা আইনানুমোদিত বলেই অবাধ বা নিঃশর্ত হতে পারে না। তিনি বলেছেন: “…legal liberty, just because it is legal, is not an absolute or unconditional liberty.” আইনানুমোদিত মানেই আইন কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। এই নিয়ন্ত্রণ সকলের স্বাধীনতার স্বার্থে ব্যক্তির স্বাধীনতার উপর আরোপিত হয়। আবার বার্কারের মতে ‘প্রত্যেকের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা সকলের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার দ্বারা সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত।’ তার কথায়: “The need of liberty for each is necessary qualified and conditioned by the need of liberty for all.”

স্বাধীনতা অবাধ নয়: আইনানুমোদিত স্বাধীনতা নির্দিষ্ট। ব্যক্তির আত্মশক্তির বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতাটুকু ব্যক্তিকে দেওয়া হয়। এই স্বাধীনতা অপর কারও ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিপন্থী হতে পারে না। প্রত্যেকের স্বাধীনতা অপর সকলের স্বাধীনতার আপেক্ষিক। বার্কার যথার্থই বলেছেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তিরই স্বাধীন হওয়া উচিত।…..তাই কোনো ব্যক্তিই অবাধভাবে স্বাধীন হতে পারে না।’ এই জন্য স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে পারে না। স্বাধীনতা অনিয়ন্ত্রিত হলে দুর্বলের স্বাধীনতা সবলের দয়ার দানে পরিণত হয়। শিল্পপতির অবাধ স্বাধীনতা থাকলে শ্রমিকের স্বাধীনতা বিপন্ন হতে বাধ্য। সুতরাং নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা সকলের জন্য প্রকৃত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করে। অধ্যাপক ল্যাস্কির ভাষায়, ‘স্বাধীনতার প্রকৃতিতেই নিয়ন্ত্রণ বর্তমান’ (“Liberty…involves in its nature restraints…”)। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে এই নিয়ন্ত্রণ কার্য সম্পাদন করে স্বাধীনতার প্রকৃত স্বরূপ বজায় রাখে; কোনোক্রমে স্বাধীনতার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না।

আইনের দ্বারা স্বাধীনতার সৃষ্টি ও প্রসার ঘটে: বিভিন্ন আইনের দ্বারা স্বাধীনতার সৃষ্টি ও প্রসার ঘটে। দৃষ্টান্ত হিসাবে শ্রমিক কল্যাণ আইনের কথা বলা যায়। এই সকল আইনের দ্বারা মালিক শ্রেণীর স্বেচ্ছাচারিতা সঙ্কুচিত হয়েছে এবং শ্রমিকশ্রেণীর স্বাধীনতা সম্প্রসারিত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রীচির মতে, ‘স্বাধীনতাকে যদি আত্মবিকাশের জন্য আবশ্যক সুযোগ-সুবিধা বলে গণ্য করা হয়, তবে তা অবশ্যই আইনের দ্বারা সৃষ্ট তা ছাড়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের প্রতিনিধিপুষ্ট আইনসভার দ্বারা জনমত অনুসারে আইন প্রণীত হয়। সুতরাং আইন ও জনগণের স্বাধীনতার মধ্যে বিরোধ থাকতে পারে না। রুশোর মতে ‘স্ব-নির্দিষ্ট আইনের প্রতি আনুগত্যই স্বাধীনতা” (“Obedience to law which we prescribe to ourselves is liberty.”)।

স্বাধীনতা আইনের দ্বারা সৃষ্ট, সংরক্ষিত ও সম্প্রসারিত হয়: সুতরাং আইনের নিয়ন্ত্রণ বলতে স্বাধীনতার হ্রাস বোঝায় না। রাষ্ট্র কর্তৃক আইনের দ্বারা স্বীকৃত, সংরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত পরস্পরের আপেক্ষিক নির্দিষ্ট স্বাধীনতাই প্রকৃত স্বাধীনতা। প্রকৃত স্বাধীনতা আইন কর্তৃক সৃষ্ট, সংরক্ষিত ও সম্প্রসারিত হয়–কদাচ সঙ্কুচিত হয় না। উইলোবির মতানুসারে নিয়ন্ত্রণ আছে বলেই স্বাধীনতার অস্তিত্ব সম্ভব। আইনের মাধ্যমেই এই নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হয়। স্বাধীনতা সামাজিক পরিবেশেই সম্ভব। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত কাজের সীমা নির্দেশ করে এবং স্বাধীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করে। আইন সরকারের অন্যায় হস্তক্ষেপও রোধ করে এবং সরকারের যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে রক্ষা করে। আবার আইন সমাজে শৃঙ্খলা স্থাপন করে স্বাধীনতার পরিবেশ সংরক্ষণ করে। তার ফলে তার স্বাধীন সত্তাকে পুরোপুরি বিকশিত করতে পারে।

মার্কসীয় ধারণা: তবে বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় আইন বৈষম্যমূলক হয়। এ ধরনের আইন শোষণপন্থী এবং প্রকৃত স্বাধীনতার বিরোধী। দৃষ্টান্ত হিসাবে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যমলুক আইনের কথা বলা যায়। এই আইন ঐ দেশের কৃষ্ণকায় নাগরিকদের অধিকারকে সঙ্কুচিত করেছে। সুতরাং এ রকম আইন স্বাধীনতার অনুপন্থী নয়—পরিপন্থী। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে ধনবৈষম্যমূলক পুঁজিবাদী সমাজে রাষ্ট্রীয় আইন মুষ্টিমেয় বিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে। তার ফলে আর্থনীতিক দিক থেকে এই প্রতিপত্তিশালী শ্রেণীর স্বাধীনতা ভোগ সুনিশ্চিত হয়। এ ধরনের সমাজব্যবস্থায় সকলের বা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বাধীনতা ভোগ সম্ভব হয় না। কেবলমাত্র শ্রেণীহীন ও শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজে আইনের মাধ্যমে সকলের স্বাধীনতার সৃষ্টি ও সংরক্ষণ সম্ভব হয়। একমাত্র সাম্যভিত্তিক সমাজেই আইন স্বাধীনতার অনুকূল ভূমিকা পালন করে।