আইনের সংজ্ঞা: বার্কার তাঁর Principles of Social and Political Theory শীর্ষক গ্রন্থের চতুর্থ খণ্ডের তৃতীয় পরিচ্ছদে ‘সাম্যের নীতি’ (The Principles of Equality) সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে সাম্য কথাটির অর্থ হল সুযোগ-সুবিধা বা অধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রে কোন প্রকার পার্থক্য সৃষ্টি না করা। সাম্যের নীতি অনুসারে অধিকার হিসাবে একজনের জন্য যে সমস্ত শর্ত নিশ্চিত করা হবে, তার সমস্ত কিছু অন্যান্যদের জন্যও সমপরিমাণে নিশ্চিন্ত করা হবে; এবং অনুরূপভাবে অধিকার হিসাবে অন্যান্যদের জন্য যা দেওয়া হবে, একেও তা দিতে হবে। বার্কার বলেছেন: “The Principle of Equality accordingly means that whatever conditions are guaranteed to me in the form of rights, shall also, and in the same measure, be guaranteed to others, and that whatever rights are given to others shall also be given to me.” বার্কার বার্কের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলেছেন, সকলের সমানাধিকার আছে, কিন্তু সমপরিমাণ জিনিস লাভের অধিকার নেই।’ বার্কারের মতে আইন কেবলমাত্র আইনগত যোগ্যতাই প্রদান করে। তিনি বলেছেন: “Law is a given of legal capacities, and of legal capacities only.” আইন যদি এই সমস্ত যোগ্যতা নিরপেক্ষভাবে বণ্টন করে, তা হলে বুঝতে হবে যে সাম্যের নীতিটি সম্পূর্ণভাবে মানা হচ্ছে। এবং ধরে নিতে হবে সাম্যের নীতিটি পালন ও প্রয়োগের ব্যাপারে -যা কিছু করণীয় আইন তা করছে।
বৈধ সাম্য: বার্কারের অভিমত অনুসারে প্রত্যেক আইনানুমোদিত ব্যক্তিত্ব (Legal personality) আইনগত সামর্থ্যের বিচারে পরস্পর সমান। রাষ্ট্র ব্যক্তি মানুষকে যে আইনানুমোদিত ব্যক্তিত্ব প্রদান করে, তা সকলকেই সমানভাবে প্রদান করে। তার কারণ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যে পার্থক্যই থাকুক না কেন, আইনের চোখে সকলেই সমান। বার্কার বলেছেন: “…that each legal personality is equal to every other in terms of legal capacity. The state which vests us with legal personalities… vests us all with equal marks, partly because it simply cannot distinguish our difference…but ultimately for the far deeper reason that we all matter equally before the law,…” বার্কারের মতে নাগরিক রাষ্ট্রের মধ্যে যে সাম্য ভোগ করে তা হল আইনানুগ বা বৈধ সাম্য। আইনের দৃষ্টিতে সাম্য হল বৈধ সাম্য। সাম্যের নীতি অনুসারে আইনানুমোদিত সকল নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র সমান বৈধ আচরণ করবে। কারণ আইনানুসারে সকলে সমমর্যাদাসম্পন্ন।
সামাজিক ক্ষেত্রে সাম্য ও অসাম্য: বার্কারের মতে বৈধ সামাই শেষ কথা নয়। রাষ্ট্রীয় স্তরে সাম্যের অস্তিত্ব সত্ত্বেও সামাজিক স্তরে সাম্য থাকতে পারে এবং থাকে। তাঁর মতানুসারে ব্যক্তি মানুষের সামর্থ্যের ক্ষেত্রে বৈষম্য এবং অন্যান্য কারণের জন্য সমাজে অসাম্যের সৃষ্টি হয়ে থাকে। প্রত্যেক ব্যক্তি হল সমাজের সদস্য। সুতরাং রাষ্ট্রের বাইরেও ব্যক্তি মানুষের একটি স্বতন্ত্র সত্তা বর্তমান। ব্যক্তির অন্তর্নিহিত সত্তার বিকাশের ক্ষেত্রে সমাজের ভূমিকার গুরুত্ব বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। বার্কারের মতানুসারে সমাজের ক্ষেত্র হল আইন বহির্ভূত (extra legal)। এই আইন-বহির্ভূত ক্ষেত্রে সাম্যের সঙ্গে অসাম্যও থাকে। এ ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সাম্যের অস্তিত্ব অসম্ভব। কারণ সমাজের সকলের সামর্থ্য এক রকম নয়। সামর্থ্যের বিচারে কেউ এগিয়ে, আবার কেউ পিছিয়ে। এর মধ্যে সামাজিক ক্ষেত্রে অসাম্যের মূল কারণ নিহিত আছে। যারা অধিকতর সামর্থ্যের অধিকারী, তারা এই অধিক সামর্থ্যের কল্যাণে অধিক পরিমাণে সম্পদ-সামগ্রীর অধিকারী হয়।
সাম্য হল শুরু, সমাপ্তি নয়: বার্কারের মতানুসারে সাম্য হল শুরুর বিষয়; সাম্যকে সমাপ্তি বলা যায় না। সমাপ্তি ব্যক্তিবর্গের উপর নির্ভরশীল। ব্যক্তিবর্গ কীভাবে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত সমানাধিকার বা সুযোগ সুবিধার সদ্ব্যবহার করে, তার উপরই সমাপ্তি নির্ভরশীল। বার্কার বলেছেন: “Equality is thus the beginning, not the end; the end depends on ourselves and on the use which we make of the equal conditions guaranteed to us, as a beginning, by the state.” বার্কার এই বিষয়টিকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন দৌড় শুরুর আগে সকলে একটা সমান্তরাল রেখায় দাঁড়িয়ে থাকবে। রাষ্ট্র প্রত্যেককে সমস্ত ব্যক্তিসত্তার প্রকৃষ্টতম বিকাশের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা বা শর্তাদি প্রদান করবে। তাই নিয়ে ব্যক্তিবর্গ দৌড় শুরু করবে। কিন্তু পরিণামে অর্জিত যোগ্যতার ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখা দিতেই পারে। বার্কার বলেছেন: “We are thus arranged, as it were in a level line at the starting points of the race that lies ahead, and we start from the level line, so far as the State is concerned, with equal conditions guaranteed to each for making the best for himself however much we may eventually differ in what we actually make of ourselves.” বার্কারের বক্তব্য হল সাম্যের প্রয়োজনে রাষ্ট্র সকলকে সমান সুযোগ বা অধিকার প্রদান করবে। কিন্তু এই সমস্ত সুযোগ-সুবিধার সদ্ব্যবহার সকলে সমানভাবে করতে পারে না। কারণ এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও তার সামর্থ্যের উপর নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কিছু করার নেই। ব্যক্তি মানুষের অন্তর্নিহিত যোগ্যতা বা সামর্থ্য রাষ্ট্র গড়ে দিতে পারে না। এই কারণে সকলের ব্যক্তিত্বের সমান বিকাশ ঘটে না। অর্থাৎ সাম্যের ভিত্তিতে ব্যক্তি-মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন হল নিতান্তই একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিষয়।
সাম্যের ধারণা পরিবর্তনশীল: বার্কারের অভিমত অনুসারে সাম্য হল একটি পরিবর্তনশীল ধারণা। সাম্য অত্যন্ত সহজভাবে তার আকার পরিবর্তন করতে পারে এবং নতুন আকৃতি ধারণ করতে পারে। বাকার বলেছেন: “Equally is a Protean notion it changes its shape and assumes new forms with a ready facility.” আর্থ-সামাজিক ও আইনগত অবস্থার পরিবর্তন সাম্য সংক্রান্ত ধারণার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন সূচিত করে। বার্কারের অভিমত হল সামাজিক সাম্যের দ্বারা আইনগত সাম্য ভূষিত হওয়া দরকার। তিনি বলেছেন: “…that legal equality should thus be crowned by social equality.”
সাম্য হল উৎপত্তিগত বা আহৃত মূল্য: বার্কারের মতে সাম্য হল উৎপত্তিগত বা আহৃত মূল্যবোধ (derivative value)। সাম্য ধারণাটির উৎপত্তি হয়েছে ব্যক্তিত্ব বিকাশের সর্বোচ্চ মূল্যবোধ থেকে। এটা প্রত্যেকের মধ্যেই একইভাবে ও সমানভাবে বর্তমান। তবে তা প্রত্যেকের নিজস্ব পৃথক পদ্ধতি এবং নিজস্ব স্বতন্ত্র ধারায় বর্তমান। সেই সর্বোচ্চ মূল্যবোধের সঙ্গে সাম্যের সামঞ্জস্য সাধন আবশ্যক। বার্কার বলেছেন: “Equality, after all, is a derivative value. It has derived from the supreme value of the development of personality-in each alike and equally, but in each along its own different line and of its own separate motion. It has to be adjusted to that supreme value.” তবে এ প্রসঙ্গে বার্কার সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, সাম্য যদি একরূপতা বা অভিন্নতা (uniformity)-র সৃষ্টি করে, তা হলে মানুষের ব্যক্তিত্বের যাবতীয় বৈচিত্র্যের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ অতিঅবশ্যই ব্যর্থ হবে। অধ্যাপক বার্কার সাম্যের আপেক্ষিকতার কথা বলেছেন। তাঁর মতানুসারে ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বের সর্বোচ্চ বিকাশ সাধনই হল সাম্যের উদ্দেশ্য। সাম্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এই সর্বোচ্চ মূল্যবোধটিকে সামনে রাখবে। তবে ব্যক্তি মানুষের আদর্শ, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকে। ব্যক্তিসত্তার বিকাশের ক্ষেত্রে এই পার্থক্যকে স্বীকৃতি জানাতে হবে। প্রত্যেককে সমান সুযোগ দিতে হবে এবং স্ব স্ব পথে এগোবার সুযোগ দিতে হবে। ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য হল বাস্তব সত্য। এই সত্যকে অস্বীকার করা যায় না। সাম্যের উদ্দেশ্যে যদি সমরূপতা (uniformity) হয়, তাহলে ব্যক্তিত্বের প্রকৃষ্টতম বিকাশ বা সর্বোচ্চ মূল্যবোধ ব্যাহত হবে। সাম্য বলতে সর্বক্ষেত্রে সমরূপতা বোঝায় না। সমরূপতাকে স্বীকার করার অর্থ হল বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করা। সেক্ষেত্রে ব্যক্তিত্ব বিকাশের সর্বোচ্চ মূল্যবোধের সঙ্গে সাম্যের ধারণার সামঞ্জস্য সাধন সম্ভব হবে না।
আইনগত ও সামাজিক সাম্য: বার্কার সাম্যের কয়েকটি ধরন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি আইনগত সাম্যকে কার্যকর করার স্বার্থে সামাজিক সাম্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। সামাজিক স্তরে সাম্যের অস্তিত্ব ব্যতিরেকে আইনের পরিমণ্ডলে প্রাপ্ত সাম্যকে কার্যকর করা যাবে না। তবে বার্কার পরিপূর্ণভাবে সামাজিক সাম্যের কথা বলেন নি। তিনি কিছু পরিমাণে সামাজিক সাম্যের (some measure of social equality) প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। আবার উভয়ের সফল প্রয়োগের স্বার্থে, বিশেষত আইনগত সাম্যের বাস্তবায়নের স্বার্থে আর্থনীতিক সাম্য অপরিহার্য। বার্কার বলেছেন: “…equality in respect of economic resources is…. means to effective legal equality.” তাঁর অভিমত হল ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে আইনগত সাম্যই যথেষ্ট নয়; সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক সাম্য এবং সম্পদের বণ্টনকে সুনিশ্চিত করা আবশ্যক।
আর্থনীতিক সাম্য: বার্কার আর্থনীতিক সাম্যের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতানুসারে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য ব্যতিরেকে অন্যান্য সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এই কারণে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য আনয়নের ব্যাপারে তিনি রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকার উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। তার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এও স্বীকার করেছেন যে আর্থনীতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার কাজটি মোটেই সহজসাধ্য নয়। আরও স্পষ্টভাবে তিনি বলেছেন যে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ “আনয়ন অসম্ভব। তবে সম্প সামগ্রীর কেন্দ্রীভবন প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করবে। অর্থাৎ সংশোধনমূলক ব্যবস্থাদির মাধ্যমে রাষ্ট্র আর্থনীতিক ক্ষেত্রে অসাম্য হ্রাস করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয় এবং হবে। বার্কারের অভিমত হল যে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকার ফলে আর্থনীতিক অসাম্য কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। এবং তারই ফলশ্রুতি হিসাবে ব্যক্তিবর্গের মর্যাদা বৃদ্ধির ঘটনা ঘটেছে। তবে এ প্রসঙ্গে বার্কার মন্তব্য করেছেন যে আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য বিষয়টি ব্যাপক এবং জটিল। এ ক্ষেত্রে সহজেই কতকগুলি সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না।
আর্থনীতিক সাম্য আইনগত সাম্যের আপেক্ষিক: আর্থনীতিক সাম্যের বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বার্কার বলেছেন যে, সম-নাগরিকতার দিক থেকে আর্থনীতিকক্ষেত্রে সাম্য আবশ্যক। এ কথা ঠিক। কিন্তু সাম্য সম্পূর্ণ বা চরম নয়। এ হল সেই পরিমাণ সাম্য যা রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিপূর্ণ আইনগত সাম্যের মর্যাদার জন্য প্রয়োজনীয় বা এর আপেক্ষিক। তার থেকে কম বা বেশী নয়। বার্কারের মতে আর্থনীতিক সাম্য হল আইনগত সাম্যের আপেক্ষিক। তিনি বলেছেন: “Economic equality, after all, is relative to legal equality.” শুধু তাই নয়। আর্থনীতিক সাম্য আইনগত সাম্যের থেকেও অধিক বৃহৎ ও মৌলিক বিষয়ের আপেক্ষিক। আর্থনীতিকসাম্য একটি সর্বোচ্চ মূল্যবোধের (supreme value) আপেক্ষিক। এই সর্বোচ্চ মূল্যবোধ ব্যক্তিত্বের সামর্থ্যের বিকাশের মধ্যেই বর্তমান। এবং সাম্য সম্পর্কিত সমগ্র বিষয়টির উৎপত্তি হয়েছে এই ধারণা থেকেই। এই সর্বোচ্চ মূল্যবোধের সঙ্গে আর্থনীতিক সাম্যের ধারণাটি সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া আবশ্যক।
পূর্ণাঙ্গ আর্থনীতিক সাম্যের কথা বলা হয়নি: বার্কার সামগ্রিকভাবে বা পরিপূর্ণ অর্থে আর্থনীতিক সাম্যের কথা বলেননি। তাঁর মতে এরকম পূর্ণাঙ্গ আর্থনীতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ন্যায়নীতিসম্মত নয়। অধিকতর যোগ্যতা, অনুকূল পরিবেশ, সৌভাগ্যমূলক সুযোগ প্রভৃতি সূত্রে অর্জিত সম্পদের অধিকারীকে বঞ্চিত করা অনুচিত। আর্থনীতিক উপায়ে এই সম্পদ সংগৃহীত হয়নি। আবার রাষ্ট্রের জন্য এ ধরনের অসাম্যের সৃষ্টি হয়নি। তাই একে অস্বীকার করা যায় না। বার্কারের অভিমত হল আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সাম্যের ব্যাপারে যে-কোন ধরনের সাধারণ নীতিকে নৈতিক কারণে বাতিল করে দেওয়া যায়। তিনি বলেছেন: “We may, therefore dismiss, no moral grounds, any general policy of economic equality.” অর্থাৎ কিছু কিছু আর্থনীতিক অসাম্য সমাজে থাকবে। তবে এই অসাম্য যাতে আইনগত সাম্যকে ক্ষুণ্ণ না করে তা দেখা দরকার।
Leave a comment