আন্তর্জাতিক আইনের পটভূমি:
বর্তমান বিশ্বে কোন রাষ্ট্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ বা আত্মনির্ভরশীল নয়। প্রতিটি রাষ্ট্রই অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে আর্থনীতিক রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি বহুবিধ পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে এই পারস্পরিক সম্পর্ক অবাধ হতে পারে না। ল্যাস্কির মতানুসারে বর্তমানে রাষ্ট্রগুলি পরস্পরের উপর এত বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যে, কোন রাষ্ট্র অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার অধিকারী হলে তা অন্যান্য রাষ্ট্রের শান্তির পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে পড়বে। তিনি বলেছেন: “The world has become so interdependent that an unfettered will in any State is fatal to the peace of other States.” তাই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তি ও শৃঙ্খলার স্বার্থে রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়া আবশ্যক। এই প্রয়োজনের তাগিদেই আন্তর্জাতিক আইনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।
আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞা:
যে সকল নিয়মকানুন সভ্য রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণভাবে সেগুলিকেই আন্তর্জাতিক আইন বলে। লরেন্স বলেছেন: “The rules which determines the conduct of the general body of civilised state in their mutual dealings.” fe রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে সকল স্বীকৃত আন্তর্জাতিক নিয়মাবলী প্রচলিত তাই আন্তর্জাতিক আইন হিসাবে পরিগণিত হয়। প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক আইনবিদ ওপেনহেইম (Oppenheim) ও অনুরূপ মত পোষণ করেন। তাঁর মতে “(International law is the body of customary and conventional rules which are considered legally binding by civilised states in their inter-course with each other.” ফেন্উইকের মতে, ‘আন্তর্জাতিক আইন হল সেই সমস্ত সাধারণ নীতি এবং নির্দিষ্ট নিয়মের সমষ্টি যা আন্তর্জাতিক সমাজের সদস্যগণ তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে মেনে চলে” (“The body of general principles and specific rules which are binding upon the international community in their mutual relations.”)। ব্রিয়ারলির মতানুসারে, যে সকল নিয়ম ও মূল নীতি সভ্য রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে মেনে চলা হয়, তাই হল আন্তর্জাতিক আইন (“The body of rules and principles of action which are binding upon civilised states in their relation with one another.”)। আন্তর্জাতিক আইনে রাষ্ট্রসমূহের অধিকার, এই অধিকার রক্ষার ব্যবস্থাদি এবং অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে তার প্রতিবিধানের উপায় প্রভৃতি সম্পর্কে নির্দেশ উল্লিখিত থাকে।
আন্তর্জাতিক আইনের বিভিন্ন উৎস:
আন্তর্জাতিক আইনের উৎস প্রসঙ্গে আইনবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। তবে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসাবে রাষ্ট্রসমূহের সম্পর্কের ক্ষেত্রে উদ্ভূত বিভিন্ন ব্যবহারিক প্রথা, গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সন্ধি ও চুক্তিসমূহ, আন্তর্জাতিক সংগঠনের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জাতিক আদালতের বিধান (Statute)-এর ৩৮ ধারা অনুসারে আন্তর্জাতিক আইনের নিম্নলিখিত উৎসগুলির কথা বলা হয়। (ক) বিবদমান রাষ্ট্রগুলি কর্তৃক স্বীকৃত এবং সাধারণ বা বিশেষ আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্ট নিয়মাবলী; (খ) আন্তর্জাতিক প্রথাসমূহ যা আইনের মত বাধ্যতামূলকভাবে স্বীকৃত। (গ) সভ্য রাষ্ট্রসমূহের দ্বারা স্বীকৃত আইনের সাধারণ নিয়মসমূহ; (ঘ) বিশিষ্ট আইনবিদদের বিভিন্ন পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনা এবং (ঙ) আদালতের সিদ্ধান্ত। তা ছাড়া রাষ্ট্রপ্রধান এবং কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের মতামতও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রথা ও রীতিনীতি সৃষ্টিতে সাহায্য করে থাকে। তবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইনের উৎস হিসাবে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়নের উদ্যোগ-আয়োজনকে স্বীকার করা হয়।
আন্তর্জাতিক আইনের প্রকারভেদ:
পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলির মধ্যে স্বাভাবিক বা যুদ্ধকালীন সকল সময়েই ন্যায়সঙ্গত ও সুস্থ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য তিন ধরনের আন্তর্জাতিক আইন পরিলক্ষিত হয়: শান্তিকালীন আইন (Law of Peace), যুদ্ধসংক্রান্ত আইন (Law of War) এবং নিরপেক্ষতার আইন (Law of Neutrality)। এগুলি সবই সরকারী আন্তর্জাতিক আইন (Public International Law) হিসাবে গণ্য হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় যে সকল আন্তর্জাতিক আইন রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করে সেগুলিকে শান্তিকালীন আন্তর্জাতিক আইন বলে। বিবদমান রাষ্ট্রগুলি যুদ্ধের সময়ে যে সকল নিয়ম মান্য করে চলে সেগুলিকে যুদ্ধসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন বলা হয়। বিবদমান রাষ্ট্রগুলি সম্পর্কে পুরোপুরি নিরপেক্ষতা অবলম্বন সংক্রান্ত আইনকে নিরপেক্ষতা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন বলে। তা ছাড়া আর এক ধরনের আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন আছে যা এক রাষ্ট্রের নাগরিকের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্র বা তার নাগরিকের সমস্যাদি মীমাংসা করে। এগুলিকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক আইন (Private International Law) বলে। অবৈধ সন্তানের অধিকার, বিবাহ বিচ্ছেদ প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কিত আইন ব্যক্তিকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক আইনের অন্তর্ভুক্ত। ব্যক্তিগত আন্তর্জাতিক আইনকে অনেকে আন্তর্জাতিক আইন হিসাবে স্বীকার করতে রাজী হন না। এঁদের মতানুসারে ব্যক্তিগত সম্পর্ক আন্তর্জাতিক আইনের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলির সম্পর্ক নির্ধারণ সম্পর্কিত বিষয়ই কেবল আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আসে। তা ছাড়া সমালোচকরা পররাষ্ট্রনীতিকেও আন্তর্জাতিক আইন হিসাবে স্বীকার করেন না। এঁদের মতে পররাষ্ট্রনীতি হল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক আইন নয়।
আন্তর্জাতিক আইনের প্রকৃতি বা আন্তর্জাতিক আইন কি আইন পদবাচ্য?
বিপক্ষে যুক্তি: আন্তর্জাতিক আইন প্রকৃতপক্ষে আইন পদবাচ্য কি না এ বিষয়ে বিতর্কের অন্ত নেই। একদল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আন্তর্জাতিক আইনকে আইন হিসাবে মর্যাদা দেন, অপরদল তা স্বীকার করেন না। অস্টিন, হল্যান্ড প্রমুখ আইনবিদ আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকৃত আইন হিসাবে গণ্য করতে রাজী নন।
(১) তাঁদের মতে সার্বভৌমের আদেশই হল আইন। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন কোন চরম ক্ষমতাসম্পন্ন সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সৃষ্ট বা প্রযুক্ত হয় না।
(২) আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে কোন রাষ্ট্রই বাধ্য নয়। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হলে এর প্রতিকার বা আইনভঙ্গকারীকে শাস্তি প্রদানের কোন ব্যবস্থা নেই। যে আইন অমান্যের পশ্চাতে শাস্তির ভয় নেই তাকে প্রকৃত বিচারে আইনের মর্যাদা দেওয়া যায় না। ল্যাস্কি বলেছেন: “International law is only valid for a given State to the degree that it is prepared to accept its substance.”
(৩) আন্তর্জাতিক আইন বলতে কতকগুলি অসম্পূর্ণ নিয়মের সমষ্টিকে বোঝায়। এর কোন নির্দিষ্ট বা সর্বসম্মত রূপ নেই। অবস্থা ও স্বার্থ বিচারে বিভিন্ন রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে একে ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ করে। এই সমস্ত কারণে হল্যান্ড (Holland) -এর মতে, আন্তর্জাতিক আইন হল আইনশাস্ত্রের লোপবিন্দু (“International law is the vanishing point of jurisprudence.”)। অস্টিন ও তাঁর অনুগামীরা আন্তর্জাতিক আইনকে ‘সৌজন্যমূলক আইন’ (Law by courtesy) হিসাবে গণ্য করার এবং একে নীতিশাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী। অস্টিনের অনুগামী লর্ড সলবেরী (Lord Salisbury)-র অভিমত হল, ‘যে অর্থে আইন শব্দটি প্রচলিত, আন্তর্জাতিক আইন সে অর্থে আইন নয়’ (“International law has not any existence in the sense in which the term law is usually used.”)। সলবেরী আরও বলেছেন : “International law cannot be enforced by any Tribunal and therefore to apply to it the pharse ‘Law’ is to some extent misleading.”
(৪) ল্যাস্কির মতানুসারে, বর্তমান কালের রাষ্ট্রব্যবস্থায় শ্রেণী সম্পর্কের আবর্তে আন্তর্জাতিক আইনকে বলবৎ করা অসম্ভব। রাষ্ট্রসমূহের সম্মতির উপর আন্তর্জাতিক আইনের বৈধতা নির্ভরশীল বলে এই অনুমোদন আংশিক ও অসম্পূর্ণ। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা বজায় থাকলে, রাষ্ট্রীয় আইনের উপরে আন্তর্জাতিক আইনকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না।
সপক্ষে যুক্তি: অপরপক্ষে মেইন, স্যাভিগ্নি প্রমুখ ঐতিহাসিক আইনবিদ্ এবং হল, ওপেনহিম, ব্রিয়ারলি ফেনউইক, কেলসন, লরেন্স, পোলক প্রমুখ চিন্তাবিদদের মতে আন্তর্জাতিক আইন স্বীকৃত প্রথা ও চিরন্তন ন্যায়-নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত যথার্থ আইন।
(ক) তাঁদের মতে জাতীয় আইনের মত আন্তর্জাতিক আইনও কতকগুলি শাশ্বত প্রথা ও ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। আইন সকল সময়ে সার্বভৌমের আদেশ নয়। প্রথা ও রীতিনীতির ভিত্তিতেও আইনের সৃষ্টি হয়।
(খ) সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের অভাব হেতু আন্তর্জাতিক আইনকে আইনের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা অসঙ্গত। কারণ সার্বভৌম শক্তির প্রয়োজন আইন প্রয়োগের জন্য—আইনের অস্তিত্বের জন্য নয়। আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের জন্য বিশ্বসংস্থা আছে।
(গ) আন্তর্জাতিক আইনকে ভঙ্গ করা হয় বলে তা আইন হিসাবে গণ্য হতে পারে না, এ যুক্তি অসঙ্গত। আন্তর্জাতিক আইনের মত জাতীয় আইনও ভঙ্গ হয়। এতদসত্ত্বেও জাতীয় আইন ‘আইন’ হিসাবে গণ্য হলে, আন্তর্জাতিক আইনকে ‘আইন’ হিসাবে স্বীকার না করার কোন যুক্তি নেই।
(ঘ) কোন রাষ্ট্রই প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের কথা স্বীকার করে না। দোষী রাষ্ট্রও ব্যাখ্যার হেরফের করে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে সে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেনি। রাষ্ট্রসমূহের এই প্রবণতা আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের পরিচায়ক।
(ঙ) উৎসের দিক থেকে বিচার করলে আন্তর্জাতিক আইন আইন-পদবাচ্য। কারণ জাতীয় আইন ও আন্তর্জাতিক আইনের উৎসগুলি মোটামুটি এক। আবার জাতীয় আইনের মত এই আইনও ক্রমবিবর্তনের পথে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে।
(চ) ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের জন্য যেমন আইন দরকার হয়, তেমনি রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণের জন্যও আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি থেকে জনগণ জাতীয় আইনকে মান্য করে এবং রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক আইনকে মান্য করে। অর্থাৎ সাধারণ স্বীকৃতির উপর জাতীয় আইনের মত আন্তর্জাতিক আইনও প্রতিষ্ঠিত।
(ছ) আবার আন্তর্জাতিক আইন একেবারে অবলবৎযোগ্য—এই ধারণাও ভ্রান্ত। বর্তমানে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
(জ) আইন শাস্তির ভয়ে মান্য করা হয় না—মান্য করা হয় জনমতের ভয়ে। আন্তর্জাতিক আইনের পিছনে সমর্থন হিসাবে শক্তিশালী বিশ্বজনমত ক্রমশ গড়ে উঠছে।
(ঝ) গেটেলর মতানুসারে আন্তর্জাতিক আইনের যে সমস্ত ত্রুটি বর্তমানে দেখা যায়, প্রাথমিক পর্যায়ে যে-কোন আইনের ক্ষেত্রে সেগুলি থাকাই স্বাভাবিক।
উপসংহার: বস্তুতপক্ষে, উপরিউক্ত মতবাদ দুটির মধ্যে পারস্পরিক বিরোধিতার মূল কারণ হল আইনের সংজ্ঞা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। যাই হোক, বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইনবিদ্গণ আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকৃত আইনের মর্যাদা দিতে আগ্রহী। এ প্রসঙ্গে হল ও ওপেনহেইমের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁরা আন্তর্জাতিক আইনের অনুকূলে ব্যাপক ও বলিষ্ঠ বিশ্বজনমত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। পৃথিবীর সকল শান্তিকামী মানুষ দৃঢ়ভাবে এই আশা পোষণ করেন যে আন্তর্জাতিক আইন যথার্থভাবে আইনের ভূমিকা পালন করে বিশ্বশান্তি বজায় রাখতে সক্ষম হবে। আন্তর্জাতিক আইনের একটি বড় অনুমোদন হল শক্তিশালী ও সুস্থ বিশ্বজনমত। তা ছাড়া, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ এবং আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের তত্ত্বাবধানে এই আইন ক্রমশ প্রকৃত আইনের সর্ববিধ বৈশিষ্ট্য অর্জনের পথে অগ্রসর হচ্ছে। পোলক বলেছেন: “International law is a body of customs and observances in an imperfectly organised society, which have not fully acquired the character of law, but which are on the way to become law.’ বিশ্বশান্তি ও নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে বর্তমানে সকল রাষ্ট্রই যথাসম্ভব আন্তর্জাতিক আইন মান্য করে চলে। একথা অনস্বীকার্য যে, আন্তর্জাতিক আইন অমান্যের ঘটনা কখনো কখনো ঘটলেও এই আইন সাধারণ আনুগত্য লাভ করেছে। রাষ্ট্রীয় আইন কতকগুলি নৈতিক মান ও গণ-অনুমোদনের ভিত্তিতে গড়ে উঠে। আন্তর্জাতিক আইনও সাধারণত আন্তর্জাতিক ন্যায়নীতি এবং সভ্য রাষ্ট্রসমূহের অনুমোদনের ভিত্তিতে গড়ে উঠে। তাই গিলক্রিস্ট তাঁর Principles of Political Science গ্রন্থে এই মন্তব্য করেছেন : “International Law is in this way half law, half morality.” তবে আন্তর্জাতিক আইনের মধ্যে অস্পষ্টতা ও দুর্বলতা এখনও আছে। পরিশেষে স্যুম্যানের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতানুসারে মানুষ যতদিন প্রতিষ্ঠিত বিধান অনুসারে আচরণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করবে, আইনের নীতির প্রাণবন্ত এবং ক্রমবর্ধমান সমষ্টি হিসাবে আন্তর্জাতিক আইন তত দিন তার অস্তিত্ব বজায় রাখবে।
আন্তর্জাতিক আইনের পথে প্রতিবন্ধকতা
আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকৃত অর্থে আইন বলা যায় কিনা এ প্রশ্নও ওঠে। আন্তর্জাতিক আইনকে যথার্থ আইনের মর্যাদায় মণ্ডিত করার ব্যাপারে আন্তর্জাতিকতাবাদীদের আন্তরিকতার অভাব নেই। কিন্তু কতকগুলি প্রতিবন্ধকতা এক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সাফল্যের পথে বাধা হিসাবে বিরাজ করছে।
(১) আন্তর্জাতিকতাবাদী দার্শনিক রাসেল ও রাধাকৃষ্ণণ (Radha krishnan) এর মতানুসারে মানুষের ক্ষমতার দত্ত এবং মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা, ভয়, অবিশ্বাস প্রভৃতি আন্তর্জাতিক আইনের বাস্তবায়নের পথে একটি বড় বাধা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিকাশ মানুষের হাতে অমিত বিধ্বংসী ক্ষমতা এনে দিয়েছে। এই শক্তিমত্তার উন্মত্ততা শক্তিধর বৃহৎ রাষ্ট্রগুলিকে যুদ্ধোন্মাদ করে তুলেছে। এই রাষ্ট্রগুলি আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করার মধ্যেই নিজের ক্ষমতার মদমত্ততার সার্থকতা খুঁজে পায়। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ বলেছেন: “The logical outcome of power politics in the nuclear age will not be world supremacy but universal genocide.” রাসেল আন্তর্জাতিক আইনের বাস্তব রূপায়ণের পথে একটি প্রধান প্রতিবন্ধক হিসাবে মানুষের অযৌক্তিক শক্তিমত্তার কথা বলেছেন।
(২) সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধারণাও এক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রের মত বাহ্যিক ক্ষেত্রেও প্রত্যেক রাষ্ট্র অবাধ ও চরম সার্বভৌম ক্ষমতার দাবি ছাড়তে নারাজ। তার ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইনকে অগ্রাহ্য করে বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটে। এই কারণে বলা হয় যে, সার্বভৌম রাষ্ট্রের ধারণা আন্তর্জাতিক আইনের যথার্থ আইনের মর্যাদা লাভের পথে একটি অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক। রাসেল বলেছেন: “The claim to absolute sovereignty is in effect a claim that all external affairs are to be regulated purely by force.”
(৩) আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঠাণ্ডা লড়াই বা স্নায়ুযুদ্ধ আন্তর্জাতিক পথে আর একটি প্রতিবন্ধক। বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্র সমাজতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক দুই শিবিরে বিভক্ত। এছাড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি জোট-নিরপেক্ষতার নামে জোটবদ্ধ। এই অবস্থায় শক্তিধর বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জকে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের ক্ষেত্র হিসাবে ব্যবহার করছে। উভয় গোষ্ঠীর বৃহৎ শক্তিগুলির নিজেদের বা আশ্রিত কোন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তা অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। শক্তিধর বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির মধ্যে এই ঠাণ্ডা লড়াই আন্তর্জাতিক আইনের বিকাশ ও প্রয়োগের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
(৪) পুঁজিবাদ বিকশিত হয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি তখন তাদের ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য আন্তর্জাতিক আইনকে অগ্রাহ্য করতে দ্বিধা করে না। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির এই সাম্রাজ্যবাদী প্রয়াস এবং পারস্পরিক প্রতিযোগিতা আন্তর্জাতিক আইনের বিকাশের পথে অন্যতম অন্তরায়।
(৫) ল্যাস্কিকে অনুসরণ করে বলা হয় যে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলির আভ্যন্তরীণ শ্রেণী-সম্পর্কের মধ্যেও আন্তর্জাতিক আইনের অন্তরায় নিহিত থাকে। এই সমস্ত রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী আর্থনীতিক বিকাশ ও ধনবৈষম্যমূলক শ্রেণী-সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। এই অবস্থায় আর্থনীতিক দিক থেকে প্রতিপত্তিশালী শ্রেণী রাজনীতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়। এই শ্রেণী তাদের পুঁজিবাদী স্বার্থের পরিপোষণের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক আইনের যাবতীয় বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।
(৬) অন্যান্য অসুবিধা: আন্তর্জাতিক আইনের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ ও স্বাভাবিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে আরও কতকগুলি অসুবিধা আছে।
- (ক) এখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আইনকে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে বিধিবদ্ধ করা যায়নি। পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন করার মত কোন বিশ্ব আইনসভা গঠন করা এখনও সম্ভব হয়নি।
- (খ) আন্তর্জাতিক আদালত বিশ্ব-আদালত হিসাবে তার ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এই আদালতের স্বেচ্ছাধীন এলাকাভুক্ত ক্ষমতা কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়েছে। বিবদমান রাষ্ট্রগুলির পূর্ণ সম্মতি ছাড়া এই আদালত বিবাদ-বিসম্বাদের মীমাংসা করতে পারে না।
- (গ) বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে অবিশ্বাস ও পারস্পরিক সহযোগিতার অভাব এক্ষেত্রে আর একটি অন্তরায়।
- (ঘ) সর্বোপরি আন্তর্জাতিক আইনের নিয়ম-নীতিগুলি নির্ধারণের ব্যাপারে শক্তিধর বৃহৎ রাষ্ট্রগুলির মধ্যে এখনও মতপার্থক্যের অবসান ঘটেনি।
Leave a comment