ন্যায় সম্পর্কিত গ্রীক ধারণা:
দেশ-কাল ভেদে চিন্তাবিদদের মধ্যে ন্যায়-ধারণা সম্পর্কে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীনকালের গ্রীক দর্শন রাষ্ট্রতত্ত্বের বহু ও বিভিন্ন বিষয়ের উৎসস্থল হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। ন্যায়-ধারণার ক্ষেত্রেও এ কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। ন্যায় সম্পর্কিত প্রাচীন ধারণার সন্ধান গ্রীক দর্শনে পাওয়া যায়। প্রাচীনকালের পিথাগোরীয় (Pythagoreans) গ্রীক দার্শনিকদের রচনায় ন্যায়-ধারণার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। ন্যায়কে তাঁরা বর্গসম (square number) ধারণা হিসাবে দেখেছেন। এ হল সমান অংশ নিয়ে গঠিত একটি বিষয়। ন্যায়ের এই ধারণা হল সমন্বয়পূর্ণ ও সমানুপাতিক এক ধারণা। এই ধারণা অনুসারে একটি ন্যায়সঙ্গত রাষ্ট্র গঠিত হয় সুষম অংশসমূহকে নিয়ে। এবং এই সমতার নিরবচ্ছিন্ন অস্তিত্বই হল ন্যায়ের পরিচায়ক। ন্যায়ের এই ধারণায় লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অথবা আক্রমণ করার বা আক্রান্ত হওয়ার কোন বিষয় নেই। ন্যায় সম্পর্কে গ্রিক পণ্ডিত প্লেটোর ধারণার পরিচয় পাওয়া যায় তার Republic শীর্ষক বিখ্যাত গ্রন্থে। প্লেটোর ন্যায় সম্পর্কিত ধারণা বহুলাংশে অধিবিদ্যামূলক। তিনি আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ন্যায়ের ধারণাকে ব্যাখ্যা করেছেন। প্লেটোর রাষ্ট্র সম্পর্কিত মতবাদ ন্যায়ের ধারণায় পরিণতি লাভ করেছে। প্লেটোর অভিমত অনুসারে গ্রীকদের চারটি গুণগত উৎকর্ষ বর্তমান। এই সমস্ত গুণগত উপাদানের মধ্যে ন্যায় হল অন্যতম। এবং এই ন্যায়-ধারণা সকল গ্রীক নাগরিকের মনের মধ্যে বর্তমান। কিন্তু অন্য তিনটি গুণগত উৎকর্ষ রাষ্ট্রের এক-একটি শ্রেণীর মধ্যেই দেখা যায়। গ্রীকদের অন্য তিনটি গুণগত উপাদান হল: প্রজ্ঞা, শৌর্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণ। শাসকশ্রেণী প্রজ্ঞার ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করে। সৈন্যরা সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করে। এবং উৎপাদকেরা আত্মনিয়ন্ত্রণের গুণের ভিত্তিতে উৎপাদন কার্য পরিচালনা করে। যুক্তি, উৎসাহ ও চাহিদা সঙ্গত সীমার মধ্যে থাকলেও ব্যক্তি মানুষের মধ্যে ন্যায়ের অস্তিত্ব অনুধাবন করা যায়। ব্যক্তি নিজের অবস্থানগত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদন করলে এবং অপরের অবস্থানগত দায়িত্ব সম্পাদনে অবাঞ্ছিতভাবে হস্তক্ষেপ না করলে তাকেই বলে ন্যায়।
রোমান আইনবিদদের কাছে রাষ্ট্রীয় আইন হল উন্নততর আইন এবং এই আইন হল চূড়ান্ত ন্যায়ের অংশ। আইনবিদরা হল ন্যায়ের পূজারী। ভোগবাদীরা সুখ ব্যতিরেকে অন্য কোন গুণগত উৎকর্ষে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁদের মতানুসারে চূড়ান্ত ন্যায় বলে কোন কিছুই কখনো ছিল না। অগাস্টাইনের অভিমত অনুযায়ী ন্যায়ের ধারণা ধর্ম ও পবিত্রতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আবার ন্যায় বলতে শান্তিকেও বোঝায়। শান্তির অপর নাম হল ন্যায়। দেবতার সঙ্গে মানুষের সঙ্গত সম্পর্ক স্থাপন এবং সংঘাত-সংঘর্ষের অনুপস্থিতিই হল ন্যায়। ন্যায়ের অনুপস্থিতিতে দেশ চোর-ডাকাতে ভরে যাবে।
উপযোগবাদীরা ন্যায়-ধারণার সমর্থক ছিলেন না। ডেভিড হিউম ন্যায় ও স্বাধীনতার ধারণার পরিবর্তে উপযোগের নীতির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি স্বাভাবিক স্বাধীনতা ও ন্যায়ের ধারণাকে উপহাস করেছেন। বেহাম সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক সুখের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এবং তিনি এই নীতির মানদণ্ডে ন্যায়-অন্যায় যাচাই করার কথা বলেছেন। ন্যায়ের সর্বজনীন আইনকে তিনি রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসাবে দেখার পক্ষপাতী নন। মানুষের চাহিদা পূরণের মধ্যেই রাষ্ট্রের ভিত্তি বর্তমান।
ন্যায় সম্পর্কে মার্কসীয় মতবাদ
ন্যায় সম্পর্কিত মতবাদগুলি মূলত দুধরনের: উদারনীতিক ও মার্কসবাদী। ন্যায় সম্পর্কিত মার্কসীয় মতবাদ এ বিষয়ে উদারনীতিক মতবাদ থেকে স্বতন্ত্র। ন্যায়-ধারণা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মার্কস মূলত উৎপাদন-সম্পর্কের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় ন্যায়-ধারণা পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থা এবং পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল। এই অবস্থায় একমাত্র উৎপাদন-উপাদানের মালিক শ্রেণীর ক্ষেত্রেই ন্যায়ের ধারণা অর্থবহ প্রতিপন্ন হয়। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শ্রমজীবী জনতার কাজে আনুষ্ঠানিকভাবে যা ন্যায়, বাস্তবে তা হল অন্যায়। মার্কস ন্যায়-ধারণা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রধোর মত সমাজতান্ত্রিকদের সমালোচনা করেছেন। প্রুধোঁ সামাজিক ন্যায়ের তত্ত্ব প্রচার করেছেন; কিন্তু তিনি সামাজিক সমস্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক ন্যায়ের প্রাসঙ্গিকতাকে অনুধাবন করতে পারেননি। মার্কসের মতানুসারে ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বণ্টনমূলক ন্যায়ের ধারণা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক। এ ধরনের সমাজব্যবস্থায় কেবলমাত্র উৎপাদন উপাদানের মালিক শ্রেণীর পক্ষেই ন্যায়ের ধারণার প্রাসঙ্গিকতা পরিলক্ষিত হয়; শ্রমিক শ্রেণীর ক্ষেত্রে ন্যায় বলে কিছু থাকে না। একমাত্র উৎপাদন উপাদানের উপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলে এবং শোষক শ্রেণীর অবসান ঘটলে মেহনতী মানুষের জন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে।
মার্কসীয় দর্শনে ন্যায়ের ধারণাকে শ্রেণী-সংগ্রামের মতবাদের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। মার্কসবাদীদের মতানুসারে রাষ্ট্র হল শ্রেণী-শোষণের একটি যন্ত্র বিশেষ। রাষ্ট্র একটি শ্রেণীর পক্ষে অপর একটি শ্রেণীর উপর শাসন-শোষণ কায়েম করে। স্বভাবতই এরকম রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গেই ন্যায় ও আইন-ব্যবস্থা সম্পর্কযুক্ত। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শাসক বুর্জোয়া শ্রেণী নিজেদের ক্ষমতাসীন রাখার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করে। সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। সর্বহারার একনায়কতন্ত্র কায়েম হয়। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার জায়গায় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে সহায়ক আইন প্রণীত ও কার্যকর হয়। শ্রমজীবী জনতার অগ্রবর্তী বাহিনী হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। কমিউনিস্ট পার্টির তত্ত্বাবধানেই সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম গৃহীত ও পরিলক্ষিত হয়। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আদালত বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
ন্যায়-ধারণা সম্পর্কে রাফায়েল:
বার্কার তাঁর Principles of Social and Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে ন্যায়-ধারণা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা করা হয়েছে। অতঃপর ‘ন্যায়’ সম্পর্কে রাফায়েলের ধারণা আলোচনা করা আবশ্যক। র্যাফায়েল তাঁর Problem of Political Philosophy শীর্ষক গ্রন্থে ন্যায়-ধারণা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি আইন ও সামাজিক নৈতিকতার পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়-ধারণা বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মতানুসারে ন্যায়-ধারণাকে আইনের এলাকা থেকে আলাদা করা যায় না। সমাজজীবনে আইন বিভিন্ন বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে এবং এইভাবে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করে। দেশের সমগ্র আইনব্যবস্থাকে সমাজের সম্পূর্ণ ন্যায়-ব্যবস্থা হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। আবার ন্যায়-ধারণার উৎস হিসাবে প্রচলিত প্রথা চলে আসা দৃষ্টান্ত ও আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনের কথা বলা হয়। রাফায়েলের অভিমত অনুসারে ন্যায়-ধারণার ভিত্তিতে সামাজিক নৈতিকতার কাঠামোটি গড়ে ওঠে। ন্যায় ব্যতিরেকে সামাজিক নৈতিকতার অস্তিত্ব অসম্ভব। অর্থাৎ আইনের মত সামাজিক নৈতিকতার সঙ্গেও ন্যায়-ধারণা সম্পর্কযুক্ত। প্রকৃত প্রস্তাবে সামাজিক নৈতিকতা ও আইন এই দুটি ক্ষেত্রেই ন্যায়-ধারণার প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। শৃঙ্খলা বিন্যাসের সঙ্গেও ন্যায়-ধারণার সংযোগ সম্পর্ক বর্তমান। শৃঙ্খলা-বিন্যাসের অভাব ন্যায়ের অভাবকে প্রতিপন্ন করে। বিশৃঙ্খল অবস্থায় ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। ন্যায় ধারণা বৈধ ও নৈতিক হতে পারে। এ দিক থেকে বৈধ ন্যায় ও নৈতিক ন্যায়ের কথা বলা হয়। আবার ন্যায়ের ধারণা স্থিতাবস্থা ও পরিবর্তনশীলতা উভয়ের পরিপোষক হতে পারে। অর্থাৎ ন্যায়-ধারণা সমকালীন সমাজের স্থিতাবস্থা সংরক্ষণের পক্ষপাতী হতে পারে, আবার সংস্কারমূলক প্রগতিশীল ব্যবস্থাদির পক্ষপাতী হতে পারে। এ হল রক্ষণাত্মক ও সংস্কারমূলক ন্যায়ের কথা। সংস্কারমূলক ন্যায় হল সামাজিক ন্যায়। সাধারণত সমাজসংস্কারকদের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়।
ন্যায় সম্পর্কিত সাবেকী ধারণায় বিচারবুদ্ধির প্রভাব:
ন্যায়-ধারণার উৎস হিসাবে যুক্তি বা বিচারবুদ্ধি (reason)-র উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। আবার সমকালীন সামাজিক সচেতনতার উপর বিচারবুদ্ধি বহুলাংশে নির্ভরশীল। সুতরাং সমকালীন সামাজিক সচেতনতার পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়-ধারণার সঠিক অর্থ অনুধাবন করা যায়। এই সামাজিক সচেতনতাকেই র্যাফায়েল আধুনিক সচেতনতা হিসাবে অভিহিত করেছেন। সামাজিক সচেতনতা হল গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল। স্বভাবতই ন্যায়-ধারণাও হল গতিশীল ও পরিবর্তনশীল। কালের পরিবর্তন ও সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে নতুন ও প্রগতিশীল ন্যায়-ধারণার সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। তবে ন্যায়-ধারণা বিচারবুদ্ধির দ্বারা সমর্থিত হওয়া আবশ্যক। ন্যায় সম্পর্কিত সাবেকি ধারণায় বিচারবুদ্ধি, যুক্তি ও নৈতিকতার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। ন্যায়ের সনাতন ধারণায় ন্যায়পরায়ণ মানুষের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। গুরুত্ব আরোপ করা হয় সেই সমস্ত গুণগত উপাদান ও উৎকর্ষের উপর যা মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের পরিধিকে প্রসারিত করে। বলা হয় যে, আইন ও প্রচলিত রীতিনীতির ভিত্তিতে নির্ধারিত মর্যাদা বা অবস্থা অনুসারে প্রত্যেকে নিজের নিজের দায়িত্ব সম্পাদন করবে। গ্রীক পণ্ডিত প্লেটো ন্যায় সম্পর্কিত মতবাদ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণীর নাগরিকের স্বতন্ত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে এই দায়িত্ব ও কর্তব্যের সঠিক সম্পাদনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ গুণাবলীর উৎকর্ষ সাধনের ব্যাপারে সকল নাগরিক সাধ্যমত উদ্যোগী হবে। এ ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্যের মাধ্যমে ন্যায়ের অভিব্যক্তি ঘটে। এই জায়গায় প্রত্যেকের উপনীত হওয়া আবশ্যক। এবং এই উদ্দেশ্যের সার্থক বাস্তবায়নের জন্য ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের উপর বিচারবুদ্ধির অনুশাসন আবশ্যক। ন্যায়ের অনুবর্তী রাষ্ট্রে সরকারী ক্ষমতায় আসীন থাকবেন দার্শনিক রাজা (Philosopher King)। এবং এই দার্শনিক রাজা হলেন যুক্তি ও বিচারবুদ্ধির জীবন্ত প্রতীক। ন্যায় সম্পর্কিত সাবেকী ধারণা অনুসারে ব্যক্তিকে সমাজজীবনের এক পূর্বনির্ধারিত আদর্শের অনুগামী হতে বলা হয়।
ন্যায়ের আধুনিক ধারণা ও সামাজিক ন্যায়:
ন্যায় সম্পর্কিত সনাতন ধারণা ও আধুনিক ধারণার মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ন্যায় সম্পর্কিত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কতকগুলি মানুষের মানবিক মূল্যবোধের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এবং এই সমস্ত মূল্যবোধের বাস্তবায়নের জন্য সমাজব্যবস্থায় সংস্কার সাধন বা পরিবর্তনের উপর জোর দেওয়া হয়। ন্যায় সম্পর্কিত সাবেকী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে এখন সামাজিক ন্যায়ের আধুনিক ধারণার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সংস্কারবাদী ন্যায়-ধারণা বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার সংস্কার সাধন বা পরিবর্তন সাধনের পক্ষপাতী। সংস্কারবাদী ন্যায়-ধারণা জনসাধারণের প্রয়োজন পূরণের পক্ষপাতী। ন্যায়ের এই ধারণাকেই বলে সামাজিক ন্যায়। সামাজিক ন্যায় সামাজিক পরিবর্তনের পিছনে সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করে। সমাজব্যবস্থার মধ্যে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠই হল সামাজিক ন্যায়। সমাজব্যবস্থার কাছে ব্যক্তিবর্গের ন্যায্য দাবিদাওয়ার অভিব্যক্তিই হল সামাজিক ন্যায় বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা যখন শোষণ-পীড়ন ও অন্যায়-অবিচারের পরিপ্রেক্ষিতে অসহনীয় হয়ে পড়ে তখন মানুষ সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। এবং মানুষ সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক সংস্কার সাধনের সামিল হয়। অর্থাৎ সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক পরিবর্তনের দাবি উঠে সামাজিক ন্যায়ের ধারণা অনুসারে একটি বিশেষ প্রজ্ঞার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সমগ্র বিশ্বসংসারের উপর এই প্রজ্ঞার প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
ন্যায়-ধারণার প্রকারভেদ:
ন্যায় ধারণা গণতন্ত্রের অন্যতম মূল স্তম্ভ হিসাবে বিবেচিত হয়। গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে ন্যায়ের ধারণা ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। আধুনিককালে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। তার ফলে মানুষের জীবনধারার সকল ক্ষেত্রে ন্যায়ের ধারণা সম্প্রসারিত হয়েছে। সমাজজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ন্যায়-ধারণার প্রয়োগ ও প্রসারের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক, অর্থনীতিক ও রাজনীতিক ন্যায়ের পরিচয় পাওয়া যায়। তা ছাড়া আইনগত ন্যায়ের কথা বলা হয়। ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় সামাজিক, আর্থনীতিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। ন্যায়-ধারণার এই প্রকারভেদ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা আবশ্যক। ন্যায়-ধারণার প্রকারভেদ প্রসঙ্গে সামাজিক ন্যায়, আর্থনীতিক ন্যায়, রাজনীতিক ন্যায়, আইনগত ন্যায় প্রভৃতির কথা বলা হয়। কিন্তু ন্যায়ের এই সমস্ত ধরন সম্পর্কে স্বাতন্ত্র্যমূলক আলোচনা সর্বাংশে স্বীকার্য নয়। কারণ ন্যায়ের এই ধরনগুলির মধ্যে পার্থক্যের সীমানা মোটেই সুস্পষ্ট নয় বরং বহুলাংশে অস্পষ্ট। এক ধরনের ন্যায়ের আলোচনায় যা আসে অন্য ধরনের ন্যায় সম্পর্কিত আলোচনায়ও তা আসে। এ প্রসঙ্গে জোহারি যথার্থই বলেছেন: “… while the case of positive justice may be said to involve there broad dimensions-social, economic and political we cannot draw a water light boundary line between them. As a matter of fact borderlines are fluid and what comes under one category is amenable to fall under another also.”
Leave a comment