অ্যালমন্ড ও পাওয়েল তাঁদের Comparative Politics: A development Approach শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক উন্নয়ন সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে অ্যালমন্ড ও কোলম্যান-এর The Politics of the Developing Areas শীর্ষক গ্রন্থটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উপরি-উল্লিখিত দুটি গ্রন্থেই আধুনিকীকরণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ধারণা হিসাবে রাজনীতিক উন্নয়ন প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। অ্যালমন্ড ও পাওয়েল রাষ্ট্র ও সরকারের ধারণার পরিবর্তে রাজনীতিক ব্যবস্থা (Political system) -র ধারণা গ্রহণ করেছেন। তাঁদের অভিমত অনুসারে আগেকার রাজনীতিক ব্যবস্থার তুলনায় আধুনিক উন্নত রাজনীতিক ব্যবস্থাসমূহ সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে অধিক মাত্রায় সক্ষম। এই দুই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাজনীতিক উন্নয়নের ক্রিয়ামূলক দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়নের নির্ধারক ও পর্যায় প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। বলা হয়েছে যে রাজনীতিক ব্যবস্থার কার্যাবলীর উপর তার উন্নয়ন নির্ভরশীল। অ্যালমন্ডের মতানুসারে রাজনীতিক ব্যবস্থার সামর্থ্য তিনটি পর্যায়ের কার্যাবলীর উপর ভিত্তিশীল। এগুলি হল রূপান্তর প্রক্রিয়া সম্পর্কিত, পরিচালনা সম্পর্কিত ও অভিযোজন সম্পর্কিত। রাজনীতিক ব্যবস্থার সামর্থ্য বলতে বিদ্যমান পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে কার্য সম্পাদনের প্রক্রিয়াকে বোঝায়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে গণতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় (Democratic Political System) ক্ষমতার বণ্টন নীতিকে অনুসরণ করা হয় এবং সর্বাত্মক রাজনীতিক ব্যবস্থায় (Totalitarian Political System) নিয়ন্ত্রণের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। স্বভাবতই এই দু’ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থার সামর্থ্য অভিন্ন নয়। সরকার চাহিদা ও সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। একেই বলে রূপান্তর প্রক্রিয়া। রাজনীতিক ব্যবস্থার অংশসমূহকে সাবলীল করাকেই অ্যালমন্ড সংযোজন ও অভিযোজন হিসাবে অভিহিত করেছেন। রাজনীতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন এই কাজের মানের উপর নির্ভরশীল। রাজনীতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান কাঠামোর মাধ্যমে একটি স্থির ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। যেমন, আদালত এই কাঠামোর ভূমিকা হল বিচারকার্য সম্পাদন করা। অ্যালমন্ড ও পাওয়েল রাজনীতিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত অংশসমূহের স্বাতন্ত্র্য এবং কাঠামোগত বৈচিত্র্যের ব্যাপারেও আলোচনা করেছেন।
রাজনীতিক উন্নয়ন বিকাশ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অ্যালমন্ড-পাওয়েল রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এই দুই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাজনীতিক উন্নয়ন প্রসঙ্গে চারটি সমস্যার কথা বলেছেন। এই চারটি সমস্যা হল:
-
(১) রাষ্ট্রগঠন (State Building),
-
(২) জাতি-গঠন (Nation Building),
-
(৩) রাজনীতিক অংশগ্রহণ (Political Participation) এবং
-
(৪) বণ্টন ও কল্যাণ সাধন (Distribution and Welfare)
(১) রাষ্ট্র-গঠন: অ্যালমন্ড ও পাওয়েলের মতানুসারে রাষ্ট্রের বিভিন্ন নতুন কাঠামো গড়ে তোলা এবং বিদ্যমান কাঠামোগুলির মধ্যে বিশেষীকরণের ব্যবস্থা (differentiation)-ই হল রাষ্ট্রগঠন। অর্থাৎ আধুনিক সরকারী ও প্রশাসনিক হাতিয়ার ও সহায়ক মাধ্যম থাকা দরকার। অনগ্রসর দেশগুলিতে রাষ্ট্র নিম্নমানের প্রশাসনিক হাতিয়ার ও অপ্রতুল সংগঠনের সাহায্যে কাজকর্ম পরিচালনা করে। পশ্চাদপদ দেহসমূহে বিভিন্ন ধরনের আর্থ-রাজনীতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমস্যাদির সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও বিশেষীকৃত সংগঠন রাষ্ট্রের হাতে থাকে না। অথচ উন্নতিকামী বা উন্নতিশীল দেশগুলিতে এ রকম নানান সমস্যা বিভিন্ন সময়ে দেখা দেয়। সামান্য কিছু সাংগঠনিক হাতিয়ারের সাহায্যে সকল রকম সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও আর্থ রাজনীতিক সংকটের মোকাবিলার চেষ্টা করা হয়। এই সমস্ত দেশে সুসংগঠিত আমলাতন্ত্র, সুসংহত বিচারব্যবস্থা, আইনের অনুশাসন প্রভৃতি বিশেষীকৃত সংগঠনসমূহের অভাব পরিলক্ষিত হয়। বহু ও বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য সরকার যখন পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক হাতিয়ার গড়ে তোলে তখনই রাষ্ট্র গঠনের কাজ সম্পন্ন হয়। রাষ্ট্র গঠন বলতে বোঝায় যে সমস্ত ধরনের আধুনিক রাজনীতিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এই সমস্ত কাঠামো হবে বিশেষীকৃত। অর্থাৎ এ রকম এক-একটি কাঠামোর উপর বিশেষ একটি কার্য সম্পাদনের দায়িত্ব থাকবে। তা ছাড়া সমগ্র দেশ জুড়ে, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সমস্ত কাঠামোর কাজকর্ম ছড়িয়ে পড়বে।
(২) জাতি-গঠন: জাতি-গঠন বলতে প্রকৃত প্রস্তাবে জাতীয় সংহতিকে বোঝায়। এর অর্থ সংকীর্ণ আনুগত্যের পরিবর্তে ব্যক্তি রাষ্ট্র বা জাতির (nation) প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করবে। ব্যক্তির আনুগত্য পরিবার, জাতি-গোষ্ঠী, জাতি (caste) বা সম্প্রদায় (community), ধর্ম, অঞ্চল প্রভৃতি সংকীর্ণ বিষয়াদিগত হবে না। ব্যক্তি মানুষের আনুগত্য সমগ্র জাতির (nation) প্রতি প্রসারিত হবে। রাষ্ট্র গঠন এবং জাতি গঠন এক সঙ্গে সম্পন্ন হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। উন্নতিশীল কোন কোন রাষ্ট্রগঠনের সমস্যার সমাধান হওয়ার পরও জাতি গঠনের সমস্যা থেকে যায়।
(৩) রাজনীতিক অংশগ্রহণ: রাজনীতিকভাবে কোন সমাজ বিকশিত হতে থাকলে, সংশ্লিষ্ট সমাজের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের ব্যাপারে অধিকতর আগ্রহী হয়ে উঠে। তারা এই প্রক্রিয়ায় অংশীদার হওয়ার ব্যাপারে দাবি জানাতে থাকে। এই দাবি অভিব্যক্তি লাভ করে সাধারণত রাজনীতিক দল, চক্রী দল, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী প্রভৃতি রাজনীতিক কাঠামোর মাধ্যমে। এই সমস্ত চাহিদার প্রতি সরকারকে সদ্ব্যর্থক প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করতে হয়। সরকারকে এই উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় রাজনীতিক পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হয়। এইভাবে রাজনীতিক অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি ও সম্প্রসারিত করতে হয়।
(৪) বণ্টন ও কল্যাণসাধন: রাজনীতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুফলসমূহে, জাতীয় আয় প্রভৃতি সমভাবে বণ্টনের দাবি উত্থাপিত হয়। দাবি করা হয় যে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সকল অংশের মধ্যে কল্যাণমূলক ব্যবস্থাদির সুফল সমভাবে বণ্টিত হবে। সকলকে সমান সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। সরকারী চাকরী বা পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে গুণগত যোগ্যতাই হবে একমাত্র বিবেচ্য বিষয়।
Leave a comment