আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় রাজনীতিক পরিবর্তনের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতি ও বিকাশ এ ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। রাজনীতিক মতাদর্শের সঙ্গে রাজনীতিক পরিবর্তনের বিষয়টিও তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনীতিক মতাদর্শ ও রাজনীতিক পরিবর্তন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।

পরিবর্তনের সংজ্ঞা:

পরিবর্তন হল প্রকৃতির নিয়ম। সর্বত্র সর্বক্ষেত্রে পরিবর্তন প্রতিনিয়ত পরিলক্ষিত হয়। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থনীতিক এবং রাজনীতিক ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন প্রতিপন্ন হয়। রাজনীতিক পরিবর্তন হল সামাজিক পরিবর্তনেরই অংশবিশেষ। পরিবর্তন বলতে কোন বিষয়ে একটি অবস্থান থেকে আর একটি অবস্থানে উপনীত হওয়াকে বোঝায়। Tribal Politics in West Bengal শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে: “Change as such means that there is some alteration through periods of time in the object under reference.” বস্তুত পরিবর্তন হল আগের অবস্থা থেকে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হওয়া। পরিবর্তন মূল্যমানের (value judgement) ধারণার সঙ্গে সম্পর্ক রহিত। বিশেষ একটি পরিবর্তন ভাল হতে পারে বা মন্দ হতে পারে। অর্থাৎ পরিবর্তন মূল্যমান-নিরপেক্ষ (value neutral)। কোন একটি‌ রাজনীতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তনের ফলশ্রুতি হিসাবে সংশ্লিষ্ট সমাজের প্রগতি বা পশ্চাদগতি ঘটতে পারে। এই অর্থে রাজনীতিক পরিবর্তন সম্পর্কিত ধারণা অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক। রাজনীতিক পরিবর্তনের ধারণার মধ্যে রাজনীতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও রাজনীতিক অবনয়নের ধারণা বর্তমান থাকে। রাজনীতিক পরিবর্তন মানেই রাজনীতিক উন্নয়ন নয়। কিন্তু রাজনীতিক উন্নতি বলতে সব সময় রাজনীতিক ক্ষেত্রে অগ্রবর্তী হওয়াকে বা প্রগতিকে বোঝায়। রাজনীতিক উন্নতির অর্থ হল উন্নততর অবস্থায় রাজনীতিক ব্যবস্থায় উপনীত হওয়া বা অধিকতর প্রগতিশীল প্রশাসনিক পর্যায়ে উপনীত হওয়া।

রাজনীতিক পরিবর্তনের ধারণা:

রাজনীতিক পরিবর্তন সম্পর্কিত ধারণাটির পর্যালোচনা ব্যতিরেকে রাজনীতিক মতাদর্শের সঙ্গে এর সঠিক সম্পর্ক অনুধাবন করা যাবে না। বস্তুত ‘রাজনীতিক পরিবর্তন? কোন নতুন বিষয় নয়। রাজনীতিক পরিবর্তন যে-কোন রাজনীতিক ব্যবস্থার একটি স্বাভাবিক দিক। একে কেবল আধুনিক বলা যায় না। প্রকৃত প্রস্তাবে পরিবর্তন ব্যাপারটাই মানুষের মত প্রাচীন। বিশিষ্ট সমাজতত্ত্ববিদ্ সচ্চিদানন্দ তাঁর Profiles of Tribal Culture in Bihar শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Change is an old as man.” রাজনীতিক পরিবর্তন বলতে রাজনীতিক ব্যবস্থার রূপান্তর বা অবস্থান্তরকে বোঝায়। রাজনীতিক কাঠামো, আচার-আচরণ, বিধিরীতি, মূল্যবোধ প্রভৃতিতে পরিবর্তন ঘটলে তাকে রাজনীতিক পরিবর্তন বলা যায়। রাজনীতিক পরিবর্তন হল এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোন নির্দিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থায় কাঠামো ও কার্যগত (structural and functional) পরিবর্তন ঘটে। অন্যভাবে বলা যায় যে, কাঠামো ও কার্যাবলীর ক্ষেত্রে রাজনীতিক ব্যবস্থার যে সংগঠনগত পরিবর্তন ঘটে তা রাজনীতিক পরিবর্তন হিসাবে প্রতিপন্ন হয়।

বটোমারের রাজনীতিক পরিবর্তনের ব্যাখ্যা:

বটোমার রাজনীতিক পরিবর্তনের ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। বর্তমান শতাব্দীর বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ব্যাপক রাজনীতিক পরিবর্তনের ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে বড় মাপের রাজনীতিক পরিবর্তন বলতে রাজনীতিক ক্ষেত্রে সেই রূপান্তরকে বোঝায় যার মাধ্যমে সরকারী যন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সম্পাদিত হয় এবং সামাজিক গোষ্ঠীসমূহের ক্রমোচ্চ স্তরবিন্যাস (hierarchical stratification)-এর পুনর্বিন্যাস সহ অপরাপর সামাজিক সম্পর্কের কাঠামোগত তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন সংঘটিত হয়। উল্লেখযোগ্য রাজনীতিক পরিবর্তনের উদাহরণ হিসাবে অধ্যাপক বটোমোর সমগ্রতাবাদী ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের অভ্যুত্থান এবং জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশের কথা বলেছেন। বর্তমান শতাব্দীর রাজনীতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সমগ্রতাবাদী প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। আবার এই বিংশ শতাব্দীতেই সমগ্রতাবাদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়াও পরিলক্ষিত হয়। আবার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্তরণের পথে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী প্রতিক্রিয়া প্রতীয়মান হয়।

সংস্কারমূলক রাজনৈতিক পরিবর্তন:

রাজনীতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এই প্রক্রিয়াগত পার্থক্যের পিছনে রাজনীতিক মতাদর্শগত পার্থক্য বর্তমান থাকে। রাজনীতিক পরিবর্তন দু’ধরনের হতে পারে : সংস্কারমূলক এবং বৈপ্লবিক। সংস্কারমূলক রাজনীতিক পরিবর্তনে যারা বিশ্বাসী তাদের উদ্দেশ্য হল প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থার অস্তিত্বকে অটুট রাখা এবং সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা। এই উদ্দেশ্যে সংস্কারপন্থীরা সংস্কারমূলক আইন প্রণয়ন এবং আনুষঙ্গিক শাসনতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থাদি অবলম্বন করার পক্ষপাতী। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে পুঁজিবাদী বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের সংস্কারমূলক মতাদর্শের কথা বলা যায়। এই শ্রেণীর চিন্তাবিরা রাজনীতিক পরিবর্তনের ব্যাপারে মতৈক্যের ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে চান। উদারনীতিক গণতন্ত্রের প্রবক্তারাও রাজনীতিক ক্ষেত্রে সংস্কারমূলক পরিবর্তনের পক্ষপাতী। শ্রেষ্ঠতাবাদেও মূলত শাসনতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাজনীতিক পরিবর্তনের কথা বলা হয়।

বৈপ্লবিক রাজনীতিক পরিবর্তন:

আবার রাজনীতিক পরিবর্তন বৈপ্লবিক প্রকৃতির হতে পারে। রাজনীতিক ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনকে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলে। এই ধরনের পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হল বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার বিলোপ সাধন এবং নতুন রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। মার্কসীয় মতাদর্শ অনুসারে রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা বলা হয়। মার্কসবাদে আমূল পরিবর্তনের জন্য শ্রেণী সংগ্রাম ও বিপ্লবের পথ অনুসরণ করার কথা বলা হয়। মার্কসীয় দর্শন অনুসারে সমাজের সর্বহারা শ্রেণী ঐক্যবদ্ধভাবে পুঁজিপতি শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের সামিল হবে এবং তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করবে। এইভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।

রাজনীতিক পরিবর্তন ও রাজনীতিক মতাদর্শ পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। রাজনীতিক মতাদর্শের উদ্দেশ্য হল রাজনীতিক ব্যবস্থার উৎসাদন বা পরিবর্তন প্রতিরোধ করা বা পরিবর্তনের ভিত্তি প্রস্তুত করা। যেমন, বুর্জোয়া রাজনীতিক মতাদর্শের উদ্দেশ্য হল বুর্জোয়া রাজনীতিক ব্যবস্থার সংরক্ষণ বা পরিবর্তন প্রতিরোধ। আবার মার্কসীয় রাজনীতিক মতাদর্শের মূল হল শোষণমূলক বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন বা উৎসাদন এবং নতুন শোষণহীন সমাজব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা আবশ্যক যে রোম সাম্রাজ্যের পতনের ক্ষেত্রে রোমক আইনের ভূমিকা এবং ব্রিটিশ উপনিবেশসমূহের পতনের ক্ষেত্রে সংসদীয় গণতান্ত্রিক মতাদর্শের অবদান অনস্বীকার্য।

ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস ও রাজনীতিক পরিবর্তন:

রাজনীতিক পরিবর্তন বাহ্যিক প্রেক্ষাপটে সব সময় সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হবেই, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে এ ধরনের রাজনীতিক পরিবর্তন অনুভূত হয়ে থাকে। রাজনীতিক পরিবর্তন বিভিন্ন কারণে সম্পন্ন হয়ে থাকে। এ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সমাজব্যবস্থার চেহারা-চরিত্রের উপর নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার, শাসক-গোষ্ঠীর যোগ্যতা ও অযোগ্যতা, সামরিক অভ্যুত্থান বা প্রাসাদ বিপ্লব, বিশিষ্ট এলিট গোষ্ঠীর অভ্যুত্থান বা অবসান, বৌদ্ধিক বা সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তবে রাজনীতির কেন্দ্রীয় কথা হল ক্ষমতা। এই কারণে সমাজে ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসের দৃশ্যপটে রাজনীতিক পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে সামাজিক ক্ষেত্রে ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন সূচিত হয়। সামাজিক ক্ষমতার অধিকারীর পরিবর্তন ঘটলে সরকারী ক্ষমতার অধিকারীরও পরিবর্তন ঘটে। এ ধরনের রাজনীতিক পরিবর্তন স্থানীয়, আঞ্চলিক বা জাতীয় স্তরে সংঘটিত হতে পারে।

অনুকূল পরিস্থিতি ও রাজনীতিক সংগঠন:

রাজনীতিক পরিবর্তনের পিছনে বিভিন্ন কারণ বর্তমান থাকে। তবে এ কথা ঠিক যে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থায় সংকটের সৃষ্টি হলে পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত হয়। এই সংকট ব্যাপক হলে রাজনীতিক পরিবর্তনের মাত্রাও বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ রাজনীতিক পরিবর্তনের জন্য অনুকূল পরিস্থিতির প্রয়োজন আছে। বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তনের দাবি তীব্রতর হলে রাজনীতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের অনুকূল হয়ে উঠে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে রাজনীতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে সফল করে তোলার ক্ষেত্রে পরিবর্তনকামী রাজনীতিক সংগঠনের সহায়ক ভূমিকার গুরুত্বও অনস্বীকার্য। দেশবাসীর উপর রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলীর প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। জনসাধারণের রাজনীতিক মূল্যবোধ বা মনোভাবের সংরক্ষণ বা পরিবর্তনের ব্যাপারে রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকার কার্যকারিতা বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কোন কোন রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান রাজনীতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের পক্ষে সহায়ক ভূমিকা পালন করে; আবার কোন কোন রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতাবস্থা সংরক্ষণের পক্ষে ভূমিকা পালন করে।

রাজনীতিক দলের ভূমিকা:

রাজনীতিক পরিবর্তন সাধন বা রাজনীতিক পরিবর্তন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে রাজনীতিক দল সংগঠিতভাবে ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশেষ কোন রাজনীতিক মতাদর্শকে প্রয়োগ ও‌ প্রতিষ্ঠিত করা, রাজনীতিক পরিবর্তনকে সম্ভব করে তোলা বা রাজনীতিক পরিবর্তনকে আটকান প্রভৃতি ক্ষেত্রে সুসংগঠিত রাজনীতিক দলের ভূমিকা এক কথায় তাৎপর্যপূর্ণ। স্বভাবতই রাজনীতিক পরিবর্তন সাধন বা পরিবর্তন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বিপ্লবী রাজনীতিক দলের মত একটি প্রতিবিপ্লবী রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব ও সক্রিয় ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। মহামতী লেনিনের অভিমত অনুসারে বিপ্লবকে সম্ভব করে তোলার জন্য একটি বিপ্লবী রাজনীতিক প্রতিবিপ্লবী দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য। রাজনীতিক পরিবর্তনের অনুকূলে বা প্রতিকূলে বিভিন্ন রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। যেমন, শ্রেণী-বৈষম্য ও শ্রেণী-শোষণযুক্ত সমাজব্যবস্থায় আর্থনীতিক ক্ষেত্রে প্রাধান্যকারী সংখ্যালঘু শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণে বিদ্যমান রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানগুলি ভূমিকা পালন করে। তার ফলে ন্যায়-নীতিহীন পথে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের উপর শাসন শোষণ কায়েম হয়। এই অবস্থায় সাম্যবাদী বিপ্লবী দল শ্রেণীহীন, শোষণশূন্য সাম্যবাদী সমাজের আদর্শ প্রচার করে। এবং এই রাজনীতিক মতাদর্শে শোষিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানবগোষ্ঠীকে অনুপ্রাণিত করে ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সহায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

রাজনীতিক পরিবর্তনের পিছনে আর্থনীতিক শক্তির ক্রিয়া:

রাজনীতিক পরিবর্তনের পিছনে বিভিন্ন কারণ ক্রিয়াশীল হয়ে থাকে। তবে রাজনীতিক পরিবর্তন সাধনের ক্ষেত্রে আর্থনীতিক শক্তির প্রাধান্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। রাজনীতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মৌলিক শক্তি হিসাবে আর্থনীতিক শক্তির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য। মার্কসীয় দর্শন অনুযায়ী উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় থাকা অবধি সমাজে সমকালীন সামাজিক ও রাজনীতিক ব্যবস্থা বহাল থাকে। কালক্রমে উৎপাদন শক্তির বিকাশের সঙ্গে প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্ক সামঞ্জস্যহীন হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। একেই বলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মার্কসবাদে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা বলা হয়। সমাজব্যবস্থায় আর্থনীতিক কাঠামোর পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন সূচিত হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ ও প্রসারের পরিপ্রেক্ষিতে নিরন্তর আর্থনীতিক ক্ষেত্রে বিকাশ ঘটছে। মানবসমাজে ও সমাজবাসীদের উপর আর্থনীতিক বিকাশের প্রভাব সর্বব্যাপক। স্বভাবতই রাজনীতিক সংগ্রাম আর্থনীতিক বিকাশের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। প্রাযুক্তিক ও আর্থনীতিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে অর্জিত গুণাবলীর ভিত্তিতে সমাজের বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠী বিশিষ্ট হয়ে উঠে। বিশিষ্ট সামাজিক গোষ্ঠীসমূহ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে উপনীত হয়। তার ফলে সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক শক্তি-সাম্যের পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তন রাজনীতিক পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করে।

রাজনীতিক ব্যবস্থার সংকট:

সমকালীন রাজনীতিক ব্যবস্থার সংকটের প্রকৃতি ও ব্যাপকতার উপর রাজনীতিক পরিবর্তনের মাত্রা বহুলাংশে নির্ভরশীল। কোন দেশের রাজনীতিক ব্যবস্থায় সংকট তীব্র ও প্রকট হয়ে পড়লে, প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিও প্রবলভাবে প্রতিপন্ন হয়। একে বলে পরিবর্তনের পরিস্থিতি। রাজনীতিক পরিবর্তন সাধনের স্বার্থে এই পরিস্থিতির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অন্যথায় কেবলমাত্র পরিবর্তনকামী রাজনীতিক সংগঠনের মাধ্যমে রাজনীতিক পরিবর্তন সাধন অসম্ভব।

রাজনীতিক মতাদর্শের দ্বিবিধ ভূমিকা:

প্রত্যেক রাজনীতিক ব্যবস্থায় একটি প্রাধান্যকারী মতাদর্শ থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য রাজনীতিক মতাদর্শ ও থাকে। রাজনীতিক মতাদর্শের ভূমিকার দুটো দিক আছে। বিশেষ একটি রাজনীতিক ব্যবস্থা সংরক্ষণ করা হল একটি দিক এবং আর একটি দিক হল অন্য সকল রাজনীতিক ব্যবস্থার বিলোপ সাধন। প্রতিটি রাজনীতিক মতাদর্শ নির্দিষ্ট একটি রাজনীতিক ব্যবস্থা সংরক্ষণের জন্য কাজ করে; তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক ব্যবস্থায় বিরোধী ব্যবস্থার অগ্রগতি প্রতিহত করার জন্যও কাজ করে। এই কারণে প্রত্যেক রাজনীতিক মতাদর্শ প্রথম রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈধকরণের ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করে এবং অন্যান্য বিরোধী রাজনীতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিকূল ভূমিকা গ্রহণ করে। অর্থাৎ প্রত্যেক রাজনীতিক ব্যবস্থার সপক্ষে রাজনীতিক মতাদর্শ থাকে, আবার বিপক্ষেও বিরোধী রাজনীতিক মতাদর্শ থাকে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে পুঁজিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থা ও পুঁজিবাদী মতাদর্শ এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থা ও মার্কসীয় মতাদর্শের কথা বলা যায়। পুঁজিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থা সংরক্ষণ এবং তার বৈধতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বুর্জোয়া মতাদর্শ আত্মনিয়োগ করে। সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী অন্যান্য রাজনীতিক ব্যবস্থা ও শক্তিকে প্রতিহত করার ব্যাপারে বুর্জোয়া রাজনীতিক ব্যবস্থা সচেষ্ট থাকে। অনুরূপভাবে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সংরক্ষণ এবং তার বৈধতাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মার্কসবাদ সক্রিয় থাকে। আবার অ সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থা ও শক্তিসমূহকে প্রতিহত করার জন্য মার্কসবাদ চেষ্টা করে। এইভাবে সকল দেশে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার অনুকূল ও প্রতিকূল রাজনীতিক মতাদর্শ বর্তমান থাকে। মার্কসীয় মতাদর্শ হল সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার অনুকূল এবং পুঁজিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতিকূল। তেমনি আবার পুঁজিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থার অনুকূল এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার প্রতিকূল হল বুর্জোয়া রাজনীতিক ব্যবস্থা। মার্কসবাদের উদ্দেশ্য হল সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থার সংরক্ষণ এবং সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থার বিলোপ সাধন। তেমনি বুর্জোয়া মতাদর্শের লক্ষ্য হল পুঁজিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতাবস্থা বজায় রাখা এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক ব্যবস্থাকে প্রতিহত করা।

যুদ্ধ ও রাজনীতিক পরিবর্তন:

রাজনীতিক পরিবর্তন সাধনের ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ হিসাবে যুদ্ধের কথাও বলা হয়। বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পরিস্থিতি যুদ্ধের মাধ্যমে ত্বরান্বিত হয়। রাজনীতিক পরিবর্তনের ধারাকে যুদ্ধ প্রভাবিত করে। প্রথম মহাযুদ্ধে জারের শাসনের বিপর্যয় ঘটে। যুদ্ধকে অব্যাহত রাখার ব্যাপারে কেরেনেস্কি সরকার সক্রিয়ভাবে উদ্যোগী হয়। তারফলে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় রুশ বিপ্লব ত্বরান্বিত হয়। অনেক ক্ষেত্রেই যুদ্ধের সঙ্গে বিপ্লবের গভীর সম্পর্কের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয়। আবার রাজনীতিক জমানার পরিবর্তনের ফলেও যুদ্ধের ঘটনা ঘটতে পারে এবং ঘটেও। সাবেক রাজছত্রের হীনবল হয়ে পড়ার সুযোগে অনেক সময় যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। এবং এইভাবে যুদ্ধের মাধ্যমে পুরাতন রাজনীতিক জমানার অবসান ঘটে এবং নতুন রাজনীতিক জমানার সূচনা হয়। সুতরাং যুদ্ধ ইতিহাসের গতিপথ নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ রকম নজির অতীতের মত আধুনিক ইতিহাসেও অল্পবিস্তর বর্তমান। তা ছাড়া বিভিন্ন সমাজের বিকাশের ক্ষেত্রে যুদ্ধের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। আবার রাজনীতিক ক্ষমতার ভিত্তিকে সুদৃঢ় ও সম্প্রসারিত করার ক্ষেত্রে যুদ্ধের অবদান অনস্বীকার্য। মানবজাতির ইতিহাসে এ রকম নজির অসংখ্য। রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকের অভিমত অনুসারে জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় শক্তির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধের সৃষ্টি হয়।

রাজনীতিক স্থিতাবস্থা ও পরিবর্তন:

সমাজের প্রাধান্যকারী রাজনীতিক মতাদর্শ প্রচলিত রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈধতাকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং বিরোধী রাজনীতিক শক্তিগুলিকে প্রতিহত ও বিলুপ্ত করতে চেষ্টা করে। এইভাবে সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক মতাদর্শ বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার স্থিতাবস্থা সংরক্ষণের চেষ্টা করে। একটি রাজনীতিক মতাদর্শের সমর্থনের মাধ্যমে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা অধিকতর শক্তিশালী হয় এবং তার অস্তিত্ব অটুট থাকে। সংশ্লিষ্ট রাজনীতিক মতাদর্শ বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার অবসান বা পরিবর্তনকে প্রতিহত করে; আবার অন্যান্য বিরোধী রাজনীতিক মতাদর্শ বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের ব্যাপারে প্রয়াস চালায়। এবং এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিরোধী রাজনীতিক মতাদর্শগুলি জনসাধারণের মধ্যে পরিবর্তনকামী মানসিকতা সৃষ্টির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। পূর্বোক্ত উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায়। পুঁজিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থাকে বুর্জোয়া মতাদর্শ সংরক্ষণ করতে এবং অধিকতর দৃঢ়ভিত্তিক করতে চায়। পুঁজিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থার অবসান বা পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে নির্মূল করার ব্যাপারে বুর্জোয়া মতাদর্শ সচেষ্ট থাকে। অপরদিকে মার্কসীয় মতাদর্শ পুঁজিবাদী রাজনীতিক ব্যবস্থার বিলোপ সাধন এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে রাজনীতিক মতাদর্শ রাজনীতিক দল ও সহায়ক সংগঠনসমূহের মাধ্যমে উদ্দেশ্য সাধনে উদ্যোগী হয়।

রাজনীতিক পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্যসূচক বিষয়:

রাজনীতিক পরিবর্তন পর্যালোচনার ক্ষেত্রে কতকগুলি বৈশিষ্ট্যসূচক বিষয় বিশ্লেষণ করা দরকার। প্রথমে ক্রমান্বয়ী রাজনীতিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে আলোচনা করা আবশ্যক। সাম্প্রতিক কালের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতিক দল এই ধরনের পরিবর্তনকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেছে। ক্রমান্বয়ে রাজনীতিক পরিবর্তন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে চাপসৃষ্টিকারী বিভিন্ন গোষ্ঠীর (Pressure groups) মাধ্যমে সরকারকে প্রভাবিত করা, বিভিন্ন আইনের পরিবর্তন করা, বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন প্রভৃতির কথা বলা হয়। এ ধরনের রাজনীতিক পরিবর্তন সাধারণত ক্ষুদ্র হয় এবং মৌলিক রাজনীতিক পরিবর্তন সাধনে সক্ষম নয়। তবে ক্রমান্বয়ী রাজনীতিক পরিবর্তন সহিংস হতে পারে। আবার সংস্কারপন্থীরা শান্তিপূর্ণ পথে ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে সংস্কার সাধনের পক্ষপাতী। এঁরা বিশ্বাস করেন যে বিভিন্ন সংস্কার একত্রিতভাবে একদিন মৌলিক রাজনীতিক পরিবর্তন সাধনে সক্ষম হবে। আবার বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রীরা সহিংস আন্দোলনের পথে আকস্মিকভাবে মৌলিক পরিবর্তন সংঘটিত করার পক্ষপাতী। এ ধরনের রাজনীতিক পরিবর্তনের ফলে সমগ্র সমাজব্যবস্থার মৌলিক রূপান্তর ঘটে। বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন একটি শ্রেণী সরকারী ক্ষমতা দখল করে। এ হল রাজনীতিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন। বড় ধরনের রাজনীতিক পরিবর্তনের উদাহরণ হিসাবে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার আবির্ভাব ও অবসান, সমগ্রতাবাদী রাষ্ট্রের উত্থান, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশ প্রভৃতির কথা উল্লেখযোগ্য। যদিও পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার মধ্যেই ফ্যাসীবাদী ব্যবস্থা ও জনকল্যাণমূলক উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবস্থান পরিলক্ষিত হয়।

রাজনীতিক পরিবর্তনের ধারণার বিবর্তন:

মানুষের রাজনীতিক চিন্তার একেবারে প্রাথমিক অবস্থাতেও রাজনীতিক পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা বর্তমান ছিল। প্রাচীনকালে গ্রীক দার্শনিকরা রাজনীতিক পরিবর্তনের কারণ হিসাবে ভারসাম্যহীন প্রশাসনের কথা বলেছেন। জনসাধারণের প্রয়োজনের প্রতি উদাসীন জমানায় রাজনীতিক পরিবর্তন সূচিত হয়। গ্রীক পণ্ডিত প্লেটো, উত্তরাধিকার সূত্রে রাজত্ব বা জমানার পরিবর্তনকে রাজনীতিক পরিবর্তন হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। তাঁর অভিমত অনুসারে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিক্ষোভ ও বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক স্বৈরাচারের সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অদিগুরু অ্যারিস্টটল শাসনের উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পরিবর্তন প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। এইভাবে এই গ্রীক দার্শনিক রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, গণতন্ত্র প্রভৃতি শাসনব্যবস্থার কথা বলেছেন। সরকারের এই সমস্ত শ্রেণীবিভাজন আসলে রাজনীতিক পরিবর্তনের প্রকাশ। চিন্তাজগতে সংকীর্ণ রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর ধর্মীয় ধারণার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। স্বভাবতই এই সময় উচ্চতর ধর্মীয় উদ্দেশ্যের কাছে রাষ্ট্র-শক্তির আনুগত্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক পরিবর্তনের ভাবনা ভাবা হয়েছে। অপরদিকে বৈপ্লবিক পথে মৌলিক ও সামগ্রিক রাজনীতিক পরিবর্তন হল অপেক্ষাকৃত আধুনিক রাষ্ট্র-চিত্তার ফল। আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক ও মৌলিক পরিবর্তনের উদাহরণ হিসাবে ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লব এবং ১৯১৭ সালে রাশিয়ার মহান অক্টোবর বিপ্লবের কথা বলা হয়। মানবসভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে এই দুটি বিপ্লব বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সপ্তদশ শতকের ইংরেজ রাষ্ট্রচিন্তায় রাজনীতিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে বহুলাংশে ইতিবাচক ধারণার পরিচয় পাওয়া যায়। আবার ফরাসী বিপ্লবের তাত্ত্বিক ও প্রয়োগকর্তাদের মধ্যেও রাজনীতিক পরিবর্তনের এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। পিউরিটান বিপ্লবের প্রভাবে ইউরোপ জুড়ে রাজনীতিক চিন্তাজগতে এক পরিবর্তনের ঢেউ দেখা দেয়। এই সময় সমকালীন রাজশক্তির আধিপত্যকে অপসৃত করে গণতন্ত্র ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। সপ্তদশ শতকের ইংরেজ চিন্তাবিদরা এবং ফরাসী বিপ্লবের প্রবক্তারা প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিপ্লবের আহ্বান জানিয়েছেন এবং নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলেছেন। তবে মার্কসবাদী দার্শনিকরাই সমাজের গুণগত পরিবর্তন বা প্রগতি প্রসঙ্গে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৃতীয় বিশ্বে বহু নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত রাষ্ট্রে আগেকার পুঁজিবাদী রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানগুলি বর্তমান ছিল। সদ্য স্বাধীন এই দেশগুলি দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সর্বাঙ্গীণ উন্নতি ও প্রগতিকে সুনিশ্চিত করার জন্য বিশেষভাবে উদ্গ্রীব ও উদ্যোগী হয়। এই সময় সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনীতিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক উভয় দিক থেকেই রাজনীতিক পরিবর্তনের বিষয়টি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠে। এই সময় উন্নয়নশীল দেশগুলিতে রাজনীতিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে গভীর গবেষণা ও অনুসন্ধানমূলক আলোচনা পরিচালিত হয়। এক সময় এই সমস্ত দেশের অনেকগুলিতে রাজনীতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয় দেখা দেয়, বৈধতার সংকট সৃষ্টি হয়। সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে অনেক দেশেই অসামরিক সরকারের পতন ঘটে এবং সামরিক শাসন কায়েম হয়। রাজনীতিক বৈধতার সংকটে (legitimization crisis) কাহিল তৃতীয় বিশ্বের অনেকগুলি দেশেই শৃঙ্খলার প্রশ্নটি বিশেষভাবে গুরুত্ব লাভ করে। এই সময় স্যামুয়েল হানটিংটনের মত আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা রাজনীতিক সংগঠন ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ সম্পর্কিত আলোচনার উপর জোর দেন।

উদারনীতিক গণতান্ত্রিক দৃষ্টিতে রাজনীতিক পরিবর্তন:

রাজনীতিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবক্তারা সমাজের আমূল পরিবর্তনের পক্ষপাতী নন। তাঁরা স্থায়িত্বের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের অভিমত অনুসারে সমাজ সচল থাকে এবং অগ্রসর হয় স্থায়িত্বের গুণে। সমাজের বিকাশ ব্যাহত হবে এবং প্রগতি রুদ্ধ হবে যদি স্থায়িত্ব বিপন্ন হয়। এই কারণে স্থায়িত্বের স্বার্থে তাঁরা প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন এবং শৃঙ্খলা ও সংহতি স্থাপনের উপর জোর দেন। শাসকের দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা এবং শাসিতের শৃঙ্খলাপরায়ণতা ও আনুগত্যের ভিত্তিতে সমাজব্যবস্থার স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত হয়। উদারনীতিক গণতান্ত্রিক চিন্তাবিদদের মতানুসারে আধুনিককালের পশ্চিমী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই হল শ্রেষ্ঠ। তাঁরা সংস্কারের মাধ্যমে এই ব্যবস্থাকে অধিকতর উন্নত করার ব্যাপারে আগ্রহী। তাঁরা এই ব্যবস্থার পরিবর্তনের পক্ষপাতী নন। তাঁরা মনে করেন যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সফল বাস্তবায়ন বাধাপ্রাপ্ত হবে যদি সনাতন বিশ্বাস বা নৈতিকতাকে অস্বীকার করা হয়, সুসংহত সাধারণ সংস্কৃতি বা জীবনধারাকে অগ্রাহ্য করা হয় এবং রাজনীতিক বিষয়াদিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদদের অধিকাংশই ব্রিটিশ ও মার্কিন রাজনীতিক ব্যবস্থার উৎকর্ষ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ। উদারনীতিক গণতন্ত্রের পশ্চিমী প্রবক্তারা পরিবর্তনের একেবারে বিরোধী নন। তাঁরা বিবর্তিত পরিবর্তনের পক্ষপাতী। এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়া হল ধীর গতি এবং উদ্দেশ্য হল সামাজিক সংহতি। এই শ্রেণীর চিন্তাবিরা প্রচলিত ব্যবস্থার উন্নতি ও বিকাশের স্বার্থে সহায়ক আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতিক ব্যবস্থাদি অবলম্বন, সমাজের গণতন্ত্রীকরণ, গণ-অংশগ্রহণ, গণ-সংযোগের বিকাশ ও বিস্তার, রাজনীতিক ব্যবস্থাদির লোকায়তকরণ আইন ব্যবস্থা ও সরকারী কর্তৃত্বের বৈধকরণ, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন প্রভৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। উদারনীতিক গণতন্ত্র হল অংশগ্রহণকারী গণতন্ত্র। এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হল সকলের উপযোগী ব্যবস্থা তথা অভিপ্রেত ব্যবস্থা।

বিভিন্ন রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীর আলোচনা:

রাজনীতিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক মতবাদ বলতে রাজনীতিক ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণ ও রাজনীতিক বিকাশকে বোঝায়। পশ্চিমী গণতান্ত্রিক দেশগুলির সামগ্রিক উন্নয়নের অভিজ্ঞতার আলোকে এই আলোচনা করা হয়। সিমুর মার্টিন লিপসেট তাঁর The Political Man শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে গুণগত উৎকর্ষ ও কার্যকারিতার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে উদারনীতিক ব্যবস্থা সফল হয়েছে। ট্যালকট পারসসও তার Sociological Theory and Modern Society শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থা, শিক্ষাসংস্কৃতি, বিজ্ঞান প্রভৃতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। লুসিয়ান পাই-এর Aspects of Political Development শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক বিকাশ সম্পর্কিত উদারনীতিক ধারণার পরিচয় পাওয়া যায়। অ্যালমন্ড ও পাওয়েল-এর Comparative Politics শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত উদারনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে অবহিত হওয়া যায়। স্যামুয়েল হানটিংটন তাঁর Political Order in a Changing Society শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানগত মডেল সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি প্রগতির স্বার্থে আর্থ-সামাজিক অবস্থা বা আর্থিক পরিবর্তনের কথা বলেননি। হানটিংটন রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্যক বিকাশ ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মতানুসারে স্থায়িত্বের স্বার্থে সাম্যের পরিস্থিতি শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার, শিল্পায়ন প্রভৃতির প্রয়োজনীয়তা জরুরী। তাঁর আরও অভিমত হল রাজনীতিক ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলাকে দূর করার জন্য আধুনিকতার অস্তিত্ব যেমন অপরিহার্য, তেমনি মাত্রাতিরিক্ত আধুনিকতার কারণে অস্থায়িত্বের আশংকাও অঙ্গীকার করা যায় না। টকভিল (Alexis De Tocqueville) তাঁর Democracy in America শীর্ষক গ্রন্থে মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। ডেভিড আপতার তাঁর The Politics of Modernization শীর্ষক গ্রন্থে রাজনীতিক পরিবর্তনের এক জটিল মডেলের উল্লেখ করেছেন।

সমালোচনা: রাজনীতিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে উদারনীতিক গণতান্ত্রিক মতবাদ বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। অর্থাৎ এই মতবাদের সীমাবদ্ধতা বর্তমান। বিরুদ্ধবাদীরা বিভিন্ন দিক থেকে এই মতবাদের বিরূপ সমালোচনা করে থাকেন।

  • (১) উদারনীতিক গণতান্ত্রিক চিন্তাবিদদের মতানুসারে স্থায়িত্বই হল মূল কথা। সুতরাং এ হল একটি স্থায়িত্বের তত্ত্ব। একে রাজনীতিক পরিবর্তনের তত্ত্ব হিসাবে গণ্য করা যায় না। এই তত্ত্বে প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাটির পরিবর্তনের কথা এই তত্ত্বে নেই। এই মতবাদে রাজনীতিক ক্ষেত্রে উন্নতি বা আধুনিকীকরণের আলোচনা পাওয়া যায়। এই মতবাদে পরিবর্তনের ধারণা পাওয়া যায় না।
  • (২) উদারনীতিক গণতান্ত্রিক মতবাদে রাজনীতিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে মার্কিন রাজনীতির উন্নতি ও প্রগতির প্রশস্তি প্রচার করা হয়েছে। মার্কিন রাজনীতিক ব্যবস্থা, রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতিক তত্ত্বের ভিত্তিতে আলোচ্য মতবাদটি গড়ে উঠেছে। রাজনীতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের আলোচনা এই মতবাদে অস্বীকৃত।
  • (৩) জনসাধারণের কল্যাণ সাধন, সামাজিক শ্রেণীসমূহের মধ্যে বিরোধের অবসান এবং সামঞ্জস্য ও সংহতি সাধনের ক্ষেত্রে আলোচ্য মতবাদটির উপযোগিতা প্রসঙ্গেও বিরোধ বিতর্কের অবকাশ আছে।
  • (৪) উদারনীতিক গণতান্ত্রিক চিন্তাবিরা পশ্চিমী শিল্পসভ্যতার দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁরা পশ্চিমী সভ্যতা-সংস্কৃতি, নৈতিকতা-মূল্যবোধ প্রভৃতির দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন তাঁরা তাঁদের এই আচ্ছন্ন অবস্থাকে কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তাই তাঁরা পশ্চিমী সমাজব্যবস্থার শোষণ সংকটের দিকটি দেখতে পান নি।
  • (৫) উদারনীতিক গণতান্ত্রিক মতবাদে উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণের কতকগুলি মডেল তুলে ধরা হয়েছে। এগুলি সবই হল পাশ্চাত্ত্য মডেল। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রে এই সমস্ত মডেলের কার্যকারিতা প্রমাণ সাপেক্ষ।