পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থা
মন্ত্রীপরিষদ-শাসিত বা পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থায় সরকারের সকল ক্ষমতা তত্ত্বগতভাবে একজন রাজা বা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকে। এই রাজা বা রাষ্ট্রপতিই হলেন আইনগতভাবে শাসন-বিভাগীয় প্রধান। তিনি আইনগতভাবে সকল ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু প্রকৃত শাসন ক্ষমতা তাঁর হাতে থাকে না। তিনি জাতির প্রতীক, কিন্তু জাতিকে শাসন করেন না। তিনি শাসন-বিভাগীয় প্রধান কর্মকর্তা, কিন্তু বাস্তবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন না। তবে তাঁর নামে শাসনকার্য পরিচালিত হয়। তাই তাঁকে নামসর্বস্ব শাসক-প্রধান বলা হয় (Titular Head or Nominal Executive)। প্রকৃত শাসন ক্ষমতা মন্ত্রিপরিষদের উপর ন্যস্ত থাকে। মন্ত্রিপরিষদই হল শাসন-বিভাগের প্রকৃত কর্ণধার (Real Hear or Real Executive)। এই মন্ত্রিসভাই রাষ্ট্রপতি বা রাজার নামে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে। এজন্য একে মন্ত্রিসভা-শাসিত শাসনব্যবস্থা বলা হয়। মন্ত্রিসভা গঠিত হয় আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃস্থানীয় সদস্যদের নিয়ে। মন্ত্রিসভাকে সর্ববিধ কাজের জন্য আইনসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। আইনসভার গরিষ্ঠসংখ্যক সদস্যদের আস্থার উপর মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব নির্ভরশীল। আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থা হারালে মন্ত্রিসভা পদচ্যুত হয়। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আইনসভা বা পার্লামেন্টের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য একে পার্লামেন্টীয় সরকার বলা হয়। আইনসভার প্রতি মন্ত্রিসভার এই দায়িত্বশীলতার জন্য একে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থাও (Responsible Government) বলে।
পার্লামেন্টীয় বা মন্ত্রিসভা শাসিত সরকারের বৈশিষ্ট্য
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পার্লামেন্টীয় বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থার কতকগুলি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।
(১) নিয়মতান্ত্রিক ও প্রকৃত শাসকের অবস্থান: মন্ত্রিপরিষদ শাসিত শাসনব্যবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক বা নামসর্বস্ব শাসক (Constitutional Head or Nominal Executive) এবং প্রকৃত শাসকের (Real Head or Real Executive) মধ্যে পার্থক্য থাকে। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় আইনগতভাবে যাঁর হাতে চূড়ান্ত শাসনক্ষমতা ন্যস্ত থাকে তিনি নিজে শাসনকার্য পরিচালনা করেন না। নিয়মানুসারে তাঁর নামে কেবল শাসনকার্য পরিচালিত হয়। তাই তাঁকে নামসর্বস্ব বা নিয়মতান্ত্রিক শাসক প্রধান বলা হয়। প্রকৃত শাসনক্ষমতা মন্ত্রিসভার হাতেই ন্যস্ত থাকে। নিয়মতান্ত্রিক শাসক মন্ত্রিসভার পরামর্শক্রমে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। অর্থাৎ মন্ত্রিসভার পরামর্শই শাসন-কর্তৃপক্ষের প্রকৃত আদেশ হিসাবে গণ্য হয়। এই মন্ত্রিসভাই হল শাসন বিভাগের প্রকৃত কর্ণধার বা প্রকৃত শাসক। ভারতের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভা যথাক্রমে নিয়মতান্ত্রিক শাসক ও প্রকৃত শাসকের উদাহরণ। পার্লামেন্টীয় সরকারের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বল বলেছেন: “There is a nominal head of state whose functions are chiefly formal and ceremonial and whose political influence is limited. This head of state may be a president, as in West Germany, India and Italy, or a monarch, as in Japan, Sweden and the United Kingdom.”
(২) দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা: আইনসভার প্রতি মন্ত্রিসভার দায়িত্বশীলতা পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। মন্ত্রিসভা তার সকল কাজের জন্য আইনসভার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে। আইনসভার গরিষ্ঠসংখ্যক সদস্যের আস্থা হারালে মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। এই দায়িত্বশীলতার জন্য এই প্রকার শাসনব্যবস্থাকে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা (Responsible Government) বলে।
(৩) মন্ত্রীদের যৌথ দায়িত্বশীলতা: আইনসভার প্রতি মন্ত্রিসভার এই দায়িত্বের প্রকৃতি হল যৌথ। শাসনব্যবস্থা পরিচালনার সামগ্রিক দায়-দায়িত্ব মন্ত্রিসভার। মন্ত্রিসভার সকল সদস্য সরকারী নীতি ও কার্যাবলীর জন্য আইনসভার কাছে যৌথভাবে দায়িত্বশীল থাকে। আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হলে মন্ত্রীরা সাধারণত: জনপ্রিয় কক্ষ বা নিম্নকক্ষের কাছেই যৌথভাবে দায়িত্বশীল থাকে। যৌথ দায়িত্বের অর্থ হল কোন এক বিশেষ দপ্তরের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আইনসভা সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের ভিত্তিতে অনাস্থা জ্ঞাপন করলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীসহ সমগ্র মন্ত্রিসভাকেই পদত্যাগ করতে হয়। জেনিংস বলেছেন: “Collective responsibility means….that an attack on a Minister is an attack on the Government. The defeat of a Minister is the defeat of a Government, ” মন্ত্রিসভার উপর আইনসভা বা পার্লামেন্টের এই প্রাধান্যের জন্যই একে পার্লামেন্টীয় বা সংসদীয় সরকার ( Parliamentary Government) বলে।
(৪) মন্ত্রিসভার গঠন: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয় সমস্বার্থ, সমচেতনতা ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে। তবে সাধারণত একই রাজনীতিক দলের সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় এবং এই মন্ত্রিসভাই সরকার পরিচালনা করে। সাধারণ নির্বাচনের পর কোন একটি দল পার্লামেন্টে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে এই ঘটনা ঘটে। কিন্তু আইনসভায় কোন একটি দল এককভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারলে একাধিক দলের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা (Coalition Cabinet) গঠন করা হয়।
(৫) মন্ত্রিসভা ও আইনসভার মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ: আইন-বিভাগ ও শাসন-বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থার অপর এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিসভাই প্রকৃতপক্ষে শাসনকার্য পরিচালনা করে। তাই মন্ত্রিসভাই হল প্রকৃত শাসক। এই মন্ত্রিসভা গঠিত হয় আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে। আবার আইন প্রণয়ন আইনসভার কাজ হলেও অধিকাংশ আইনের খসড়া প্রস্তাব বিভাগীয় মন্ত্রীরাই রচনা করেন এবং আইনসভায় পেশ করেন। মন্ত্রিসভা ও আইনসভার মধ্যে এই গভীর সম্পর্ক পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থাকে স্বাতন্ত্র্য প্রদান করেছে। বল বলেছেন: “The political executive (prime minister, chancellor, etc), together with the cabinet, is part of the legislature, selected by the legislature, and can be removed by the legislature if the legislature withdraws its support.”
(৬) প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব: প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পার্লামেন্টীয় সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসাবে গণ্য হয়। আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাই হল প্রধানমন্ত্রী। তাঁর নেতৃত্বাধীনেই মন্ত্রিসভার সৃষ্টি। স্ট্রং মন্তব্য করেছেন: “If it is the party system which gives the cabinet its homogeneity, it is the position of the Prime Minister which gives its solidarity.” তিনি মন্ত্রিসভার বিভিন্ন দপ্তরের কার্যাদি তত্ত্বাবধান করেন এবং দপ্তরগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন। মন্ত্রিসভার অন্যান্য মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রপতি বা রাজার দ্বারা নিযুক্ত হন। আবার অন্যান্য মন্ত্রীদের পদচ্যুত করার মত কার্যকরী ক্ষমতাও তাঁর আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে তিনি আইনসভায়ও নেতৃত্ব দান করেন। আবার রাষ্ট্রপতি বা রাজার সঙ্গে মন্ত্রিসভা ও আইনসভার যোগাযোগ রক্ষা করেন প্রধানমন্ত্রী। এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর পদ পার্লামেন্টের শাসনব্যবস্থায় বিশেষ বৈশিষ্ট্যযুক্ত।
(৭) বিরোধী দলের ভূমিকা: একটি সুসংহত বিরোধী দলের অস্তিত্বকে পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থায় অপরিহার্য বিবেচনা করা হয়। ওয়েড ও ফিলিপস মন্তব্য করেছেন: “…Parliamentary Governments work best when opposition is able to take concerted action.” আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দল মন্ত্রিসভা বা সরকার গঠন করে। আর যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেন না তাঁরা বিরোধী দলে স্থান পান। এই বিরোধী দলই গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে সরকারকে জনকল্যাণমূলক পথে শাসনকার্য পরিচালনা করতে বাধ্য করে। সরকারী দলের স্বৈরাচারিতার পথে বাধার সৃষ্টি করে শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রের স্বরূপ সংরক্ষণের ব্যাপারে বিরোধী দলের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় একটি শক্তিশালী বিরোধী দল সরকারকে সংযত রাখতে ও গণতন্ত্রের স্বরূপ রক্ষা করতে সাহায্য করে। জেনিংস বলেছেন: “The opposition at once the alternative to the Government a focus to the discontent of the people. If there be no opposition, there is no democracy.”
(৮) ক্যাবিনেট এবং তার সংহতি ও গোপনীয়তা: পার্লামেন্টীয় সরকারের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল ক্যাবিনেটের সংহতি ও গোপনীয়তা। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিসভার মধ্যে আরও ক্ষুদ্রাকৃতির একটি সংস্থা গঠন করা হলে একে ক্যাবিনেট বলে। মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের নিয়ে এই ক্যাবিনেট গঠিত হয়। এই ক্যাবিনেটই হল সংসদীয় শাসনব্যবস্থার নীতি নির্ধারণকারী সংস্থা। ক্যাবিনেট মন্ত্রীরা ক্যাবিনেট সভায় খোলাখুলিভাবে আলাপ-আলোচনা করেন এবং পরস্পর-বিরোধী মতও ব্যক্ত করতে পারেন। কিন্তু আলাপ-আলোচনার পর ক্যাবিনেট সভায় যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় তা সকলের সিদ্ধান্ত হিসাবে বিবেচিত হয়। ক্যাবিনেট সভার আলোচনা বাইরে প্রকাশ করা যায় না। ক্যাবিনেটের ঐক্য, সংহতি ও গোপনীয়তার উপর সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়।
(৯) বল আর একটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন: “The legislature is elected for varying periods by the electorate, the election date being chosen by the formal head of state on the advice of the prime minister or chancellor.”
ইংল্যাণ্ডের দৃষ্টান্ত: ইংল্যান্ডের শাসনব্যবস্থা পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থার যথার্থ উদাহরণ হিসাবে গণ্য হয়। ইংল্যাওকে পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থার পীঠস্থান বলা হয়। এখানে শাসন-বিভাগের সর্বোচ্চ ক্ষমতা আইনত রাজা বা রাণীর উপর ন্যস্ত থাকে। তবে তিনি হলেন নামসর্বস্ব শাসক প্রধান। শাসন-বিভাগীয় প্রকৃত ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদের উপর ন্যস্ত। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ কমন্সসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হন প্রধানমন্ত্রী। সংশ্লিষ্ট দলের অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। এই মন্ত্রিপরিষদ সকল কাজের জন্য পার্লামেন্টের কাছে, বিশেষ করে কমন্সসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকে।
বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টের সরকারেও তারতম্য আছে: আবার পার্লামেন্টীয় সরকারের শাসনাধীন সকল দেশের সরকারী কাঠামো ও কার্যপদ্ধতি সব সময় একই রকম হয় না। এ ক্ষেত্রেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বল বলেছেন: “There are significant differences within parliamentary types of government.” কোন দেশের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আইনসভা এককক্ষ বিশিষ্ট, আবার কোথাও তা দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট। তা ছাড়া দ্বিতীয় কক্ষের গঠন ব্যবস্থার মধ্যেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। শাসন-বিভাগের প্রধান কর্তৃক আইনসভাকে ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচনের নির্দেশ প্রদানের ব্যাপারেও বিভিন্ন দেশের সংসদীয় শাসনব্যবস্থার তারতম্য দেখা যায়। আবার সংবিধানের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকারক হিসাবে কোথাও আছে একটি সুপ্রীম কোর্ট; অপরদিকে গ্রেট ব্রিটেনে আইনসভাই হল চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। বল আরও বলেছেন: “The number and type of political parties will have important consequences for the operation of these systems.”
সংসদীয় সরকারের সুবিধা ও অসুবিধা
পার্লামেন্টীয় সরকারের গুণ:
বর্তমানকালে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই গণতন্ত্রকে স্বাগত জানানো হয়েছে। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বার্থে পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এককেন্দ্রিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয়, সকল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই পার্লামেন্টীয় শাসন সমানভাবে জনপ্রিয়। এ ধরনের শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ করলে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণগুলি অনুধাবন করা যায়।
(১) আইন ও শাসন-বিভাগের মধ্যে সুসম্পর্ক: পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থায় আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক এবং গভীর বোঝাপড়া থাকে। এরকম শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতিকে স্বীকার করা হয় না। উভয় বিভাগের মধ্যে একটি পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সুশাসনের পথ প্রশস্ত হয়। পার্লামেন্ট মন্ত্রিসভাকে প্রয়োজনমত সকল আইন প্রণয়ন করে দেয়। এর ফলে মন্ত্রিসভার দক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দরকারী আইন পেতে অসুবিধা হয় না। শাসন-বিভাগ জনকল্যাণ সাধনের ক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে।
(২) গণতন্ত্রের স্বরূপ বজায় থাকে: এই শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিসভাই হল প্রকৃত শাসক। এই মন্ত্রিসভা আবার জনগণের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত। ফলে জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারাই সরকারী নীতি নির্ধারিত হয় এবং শাসনকার্য পরিচালিত হয়। জনগণের প্রতিনিধিপুষ্ট আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমত প্রতিফলিত হয়। সরকার এই অভিমতকে উপেক্ষা করতে পারে না। সরকার প্রত্যক্ষভাবে আইনসভার কাছে এবং চূড়ান্তভাবে জনগণের কাছে দায়িত্বশীল থাকে। এতে গণতান্ত্রিক শাসন বা জনগণের শাসনের স্বরূপ বজায় থাকে। তাই পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থা অধিকতর গণতন্ত্রসম্মত।
(৩) সরকার স্বৈরাচারী হতে পারে না: পার্লামেন্টীয় সরকারে মন্ত্রিসভাকে সরকারী নীতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে সকল বিষয়ে আইনসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। আইনসভার আস্থা হারালে মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। তাই মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না। মন্ত্রিসভার জনস্বার্থ বিরোধী এবং স্বৈরাচারী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিরোধী দল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তা ছাড়া পার্লামেন্টে জনপ্রতিনিধিদের আলাপ আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক প্রভৃতি থেকে সরকার সহজেই জনমত অনুধাবন করতে পারে। এবং কার্যত জনমতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে সরকার পরিচালিত হয়। এতে সরকার সর্বসাধারণের স্বার্থ সাধনে সচেষ্ট হতে বাধ্য হয়।
(৪) সরকারের দায়িত্ব: সরকারের স্থায়িত্ব মন্ত্রিসভা শাসিত শাসনব্যবস্থার অন্যতম গুণ হিসাবে বিবেচিত হয়। আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রতিনিধিরাই মন্ত্রিসভা গঠন করেন। দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে মন্ত্রিসভার দায়িত্ব সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চয়তা থাকে। ফলে মন্ত্রিসভা নিশ্চিতভাবে জনকল্যাণসাধনে আত্মনিয়োগ করতে পারে।
(৫) নমনীয় ও পরিবর্তনশীল: পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থা বিশেষভাবে নমনীয়। এরূপ শাসনব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে প্রয়োজনমাফিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। প্রয়োজনের তাগিদে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিপরিষদের পরিবর্তনের ব্যাপারে অসুবিধা হয় না। দৃষ্টান্ত হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংল্যাণ্ডে চেম্বারলেন (Chamberlain)-এর পরিবর্তে চার্চিল (Churchill)-কে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ করার ঘটনা উল্লেখ করা হয়। তাই বলা হয়, এই শাসনব্যবস্থা বিশেষভাবে নমনীয় ও পরিবর্তনশীল। এই সুবিধার জন্য জরুরি অবস্থায় জাতীয় প্রয়োজনে সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ পাওয়া যায়।
(৬) রাজনীতিক শিক্ষার বিস্তার: এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় জনগণের রাজনীতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে। সরকারী নীতি, দেশের বিভিন্ন সমস্যা ও সরকারী কার্যক্রম প্রভৃতি বিষয়ে পার্লামেন্টে আলোচনা ও সমালোচনা হয়। তার মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষ সরকারের ভূমিকা ও কার্যকলাপ সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারে। তা ছাড়া, দলব্যবস্থা প্রবর্তিত থাকায় প্রচার কার্যের মাধ্যমে দলগুলো শাসন সম্পর্কিত সকল বিষয়ে জনগণকে অবহিত রাখে। ক্ষমতাসীন দল সরকারী নীতি ও কার্যাবলী সম্পর্কে প্রচারের মাধ্যমে স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করে। তেমনি বিরোধী দল বা দলগুলি সরকারের নীতি ও কাজকর্মের সমালোচনা করে সরকার বিরোধী জনমত গঠনের চেষ্টা করে। এতে জনগণের রাষ্ট্রনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায়; দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত হয়।
(৭) যোগ্য ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা যায়: অনেক সময় দেখা যায় যে, দেশের অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি রাজনীতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কলুযতার মধ্যে আসতে রাজী থাকেন না। ফলে তাঁদের পক্ষে সরকারী কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয় না। এতে দেশ এই সকল যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তির সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু পার্লামেন্টারী শাসনব্যবস্থায় এইসব ব্যক্তিকে নিয়মতান্ত্রিক শাসকের পদ প্রদান করে যোগ্যতাকে মর্যাদা দেওয়া যায়।
(৮) রাজতন্ত্রের ও গণতন্ত্রের সমন্বয়: পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থায় রাজতন্ত্রকে বজায় রেখেও গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পাওয়া যায়। রাজাকে নিয়মতান্ত্রিক শাসকের পদ দিয়ে মন্ত্রিসভাকে প্রকৃত শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। উদাহরণ হিসাবে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থার কথা বলা যেতে পারে। ইংল্যাণ্ডে উত্তরাধিকারমূলক রাজতন্ত্রের সঙ্গে পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থার গণতান্ত্রিক নীতির সামঞ্জস্য সাধন সম্ভব হয়েছে।
(৯) সুশাসনের অন্তরায়: ল্যাস্কির মতানুসারে পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থায় অন্তত একটি গুণ রয়েছে, এখানে দায়িত্বের অবস্থান নির্ণয় সহজতর। তা ছাড়া ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে বাদানুবাদ ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সরকারী কাজকর্ম পরিচালিত হত। তার ফলে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সুশাসন সম্ভব হয়।
পার্লামেন্টীয় সরকারের ত্রুটি
উপরিউক্ত গুণাবলীর অস্তিত্ব সত্ত্বেও পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থা বিরূপ সমালোচনার হাত এড়াতে পারে নি। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে এরূপ সরকারের বিরুদ্ধে বহুবিধ ত্রুটির কথা বলা হয়।
(ক) সুশাসনের অন্তরায়: এই সকল শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতি প্রযুক্ত হয় না। এখানে মন্ত্রিসভার সদস্যগণ হলেন আইনসভার সদস্য। ফলে মন্ত্রিগণকে শাসনকার্য ছাড়াও আইন প্রণয়ন কার্যে অংশগ্রহণ করতে হয় এবং প্রশ্নোত্তর দানে ব্যস্ত থাকতে হয়। তা ছাড়া মন্ত্রীদের বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হয়। এর ফলেও মন্ত্রীদের অনেকটা সময় চলে যায়। এতে বিভাগীয় মন্ত্রিগণ তাঁদের উৎসাহ-উদ্দীপনার পুরোটাই প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নিয়োগ করতে পারেন না। এটি সুশাসনের অন্তরায় হিসাবে বিবেচিত হয়।
(খ) অখণ্ড সরকারী নীতি অনুসৃত হয় না: পার্লামেন্টীয় সরকারের পরিবর্তনশীলতা বা নমনীয়তা অন্যতম গুণ হিসাবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এটি সরকারী নীতি ও কার্যক্রমের অখণ্ডতার বিরোধী। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় ঘন ঘন মন্ত্রিসভার পরিবর্তনের আশংকা থাকে। তাই দীর্ঘকাল স্থায়ী কোন সরকারী নীতি অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। নির্দিষ্ট ও স্থায়ী শাসননীতির অভাব এ ধরনের সরকারের একটি বড় ত্রুটি। এতে সরকারের দৃঢ়তা ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়।
(গ) জরুরি অবস্থার উপযোগী নয়: এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সরকারী সকল সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গৃহীত হয়। সেজন্য কোন বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না। এর ফলে বহিরাক্রম, আভ্যন্তরীণ গোলযোগ প্রভৃতি আপৎকালীন অবস্থায় দেশ বিপদাপন্ন হয়ে পড়ে। কারণ পার্লামেন্টারী সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দৃঢ়তার সঙ্গে জরুরী অবস্থার মোকাবিলা করতে পারে না।
(ঘ) দলব্যবস্থার ত্রুটি: পার্লামেন্টীয় শাসনব্যবস্থায় রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য বিবেচিত হয়। ফলে এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় দলব্যবস্থার সকল ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। সংকীর্ণ দলাদলি, দলীয় স্বার্থসাধন, যোগ্যতার উপেক্ষা প্রভৃতি শাসনব্যবস্থার দক্ষতার হানি ঘটায়। ব্রাইস পার্লামেন্টীয় সরকারের অন্যতম অসুবিধা হিসাবে দলীয় মনোভাব ও উত্তেজনার কথা বলেছেন। এই কারণে পার্লামেন্টের মূল্যবান শক্তির অপচয় হয়। সরকারের দোষ-ত্রুটির সমালোচনার পরিবর্তে সর্বক্ষেত্রে সরকারের বিরোধিতা করাই বিরোধী দলের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়।
(ঙ) দুর্বল ও অস্থায়ী: দেশে বহুদল ব্যবস্থা থাকলে পার্লামেন্টারী সরকার দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বহু রাজনীতিক দলের অস্তিত্বের ফলে অনেক সময় কোন বিশেষ রাজনীতিক দলের সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সম্ভব হয় না। বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে একাধিক দলের সমন্বয়ে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। মন্ত্রীদের মধ্যে নীতিগত মতপার্থক্যের জন্য কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা দুর্বল হয় এবং যে কোন সময় ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে এরূপ মন্ত্রিসভা কখনই জনকল্যাণ সাধনে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বা জনসেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারে না।
(চ) নয়া স্বৈরাচার: আবার দেশে দ্বি-দল ব্যবস্থা থাকলেও পার্লামেন্টারী শাসনে এক নূতন বিপত্তির সৃষ্টি হয়। দু’টি রাজনীতিক দল থাকলে একটি দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার গঠন করতে পারে। এতে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সংখ্যালঘিষ্ঠ বিরোধী দল অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারী দল স্থায়িত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকে এবং আইনসভাকে দিয়ে যে কোন আইন পাস করিয়ে নিতে পারে। মন্ত্রিসভার স্বৈরাচারের পথে সাফল্যের সঙ্গে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ক্ষমতা বিরোধী দলের থাকে না। ফলে মন্ত্রিসভার স্বৈরাচারী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। একে ‘নয়া স্বৈরাচারী’ (New Despotism) বলা হয়।
(ছ) অযোগ্য ব্যক্তিদের প্রাধান্য: পার্লামেন্টারী শাসনব্যবস্থায় পার্লামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও প্রাধান্যের কথা আগে বলা হয়েছে। কিন্তু যে সকল জনপ্রতিনিধি পার্লামেন্টের সদস্যপদ লাভ করেন তারা গুণগত যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হন না। যে সব চতুর ব্যক্তিরা মিথ্যা প্রলোভনের দ্বারা জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারেন, নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা অধিক। এতে আইনসভায় বহু অযোগ্য ব্যক্তি স্থান পান। তার ফলে পার্লামেন্টের যোগ্যতা হ্রাস পায়; পার্লামেন্ট দক্ষতার সঙ্গে যোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে না।
(জ) আমলাতান্ত্রিক: মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যাপারেও অনুরূপ ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে। মন্ত্রিগণ বিচক্ষণতা বা অভিজ্ঞতার পরিবর্তে দলের উপর তাঁদের ব্যক্তিগত প্রভাবের ভিত্তিতে মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। তা ছাড়া মন্ত্রীরা জনপ্রিয়তা, সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন ও সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আনুগত্যের কারণে মনোনীত হন। তাই এই শাসনব্যবস্থাকে অপেশাদার বা শৌখিন সরকার (Government by amateurs ) বলে অভিহিত করা হয়। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মন্ত্রীদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা থাকে না। সুতরাং শাসনকার্য পরিচালনার ব্যাপারে মন্ত্রিগণ স্থায়ী সরকারী কর্মচারী বা আমলাদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হন। এতে জনগণের প্রতিনিধিদের পরিবর্তে আমলাদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। পার্লামেন্টীয় শাসন আমলাতান্ত্রিক শাসনে রূপান্তরিত হয়।
(ঝ) দুর্নীতি ও স্বজন-পোষণ: তা ছাড়া মন্ত্রিসভার স্থায়িত্ব আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল। তাই মন্ত্রিগণ অস্তিত্বের স্বার্থে আইনসভার সদস্যদের যে-কোনো উপায়ে সন্তুষ্ট রাখার জন্য অধিক মনোযোগী হন। এই উদ্দেশ্যে তাঁরা স্বজন-পোষণ ও অন্যান্য দুর্নীতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করেন না। এতে প্রশাসনের নৈতিক মান অবনমিত হয় এবং জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়।
(ঞ) ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হতে পারে: সমালোচকদের অনেকের মতে সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসৃত হয় না। অথচ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে ব্যক্তি-স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বলা হয়ে থাকে। সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় আইন-বিভাগ ও শাসন-বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বর্তমান থাকে। তার ফলে এই দুই বিভাগের মধ্যে এক ‘অশুভ আঁতাত’-এর আশঙ্কা থাকে। এই কারণে ব্যক্তি-স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
(ট) ধনতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক: অনেকের মতে সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে ধনতন্ত্রের সংযোগ ও সম্পর্ক বর্তমান। বলা হয় যে সংসদীয় রাজনীতিক ব্যবস্থায় বিত্তবান শ্রেণীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে। রজনী পাম দত্তের মতানুসারে বুর্জোয়া শ্রেণী মধ্যযুগের বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণী ও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে সংসদীয় গণতন্ত্রের হাতিয়ারকে ব্যবহার করেছে। অভিযোগ করা হয় যে, এ ধরনের শাসনব্যবস্থার সঙ্গে ধনতন্ত্রের একটা কার্য কারণ সম্পর্ক বর্তমান।
মূল্যায়ন: কিন্তু বহু বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও পার্লামেন্টারী শাসনব্যবস্থাই বর্তমান কালে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। কি এককেন্দ্রিক, কি যুক্তরাষ্ট্রীয়—সকল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এরূপ সরকার সমানভাবে জনপ্রিয়। এই ব্যাপক জনপ্রিয়তা এর উৎকর্ষেরই পরিচায়ক। এর বিরুদ্ধে যে সব সমালোচনা করা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলি অভ্রান্ত নয়। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পরিপ্রেক্ষিতে যা বলা হয়, তা গ্রহণযোগ্য নয়। বর্তমান কালে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ কাম্য আদর্শ হিসাবে গণ্য হয় না। বহুদলব্যবস্থা প্রসঙ্গে যা বলা হয়, সেক্ষেত্রে বক্তব্য হল দ্বি-দল ব্যবস্থাই পার্লামেন্টারী ব্যবস্থার পক্ষে অধিক উপযোগী। দ্বি-দল ব্যবস্থায় যে ‘নয়া স্বৈরাচারের কথা বলা হয় তা একেবারে অগ্রাহ্য করা যায় না বটে, কিন্তু বিরোধী দলের ভূমিকাকেও মোটেই অস্বীকার করা যায় না। এই শাসনব্যবস্থায় সরকারের দায়িত্বশীলতা বাস্তবে রূপায়িত হয়।
Leave a comment