সাংগঠনিক বিচারে আইনসভা দু’ধরনের হতে পারে। আইনসভা একটি বা দু’টি কক্ষ নিয়ে গঠিত হতে পারে। একটিমাত্র কক্ষ নিয়ে গঠিত আইনসভাকে এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা (Unicameral Legislature) বলে এবং দু’টি কক্ষ নিয়ে গঠিত আইনসভাকে দ্বি কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা (Bi-cameral Legislature) বলে। বর্তমানে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের আইনসভাই দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট (Bi-cameral)। এ ধরনের আইনসভার দু’টি কক্ষের বা পরিষদের একটি প্রথম বা নিম্নকক্ষ (Lower Chamber) এবং অপরটি উচ্চকক্ষ (Upper Chamber)। নিম্নকক্ষ সকল ক্ষেত্রেই জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে গঠিত হয়। তাই একে জনপ্রিয় কক্ষও (Popular Chamber) বলা হয়। কোন কোন দেশে আইনসভার নিম্নকক্ষে কিছু সদস্য মনোনয়নের ব্যবস্থা দেখা যায়। ভারতে রাষ্ট্রপতি লোকসভায় এবং রাজ্যপাল বিধান পরিষদে ইঙ্গ-ভারতীয় (Anglo-Indian) সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি মনোনীত করতে পারেন। আর উচ্চকক্ষের গঠন-পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। ইংল্যাণ্ডের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ লর্ডসভা (House of Lords) কেবল অভিজাত শ্রেণীর ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত। লর্ডসভার অধিকাংশ সদস্য উত্তরাধিকার সূত্রে সদস্যপদ লাভ করেন। বার্ষিক কিছু সদস্যকে মনোনীত করা হয়। লর্ডসভার কোন সদস্যই নির্বাচিত হন না। তাই লর্ডসভা হল অ-নির্বাচিত (non-elective)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘কংগ্রেসের’ উচ্চকক্ষ ‘সিনেট’ (Senate) অঙ্গরাজ্যগুলির ২ জন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত। ভারতের আইনসভা সংসদ বা পার্লামেন্টেও দ্বি-পরিষদীয়। উচ্চ পরিষদের নাম রাজ্যসভা (Council of States) এবং নিম্ন-পরিষদের নাম লোকসভা (House of the People)। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা যে সকল রাষ্ট্রে আছে, সেইসব রাষ্ট্রে আইনসভার উচ্চকক্ষের ক্ষমতা ও মর্যাদা এক রকম নয়। কেবল পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রীম সোভিয়েতের উভয় কক্ষ সমক্ষমতাসম্পন্ন ছিল। অন্য কোন দেশের দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ক্ষেত্রে এটা দেখা যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেসের উচ্চকন্দ্র ‘সিনেট’ নিম্নকক্ষ ‘প্রতিনিধি সভা’-র তুলনায় অনেক বিষয়ে অধিক ক্ষমতার অধিকারী। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ‘কমন্সসভা’ উচ্চকক্ষ ‘লর্ড সভা’-র তুলনায় অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন।
দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা
দ্বি-কক্ষ ব্যবস্থার সমস্যা: আধুনিককালে পৃথিবীর অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আইনসভা দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট। Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে অ্যালান বল বলেছেন: “Most modern assemblies have two chambers, the most prominent exception being New Zealand…. Denmark Sweden.” ফাইনার আইনসভা দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট হওয়ার ব্যাপারে দুটি কারণ দেখিয়েছেন। এই কারণ দুটি হল: যুক্তরাষ্ট্রীয় তত্ত্বের অপরিহার্য অঙ্গ এবং শাসনতন্ত্রে জনপ্রিয় নীতির প্রাধান্য নিয়ন্ত্রণ। তিনি বলেছেন: “Legislatures are bicameral for two broad and different reasons; as a part of federalism and as the result of the desire to check the popular principle in the constitution.” সুষ্ঠুভাবে কার্য সম্পাদনের জন্য আইনসভা এক কক্ষবিশিষ্ট বা দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়—এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের শেষ নেই। এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অনেকের কাছে আদর্শ আইনসভা হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। আবার অনেকের কাছে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভাই হল আদর্শ।
এই সূত্রে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করা হয়ে থাকে। দ্বি কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষের যুক্তিগুলি এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার বিপক্ষে যায়। তেমনি এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষের যুক্তিসমূহ দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার বিপক্ষে যায়। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে এবং এক-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার বিপক্ষে যাঁরা আলোচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: জে. এস. মিল., লর্ড ব্রাইস, ব্লণ্টলী, লাইবার, লর্ড অ্যাক্টন, লেকী, হেনরী মেইন, জেফারসন, গেটেল, দুগু্যই প্রমুখ। অপরদিকে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার বিরুদ্ধে এবং এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার সপক্ষে যাঁরা যুক্তি দেখিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ল্যাস্কি, বোম, আবে সিঁয়ে, ফ্রাংকলিন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দ্বি-কক্ষ ব্যবস্থার সপক্ষে যুক্তি
দ্বি-কক্ষ ব্যবস্থার পক্ষে সাধারণত নিম্নলিখিত যুক্তিগুলির উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়।
(১) সুচিন্তিত আইন প্রণীত হয়: দ্বি-পরিষদ ব্যবস্থায় যথেষ্ট বিচার-বিবেচনার সঙ্গে জাতীয় স্বার্থের অনুকূল আইন প্রণীত হয়। এক পরিষদীয় ব্যবস্থায় আকস্মিক আবেগে অবিবেচনা-প্রসূত হঠকারী ও জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী আইন প্রণীত হতে পারে। এক পরিষদীয় ব্যবস্থায় পুনর্বিবেচনার কোন সুযোগ থাকে না। তাই অনিষ্টকর আইন রচিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। দ্বি-পরিষদ ব্যবস্থা এরূপ আশঙ্কা থেকে মুক্ত। দ্বিতীয় পরিষদ থাকলে প্রতিটি বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ পাওয়া যায়। এতে বিলটির কোন দোষ-ত্রুটি থাকলে তা ধরা পড়ে এবং সংশোধন করা হয়। তা ছাড়া, দ্বিতীয় পরিষদে কালক্ষেপ হয় বলে প্রথম পরিষদের সাময়িক উত্তেজনা অন্তর্হিত হয়; আবেগের পরিবর্তে প্রজ্ঞা ও যুক্তি কার্যকরী হয়। লেকী দ্বিতীয় কক্ষের নিয়ন্ত্রণমূলক, সংস্কারমূলক ও প্রতিরোধমূলক প্রভাবের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেছেন: “The necessity of a second chamber to exercise a controlling, modifying and retarding influence, has acquired almost the position of axiom.” বল বলেছেন: “…an additional chamber may present hasty action by the first, acts as a conservative stabiliser and assists the first in its many duties.”
(২) একমাত্র কক্ষের স্বৈরাচার রোধ: লর্ড অ্যাক্টনের মতানুসারে দ্বিতীয় পরিষদ হল স্বাধীনতার একটি অপরিহার্য নিরাপত্তা (A second chamber is the essential security for freedom)। একটিমাত্র পরিষদ নিয়ে আইনসভা গঠিত হলে তা স্বৈরাচারী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ এই পরিষদকে নিয়ন্ত্রণ করার কোন উপায় থাকে না। কিন্তু দ্বিতীয় পরিষদের উপস্থিতি প্রথম পরিষদের স্বৈরাচার রোধ করতে পারে। সেজন্য বলা যায় যে, উচ্চ পরিষদ নিম্নপরিষদের অত্যাচার থেকে জনসাধারণের ব্যক্তি-স্বাধীনতা রক্ষা করে। গেটেলের অভিমত হল যে, উচ্চকক্ষ স্বৈরাচার প্রতিরোধ করে এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা রক্ষা করে। তিনি বলেছেন: “The existence of the second chamber is a guarantee of liberty as well as to some extent a safeguard against tyranny.” লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce)-এর মতানুসারে একটি কক্ষের ঘৃণ্য, অত্যাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে, এই বিশ্বাস থেকে দ্বিতীয় কক্ষের প্রয়োজনীয়তার উদ্ভব হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হল সম-ক্ষমতাসম্পন্ন অপর একটি কক্ষের সহাবস্থানের দ্বারা তার গতিরোধ করা। তিনি বলেছেন: “The necessity of two chamber is based on the belief that the innate tendency of an assembly to become hateful, tyrannical and corrupt needs to be checked by the co-existence of another house of equal authority.” বিচারপতি স্টোরী (Justice Story)-র অভিমত অনুসারে নিজের ক্ষমতার এলাকাকে অতিক্রম করার এক প্রবণতার দ্বারা আইনসভা পরিচালিত হয়ে থাকে। এই কারণে একটি সংস্থার অনিয়ন্ত্রিত কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে আর একটি সংস্থার প্রাধান্যের মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষা করা যায়।
(৩) দ্বিতীয় কক্ষের সহায়ক ভূমিকা: বর্তমান জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে আইনসভার কাজের চাপ বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একটিমাত্র পরিষদের পক্ষে এ সকল কার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা অসম্ভব। অপরপক্ষে, আইনসভার দু’টি পরিষদ থাকলে এবং দ্বিতীয় পরিষদে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবগুলি উত্থাপনের সুযোগ থাকলে, গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কমূলক বিলগুলি সুচারুরূপে বিচার-বিবেচনার জন্য প্রথম পরিষদ প্রয়োজনীয় সময় পেতে পারে। বল বলেছেন: “Certainly the second chamber can assist the lower house with the legislative programme initiating and amending bills….”
(৪) উচ্চ পরিষদে বিদগ্ধ ব্যক্তিদের মনোনয়ন: আইনসভার দ্বিতীয় পরিষদ থাকলে বিশেষ ধরনের স্বার্থ বা বিশেষ শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা যায়। প্রত্যেক দেশেই এমন অনেক জ্ঞানী-গুণী ও বিদগ্ধ ব্যক্তি থাকেন যাঁরা প্রত্যক্ষ নির্বাচনের বিড়ম্বনা ও জটিলতার মধ্যে জড়িয়ে পড়তে রাজী থাকেন না। উচ্চ পরিষদে পরোক্ষ নির্বাচন বা মনোনয়নের দ্বারা দেশের এইসব পণ্ডিত ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের আইনসভায় স্থান করে দেওয়া যায়। এতে দেশ শ্রেষ্ঠ জ্ঞান-বুদ্ধির সেবা লাভ করতে পারে এবং আইনসভায় জনমতের উন্নততর প্রতিফলন ঘটে। দ্যুণ্ডই বলেছেন: “The best type of legislature would be that in which one chamber would represent the population as a whole, and another the various groups in which the population is divided.” ব্রিটেনে রাজা বা রানী লর্ডসভার আজীবন সদস্যপদে বিশিষ্ট প্রাক্তন পদাধিকারীদের মনোনীত করতে পারেন। সাধারণত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, কমন্সসভার স্পীকার, রাষ্ট্রদূত প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গের ভিতর থেকে এই নিয়োগ করা হয়। আবার ভারতে রাজ্যসভায় বারজন বিশিষ্ট ভারতীয়কে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করতে পারেন।
(৫) জনমতের সুষ্ঠু প্রতিফলন: দ্বি-পরিষদ ব্যবস্থায় জনমতের সুষ্ঠু প্রতিফলন ঘটে। এক-পরিষদীয় আইনসভার একমাত্র পরিষদ জনগণের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হওয়ার পর এবং নির্দিষ্ট কার্যকাল অতিক্রান্ত হওয়ার আগে জনমতের পরিবর্তন ঘটতে পারে। তখন এটি আর জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। কারণ জনমতের সঙ্গে এর সামঞ্জস্যের অভাব ঘটে। দ্বি-পরিষদীয় ব্যবস্থা এরূপ আশঙ্কা থেকে মুক্ত। আইনসভার দু’টি পরিষদ বিভিন্ন সময়ে নির্বাচিত হলে প্রবহমান জনমত যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়। দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট ব্যবস্থায় পরিবর্তনশীল জনমতের গতি-প্রকৃতি অনুসন্ধান ও পরিমাপ করা যায়। গেটেলের অভিমত অনুসারে সমষ্টিগত ইচ্ছা (General will)-র সঠিক ব্যাখ্যা দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার মাধ্যমে পাওয়া যেতে পারে।
(৬) রাষ্ট্রনৈতিক শিক্ষার বিস্তার: উচ্চপরিষদ জনগণের রাজনীতিক শিক্ষা বিস্তারেও সাহায্য করে। উচ্চ-পরিষদের প্রতিটি বিলকে পুনরায় বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা হয়। আইনসভায় বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনা ও বিতর্ক বেতার, সংবাদপত্র প্রভৃতির মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছায়। সেই সকল আলোচনার সুবাদে জনগণও সকল বিষয় পুনরায় পর্যালোচনা করে দেখার সুযোগ পায়। এতে তাদের রাষ্ট্রনৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটে।
(৭) যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার গুরুত্ব: আবার যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় উচ্চ-পরিষদের অস্তিত্বকে তাপরিহার্য বিবেচনা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র গঠনকারী অঙ্গরাজ্যগুলোর স্বতন্ত্র স্বার্থের সহাবস্থান পরিলক্ষিত হয়। জাতীয় স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে জনগণের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত নিম্ন পরিষদ। আর অঙ্গরাজ্যগুলির স্বতন্ত্র স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য থাকে উচ্চপরিষদ। যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার উচ্চ পরিষদ গঠিত হয় অঙ্গরাজ্যগুলির প্রতিনিধি নিয়ে। গেটেল মন্তব্য করেছেন: “The bicameral system affords an opportunity of giving representation to the political units composing the federation.” সেজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় আইনসভার উচ্চকক্ষ অঙ্গরাজ্যগুলির সমসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত হয়।
(৮) পরস্পরের দোষ-ত্রুটি সংশোধন: দ্বি-পরিষদ ব্যবস্থার সপক্ষে আরও বলা হয় যে, দু’টি পরিষদ পরস্পরের দোষ-ত্রুটি সংশোধন করতে পারে। দ্বিতীয় পরিষদের সদস্যগণ প্রবীণ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, কিন্তু সাধারণত সংরক্ষণশীল। অপরপক্ষে, প্রথম পরিষদের সদস্যগণ নবীন এবং অনভিজ্ঞ হলেও অত্যন্ত উৎসাহী। দ্বিতীয় পারষদ প্রথম পরিষদের অত্যুৎসাহকে সংযত করতে পারে; আবার প্রথম পরিষদ, দ্বিতীয় পরিষদের রক্ষণশীলতাকে দূর করতে পারে। এ ব্যাপারটি জাতীয় স্বার্থের জন্যই প্রয়োজন। গার্নারের অভিমত অনুসারে আইনসভায় অধিকতর রক্ষণশীল অংশের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করে দ্বিতীয় কক্ষ অধিকতর পরিবর্তনকামী শক্তিকে প্রতিহত করতে পারে। বল আরও বলেছেন: “… the real basis for a defence of second chambers is political second chambers act as a more conservative force in the political system, and must be seen as indicating a fear of liberal representation in the populistic sense.”
(৯) সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষা: আইনসভা এক কক্ষবিশিষ্ট হলে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সাধারণত প্রতিনিধি পাঠাতে পারে না। আর আইনসভায় প্রতিনিধি না থাকায় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ অবহেলিত হয়। কিন্তু আইনসভা দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট হলে উচ্চকক্ষে পরোক্ষ নির্বাচন বা মনোনয়নের মাধ্যমে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু প্রতিনিধি প্রেরণের সুযোগ পাওয়া যায়। এইভাবে গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম শর্ত পূরণ করা যায়। সুশাসনের জন্য সমাজের সকল শ্রেণী ও স্বার্থের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা আইন-সভায় থাকা দরকার। আইনসভা এক কক্ষবিশিষ্ট হলে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সকল শ্রেণীর যথার্থ প্রতিনিধিত্বের সুযোগ থাকে না। আবার বহু জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রতিটি জাতি নিজের ভাষা-সাহিত্য, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি প্রভৃতি সংরক্ষণের স্বার্থে দ্বিতীয় কক্ষের সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। বলের অভিমত অনুসারে দ্বিতীয় কক্ষের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থাকে ব্যাপক করে তোলা যায়। সাধারণ ব্যবস্থায় বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠী ও শ্রেণীর প্রতিনিধি প্রেরণের সুযোগ থাকে না। এই কারণে দ্বিতীয় কক্ষ দরকার। দ্বিতীয় কক্ষ বিভিন্ন ভাষা, পেশা, সংস্কৃতি প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহের প্রতি-নিধিত্বের সুযোগ সৃষ্টি করে। অ্যালান বল বলেছেন: “…a second chamber widens the basis of representation…..”
(১০) শাসন-বিভাগের নিরাপত্তা: দ্বিতীয় পরিষদ শাসন বিভাগের অনুকূলে একমাত্র পরিষদের অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার বিরুদ্ধে অবশ্যিক নিরাপত্তা হিসাবে বিবেচিত হয়। নিম্নকক্ষ ইচ্ছামত আইন তৈরি করে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বাধা-বিপত্তির সৃষ্টি করলে, শাসন-বিভাগ উচ্চকক্ষের সাহায্যে নিম্নকক্ষের স্বৈরাচারের হাত থেকে রক্ষা পায়। অর্থাৎ দ্বিতীয় কক্ষ প্রথম কক্ষের স্বৈরাচার থেকে শাসন-বিভাগকে রক্ষা করে। এই কারণে গেটেল (Gettell) প্রমুখ চিন্তাবিদদের অভিমত হল আইনসভা দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট হলে, কক্ষ দু’টি পরস্পরের ক্ষমতা ও কাজের সীমা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তার ফলে শাসন-বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।
(১১) সমাজতন্ত্রবাদীদের মত: দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পশ্চিমী গণতন্ত্রের প্রবক্তাদের যুক্তি এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রবক্তাদের যুক্তি এক নয়। সমাজতন্ত্রবাদীদের মতানুসারে বহুজাতিভিত্তিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতি ও জনসমাজের শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভাষা-ধর্ম প্রভৃতি সংরক্ষণের জন্য দ্বিতীয় কক্ষের প্রয়োজন।
(১২) ম্যারিয়েটের মত: ম্যারিয়ট ইতিহাসগত বিচারে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভাকে সমর্থন করেছেন। ইতিহাসের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে আইনসভা দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তিনি বলেছেন: “Experience has been in favour of two chambers, and it is not wise to disregard the lessons of history.” ম্যারিয়টের মতানুসারে বিভিন্ন দেশের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা যায়।
দ্বি-কক্ষ ব্যবস্থার বিপক্ষে যুক্তি:
উচ্চপরিষদের সপক্ষে প্রদর্শিত যুক্তিগুলি সর্বাংশে সত্য নয়। উপরিউক্ত যুক্তিগুলি খণ্ডন করে দ্বি-পরিষদ ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করা হয়। উচ্চপরিষদের বিরোধীদের মধ্যে আবে সিঁয়ে, বেস্থাম, ফ্রাঙ্কলিন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর নাম উল্লেখযোগ্য।
(ক) অনাবশ্যক: সুচিন্তিত আইনের জন্য দ্বিতীয় পরিষদ আবশ্যক; অন্যথায় অবিবেচনাপ্রসূত আইন প্রণীত হতে পারে বলে যে যুক্তি দেখানো হয়, তা অভ্রান্ত নয়। কারণ বর্তমান কালের আইন প্রণয়ন পদ্ধতি বিশেষভাবে দীর্ঘ এবং নানা পর্যায়ে বিভক্ত। বিচার-বিবেচনা না করে ক্ষণিকের আবেগে কোন আইনই প্রণীত হয় না। অধিকাংশ আইনের খসড়া প্রস্তাব সরকারের মূলনীতি অনুসারে আইনজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তিদের দ্বারা রচিত হয় এবং বিধি-নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আলাপ-আলোচনা এবং বিতর্ক ও বিশ্লেষণের বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করার পর পাস হয়। সেইজন্য এক-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভায়ও অবিবেচনাপ্রসূত আইন প্রণীত হওয়ার আশঙ্কা নেই। সুতরাং আইনের ভুল-ভ্রান্তি সংশোধনের জন্য উচ্চকক্ষের অস্তিত্ব অনাবশ্যক।
(খ) দ্বিতীয় কক্ষ প্রথম কক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তা কাম্যও নয়: আবার উচ্চকক্ষ একমাত্র কক্ষের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ব্যক্তি-স্বাধীনতা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে বলে যে যুক্তির অবতারণা করা হয় তাও অবান্তর কারণ জনগণের প্রতিনিধিপুষ্ট নিম্নকক্ষ উচ্চকক্ষের তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী। সেজন্য দ্বিতীয় কক্ষ জনপ্রিয় কক্ষের কাজে কার্যকরীভাবে কোন নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। তাছাড়া, নিম্নকক্ষের জনগণের প্রতিনিধিদের উপর উচ্চকক্ষের মনোনীত সদস্যগণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে—এ গণতন্ত্রসম্মত নয়।
(গ) অগণতান্ত্রিক গঠন: দ্বিতীয় পরিষদের বিরুদ্ধে আরও একটি অভিযোগ হল : এর গঠন অগণতান্ত্রিক। গণতন্ত্রের আদর্শ অনুসারে আইনসভা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হবে। কিন্তু দ্বিতীয় কক্ষ সাধারণত বিত্তবান, মনোনীত ও রক্ষণশীল ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হয়। ইংল্যাণ্ডের লর্ডসভার সদস্যগণ উত্তরাধিকারসূত্রে পদ লাভ করেন। আর ভারতের মত সংসদীয় শাসনে দলীয় মন্ত্রিসভার সমর্থনপুষ্ট ব্যক্তিগণই মনোনীত হওয়ার সুযোগ পান। সুতরাং মনোনয়ন সূত্রে জ্ঞানী-গুণী ও পণ্ডিত ব্যক্তিগণ দ্বিতীয় কক্ষে সদস্যপদ লাভ করেন– এও সঠিক নয়।
(ঘ) দায়িত্ব বিভক্ত হয়ে পড়ে: দু’টি পরিষদ নিয়ে গঠিত হলে আইনসভার দায়িত্ব বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় আইন প্রণয়নের সঠিক দায়িত্ব নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। একে অপরের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দু’টি সঠিক পরিষদের প্রত্যেকটি অব্যাহতি লাভের চেষ্টা করে। সেজন্য বলা হয় দায়িত্বের বিভাজন দায়িত্ব নাশেরই সামিল। ডিমক ও ডিমক মন্তব্য করেছেন: bicameralism divides responsibility…and may even destroy it.”
(ঙ) শ্রেণীস্বার্থ প্রাধান্য পায়: দ্বিতীয় পরিষদের সপক্ষে অন্যতম যুক্তি হিসাবে বলা হয় যে, এই পরিষদ সকল শ্রেণী ও স্বার্থের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করে। কিন্তু এই ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে মোটেই কাম্য নয়। কারণ এর ফলে জাতির বৃহত্তম স্বার্থের পরিবর্তে শ্রেণীস্বার্থ প্রাধান্য পায়। দ্বিতীয় কক্ষের আলোচনায় জনগণের সামগ্রিক কল্যাণের পরিবর্তে বিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার আগ্রহ বেশী প্রকাশ পায়। তাই দ্বিতীয় কক্ষকে প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীস্বার্থ সংরক্ষণের দুর্গ হিসাবে সমালোচনা করা হয়।
(চ) সংখ্যালঘুর স্বার্থ রক্ষার জন্যও অনাবশ্যক: সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যও দ্বিতীয় পরিষদ অনাবশ্যক। কারণ সংবিধানেই বিভিন্ন উপায়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ বজায় রাখার ব্যবস্থা করা যায়। সুতরাং আইনসভার একটি কক্ষ থাকলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই।
(ছ) প্রগতিবিরোধী: আবার দু’টি কক্ষ সমক্ষমতাসম্পন্ন হলে এই দ্রুত পরিবর্তনশীল জগতে আইন প্রণয়নের ব্যাপারে অযথা বিলম্ব হয়। প্রথম পরিষদের বিরোধিতা করা দ্বিতীয় পরিষদের অভ্যাসে পরিণত হয়। অনেক ক্ষেত্রে জনকল্যাণমূলক এবং প্রগতিশীল আইন প্রণয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সেজন্য এটি প্রগতির পরিপন্থী বলে বিবেচিত হয়। বল বলেছেন: “second chambers act as a more conservative force in political system and must be seen as indicating a fear of liberal representation in the populistic sense.”
(জ) আইন প্রণয়নে বিলম্ব: দ্বিতীয় কক্ষ আইন প্রণয়নকে বিলম্বিত করে। দুটি কক্ষের মধ্যে বিরোধ বাধলে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। তার ফলে প্রশাসন ব্যবস্থা শ্লথগতিসম্পন্ন হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য পূরণ প্রতিহত হয়। জনস্বার্থ বিঘ্নিত হয়। জরুরী অবস্থায় আইন প্রণয়ন বিলম্বিত হলে সংকটের সৃষ্টি হতে পারে। এই কারণে জরুরী অবস্থায় দ্বিতীয় কক্ষ অর্থহীন ও অপ্রাসঙ্গিক প্রতিপন্ন হয়। ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কক্ষ অকারণ বিলম্বের সৃষ্টি করে।
(ঝ) ব্যয়বহুল এবং অপচয়মূলক: দ্বি-পরিষদ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আর একটি অভিযোগ হল: এটি ব্যয়বহুল এবং অপচয়মূলক। দু’টি পরিষদ থাকলে অতিরিক্ত সরকারী অর্থ ব্যয় হবে এ কথা বলাই বাহুল্য। আর দ্বিতীয় পরিষদ যদি অনাবশ্যক হয় তবে এই ব্যয় অপচয় ব্যতীত কিছুই নয়।
(ঞ) যুক্তরাষ্ট্রেও দ্বিতীয় কক্ষ অপরিহার্য নয়: ল্যাস্কির অভিমত অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রীয় উচ্চকক্ষ অনাবশ্যক। যুক্তরাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যেই অঙ্গরাজ্যগুলির স্বার্থসংরক্ষণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রয়েছে। লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয় শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতার বণ্টন, যুক্তরাষ্ট্রীয় উচ্চ আদালতের অস্তিত্ব প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে অঙ্গরাজ্যগুলির স্বতন্ত্র স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা লাভ করে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চকক্ষ অপরিহার্য নয়।
(ট) আবে সিঁয়ের মত: প্রখ্যাত ফরাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আবে সিঁয়ে যথার্থই বলেছেন, উচ্চপরিষদ নিম্নপরিষদের সঙ্গে একমত হলে তা বাহুল্য মাত্র, আর উচ্চপরিষদ নিম্নপরিষদের সঙ্গে যদি একমত না হয়, তবে তা অনিষ্টকর (“If the second chamber agrees with the first, it is superflous; if it disagree it is pernicious.”)।
(ঠ) ল্যাস্কির মন্তব্য: ল্যাস্কিও দ্বিতীয় পরিষদের বিরোধিতা করে বলেছেন যে, আধুনিক রাষ্ট্রের সকল প্রয়োজন মিটাবার পক্ষে এক-পরিষদীয় আইনসভাই যথেষ্ট। তিনি বলেছেন: “The single chamber… legislative assembly seems best to answer the needs of the modern state.” এর মাধ্যমে সরকারের গঠন ও পরিচালনা বেশ সরল ও ব্যয়ভার মুক্ত হয়।
(ড) ফ্রাঙ্কলিনের যুক্তি: জনগণের প্রতিনিধিস্বরূপ যে আইনসভা তা দু’টি কক্ষে বিভক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কারণ কোন বিশেষ বিষয়ে জনগণের ইচ্ছা দুটো রূপে প্রকাশিত হতে পারে না। আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন হল জনগণের ইচ্ছার প্রকাশ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এই আইন বিভিন্ন ধারায় প্রকাশিত হওয়া সম্ভব নয়। এই কারণে ফ্রাঙ্কলিন বিপরীতমুখী গতিযুক্ত ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়ি হিসাবে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভাকে ব্যঙ্গ করেছেন।
(ঢ) তাছাড়া দ্বিতীয় কক্ষের গঠন ব্যবস্থা সম্পর্কেও ব্যাপক মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। দ্বিতীয় কক্ষের কার্যকালের মেয়াদ, ক্ষমতা ও কার্যাবলী সম্পর্কেও মতানৈক্যের শেষ নেই।
বর্তমান কালে তাই এক পরিষদীয় আইনসভার প্রতি ঝোঁক পরিলক্ষিত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে গ্রীস, তুরস্ক, বুলগেরিয়া, যুগোশ্লোভিয়া, রুমানিয়া, পানামা প্রভৃতি দেশে এক কক্ষবিশিষ্ট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনেকে আবার উচ্চকক্ষের উপযোগিতাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেন না। তাঁদের মতানুসারে উচ্চকক্ষের গঠন ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রসম্মত করতে পারলে, উচ্চকক্ষ একটি সংশোধনী কক্ষ (revising chamber) হিসাবে জনকল্যাণসাধনের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। তাই এখনও অনেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দ্বি কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার অস্তিত্ব দেখা যায়।
উপসংহার: গেটেলের অভিমত অনুসারে রাজনীতিক বিবর্তনের একটি অঙ্গ হল এই দ্বি-পরিষদীয় ব্যবস্থা। বিভিন্ন বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও বর্তমান রাজনীতিক ব্যবস্থায় দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার অস্তিত্ব অব্যাহত আছে। অধিকাংশ রাষ্ট্রের আইনসভাই হল দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় দ্বিতীয় কক্ষ আছেই। যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয়কক্ষ সাধারণত অঙ্গরাজ্যগুলির সমপ্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে গঠিত হয়। মার্কিন সিনেট, একশ জন সদস্যকে নিয়ে গঠিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্যের প্রতিটি দু’জন করে প্রতিনিধি সিনেটে নির্বাচিত করে। সুইজারল্যাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার উচ্চপরিষদে প্রতিটি ক্যান্টন থেকে দুজন করে প্রতিনিধি এবং প্রতিটি অর্ধ-ক্যান্টন থেকে একজন করে প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। অস্ট্রেলিয়ান সিনেট গঠিত হয় ছটি অঙ্গরাজ্যের প্রতিটি থেকে দশজন প্রতিনিধিকে নিয়ে। প্রকৃত প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় কক্ষের বিশেষ গুরুত্ব বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। বল-এর মতানুসারে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাই হল উচ্চকক্ষের পক্ষে সর্বাধিক প্রাসঙ্গিক যুক্তি। বল তাঁর Modern Government and Politics শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “It would seem that in the absence of the development of some effective form of functional representation, a federal structure provides the greatest relevance for second chambers.” সমালোচকদের অনেকে মার্কিন সিনেটকে রাজনীতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। কিন্তু অন্য কোন দেশের আইনসভার উচ্চকক্ষকে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকার করতে সম্মত নন। ১৯৫৮ সালের ফরাসী সংবিধানে সিনেটকে অধিকতর শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সে উদ্যোগ অর্থবহ হয়ে উঠেনি।
Leave a comment