বর্তমানে জনকল্যাণকর রাষ্ট্রব্যবস্থা (welfare state) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে সরকারের দায়-দায়িত্বও অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানবজীবনের সক ক্ষেত্রে সরকারের কল্যাণহস্ত প্রসারিত। সরকারের কাজকর্ম বৃদ্ধির সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই শাসন-বিভাগের কার্যাবলী অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জনজীবনে শাসন-বিভাগের দায়িত্ব এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে শাসন-বিভাগের কার্যাবলীকে নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়।
(১) আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা: সুশৃঙ্খল সমাজজীবন সম্ভব করার জন্যই মানুষ রাজনীতিক জীবনে সংগঠিত হয়েছে। এই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকা দরকার। এই কারণে আভ্যন্তরীণ শান্তি রক্ষা শাসন-বিভাগের একটি গুরুদায়িত্ব হিসাবে গণ্য হয়। শাসন-বিভাগের প্রধান কাজ হল রাষ্ট্রের মধ্যে আইনকে প্রয়োগ করা, নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, স্থায়ী কর্মচারীদের নিযুক্ত করা প্রভৃতি। ব্যাপক অর্থে শাসন-বিভাগকে আভ্যন্তরীণ শাসনকার্য পরিচালনা করতে হয়। এই কার্য সম্পাদনের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে শাসন-বিভাগের স্বরাষ্ট্র দপ্তর (Home Department)-এর উপর।
(২) পররাষ্ট্র সংক্রান্ত কার্য: বর্তমান সভ্য দুনিয়ার সকল স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। উন্নত সভ্যতা-সংস্কৃতি ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির যুগে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র পরস্পরের অত্যন্ত কাছে এসেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরস্পরের উপর নির্ভরশীল রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর পররাষ্ট্র সংক্রান্ত যাবতীয় কার্য শাসন-বিভাগের গুরুদায়িত্ব হিসাবে গণ্য হয়। পররাষ্ট্র বিষয়ক কার্য বলতে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপন, রাজনীতিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদন, বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ, অন্যান্য রাষ্ট্রে দূত প্রেরণ এবং তাদের রাষ্ট্রদূতকে নিজ রাষ্ট্রে গ্রহণ, সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মত আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক আরোপিত দায়িত্ব পালন ইত্যাদিকে বোঝায়। রাষ্ট্রের প্রতিভূ হিসাবে রাষ্ট্রপ্রধানই এই দায়িত্ব পালন করেন। শাসন-বিভাগের পররাষ্ট্র দপ্তর (Department of External Affairs) এর মাধ্যমে এই সমস্ত কার্য সম্পাদন করা হয়।
(৩) প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কার্য: রাষ্ট্রের অখণ্ডতা রক্ষা করা, বহিরাক্রমণ প্রতিহত করা এবং প্রয়োজন দেখা দিলে যুদ্ধ ঘোষণা করা শাসন-বিভাগের গুরুদায়িত্ব হিসাবে বিবেচিত হয়। শাসন-বিভাগ এই উদ্দেশ্যে স্থল-বাহিনী, নৌ-বাহিনী, বিমান বাহিনী গঠন, অন্যান্য সামরিক কর্মচারী নিয়োগ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। শাসন-বিভাগের প্রধানই হলেন সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তিনি সৈন্যাধ্যক্ষগণকে নিয়োগ ও পদচ্যুত করেন। তিনিই যুদ্ধ ঘোষণা ও পরিচালনা করেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য আইন বিভাগের পূর্বানুমোদন প্রয়োজন হয়। এই সমস্ত সামরিক কার্যাবলী শাসন বিভাগের প্রতিরক্ষা দপ্তর (Defence Department)-এর মাধ্যমে সম্পাদিত হয়।
(8) আইন সংক্রান্ত কার্য: বর্তমানকালের রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইন প্রণয়নের ব্যাপারেও শাসন-বিভাগকে কতকগুলি আইনসংক্রান্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়। বর্তমানে অধিকাংশ দেশে রাষ্ট্রপ্রধান আইনসভার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে গণ্য হন। তিনিই আইনসভার অধিবেশন আহ্বান করেন; আবার প্রয়োজনবোধে আইনসভার অধিবেশন স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। তিনি ইচ্ছা করলে আইনসভা ভেঙ্গে দিতেও পারেন। তাঁর সম্মতি ছাড়া কোন বিল আইনে পরিণত হয় না। ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং ইংল্যাণ্ডের রাজা বা রানী পার্লামেন্টের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এই হিসাবে তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে আইন-বিভাগের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। আবার শাসন-বিভাগ সরাসরি আইনও প্রণয়ন করতে পারে। বর্তমানে আইনসভাকে অসংখ্য বিষয় নিয়ে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই আইনসভা কেবল আইনের মূল কাঠামোটি রচনা করে দেয়। আর শাসন বিভাগ খুঁটিনাটি বা উপ-আইন (by-law) প্রণয়ন করে মূল আইনের ফাঁকগুলি পূরণ করে। একে অর্পিত ক্ষমতা-প্রসূত আইন (Delegated Legislation) বলে। তা ছাড়া আইনসভা অধিবেশনে না থাকাকালীন সময়ে শাসন-বিভাগ প্রয়োজনবোধে জরুরী আইন (Ordinance) জারি করতে পারে।
(৫) বিচার সংক্রান্ত কার্য: শাসন-বিভাগের কয়েকটি বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতাও আছে। অনেক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধান উচ্চ আদালতে বিচারপতিদের নিযুক্ত করেন। তিনি দণ্ডিত অপরাধীর দণ্ড হ্রাস করতে পারেন, স্থগিত রাখতে আবার ক্ষমা প্রদর্শন করতে পারেন। আবার কর নির্ধারণ, নিয়োগ, পদোন্নতি, পদচ্যুতি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে আপত্তির নিষ্পত্তি শাসন-বিভাগই করে থাকে। তা ছাড়া শাসন-বিভাগের কর্মচারীদের অন্যায় আচরণ, দুর্নীতি প্রভৃতির বিচার অনেক দেশে বিশেষ আইনের সাহায্যে শাসন-বিভাগের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়। এক্ষেত্রে ব্রিটেনের শাসন-বিভাগীয় আইন (Administrative Law) ও ফ্রান্সের প্রশাসনিক আইন (Droit Administratif)-এর কথা বলা যায়। এই ধরনের বিচার শাসন-বিভাগীয় বিচার (Administrative Justice) হিসাবে পরিচিত। তবে শাসন-বিভাগের বিচার সংক্রান্ত কাজ প্রকৃতপক্ষে আদালতের কার্য সম্পাদনের মত নয়। তাই শাসন-বিভাগের এই বিচার সংক্রান্ত কাজকে আধা-বিচার-বিভাগীয় (quasi-judicial) কাজ বলা হয়।
(৬) অর্থ সংক্রান্ত কার্য: জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারের বিবিধ কার্য সম্পাদনের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। সাধারণত কর ধার্য ও সেবামূলক কার্যাদি সম্পাদন প্রভৃতি উপায়ে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগৃহীত হয়। শাসন-বিভাগই সরকারী অর্থ সংগ্রহ এবং ব্যয় নির্বাহ করে। তবে কর ধার্য ও ব্যয়বরাদ্দের ব্যাপারে আইনসভার অনুমোদন আবশ্যক। সরকারের অর্থ সংক্রান্ত কার্য শাসন-বিভাগের অর্থ দপ্তর (Finance Department)-এর মাধ্যমে সম্পাদিত হয়ে থাকে।
(৭) নীতি নির্ধারণ সংক্রান্ত কার্য: স্বরাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্র সংক্রান্ত কাজকর্ম পরিচালনার জন্য সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতি থাকতে হয়। সরকারের শাসন-বিভাগ এই নীতি নির্ধারণ করে। ইংল্যাণ্ড, ভারত প্রভৃতি সংসদীয় শাসনব্যবস্থার দেশে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ক্যাবিনেট এই নীতি প্রণয়ন করে থাকে। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসনব্যবস্থায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারী নীতি নির্ধারণ ও প্রয়োগের দায়িত্ব ও ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত থাকে।
(৮) জনকল্যাণমূলক কার্য: উপরিউক্ত আবশ্যিক কার্যাবলীর কথা বাদ দিলেও, বর্তমানে শাসন বিভাগকে অন্যান্য অনেক কার্য সম্পাদন করতে হয়। সাম্প্রতিককালে প্রতিটি রাষ্ট্র জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগ করেছে। তারফলে স্বাভাবিকভাবে শাসন-বিভাগের কার্যক্ষেত্রের পরিধি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন শাসন-বিভাগকে জনশিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, পরিবহন ও শিল্পবাণিজ্য, ডাক ও তার এবং অন্যান্য সেবামূলক বহুবিধ কার্যাদি সম্পাদিত করতে হয়। অনেক সময় আবার শাসন-বিভাগকে কোন কোন দ্রব্যের উৎপাদন ও বণ্টনের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।
সাম্প্রতিককালে শাসন-বিভাগের কার্যাবলী অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তার ফলে শাসন-বিভাগও এখন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রপতি শাসিত এবং সংসদীয়— উভয় ধরনের শাসনব্যবস্থাতেই শাসন-বিভাগের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
Leave a comment