এক-দলীয় ব্যবস্থার সংজ্ঞা:
আপাতবিচারে মনে হয়, এক-দলীয় ব্যবস্থার সংজ্ঞা নির্ধারণ সহজ। বাস্তবে কিন্তু তা ততটা নয়। তবে সাধারণভাবে বলা যেতে পারে যে, সমগ্র দেশে একটিমাত্র রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব স্বীকৃত হলে তাকে এক-দলীয় ব্যবস্থা বলে। দেশের এই একমাত্র দলটি তার আদর্শ, নীতি ও কর্মসূচী অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকে। অ্যালমও এক-দলীয় ব্যবস্থাকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন। সাধারণ একদলীয় ব্যবস্থা (মিশর, স্পেন) এবং সর্বাত্মক একদলীয় ব্যবস্থা (গণ-প্রজাতন্ত্রী চীন, নাৎসী জার্মানী)।
সাধারণ এক দলীয় ব্যবস্থা:
সাধারণ এক-দলীয় ব্যবস্থায় একটিমাত্র রাজনীতিক দলের সর্বময় কর্তৃত্ব স্বীকৃত। এই দল দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে। তবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ঐ একমাত্র দলের প্রার্থীরাই পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে তানজানিয়ার দলীয় ব্যবস্থার কথা বলা যায়। তানজানিয়ার একমাত্র স্বীকৃত রাজনীতিক দল হল ‘তানজানীয় আফ্রিকান জাতীয় ইউনিয়ন’ (The Tanzanian African National Union)। এই দলের একাধিক প্রার্থী একই নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে পারেন। তাছাড়া একমাত্র স্বীকৃত দল হলেও দলটি জনজীবনের সকল দিক চূড়ান্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করে না। কেনিয়ায় ‘কেনিয়া আফ্রিকান জাতীয় ইউনিয়ন’ (Kenya African National Union) বিরোধী দলকে নিষিদ্ধ করে একমাত্র দল হিসাবে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করে।
সর্বাত্মক এক-দলীয় ব্যবস্থা:
সর্বাত্মক এক-দলীয় ব্যবস্থায়ও একটিমাত্র রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব স্বীকৃত। তবে এই একমাত্র দলটির নীতি ও মতাদর্শ চরম, অভ্রান্ত এবং শ্রেষ্ঠ বলে প্রচার করা হয়। দলটি সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থনীতিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি জনজীবনের সকল দিক চরম ও চূড়ান্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। ঐ একটিমাত্র দলই তার আদর্শ ও নীতি অনুসারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণ করে। কোন রকম বিরোধিতাকে এখানে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। বিরোধী মতামত ও বিরোধী দলকে কঠোরভাবে দমন করা হয়ে থাকে। এ ধরনের একদলীয় ব্যবস্থায় সদস্যদের সার্বিক আনুগত্য সুনিশ্চিত করার জন্য দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। সর্বাত্মক এক-দলীয় ব্যবস্থার উদাহরণ হিসাবে জার্মানীর নাৎসী দল এবং ইতালীর ফ্যাসিস্ট দলের ভূমিকার কথা বলা যেতে পারে। উদারনীতিক গণতন্ত্রের সমর্থকদের মতানুসারে এ ধরনের এক-দলীয় ব্যবস্থা প্রকৃতিগত বিচারে অগণতান্ত্রিক।
ফ্যাসিবাদী একদলীয় ব্যবস্থা এবং সাম্যবাদী এক-দলীয় ব্যবস্থা:
সর্বাত্মক এক-দলীয় ব্যবস্থার মধ্যেও প্রকারভেদ আছে। উপরি-উল্লিখিত সর্বাত্মক এক দলীয় ব্যবস্থা হল নাৎসীবাদী ও ফ্যাসিবাদী। এ ছাড়া সাম্যবাদী এক দলীয় ব্যবস্থাও সর্বাত্মক। উদাহরণ হিসাবে গণ-প্রজাতন্ত্রী চীন প্রভৃতি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির এক-দলীয় ব্যবস্থার কথা বলা যায়। সাম্যবাদী সর্বাত্মক এক-দলীয় ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক বলা যায় না। সমাজে শ্রেণীবৈষম্য থাকলে, বিভিন্ন শ্রেণীস্বার্থের রক্ষক হিসাবে বিভিন্ন রাজনীতিক দল বর্তমান থাকে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজ হল শ্রেণীহীন ও শোষণহীন। তাই এখানে একাধিক রাজনীতিক দলের প্রয়োজন থাকে না। এখানে মেহনতী মানুষের স্বার্থের ধারক ও বাহক হিসাবে ‘কমিউনিস্ট দল’ নামে একটি মাত্র রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব স্বীকৃত। এই দল ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার’ (Democratic Centralism) নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। নাৎসীবাদী বা ফ্যাসীবাদী সর্বাত্মক এক-দলীয় ব্যবস্থায় ব্যক্তিপূজাই হল বড় কথা। কিন্তু সাম্যবাদী সর্বাত্মক এক-দলীয় ব্যবস্থায় ব্যক্তিপূজা অস্বীকৃত। সর্বোপরি মৃতপ্রায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য জার্মানীতে নাৎসীবাদী এবং ইতালীতে ফ্যাসিবাদী এক-দলীয় ব্যবস্থার আবির্ভাব হয়। কিন্তু সাম্যবাদী সর্বাত্মক এক দলীয় ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হল সর্বহারার একনায়কত্বে পুঁজিবাদের সমাধি রচনা করা এবং সমাজতন্ত্র ও চূড়ান্তভাবে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত করা।
এক-দলীয় ব্যবস্থার গুণাগুণ
পশ্চিমী দুনিয়ার কয়েকটি দেশে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এক-দলীয় শাসনের সৃষ্টি হয়। জার্মানীতে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসী দল এবং ইটালীতে মুসোলিনীর নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদী দলের উৎপত্তি হয়। নাৎসীবাদী ও ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র সর্বাত্মক রাষ্ট্র ও এক-দলীয় ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। ফ্যাসিবাদী নেতা মুসোলিনী (Benito Musolini) মন্তব্য করেছেন: “A party which entirely governs a nation is in fact entirely new to history, there are no possible reference of parallels.” সাম্প্রতিক কালে পৃথিবীর সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে এক-দলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত আছে। বর্তমানে গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনে একটিমাত্র দলই সংবিধান অনুসারে স্বীকৃত। তা হল ‘কমিউনিস্ট দল’ (Communist Party)। এই দলই সমগ্র গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনে শাসনকার্য পরিচালনা করছে। সাম্প্রতিককালে পৃথিবীর অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহেও এক-দলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত আছে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা দরকার নাৎসীবাদী ও ফ্যাসীবাদী এক-দলীয় ব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সাম্যবাদী এক-দলীয় ব্যবস্থা আদর্শ, লক্ষ্য ও কর্মসূচীর বিচারে সম্পূর্ণ পৃথক প্রকৃতির। যাইহোক এশিয়া ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশেও বর্তমানে একদলীয় ব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছে।
এক-দলীয় ব্যবস্থার সপক্ষে যুক্তি:
একদলীয় ব্যবস্থার সপক্ষে এই ব্যবস্থার প্রবক্তাগণ বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেন।
(১) জাতীয় ঐক্য সংহতি: সারা দেশে একটিমাত্র দলের অস্তিত্ব স্বীকৃত হলে দেশবাসীর মধ্যে একতা বৃদ্ধি পায় এবং সংহতি বজায় থাকে। কারণ দেশের জনসাধারণ একটিমাত্র রাজনীতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় এবং সমমতাদর্শের ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ হয়। এর ফলে জাতীয় সংহতি ও শক্তি বৃদ্ধি পায়।
(২) দেশের দ্রুত সামগ্রিক উন্নতি: দেশের স্বীকৃত একমাত্র দলটি যদি জনকল্যাণের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনস্বার্থ সাধনে আত্মনিয়োগ করে তাহলে দেশের সামগ্রিক উন্নতির পথ উন্মুক্ত হয়। গণ-প্রজাতন্ত্রী চীনের দ্রুত বৈষয়িক উন্নতি এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য।
(৩) সরকারের স্থায়িত্ব: বহুদলীয় ব্যবস্থায় সরকারের স্থায়িত্বের ব্যাপারে সর্বদা আশঙ্কা থাকে। প্রায়ই সরকারের পরিবর্তন হয়। তাই কোন সরকারই নিশ্চিন্তভাবে জনস্বার্থের জন্য গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারে না। অপরপক্ষে একদলীয় ব্যবস্থায় সরকার বিশেষভাবে স্থায়ী হয়। স্থায়িত্বের ব্যাপারে নিশ্চয়তা থাকে বলে সরকার জনকল্যাণ সাধনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে।
(৪) অপব্যয় হয় না: এক দলীয় শাসনব্যবস্থা অপব্যয়ের ত্রুটি থেকে মুক্ত। এক-দলীয় ব্যবস্থার ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্যগণ নির্বাচিত হতে পারেন। নির্বাচনের জন্য বিপুল অর্থ অপচয়ের প্রয়োজন হয় না। বহুদলীয় ব্যবস্থায় নির্বাচনী প্রচারে এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পাদন করার জন্য বিপুল অর্থের অপচয় ঘটে। একদলীয় ব্যবস্থায় ঐ অর্থ উন্নয়নমূলক খাতে ব্যয় করা যায়।
(৫) গণতন্ত্র বিরোধী নয়: এক-দলীয় ব্যবস্থা গণতন্ত্র-বিরোধী এই অভিযোগ অমূলক। দেশের সমস্যাদি বিশ্লেষণ, সরকারী কার্যকলাপ সম্পর্কে গঠনমূলক সমালোচনা, পারস্পরিক মতবিনিময়ের সুযোগ প্রভৃতি গণতান্ত্রিক উপাদান একদলীয় শাসন ব্যবস্থায়ও বর্তমান। তাছাড়া এক-দলীয় ব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের পক্ষে বিশেষভাবে উপযোগী।
(৬) জরুরী অবস্থার উপযোগী : একদলীয় ব্যবস্থায় জাতীয় প্রয়োজনে বা জরুরী অবস্থায় দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। একাধিক রাজনীতিক দল থাকলে নীতি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় এবং আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে। দ্রুত ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না। তার ফলে জরুরী অবস্থায় দেশ বিপদে পড়ে। কিন্তু একদলীয় ব্যবস্থায় নীতি ও আদর্শের ক্ষেত্রে মতৈক্য থাকে। তাই দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে তা কার্যকর করতে অসুবিধা হয় না।
(৭) নির্দিষ্ট নীতি ও কর্মপন্থা: এক-দলীয় ব্যবস্থায় দেশের শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নীতি ও কর্মসূচী নির্ধারণ করা সম্ভব হয়। স্বীকৃত একমাত্র দলটি তার সুনির্দিষ্ট দলীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতি ও কর্মসূচী নির্ধারণ করতে পারে। তার ফলে সরকার জনকল্যাণসাধনের পথে দৃঢ়তার সঙ্গে এগোতে পারে।
(৮) প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়: এক-দলীয় ব্যবস্থায় যথার্থ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা হল গণতন্ত্রের মূলনীতি। ধনবৈষম্যমূলক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় গণতন্ত্রের এই মূল নীতিগুলি অর্থহীন হয়ে পড়ে। একাধিক দলের অস্তিত্বও এই ধরনের বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থায় প্রকৃত গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। অপরদিকে গণ-প্রজাতন্ত্রী চীন সহ অন্যান্য একদলীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধনবৈষম্য অন্তর্হিত বলে দাবি করা হয়। এ ধরনের শোষণহীন সমাজে রাষ্ট্রতন্ত্রের উপর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং আর্থনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য ও স্বাধীনতার ভিত্তিতে সামাজিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে সাম্য ও স্বাধীনতা বাস্তবায়িত হয়। এইভাবে এক-দলীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
এক-দলীয় ব্যবস্থার বিপক্ষে যুক্তি:
এক-দলীয় ব্যবস্থার পক্ষে উপরিউক্ত যুক্তিসমূহ প্রদর্শিত হলেও পশ্চিমী গণতন্ত্রের প্রবক্তাগণ এর তীব্র সমালোচনা করেন।
(ক) ব্যক্তি স্বাধীনতার এক-দলীয় ব্যবস্থায় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে ব্যক্তি-স্বাধীনতা বিপর্যস্ত হয় এবং স্বাধীন চিন্তার পথ রুদ্ধ হয়। চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে স্বাধীনতাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। স্বাধীন পরিবেশ ছাড়া ব্যক্তিজীবনের স্বাভাবিক বিকাশ অসম্ভব। এক-দলীয় ব্যবস্থায় তা সম্ভব হতে পারে না। দেবেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (D. N. Banerjee) বলেছেন: “Liberty of thought and discussion which is so fundamental to democracy cannot exist in a one party state…”
(খ) ব্যক্তিত্বের বিনাশ: এক-দলীয় শাসনে ব্যক্তিত্বের বিনাশ ঘটে। কারণ এক-দলীয় ব্যবস্থায় স্বাধীন চিন্তার পরিবেশ থাকে না। এক-দলীয় রাষ্ট্রে একটি নির্দিষ্ট ধাঁচে বা পথে ব্যক্তির চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা, কাজকর্ম সবই নিয়ন্ত্রিত হয়। এ রকম কৃত্রিম বা যান্ত্রিক পরিবেশ মানব প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। এতে ব্যক্তিমানুষের ব্যক্তিত্বের স্বাধীন বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়, ব্যক্তিত্বের অপমৃত্যু ঘটে।
(গ) বিপ্লবের আশংকা: দেশে বহু রাজনীতিক দল থাকলে জাতীয় ঐক্য ক্ষুণ্ন হয় বলে যে যুক্তি দেখান হয় তা সঠিক নয়। বরং বিভিন্ন রাজনীতিক দল জনগণের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা ও আশা আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশিত করে বলে জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ সঞ্চারিত বা পুঞ্জীভূত হতে পারে না। ফলে বিপ্লবের আশংকাও থাকে না। কিন্তু এক-দলীয় ব্যবস্থায় বিপ্লবের আশংকা থাকে।
(ঘ) গণতন্ত্র বিরোধী: এক-দলীয় শাসনে নানা রকম মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে প্রভাবিত করা হয়। জনগণ কোন বিষয়ে সঠিক তথ্য জানতে পারে না। তাদের চিন্তা ও মানসিকতার স্বাধীন বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাদের রাজনীতিক অধিকার ও চেতনা নিয়ন্ত্রিত হয়। তাই এক-দলীয় ব্যবস্থা গণতন্ত্র-বিরোধী।
(ঙ) প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ নেই : এক-দলীয় ব্যবস্থার ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জনগণ প্রতিনিধি বাছাই করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ঐ একটি দল যে প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়, তাকেই ভোট দিতে হয়। এটা একদলীয় নায়কত্বের পথ প্রশস্ত করে। বহুদলীয় ব্যবস্থায় বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। এতে জনসাধারণ প্রতিনিধি বাছাই করার সুযোগ পেতে পারে।
(চ) সংখ্যালঘু স্বার্থের প্রতি অবহেলা: দেশে বিভিন্ন শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের লোক থাকলে তাঁদের স্বার্থও বিভিন্ন ধরনের হয়। এই বিভিন্ন ধরনের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বের জন্য বিভিন্ন রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য। এক-দলীয় ব্যবস্থায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ অবহেলিত হয়।
(ছ) স্বৈরাচারী সরকার: যে শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দলের অস্তিত্ব অস্বীকৃত এবং সমালোচনার সুযোগ নেই, সেই শাসন-ব্যবস্থায় সরকার নিশ্চিতভাবেই স্বৈরাচারী হবে। জেনিংস (Jennings) মন্তব্য করেছেন: “If there be no opposition there is no democracy.” বিরোধী দলই সরকারী কার্যকলাপের গঠনমূলক সমালোচনা করে। তাই সরকার সঠিক পথে থাকতে বাধ্য হয়। অন্যথায় সরকার স্বৈরাচারী হবেই।
উপসংহার: যে শাসনব্যবস্থায় বিরোধী দলের অস্তিত্ব অস্বীকৃত এবং সমালোচনার সুযোগ নেই, সেই শাসনব্যবস্থায় সরকার নিশ্চিতভাবেই স্বৈরাচারী হবে। বিরোধী দলই সরকারী কার্যকলাপের গঠনমূলক সমালোচনা করে সরকারকে সঠিক পথে থাকতে বাধ্য করে। তবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলের অনুপস্থিতি এক ভিন্ন ব্যাপার। সমাজতান্ত্রিক দেশে যে একদলীয় ব্যবস্থা বর্তমান তাঁর প্রকৃতি অবশ্যই সাধারণত একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচারী ব্যবস্থা থেকে অনেক পৃথক ধরনের। সমাজতন্ত্রে একাধিক শ্রেণীস্বার্থের সংঘাত না থাকায় একাধিক দল গঠনের প্রবণতা দেখা যায় না। সমাজতন্ত্রে গণতন্ত্রের ধারণাটিও ভিন্ন। সেখানকার গণতন্ত্রে দল গঠনের স্বাধীনতা অপেক্ষা সামাজিক-আর্থনীতিক সাম্যের নীতিটি অনেক বড়।
Leave a comment