প্রভুত্বকারী দলীয় ব্যবস্থার প্রকৃতি:
প্রভূত্বকারী দলীয় ব্যবস্থায় বহু দলের অস্তিত্ব সত্ত্বেও একটি দলের কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ হল এমন এক রাজনীতিক ব্যবস্থা যেখানে বহু রাজনীতিক দল থাকে। এবং এই দলগুলির মধ্যে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগও থাকে। কিন্তু সরকার গঠন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে একটিমাত্র দলের সুস্পষ্ট কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। নির্বাচনী সাফল্যের বিচারে অন্যান্য রাজনীতিক দলগুলি হীনবল। প্রভুত্বকারী দলীয় ব্যবস্থার উদাহরণ হিসাবে ভারতের দলীয় ব্যবস্থার কথা বলা যেতে পারে। স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে পর্যন্ত ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অবিসংবাদিত প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সময় ভারতে অন্যান্য অনেক রাজনীতিক দল ছিল। এই দলগুলি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছে। এক-আধবার রাজ্যস্তরে ক্ষমতাও দখল করেছে। কিন্তু সমগ্র দেশ জুড়ে এবং জাতীয় স্তরে কংগ্রেস দলের একাধিপত্য ছিল বিরোধ বিতর্কের ঊর্ধ্বে। বর্তমানে এ ধরনের রাজনীতিক ব্যবস্থার উদাহরণ হিসাবে জাপান ও মেক্সিকোর দলব্যবস্থার কথা বলা হয়ে থাকে। জাপানের রাজনীতিতে এবং জাপানের আইনসভা ডায়েট (Diet)-এ উদারনীতিক গণতান্ত্রিক দল (Liberal Democratic Party) অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা কায়েম করেছে।
রাজনীতিক দলের গুণাগুণ
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনীতিক দলের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। বার্কারের মতানুসারে গণতন্ত্রকে গ্রহণ করলে দলীয় ব্যবস্থাকেও গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দলীয় শাসনে পরিণত হয়েছে। দলব্যবস্থা ছাড়াও প্রতিনিধিমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনীতিক দলের বহুবিধ কার্যাবলীর গুরুত্ব তার অস্তিত্বের অপরিহার্যতাকে প্রমাণ করে। আর রাজনীতিক দলের কার্যাবলীর মধ্যেই তার গুণাবলী নিহিত আছে।
(১) প্রতিনিধি নির্বাচন সহজ হয়: দলব্যবস্থার ভিত্তিতে জনগণের পক্ষে নির্বাচনে প্রতিনিধি বাছাই করা সহজতর হয়। ভোটদাতার পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক নির্বাচনপ্রার্থীর গুণগত যোগ্যতা, মতাদর্শ, নৈতিক চরিত্র প্রভৃতি নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না। দলপ্রথার ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে অসংখ্য প্রার্থীর পরিবর্তে অল্পসংখ্যক প্রার্থীর মধ্যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে। এর ফলে দলের আদর্শ ও কর্মসূচীর পরিপ্রেক্ষিতে পছন্দমত প্রতিনিধি নির্বাচন করা নির্বাচকদের পক্ষে সহজসাধ্য হয়।
(২) শ্রেষ্ঠ নীতি ও কর্মপন্থার উদ্ভব হয়: প্রতিটি রাজনীতিক দল দেশের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করে। তার মধ্যে দল অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলিকে বাছাই করে এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে প্রচার করে। এইভাবে নির্বাচনী প্রচারের সময় দেশের বিভিন্ন সমস্যা এবং তার সমাধান সম্পর্কে নীতি ও কর্মপন্থা নিয়ে বিভিন্ন রাজনীতিক দলের মধ্যে যে বাদানুবাদ হয় তার ফলে সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মপন্থার উদ্ভাবন সম্ভব হয়। এই নীতি ও কর্মপন্থা অনুসারে দেশ শাসিত হলে রাষ্ট্রের দ্রুত উন্নয়ন সাধিত হয়।
(৩) প্রতিনিধিদের মধ্যে সংহতির সৃষ্টি: প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থায় শাসনকার্য পরিচালনার মূলনীতি সম্পর্কে অধিকাংশ প্রতিনিধির ঐক্যমত আবশ্যক। তা না হলে শাসনকার্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে বাধ্য। দলব্যবস্থা প্রতিনিধিদের মধ্যে মতৈক্যের সৃষ্টি করে। তার ফলে সরকার সুসংহতভাবে ও সুনির্দিষ্ট পথে পরিচালিত হয়। প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই সরকার গঠন করে এবং ঘোষিত নীতি ও কর্মসূচী অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করে।
(৪) রাজনীতিক শিক্ষা ও চেতনার বিকাশ: রাজনীতিক দলগুলি জনসাধারণের রাজনীতিক শিক্ষা ও চেতনার বিস্তার ঘটায়। দলগুলি সমাজের অসংখ্য সমস্যা ও তার সমাধানের ব্যাপারে আলোকপাত করে। নিজ নিজ দলীয় নীতি ও পরিকল্পনার সমর্থনে যুক্তি ও তথ্য প্রচার করে। এর উদ্দেশ্য হল জনসমর্থন লাভের চেষ্টা করা। এর ফলে জনগণ রাষ্ট্রীয় সমস্যাবলী এবং বিভিন্ন দলের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মসূচী সম্পর্কে অবহিত হয়। বিভিন্ন রাজনীতিক প্রচারকার্য এবং পারস্পরিক পর্যালোচনা জনগণকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সতর্ক ও সচেতন করে তোলে। তাদের রাজনীতিক শিক্ষা ও চেতনার প্রসার ঘটে। বল বলেছেন: “Parties seek to educate instruct and activate the electorate.” গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাফল্যের স্বার্থে জনগণের এই রাজনীতিক চেতনা অপরিহার্য।
(৫) স্বৈরাচারিতা রোধ: দলব্যবস্থার মাধ্যমে স্বৈরাচারের পথ রুদ্ধ হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত সরকারী দল বিরোধী দলের সমালোচনার ভয়ে স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না। সরকারী দলের কার্যকলাপ ও ত্রুটি বিচ্যুতির উপর বিরোধী দল সতর্ক দৃষ্টি রাখে। বিরোধী দল সমালোচনার মাধ্যমে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং সপক্ষে জনমতকে পরিচালিত করার চেষ্টা করে। এর ফলে জনসমর্থন হারিয়ে পরবর্তী নির্বাচনে সরকারী দলের পরাজয়ের আশংকা থাকে। তাই বিরোধী দলের অস্তিত্ব ও সমালোচনার ভয়ে সরকারী দল খেয়াল-খুশী মত কাজ করে না, বরং সংযত আচরণ করে। সরকারী দল সদা সতর্ক থাকে যাতে বিরোধী দল কোন রকম সমালোচনার সুযোগ না পায়। এই কারণে দল ব্যবস্থাকে স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ হিসাবে গণ্য করা হয়।
(৬) সরকারের স্থায়িত্ব রক্ষা: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সরকারের স্থায়িত্বের ব্যাপারে দলীয় ব্যবস্থার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দল প্রথার ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে। ফলে সরকারের পিছনে সর্বদা পার্লামেন্টের অধিকাংশ সদস্যের সমর্থন বজায় থাকে। স্থায়িত্বের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা থাকে না। তাই সরকারও সুশাসন ও জনকল্যাণসাধনে পরিপূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করতে পারে।
(৭) আইন ও শাসন-বিভাগের মধ্যে সহযোগিতা সৃষ্টি: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় শাসন-বিভাগ ও আইন-বিভাগের মধ্যে পরিপূর্ণ সহযোগিতা ছাড়া সুশাসন অসম্ভব। দলীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে উভয় বিভাগের মধ্যে প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা যায়। আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই সরকার গঠন করে। তার ফলে উভয় বিভাগের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এর ফলে প্রশাসনিক উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায়। তাই বলা হয় যে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির ত্রুটিগুলি দলীয় ব্যবস্থায় সংশোধিত হয়। তা ছাড়া, বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারের মধ্যে এই ব্যবস্থা পারস্পরিক সহযোগিতার সৃষ্টি করে। উদাহরণ হিসাবে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কংগ্রেস দলের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
(৮) শান্তিপূর্ণভাবে সংস্কার সাধন: দলপ্রথার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে এবং নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সামাজিক, আর্থনীতিক প্রভৃতি পরিবর্তন সাধন সম্ভব হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারী দল ঘোষিত নীতি অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনমত অনুমোদিত সংস্কার সাধন করে। আবার সরকারী দলের কার্যকলাপে জনগণ সন্তুষ্ট না হলে পরবর্তী নির্বাচনে সরকারেরও পরিবর্তন সাধন করতে পারে। এইভাবে সরকারের পরিবর্তন শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে করা যায়। দলব্যবস্থা না থাকলে সরকার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সামরিক অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের আশংকা থাকে। তাই ম্যাকাইভার মন্তব্য করেছেন: “Without party system…the coup d’etat, the putsch or revolution, are the only methods of securing a change of government.”
(৯) জনমত গঠন ও প্রকাশ: দলপ্রথা জনমত গঠন ও প্রকাশের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। সংবাদপত্র, সভাসমিতি ও অন্যান্য উপায়ে দলীয় প্রচার চালান হয়। তার ফলে জনগণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে অবহিত হয় এবং নিজ নিজ মতামত গঠন করে। নির্বাচনের পূর্বে জন সমর্থনের গতি-প্রকৃতি অনুসারে জনমত প্রকাশিত হয়। দলীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমেও এর প্রকাশ ঘটে।
(১০) গণতন্ত্রের স্বরূপ সংরক্ষণ: গণতন্ত্রকে জনমতের অনুগামী শাসনব্যবস্থা হিসাবে অভিহিত করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনপ্রাপ্ত সরকারী দল জনমতকে বাস্তবে রূপায়িত করার ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করে। এইভাবে দলপ্রথা জনমত গঠন ও প্রকাশে সহায়তা করে এবং গণতান্ত্রিক স্বরূপ বজায় রাখে। কারণ জনমত হল গণতন্ত্রের প্রাণস্বরূপ। তাই মুনরো (W. B. Munro) মন্তব্য করেছেন: “Nowhere has there ever been a free government without political parties.”
(১১) রাজনীতিক স্বার্থ-সংরক্ষণ: রাজনীতিক দলের মাধ্যমে ভোটদাতাদের রাজনীতিক স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। প্রত্যেক নির্বাচকের নাম যাতে তালিকাভুক্ত হয় সে বিষয়ে রাজনীতিক দলগুলি নজর রাখে। তা ছাড়া ভোটগ্রহণ, ভোটগণনা প্রভৃতি যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হয় সেসব বিষয়েও রাজনীতিক দলগুলি প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করে।
(১২) সরকার ও জনগণের মধ্যে সংযোগসাধন: আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনীতিক দলগুলি সরকার ও জনসাধারণের মধ্যে সংযোগ রক্ষার দায়িত্ব পালন করে থাকে। জনগণের অভাব-অভিযোগের ব্যাপারে রাজনীতিক দলগুলি সরকারকে অবহিত করে এবং জনগণের সমস্যাদির প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই সমস্ত সমস্যাদির সমাধান এবং অভাব-অভিযোগের নিরসনের জন্য রাজনীতিক দলগুলি সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে। তার ফলে জনস্বার্থ সংরক্ষণে সরকারকে বাধ্য হতে হয়।
(১৩) স্বদেশ ও স্বজন-প্রীতির সৃষ্টি: রাজনীতিক দলগুলি স্বদেশ ও স্বজনপ্রীতির সৃষ্টি করে। দলগুলি জনসাধারণের মধ্যে শৃঙ্খলা আনে এবং ঐক্যবোধের সৃষ্টি করে। জনগণের মধ্যে এই ঐক্যবোধ দেশের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বের পক্ষে দরকারী। তা ছাড়া রাজনীতিক দলগুলি জনগণের ভিতর থেকে যাবতীয় সংকীর্ণতা ও কুসংস্কার দূর করে এবং স্বদেশ ও স্বজনপ্রীতির সৃষ্টি করে।
(১৪) অন্যান্য গুণ: তা ছাড়া, দলপ্রথার সমর্থনে আরও বলা হয় যে, ব্যক্তিগতভাবে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় প্রত্যেকেই অসহায়। কিন্তু দলপ্রথার মাধ্যমে ব্যক্তি তার নীতি ও আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারে। আবার বর্তমানে নির্বাচনী ব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। যোগ্য ব্যক্তি দরিদ্র হলেও দলীয় ব্যবস্থা তাকে শাসনকার্যে অংশ গ্রহণের সুযোগ করে দেয়। প্রকৃতপক্ষে দলপ্রথা ছাড়া গণতন্ত্রে সুসংহত রীতি-নীতির বিকাশ সম্ভব হয়। না। ম্যাকাইভারের মতে, বৃহদায়তন বিশিষ্ট গণতন্ত্রের পক্ষে দলীয় ব্যবস্থা অপরিহার্য। তিনি বলেছেন: “Although party is often extra-constitutional, it is an essential organ of every large scale democracy.”
রাজনীতিক দলের ত্রুটি:
উপরিউক্ত বিভিন্ন সুবিধা থাকা সত্ত্বেও দলীয় ব্যবস্থায় কতকগুলি ত্রুটি উপেক্ষা করা যায় না।
(ক) জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী: দলীয় ব্যবস্থা জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী। দেশে বহু রাজনীতিক দল থাকলে জাতীয় ঐক্য বিঘ্নিত হওয়ার আশংকা সর্বদা বর্তমান থাকে। কারণ দেশের জনসাধারণ বিভিন্ন রাজনীতিক দলের সমর্থক হিসাবে কতকগুলি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েন। দলীয় সদস্যগণ সংকীর্ণ দলীয় মনোভাবের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। তাঁরা অন্যান্য দলের স্বার্থের বিনিময়ে কেবল নিজ দলের স্বার্থের কথাই চিন্তা করেন। এতে দেশজুড়ে বিবদমান কতকগুলি রাজনীতিক দল দেশের ঐক্যের আবহাওয়াকে বিনষ্ট করে।
(খ) জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি: দলীয় ব্যবস্থায় জাতীয় স্বার্থও ব্যাহত হয়। দলগুলি সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ নিয়েই সদা ব্যস্ত থাকে। এর ফলে জাতীয় স্বার্থ অবহেলিত হয়। এমনকি দলগুলি অনেকক্ষেত্রে দলীয় স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়। এতে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ বিরোধী দল অভ্যাস বা বিদ্বেষের বশে সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারী দলের কল্যাণমূলক প্রচেষ্টার পথেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এর ফলেও জাতীয় স্বার্থের অপূরণীয় ক্ষতি হয়।
(গ) সমাজের নৈতিক মান অবনমিত হয়: যে-কোনও উপায়ে দলীয় স্বার্থ-সাধনের জন্য দলগুলি মিথ্যাচার ও বহুবিধ অসৎ উপায় অবলম্বন করে। আবার দেশের বিত্তশালী ও কায়েমী স্বার্থভোগীরাও বিভিন্ন অসৎ উপায়ে দলগুলিকে শ্রেণীস্বার্থ সাধনে নিযুক্ত করতে প্রয়াসী হন। এইভাবে দুর্নীতি, মিথ্যাচার, প্রবঞ্চনা প্রভৃতি প্রশ্রয় পায়। এতে দেশের রাজনীতিক আবহাওয়া কলুষিত হয় ও দেশের নৈতিক মান অবনমিত হয়।
(ঘ) যোগ্য ও বিজ্ঞ বহু ব্যক্তি শাসনকার্যে অংশ নিতে পারেন না: দলীয় ব্যবস্থার জন্যই দেশের অনেক জ্ঞানীগুণী ও যোগ্য ব্যক্তি শাসনকার্যে অংশ গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে এবং শাসনকার্য পরিচালনা করে। এর ফলে সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের দক্ষ এবং অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণ শাসনকার্যে অংশ গ্রহণ করতে পারেন না। তা ছাড়া, বহু বিচক্ষণ ও পণ্ডিত ব্যক্তি দল প্রথার কলুষতা ও কদর্যতার মধ্যে জড়িয়ে পড়তে চান না। ফলে দেশের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাঁদের জ্ঞানবুদ্ধির অবদান অনুপস্থিত থাকে। দেশ বহু যোগ্য ও বিজ্ঞ ব্যক্তির সেবা লাভে বঞ্চিত হয়।
(ঙ) ব্যক্তিত্বের বিনাশ ঘটে: দলপ্রথার বিরুদ্ধে আর একটি গুরুতর অভিযোগ হল এটি ব্যক্তি স্বাধীনতার বিরোধী। দলীয় সদস্য ও সমর্থকগণের ব্যক্তিগত বিচার-বুদ্ধি ও অভিপ্রায়কে দলীয় নীতি ও নির্দেশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। দলীয় সংহতির স্বার্থ বর্তমানে কঠোরভাবে রক্ষা করা হয়। দলীয় নির্দেশ অমান্য করলে বা দলীয় নীতির সমালোচনা করলে দল থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। ফলে দলের প্রত্যেক সদস্যকে নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে বিনা বাধায় দলীয় ইচ্ছার অনুগামী হতে হয়। এতে ব্যক্তির আত্মসত্তার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ব্যক্তিত্বের অপমৃত্যু ঘটে।
(চ) জনগণ বিভ্রান্ত হয়: দলীয় ব্যবস্থায় প্রতিটি দলের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল জনসমর্থনের ভিত্তিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন এবং সরকার গঠন করা। এই উদ্দেশ্যে দলগুলি নানাভাবে নিজ নিজ স্বার্থের অনুকূলে। প্রচার অভিযান পরিচালনা করে। তারা সত্য, অসত্য, অর্ধসত্য প্রভৃতি নানারকম তথ্য পরিবেশন করে। এইভাবে দলগুলি একে অপরের বিরুদ্ধে দোষারোপ করে। এমনকি দলগুলি নির্বাচকদের বিভিন্ন মিথ্যা প্রলোভন দেয়। এর ফলে জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তারা প্রতিনিধি নির্বাচনের সময় সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না।
(ছ) সরকারী দলের পক্ষপাতিত্ব: দলীয় ব্যবস্থায় যোগ্যতার পরিবর্তে সরকারী দলের পক্ষপাতিত্ব চাকরি ও অন্যান্য সরকারী আনুকূল্য লাভের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায়। যে দল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দল সরকার গঠন করে। এই সরকারী দলই বিভিন্ন সরকারী পদে যোগ্যতার বিচার না করে নিজ দলের সদস্যদের নিযুক্ত করে। এতে একদিকে সরকারের কর্মকুশলতা হ্রাস পায় এবং অপরদিকে যোগ্য ব্যক্তিত্বের মধ্যে হতাশা ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।
(জ) হিংসা, দ্বেষ ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি: দলীয় ব্যবস্থার নির্বাচনের আগে সমগ্র দেশে দলগুলি ব্যাপক প্রচার অভিযান চালায়। তাতে জাতির মর্যাদা ও সমাজের শক্তি ক্ষুণ্ণ হয়। সারা দেশে অবাঞ্ছিত হিংসা, দ্বেষ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তার ফলে জনজীবনে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এর ফলে সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
(ঝ) যান্ত্রিক বিরোধিতা: দলব্যবস্থায় সরকারের বিরোধিতা করা বিরোধী দলগুলির অভ্যাসে পরিণত হয়। সরকার জনকল্যাণসাধনের জন্য উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করলেও বিরোধী দলগুলি অন্ধভাবে তারও বিরোধিতা করে। সরকারের প্রতিটি কাজের এ রকম বিরোধিতার ফলে জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি হয়। ক্ষমতাসীন সরকারী দলও বিরোধী দলগুলির গঠনমূলক এবং যুক্তিসঙ্গত মতামতকেও অগ্রাহ্য করে। সরকারী দল ও বিরোধী দলের এ রকম পারস্পরিক যান্ত্রিক বিরোধিতা জাতীয় স্বার্থের পক্ষে অনিষ্টকর এবং গণতন্ত্রের সাফল্যের পরিপন্থী।
(ঞ) জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি: ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী সাফল্যের জন্য দেশ ও জাতির বৃহত্তম স্বার্থের কথা না ভেবেই বিভিন্ন কাজ করে এবং আইন পাস করে। এসবের উদ্দেশ্য হল চমক সৃষ্টি করা। এতে জনসমর্থন লাভের উদ্দেশ্য পূরণ হয়, কিন্তু দেশের বৃহত্তম স্বার্থের ক্ষতি হয়।
(ট) কৃত্রিম ব্যবস্থা: অনেকের মতে সারা দেশের অসংখ্য মানুষের বহুবিধ মতামত কয়েকটি দলের মাধ্যমে প্রকাশিত হতে পারে। এই কারণে জনমত প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে দলপ্রথা হল এক কৃত্রিম ব্যবস্থা। যথার্থ বিকল্প রাজনীতিক দলের অভাবে অনেকে অনন্যোপায় হয়ে প্রতিষ্ঠিত দলগুলির কোন একটিকে সমর্থন করেন। দ্বি-দলীয় ব্যবস্থায় এই ত্রুটি প্রকট হয়ে উঠে।
(ঠ) মার্কসীয় বক্তব্য: মার্কসীয় দর্শন অনুসারে দেশের রাজনীতিক আর্থনীতিক কাঠামোর উপর রাজনীতিক দলের ভূমিকা বহুলাংশে নির্ভরশীল। মার্কসবাদের মতানুসারে উদারনীতিক গণতন্ত্রে বা বুর্জোয়া গণতন্ত্রে বিত্তবান শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার কাজে রক্ষণশীল বা প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলি তাদের কর্মসূচী অনুসারে অবাধে কাজ করতে পারে। কিন্তু মেহনতী মানুষের প্রগতিশীল দলগুলি তাদের নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী কাজকর্ম পরিচালনার স্বাধীন সুযোগ পায় না। রাষ্ট্রযন্ত্র এবং বুর্জোয়া দলগুলি এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এই অবস্থায় প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার এবং নির্বাচনের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাই মার্কসবাদীদের মতানুসারে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় দল-ব্যবস্থা সঠিক অর্থে গণতন্ত্রের সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে না।
উপসংহার: যাইহোক, বহু বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও গণতন্ত্রের স্বার্থে রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব অপরিহার্য। তবে দলগুলি যাতে যথাসম্ভব ত্রুটিমুক্ত থাকে, সে-বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার। সদাজাগ্রত এবং নির্ভীক জনমতই দলগুলিকে পাপমুক্ত করার সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র। আধুনিক রাষ্ট্র দলভিত্তিক রাষ্ট্র। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারের ফলে, প্রতিটি দেশেই নাগরিকগণ উত্তরোত্তর রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছে। একে একটি সুবিন্যস্ত রূপ দেওয়ার প্রয়োজনে রাজনীতিক দলের উৎপত্তি ও প্রসার অনিবার্য হয়ে উঠে। তাই নানাবিধ ত্রুটি সত্ত্বেও দলীয় ব্যবস্থার কোন বিকল্প এখন নেই বললেই চলে। তথাকথিত ‘দলহীন গণতন্ত্রের যে ধ্বনি আমরা মাঝে মধ্যে এদেশে শুনতে পাই, তা নিতান্তই কল্পলোকের ধারণা বলা যেতে পারে। এখনকার স্বাধীন শাসনব্যবস্থায় রাজনীতিক দলের অস্তিত্ব নিতান্তই স্বাভাবিক ও অপরিহার্য। ম্যাকাইভার মন্তব্য করেছেন: “Without party organisations, there can be no unified statement of principles, no orderly evolution of policies, no regular resort to the constitutional devices of parliamentary elections….”
Leave a comment