বর্তমানে গণতন্ত্র বলতে প্রতিনিধিমূলক শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়। কার্যক্ষেত্রে এ ধরনের শাসনব্যবস্থা সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে পরিণত হয়। যে সকল প্রতিনিধি নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে শাসনকার্য পরিচালনা করেন তাঁরা বাস্তবে ভোটদাতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিমাত্র। সেজন্য লর্ড ব্রাইস বলেছেন যে, গণতন্ত্র হল নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের শাসন। আবার দলীয় ব্যবস্থার কল্যাণে সাধারণ নির্বাচন পদ্ধতিতে প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই শাসন ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণ নির্বাচন ব্যবস্থায় সংখ্যালঘুরা নিজেদের সংখ্যার অনুপাতে নির্বাচিত হতে পারে না। এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠরা শতকরা ৫১টি ভোট পেয়েও আইন সভার সকল আসন দখল করতে পারে এবং সংখ্যালঘিষ্ঠরা শতকরা ৪৯টি ভোট পেয়েও আইনসভায় কোন প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারে না। এর ফলে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হওয়ার আশংকা দেখা দেয়। সেইজন্য বর্তমানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপযুক্ত বা সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হয়। সংখ্যালঘু বলতে এক্ষেত্রে কেবল দলগত সংখ্যালঘুদের কথা বলা হয় না; ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সম্প্রদায় প্রভৃতি ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু শ্রেণীর কথা বলা হয়।

সংখ্যালঘিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বের সপক্ষে যুক্তি

(১) গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও সংখ্যালঘুদের স্বার্থ যাতে উপেক্ষিত না হয় সে বিষয়ে মিল সাবধান করেছেন। তাঁর মতে সংখ্যালঘুদের উপেক্ষা করা অগণতান্ত্রিক। কারণ সংখ্যালঘিষ্ঠদের যথোপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব হল গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য উপাদান। তিনি বলেছেন: “It is an essential part of democracy that minorities should be adequately represented.”

(২) মিল কেবল সংখ্যালঘিষ্ঠদের প্রতিনিধিত্বের গুরুত্বের কথা বলে ক্ষান্ত হননি। তাঁর মতে সংখ্যালঘিষ্ঠদের প্রতিনিধিত্ব তাঁদের সংখ্যার আনুপাতিক হারে হওয়া দরকার। তাঁর অভিমত হল: “In a really equal‌ democracy any or every section would be represented not disproportionately but proportionately….the minority should be fully represented as the majority.” 

(৩) রুশোকে অনুসরণ করে আইনকে যদি জনসাধারণের ইচ্ছার প্রকাশ হিসাবে গণ্য করা হয় তা হলে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছার সঙ্গে সংখ্যালঘিষ্ঠের ইচ্ছাকেও আইনের মধ্যে রূপ দেওয়া দরকার। অন্যথায় আইনকে জনসাধারণের ইচ্ছার প্রকাশ হিসাবে গণ্য করা যায় না।

(৪) আশংকা করা হয় যে আইনসভার সংখ্যালঘিষ্ঠদের প্রতিনিধি না থাকলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল স্বৈরাচারী হয়ে পড়তে পারে। গেটেল বলেছেন: “To prevent tyranny of the majority a number of devices are in use, granting to minorities more or less share in authority.”

(৫) সংখ্যালঘিষ্ঠদের স্বার্থ ও অভাব-অভিযোগ ক্রমান্বয়ে উপেক্ষিত হতে থাকলে দেশের মধ্যে অন্তবিপ্লবের আবহাওয়া সৃষ্টি হয়। সুতরাং সংখ্যালঘুদের সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের দাবি স্বীকার করাই রাজনীতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক।

(৬) আবার সরকারের সিদ্ধান্তসমূহ ও কাজকর্মের ফলাফল সকলকে ভোগ করতে হয়। তা ছাড়া নাগরিকমাত্রেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারকে কর দেয়। এবং জনসাধারণের এই টাকায় সরকারের ব্যয়নির্বাহ হয়। সুতরাং সরকারের নীতি নির্ধারণ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সকলেরই অংশ গ্রহণের অধিকার থাকা বাঞ্ছনীয়। এই কারণেও সংখ্যালঘিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা দরকার।

(৭) সর্বোপরি রাজনীতিক ন্যায়বিচারের স্বার্থেও সংখ্যালঘিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ থাকা অভিপ্রেত। তা না হলে রাজনীতিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। 

এই সমস্ত কারণে মিল; লেকী প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সংখ্যালঘিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজনীয়তার কথা গুরুত্বসহকারে প্রতিপন্ন করেছেন। লেকী বলেছেন: “The importance of providing some representation of minorities is extremely great.”

সংখ্যালঘিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বের বিপক্ষে যুক্তি

অনেকে আবার আইনসভার সংখ্যালঘুদের স্বার্থে স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্বের দাবিকে অস্বীকার করেন।

(১) সমালোচকদের মতে এ ধরনের ব্যবস্থা জাতীয় সংহতির বিরোধী। কারণ এর ফলে দেশ জুড়ে সংকীর্ণ দলাদলি বৃদ্ধি পায়; সাম্প্রদায়িক মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। জনগণের মধ্যে ঈর্ষা, দ্বেষ প্রভৃতি দেখা দেয়, সম্প্রীতির অভাব ঘটে এবং ভেদাভেদের অসুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

(২) সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহের স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে গঠিত আইনসভা পরস্পরবিরোধী স্বার্থগোষ্ঠীর কলহক্ষেত্রে পরিণত হয়। শক্তিশালী ও স্থায়ী মন্ত্রিসভা গঠন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সুতরাং এরকম ব্যবস্থা অস্থায়ী ও দুর্বল সরকার সৃষ্টি করে দেশের ক্ষতি করে।

(৩) সম্প্রদায়গত ভিত্তিতে আইনসভা গঠিত হলে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ অবহেলিত ও ক্ষুণ্ন হয়। কারণ এইরূপ অবস্থায় নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ নিজের নিজের সাম্প্রদায়িক স্বার্থের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। 

(৪) এ ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়বহুল ও বিভ্রান্তিকর। এই সমস্ত কারণের জন্য ল্যাস্কি, সিজউইক প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রতিনিধিত্বের এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করেননি।

উল্লিখিত বিরুদ্ধ যুক্তির অস্তিত্ব সত্ত্বেও সংখ্যালঘিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। গণতান্ত্রিক আদর্শ, রাষ্ট্রনৈতিক ন্যায় প্রভৃতি বাদ দিলেও রাজনীতিক দূরদর্শিতা, বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যালঘিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বের সমস্যাকে অগ্রাহ্য করা যায় না।

সংখ্যালঘিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বের বিভিন্ন পদ্ধতি

আইনসভার সংখ্যালঘিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিগুলি হল: 

  • (১) সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (Proportional Representation), 

  • (২) সীমাবদ্ধ ভোট পদ্ধতি (Limited Vote System), 

  • (৩) স্তূপীকৃত ভোট পদ্ধতি (Cumulative Vote System), 

  • (৪) দ্বিতীয় ব্যালট পদ্ধতি (Second Ballot System) এবং 

  • (৫) সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব (Communal Representation)।

(১) সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব

সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের অর্থ: সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব অনুসারে প্রত্যেক সংখ্যালঘিষ্ঠ শ্রেণীর সমর্থনের অনুপাতে আইনসভায় প্রতিনিধি প্রেরণের ব্যবস্থা করা হয়। আইনসভায় সকল শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের সমানুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করাই হল এই নীতির উদ্দেশ্য। বিভিন্ন দল ও সম্প্রদায়ের ভোটার সংখ্যা এবং প্রতিনিধি-সংখ্যার মধ্যেআনুপাতিক হার বজায় রেখে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করাই এই পদ্ধতির লক্ষ্য। অর্থাৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটার সংখ্যা যদি দেশের মোট ভোটার সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ হয়, তবে তারা আইনসভায় এক-তৃতীয়াংশ আসন পাবে। এর জন্য দরকারমত নির্বাচকমণ্ডলীর পুনর্গঠনের প্রয়োজন হতে পারে। কারণ নির্বাচকদের সংখ্যার অনুপাতে আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত হওয়া দরকার। প্রতিনিধিত্বের এই পদ্ধতি অনুসারে সমগ্র দেশকে বৃহৎ আকারের কতকগুলি নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত করা হয়। তা ছাড়া প্রতিটি নির্বাচন কেন্দ্র বহু আসনসমন্বিত হয়ে থাকে। জে. এস. মিল ও লেকী আইনসভায় সংখ্যালঘুর স্বার্থরক্ষার জন্য এরকম নির্বাচন পদ্ধতির কথা বলেছেন। সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের আবার দু’টি পদ্ধতি আছে। 

অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “There are many variations of P. R. (Proportional Representation) in use throughout the world but the essence of all the different types is that seats allocated in proportion to the votes cast in multi-member constituencies.”

(ক) হেয়ার পদ্ধতি (Hare system) –হেয়ার পদ্ধতির প্রকৃতি: ইংরাজ লেখক টমাস হেয়ার ১৮৫১ সালে একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের দ্বারা সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নীতি প্রবর্তন করেন। তাই এই পদ্ধতি হেয়ার পদ্ধতি নামে পরিচিত। এই পদ্ধতি অনুসারে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকা থেকে কমপক্ষে তিন জন প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। প্রত্যেক ভোটদাতার কার্যকরী ভোট কিন্তু একটি। তবে প্রত্যেক ভোটদাতা আসন-সংখ্যা অনুসারে ব্যালট পত্রে প্রার্থীদের নামের পাশে পছন্দের পরিমাপসূচক ১, ২, ৩, ৪ প্রভৃতি সংখ্যা লিখে দেন। ভোটদাতা প্রার্থীদের মধ্যে যাকে সর্বাধিক পছন্দ করেন তার নামের পাশে ১ লিখে দেন এবং অন্যান্য নামের পাশে পছন্দের ক্রম অনুসারে ২, ৩, ৪ প্রভৃতি সংখ্যা লিখে পছন্দ প্রকাশ করতে পারেন। প্রথম পছন্দ জ্ঞাপন করা ভোটদাতার পক্ষে বাধ্যতামূলক। অন্যান্য পছন্দ নাও জ্ঞাপন করতে পারেন। প্রথম পছন্দ জ্ঞাপন না করলে ব্যালটপত্র বাতিল হয়ে যাবে।

প্রত্যেক প্রার্থীকে নির্বাচিত হওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোট পেতে হয়। তাকে ‘কোটা’ (Quota) বলে। দু’টি পদ্ধতিতে ‘কোটা’ নির্ধারণ করা যায়। প্রথম পদ্ধতি অনুসারে নির্বাচন কেন্দ্রের মোট বৈধ ভোটসংখ্যাকে ঐ কেন্দ্রের আসন সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল ‘কোটা’ হিসাবে গণ্য হয়।

দ্বিতীয় পদ্ধতি অনুসারে বৈধ ভোটসংখ্যাকে আসন সংখ্যার সঙ্গে ১ যোগ করে ভাগ দেওয়া হয়। তার পর ভাগফলের সঙ্গে ১ যোগ করে ‘কোটা’ পাওয়া যায়। একে ‘ডুপ কোটা’ (Droop Quota) বলে।

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে যিনি ‘কোটা’ সংখ্যক প্রথম পছন্দের ভোট পান তিনি সরাসরি নির্বাচিত হন। এইভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধির পক্ষে কোটা অপেক্ষা অধিক প্রথম পছন্দের ভোট থাকলে তা ‘দ্বিতীয়’ পছন্দপ্রাপ্ত প্রার্থীদের হস্তান্তর করে দেওয়া হয়। এই দ্বিতীয় পছন্দের ভোটে ‘কোটা’ পেয়ে আরও কয়েকজন প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে যান। এর পর নির্বাচিত প্রার্থীদের কোটার অতিরিক্ত ভোটগুলি ‘তৃতীয় পছন্দের ভিত্তিতে অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে হস্তান্তরিত হবে এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এইভাবে ভোট হস্তান্তর এবং গণনা চলতে থাকে। এখন অতিরিক্ত ভোট হস্তান্তরের মাধ্যমেও সকল আসন পুরণ নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা কম ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীকে বাতিল করা হয় এবং তাঁর পাওয়া ভোটগুলো পছন্দ অনুসারে পুনরায় বণ্টন করা হয়। এইভাবে নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত হস্তান্তর ও গণনা চলতে থাকে। মিল হেয়ার পদ্ধতির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন: “…very greatest improvement yet made in the theory and practice of Government.” রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচনে এই পদ্ধতি অনুসৃত হয়। তা ছাড়া সুইজারল্যাণ্ড, নেদারল্যাণ্ড, বেলজিয়াম, আয়ারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের এই পদ্ধতি প্রচলিত আছে।

(খ) তালিকা পদ্ধতি (List System)— তালিকার পদ্ধতির প্রকৃতি: এই পদ্ধতি অনুসারে প্রতিটি রাজনীতিক দল নির্বাচন কেন্দ্রের আসনসংখ্যার সমান নিজ দলের প্রার্থীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে। প্রত্যেক দলের তালিকায় প্রার্থীদের নামগুলি পছন্দের ক্রম অনুযায়ী সাজান থাকে। ভোটদাতা পছন্দ অনুসারে যে-কোন একটি তালিকাকে ভোট দিয়ে সমর্থন জানায়। যতগুলি আসন থাকে ভোটদাতা ততগুলি ভোট দিতে পারে। বিভিন্ন দল তাদের তালিকাতে প্রদত্ত বৈধ ভোটসংখ্যার অনুপাতে আইনসভায় আসন লাভ করে। এক্ষেত্রে মোট বৈধ ভোটসংখ্যাকে আসনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে ‘কোটা’ নির্ধারণ করা হয়। কোন দলের তালিকার পক্ষে যতগুলি বৈধ ভোট থাকে তাকে ‘কোটা’ দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল হিসাবে যে সংখ্যা পাওয়া যায় সংশ্লিষ্ট তালিকা থেকে সেই সংখ্যক প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যাক ৬টি আসনবিশিষ্ট কোন নির্বাচন কেন্দ্রে ‘ক’, ‘খ’ এবং ‘গ’ এই ৩ টি রাজনীতিক দল তাদের প্রার্থী তালিকার ভিত্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।

সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের এই পদ্ধতি সামান্য পরিবর্তনসহ হল্যাণ্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফ্রান্স, ইস্রায়েল প্রভৃতি দেশে প্রচলিত আছে। বল বলেছেন: “In Belgium, Sweden, Denmark and Italy the voter is allowed to vary the order of the candidates in the party lists. The list system is the most popular European electoral system.”

সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সপক্ষে যুক্তিসমূহ

(১) গণতন্ত্রসম্মত: এই পদ্ধতিতে প্রতিটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল তার শক্তির অনুপাতে আইনসভায় প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারে। এর ফলে আইনসভার গঠন ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের স্বরূপ বজায় থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকলের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ ও ব্যবস্থা থাকা দরকার। মিলের মতানুসারে সংখ্যালঘিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা না থাকলে গণতন্ত্র সফল হতে পারে না। সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতিক দল তার শক্তির অনুপাতে আইনসভায় আসন পায়। তেমনি সংখ্যালঘিষ্ঠ দলগুলিও তাদের শক্তির আনুপাতিক হারে আইনসভায় আসন লাভ করে। লর্ড এ্যাকটন মন্তব্য করেছেন: “It is profoundly democratic, for it increases the influence of thousands who would otherwise have no voice in the government.”

(২) সাম্য নীতির রূপায়ণ: এই নির্বাচন পদ্ধতি সাম্যের আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করে। এই পদ্ধতিতে প্রত্যেক নাগরিক তার পছন্দমত প্রার্থী নির্বাচনের সুযোগ পায়। তার ফলে আইনসভা সমানাধিকারের ভিত্তিতে গঠিত হয়।

(৩) রাজনীতিক চেতনা বৃদ্ধি: হেয়ার পদ্ধতিতে পছন্দ জ্ঞাপনের ব্যাপার আছে। তাই এই পদ্ধতি ভোটদাতাদের মনে চিন্তা-ভাবনার উদ্রেক করে। এর ফলে জনসাধারণের মধ্যে রাজনীতিক চেতনার প্রসার ঘটে। প্রতিনিধিত্বের এই ব্যবস্থায় ভোটদাতা তার ভোটের মূল্য এবং দায়িত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে। 

(৪) যোগ্য ব্যক্তিরা নির্বাচিত হতে পারেন: সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থায় ছোট ছোট দল বা গোষ্ঠীগুলি বিজ্ঞ ও যোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয় এবং নির্বাচিত করে। যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি না থাকলেও সমানুপাতিক হারে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগে গুণী ও বিচক্ষণ ব্যক্তিরা আইনসভায় নির্বাচিত হতে পারেন। তার ফলে দেশ জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের সেবা লাভ করে। 

(৫) সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা ‘জেরিম্যাণ্ডারিং’-এর ত্রুটি ও আশংকা থেকে মুক্ত।

সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিপক্ষে যুক্তিসমূহ

(১) জাতীয় ক্ষেত্রে বিপর্যয়: এই নির্বাচনী ব্যবস্থায় দলগত বা সম্প্রদায়গত স্বার্থ প্রাধান্য পায় এবং বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ অবহেলিত হয়। তা ছাড়া দল ও সংখ্যালঘু স্বার্থের চিন্তায় দেশে বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী দল ও গোষ্ঠীর স্বার্থের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। তার ফলে জাতীয় ক্ষেত্রে অনৈক্য বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে।

(২) জটিল পদ্ধতি: এই পদ্ধতি জটিল, ব্যয়বহুল ও বিভ্রান্তিকর। দেশের জনগণের অধিকাংশ অজ্ঞ ও অশিক্ষিত হলে প্রতিনিধিত্বের সমানুপাতিক পদ্ধতিকে বাস্তবে কার্যকর করা মুস্কিল হয়ে পড়ে। বিশেষত হেয়ার পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল।

(৩) নির্বাচক ও প্রতিনিধিদের মধ্যে সম্পর্কের অভাব: ভোটদাতা এবং প্রতিনিধিত্বের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠে না। তালিকা পদ্ধতিতে এই ত্রুটি বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। এই পদ্ধতিতে প্রার্থীর গুণাগুণ বিচার-বিবেচনা না করেই ভোটদাতারা একটি তালিকার পক্ষে ভোট দেন। তা ছাড়া সমানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে একটি নির্বাচন কেন্দ্র থেকে একাধিক প্রার্থী নির্বাচিত হন এবং নির্বাচনী কেন্দ্রের এলাকাও বেশ বিস্তৃত হয়। এই কারণেও নির্বাচকমণ্ডলী ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে না।

(৪) এই পদ্ধতিতে সংখ্যালঘিষ্ঠ দলগুলি তাদের অনুকূলে সমর্থনের অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব পাবে এ বিষয়ে যথেষ্ট নিশ্চয়তা নেই।

(৫) তালিকা প্রথায় অযোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার আশংকা থাকে। 

(৬) উপনির্বাচনের ক্ষেত্রে অসুবিধা: বিরুদ্ধবাদীদের মতানুসারে উপ-নির্বাচনের ক্ষেত্রে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতিকে প্রয়োগ করা যায় না। অথচ উপ-নির্বাচনের প্রয়োজন দেখা দিতেই পারে এবং উপ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রবহমান জনমতের প্রতিফলন ঘটে।

(৭) দলীয় নেতাদের কর্তৃত্ব: প্রতিনিধিত্বের এই ব্যবস্থায় রাজনীতিক দল ও দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কর্তৃত্ব বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। দলীয় নেতাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ক্ষুণ্ন হয়। তালিকা পদ্ধতিতে এই আশংকা অধিক।

(৮) সংখ্যালঘু বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব অনিশ্চিত: অনেকের মতে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থায় কেবল সংখ্যালঘু রাজনীতিক দলগুলির প্রতিনিধিত্বের সুযোগ থাকে। কিন্তু সামাজিক, অর্থনীতিক বা পেশাগত ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীসমূহের প্রতিনিধিদের সুযোগ এই ব্যবস্থায় পাওয়া যায় না।

(৯) দুর্বল ও অস্থায়ী সরকার: প্রতিনিধিত্বের সমানুপাতিক পদ্ধতিতে কোন একটি রাজনীতিক দলের পক্ষে আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সম্ভব হয়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন দলের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হয়। কিন্তু এ ধরনের সরকার প্রকৃতিগতভাবে অস্থায়ী ও দুর্বল হয়।

(১০) শ্রেণীস্বার্থমূলক আইন: সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থায় শ্রেণীস্বার্থমূলক আইন প্রণীত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। তার ফলে ক্ষমতাসীন শ্রেণীর স্বার্থেই আইন প্রণীত হয় এবং অন্যান্য শ্রেণীর স্বার্থকে অবহেলা করা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সিজউইক (Sidgewick) এই আশংকার কথা বলেছেন।

এই সকল কারণে ল্যাস্কি, ইজমে, ফাইনার, সিজউইক প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিরূপ সমালোচনা করেছেন।

উপসংহার: সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বহু বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও অস্বীকার করার উপায় নেই যে সংখ্যালঘিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে একমাত্র এই পদ্ধতিতেই সংখ্যালঘু দল বা গোষ্ঠী নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে। এই কারণে প্রতিনিধিত্বের এই পদ্ধতি অনেক রাষ্ট্রেই সাফল্যের সঙ্গে প্রযুক্ত হয়েছে। আবার কোন কোন দেশে এর ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলিও প্রতিপন্ন হচ্ছে। প্রকৃত প্রস্তাবে প্রতিনিধিত্বের সমানুপাতিক ব্যবস্থায় এখনও নিরবচ্ছিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে।

(২) সীমাবদ্ধ ভোট পদ্ধতি

সীমাবদ্ধ ভোট পদ্ধতির স্বরূপ: এই পদ্ধতি অনুসারে নির্বাচন কেন্দ্রগুলি বহু আসনবিশিষ্ট হয়। কিন্তু প্রত্যেক ভোটদাতা আসনসংখ্যা অপেক্ষা একটি কম ভোট দিতে পারেন। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সকল আসন দখল করতে পারে না। সংখ্যালঘিষ্ঠ দল প্রত্যেক কেন্দ্রে অন্তত একটি করে আসন লাভ করতে পারে। অর্থাৎ কোন নির্বাচন কেন্দ্র ছয় আসন সমন্বিত হলে প্রত্যেক ভোটদাতা পাঁচটির বেশী ভোট দিতে পারবেন না। এর ফলে একটি আসন সংখ্যালঘুগণ পেতে সমর্থ হয়।

তবে এইরূপ নির্বাচন ব্যবস্থায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব পায় না। আবার সংখ্যালঘু দলগুলি সংখ্যায় অধিক হলে বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল অতি মাত্রায় প্রবল হলে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে নির্বাচন কেন্দ্রের সকল আসন দখল করতে পারে।

(৩) স্তূপীকৃত ভোট পদ্ধতি

স্তূপীকৃত ভোট পদ্ধতির প্রকৃতি: এই পদ্ধতি অনুসারে নির্বাচন কেন্দ্র বহু-আসনবিশিষ্ট হয় এবং যতগুলি আসন থাকে প্রত্যেক ভোটদাতার সমসংখ্যক ভোট থাকে। কোন ভোটদাতা তাঁর ভোটগুলি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ভাগ করে দিতে পারেন, আবার ইচ্ছা করলে কোন একজন প্রার্থীকেই ভোটগুলি স্তূপীকৃতভাবে দিতে পারেন। স্তূপীকৃতভাবে সকল ভোট একজন প্রার্থীকে দেওয়াকে ‘plumping’ বলে। এইভাবে ভোটদানের দ্বারা সংখ্যালঘু দল কিছু আসন সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। কারণ সংখ্যালঘু দল বা গোষ্ঠীর সকল ভোটদাতা একজন প্রার্থীর পক্ষে তাদের সকল ভোট দেয়। 

এই পদ্ধতিতে অনেক ভোট নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে। কারণ বিশেষ জনপ্রিয় প্রার্থীর প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনেক বেশী ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তা ছাড়া এই ব্যবস্থার সাহায্যে সংখ্যালঘু দল বা গোষ্ঠীর সংখ্যার অনুপাতে সঠিক প্রতিনিধিত্বের নিশ্চয়তা থাকে না।

(৪) দ্বিতীয় ব্যালট পদ্ধতি

দ্বিতীয় ব্যালট পদ্ধতির প্রকৃতি: এই পদ্ধতিতে কোন নির্বাচন কেন্দ্রে দু’জনের বেশী প্রার্থী থাকলে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে কেউই ভোটদাতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন না পেলে সর্বনিম্ন ভোট প্রাপ্ত প্রার্থীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয়বার ব্যালট গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। নির্বাচিত প্রার্থীর পিছনে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন নিশ্চিত করাই হল এই নির্বাচন ব্যবস্থার উদ্দেশ্য। এই পদ্ধতিতে একটি নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে একজন মাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হতে পারেন।

দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যাক কোন এক আসন-সমন্বিত নির্বাচন কেন্দ্রে রাম, শ্যাম ও যদু এই তিনজন প্রার্থী আছেন। এবং মোট প্রদত্ত ১০০০০ ভোটের মধ্যে রাম ৪০০০ শ্যাম ৩৫০০ এবং যদু ২৫০০ ভোট পেয়েছে। এক্ষেত্রে কেউই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্থাৎ অর্ধেকের বেশী ভোট পায়নি। এই অবস্থায় সর্বনিম্ন সংখ্যক ভোট প্রাপ্ত যদুকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বাদ দিয়ে অপর দুই প্রার্থী রাম ও শ্যামের মধ্যে দ্বিতীয়বার ব্যালটের ব্যবস্থা করা হয়।

এখন শ্যাম অর্ধেকের বেশী ভোট পেয়ে পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন। অতএব শ্যাম নির্বাচিত বলে ঘোষিত হবেন।

এরকম নির্বাচন ব্যবস্থা গণতন্ত্রসম্মত হলেও অত্যন্ত জটিল এবং ব্যয়বহুল। তা ছাড়া এ ধরনের ব্যবস্থায় প্রার্থী নির্বাচনে বিশেষ বিলম্ব হয় এবং দ্বিতীয়বার ব্যালট গ্রহণের সময় জনগণের আগ্রহ এবং ভোটসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তা ছাড়া সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা এই পদ্ধতির মাধ্যমে করা সম্ভব নয়। আগে জার্মানী, ইতালি, হল্যাণ্ড, বেলজিয়াম প্রভৃতি রাষ্ট্রে দ্বিতীয় ব্যালট পদ্ধতি প্রচলিত ছিল এখন এই সকল রাষ্ট্রে এই নির্বাচন পদ্ধতি বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে দ্বিতীয় ব্যালট পদ্ধতি ফ্রান্সে প্রচলিত আছে। বল বলেছেন: “This system is used in France with the complication of provisions for alliances of the parties at the second ballot.”

(৫) সাম্প্রদায়িক নির্বাচন

সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিদের স্বরূপ: সম্প্রদায়ভিত্তিক নির্বাচনের মাধ্যমেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা হয়। সাম্প্রদায়িক নির্বাচন দু’ভাবে হতে পারে: 

  • (ক) প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ভিত্তিক নির্বাচন এবং 

  • (খ) সাধারণ নির্বাচন ব্যবস্থায় সংখ্যালঘু প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য আসন সংরক্ষণ।

ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে ১৯০৯ সালে সাম্প্রদায়িক নির্বাচনের প্রথম পদ্ধতিটি প্রবর্তন করা হয়। এই পদ্ধতি অনুসারে এই সময় হিন্দুরা হিন্দু প্রতিনিধিকে, মুসলমানরা মুসলমান প্রতিনিধিকে এবং শিখরা শিখ প্রতিনিধিকে ভোট দিতে পারত। বর্তমানে ভারতের সংবিধান অনুসারে লোকসভা এবং রাজ্য বিধানসভাগুলিতে সংখ্যালঘু তপসিলী জাতি ও তপসিলী উপজাতিসমূহের (Scheduled Castes and Scheduled Tribes) আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে।

সমালোচনা: প্রতিনিধিত্বের এই ব্যবস্থাও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। (১) সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা দেশবাসীর মধ্যে ব্যাপক অনৈক্য ও অসদ্ভাবের সৃষ্টি করে। তার ফলে জাতীয় জীবনে সংকট ও অবাঞ্ছিত সমস্যার সৃষ্টি হয়। (২) প্রতিনিধিত্বের এই ব্যবস্থায় ভোটদাতাদের কাছে সাম্প্রদায়িক স্বার্থ বড় হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিটি সম্প্রদায় নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থ সাধনের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হয়। তারফলে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষিত হয়। (৩) তা ছাড়া এই পদ্ধতির মাধ্যমে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শক্তির অনুপাতে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা যায় না। (৪) সর্বোপরি সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। 

উপরিউক্ত নির্বাচন পদ্ধতিগুলির মধ্যে কেবল সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সংখ্যার অনুপাতে আইনসভায় প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারে। অন্যান্য পদ্ধতির মাধ্যমে সাধারণভাবে সংখ্যালঘিষ্ঠ শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা যায়।