নারীবাদী ভাবনাসভূত বক্তব্যের অল্পবিস্তর অভিব্যক্তি প্রাচীনকালে চীন দেশে দেখা গেছে। কিন্তু সেই সমস্ত কথাবার্তার কোন জোরালো প্রকাশ কোন বিকশিত রাজনীতিক তত্ত্বের মাধ্যমে ঘটেনি। মেরী উলস্টোনক্র্যাপ্ট (Mary Wollstonecraft)-এর প্রণীত A Vindication of Rights of Woman (1792) শীর্ষক গ্রন্থে নারীবাদী বক্তব্যের প্রথম সুসংগঠিত প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে মহিলাদের ভোটাধিকারের ব্যাপারে আন্দোলন সংগঠিত হয়। নারী ভোটাধিকারের আন্দোলনের সুবাদে নারীবাদ সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা অধিকতর সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। একে বলা হয় তথাকথিত ‘প্রথম পর্বের নারীবাদ’ (first-wave feminism)। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অধিকাংশ পশ্চিমী দেশগুলিতে নারী ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়। এই সাফল্যের কারণে নারী আন্দোলনের মুখ্য লক্ষ্য এবং সাংগঠনিক নীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে ‘দ্বিতীয় পর্বের নারীবাদ’ (second-wave feminism)-এর অভ্যুত্থান ঘটে। এই সময় নারী-স্বাধীনতা আন্দোলন অধিকতর সংগঠিত ও বিকশিত হতে থাকে। সমাজে নারী জাতির অবস্থার আমূল বা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ব্যাপারে দাবি-দাওয়া উত্থাপিত হতে থাকে।
নারীবাদী তত্ত্ব ও মতবাদসমূহ বহু ও বিভিন্ন। কিন্তু একটি বিষয়ে সকল নারীবাদীদের বক্তব্যের মধ্যে অভিন্নতার অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। উদ্দেশ্যগত অভিন্নতার এই ক্ষেত্রটি হল নারীজাতির সামাজিক ভূমিকার পরিধিকে যে কোন উপায়ে সম্প্রসারিত করা। নারীবাদী ধারণার অন্তর্ভুক্ত দুটি মৌলিক বিষয় হল :
-
(ক) সমাজে লিঙ্গগত অসাম্য-বৈষম্য বর্তমান এবং
-
(খ) পুরুষ জাতির এই প্রাধান্যমূলক কাঠামোর পরিবর্তন সাধন সম্ভব এবং উচিত।
নারীবাদ কথাটি নিছকই পশ্চিমী কিনা এবং এই ধারণাটি এতদঞ্চলে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া একটি বিষয় কিনা, এ বিষয় বিতর্কিত আলোচনা বর্তমান।
‘নারীবাদ’ (feminism) এই শব্দটি বিদেশী হতে পারে। কিন্তু এই ধারণাটি একটি পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়াকে প্রতিপন্ন করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে এই প্রক্রিয়াটির সূত্রপাত ঘটে। নারীজাতির অধীনতামূলক অবস্থানের বিরুদ্ধে সংগঠিত উদ্যোগ হিসাবে এই প্রক্রিয়াটি এতদঞ্চলে শুরু হয়। সুতরাং নারীবাদকে একটি বিদেশী মতবাদ বা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া ধারণা বলা যায় না।
এশিয়া মহাদেশে নারীবাদী সচেতনতার অভ্যুত্থানের বিষয়টি একটি ঐতিহাসিক বিষয়। রাজনীতিক সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে বিষয়টি সম্পর্কযুক্ত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এবং বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ঔপনিবেশিক বিদেশী শাসন-শোষণ এবং স্থানীয় সামন্ততান্ত্রিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সংগঠিত ও পরিচালিত হয়। এই সময় গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহ সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা বিকশিত হয়। নারীজাতির বিরুদ্ধে অন্যায় অবিচার ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতার সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ ঘটে। এই সময় এশিয়া মহাদেশে নারীবাদ ও নারীবাদী সংগ্রাম মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এই সময় নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিবিধ দাবি-দাওয়া নিয়ে নারীবাদীরা সোচ্চার হন। এই সমস্ত দাবি-দাওয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘বিধবা বিবাহ’, ‘বহুগামীতার উপর বিধিনিষেধ আরোপ’, ‘সতীদাহ প্রথার অবসান’, ‘নারী-শিক্ষার বিস্তার’, ‘মহিলাদের আইনী মুক্তির ব্যবস্থা’ প্রভৃতি।
নারীবাদের উদ্ভব ও বিকাশ
অন্যতম রাজনীতিক ধারণা হিসাবে নারীবাদের আবির্ভাব ঘটেছে বিংশ শতাব্দীতে। তবে বিংশশতাব্দীর ষাটের দশকের আগে অবধি নারীবাদ সম্পর্কিত আলোচনা খুব বেশী পরিচিতি পায়নি। বর্তমানে নারী আন্দোলন এবং মহিলাদের সামাজিক ভূমিকার পরিধিকে প্রসারিত করা সম্পর্কিত উদ্যোগ-আয়োজনের সঙ্গে নারীবাদ সম্পর্কিত। এ দিক থেকে বিচার করলে দুটি বুনিয়াদী বিশ্বাসের সঙ্গে নারীবাদী ধারণা সংযুক্ত। এই দুটি বিশ্বাস হল: (ক) লিঙ্গগত কারণেই নারীজাতি অসুবিধাজনক অবস্থায় অবস্থিত, (খ) মহিলাদের অসুবিধার অবসান করা যায় এবং তা করা উচিত। নারীবাদীরা নারী-পুরুষের মধ্যে রাজনীতিক সম্পর্কের ধারাকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, অধিকাংশ সমাজেই মহিলাদের অধীনতামূলক এবং পুরুষদের প্রাধান্যমূলক অবস্থান পরিলক্ষিত হয়।
নারীবাদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যসূচক বিভিন্ন মতামত ও রাজনীতিক অবস্থান পরিলক্ষিত হয়। নারী আন্দোলনসমূহের ক্ষেত্রে বিবিধ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পরিলক্ষিত হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল: নারী ভোটাধিকার অর্জন, মহিলাদের পোষাক-পরিচ্ছদের উপর নিয়ম-নিষেধের শিথিলকরণ, শিক্ষার ক্ষেত্রে সমানাধিকার, সরকারী এলিট পদসমূহে মহিলাদের সংখ্যা বৃদ্ধি, গর্ভপাত বৈধকরণ প্রভৃতি। অনুরূপভাবে আবার নারীবাদীরা আন্দোলনের সাফল্যের স্বার্থে সংস্কারমূললক ও বৈপ্লবিক— উভয় ধরনের রাজনীতিক কলাকৌশল অবলম্বন করে থাকেন। নারীবাদী মতবাদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনীতিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে।
বিংশশতাব্দীর ষাটের দশকের আগে অবধি রাজনীতিক ক্ষেত্রে লিঙ্গভেদমূলক আলোচনাকে আকর্ষক বা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়নি। সামাজিক, অর্থনীতিক ও রাজনীতিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে ভূমিকাগত পার্থক্যকে নিতান্তই স্বাভাবিক ও অপরিহার্য বলে বিবেচনা করা হত। সকল সমাজেই নারী পুরুষের মধ্যে শারীরিক কারণে সাবেকি কিছু শ্রমবিভাজন ছিল সর্বজনস্বীকৃত ও স্বাভাবিক। মহিলারা ঘর গৃহস্থালীর কাজকর্ম ও সন্তান প্রতিপালন করবে এবং পুরুষরা ঘরের বাইরের শ্রমসাধ্য কাজকর্ম সম্পাদন করবে—এই ছিল বরাবরের নারী-পুরুষের শ্রমবিভাজনের ধারা ও বিশ্বাস। সাবেকি রাজনীতিক মতবাদসমূহে এই বিশ্বাসই জায়গা করে নিয়েছে। প্রথাগত রাজনীতিক তত্ত্বসমূহে সাধারণভাবে লিঙ্গভেদের বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। রাজনীতির তাত্ত্বিক আলোচনায় ঐতিহ্যগতভাবে লিঙ্গগত পক্ষপাতিত্বের বিষয়টিকে নারীবাদে তুলে ধরা হয়েছে। দেখান হয়েছে যে, পুরুষ চিন্তাবিরা পুরুষানুক্রমে বিশেষাধিকার ও ক্ষমতা ভোগ করে আসছেন এবং রাজনীতিক কর্মসূচী থেকে মহিলাদের দূরে সরিয়ে রেখেছেন।
‘নারীবাদ’ শব্দটি সাম্প্রতিককালের। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু প্রাচীনকালের গ্রীস ও চীনের সভ্যতা-সংস্কৃতিতে নারীবাদী বক্তব্যের পরিচয় পাওয়া যায়। খ্রিষ্টান পিসান (Christine de Pisan) প্রণীত Book of the City of Ladies শীর্ষক গ্রন্থটি ১৪০৫ সালে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে অতীতের বহু বিশিষ্ট মহিলার স্মরণীয় কাজকর্মের বিবরণ আছে; আছে মহিলাদের শিক্ষার ও রাজনীতিক প্রভাবের অধিকার সম্পর্কে আলোচনা। উল্লিখিত গ্রন্থটিতে আধুনিক নারীবাদের অনেক বক্তব্যেরই অভিব্যক্তি ঘটেছে। তবে সংগঠিত নারী-আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে। আধুনিক নারীবাদ সম্পর্কিত প্রথম গ্রন্থ হিসেবে সাধারণত মেরী উলস্টোনক্রাপ্ট (Mary Wollstonecraft) প্রণীত Vindication of the Rights of Women (1792) শীর্ষক গ্রন্থটির কথা বলা হয়ে থাকে। ফরাসী বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রন্থটি প্রণীত হয়েছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে নারীবাদী আন্দোলন অধিকতর সংগঠিতভাবে অভিব্যক্তি লাভ করে। এই সময় ভোটাধিকারের সম্প্রসারণ নীতির পরিপ্রেক্ষিতে নারী-ভোটাধিকার সম্পর্কিত আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে। এই সময় মহিলাদের জন্য পুরুষদের সমান আইনগত ও রাজনীতিক অধিকারের দাবি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। নারী-ভোটাধিকার ছিল মুখ্য দাবি। কারণ মনে করা হয়েছিল যে, ভোটাধিকার ভোগের মাধ্যমে। মহিলাদের উপর আরোপিত অসাম্য-বৈষম্যসূচক অসামর্থ্যসমূহ অচিরেই অপসারিত হবে। এই সময়টি ‘প্রথম পর্বের নারীবাদ’ (first wave feminism) হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকে।
পৃথিবীর যে সমস্ত দেশে রাজনীতিক গণতন্ত্র ইতিমধ্যে বিকশিত হয়েছিল, সেই সমস্ত দেশে নারী আন্দোলন বিশেষভাবে শক্তিশালী হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ঊনবিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে নারী অন্দোলনের সুসংগঠিত অভিব্যক্তি ঘটে। গ্রেট ব্রিটেনে ঊনবিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে নারী আন্দোলন সংগঠিত হয়। ১৮৯৩ সালে প্রথম নিউজিল্যাণ্ডে মহিলাদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়। এবং এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম পর্বের নারীবাদের সমাপ্তি ঘটে। গ্রেট ব্রিটেনে ১৯১৮ সালে মহিলাদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু পুরুষের সমান ভোটাধিকার পেতে যুক্তরাজ্যের মহিলাদের আরও এক দশক লেগে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯২০ সালে মহিলাদের ভোটাধিকার স্বীকার করা হয়।
নারীজাতির ভোটাধিকারের স্বীকৃতি নারী আন্দোলনকে কার্যত দুর্বল করে দেয়। নারী ভোটাধিকার আদায় সম্পর্কিত দাবি নারীজাতির মধ্যে এক ধরনের সংহতি ও উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে নারী-আন্দোলন সংগঠিত ও পরিচালিত হয়েছিল। নারী-ভোটাধিকার স্বীকৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রিয়াকারীদের মধ্যে এক ধরনের আত্মতুষ্টির ভাব পরিলক্ষিত হয়। তারা ধরে নেন যে মহিলাদের ভোটাধিকারই নারীজাতির সামগ্রিক মুক্তিকে সুনিশ্চিত করবে। তারপর বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে নারী আন্দোলনের পুনরুত্থান পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে আর একটি অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটে। এই অধ্যায়টিকে বলা হয় দ্বিতীয় পর্বের নারীবাদ’ (second wave feminism)।
দ্বিতীয় পর্বের নারীবাদের মাধ্যমে এই বক্তব্যটির অভিব্যক্তি ঘটে যে আইনানুগ ও রাজনীতিক অধিকারসমূহের স্বীকৃতির মাধ্যমে নারীজাতির সমস্যাসমূহের সম্যক সমাধান সম্ভব নয়। এই পর্বে নারীবাদীদের ধ্যান-ধারণা ও যুক্তিসমূহ ক্রমান্বয়ে অধিকতর প্রগতিশীল ও র্যাডিক্যাল (radical) হয়ে পড়তে থাকে। অনেক সময় নারীবাদীরা বৈপ্লবিক হয়ে পড়েন। দ্বিতীয় পর্বের নারীবাদের উদ্দেশ্য মহিলাদের রাজনীতিক মুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই পর্বে নারী মুক্তি আন্দোলন এক সামগ্রিক প্রকৃতিপ্রাপ্ত হয়। সামগ্রিক বিচারে নারী-স্বাধীনতা শুধুমাত্র রাজনীতিক ও আইনগত পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। এই কারণে আধুনিক নারীবাদীরা অভিপ্রেত সামাজিক পরিবর্তন সাধনের ক্ষেত্রে র্যাডিক্যাল (radical) বা বৈপ্লবিক প্রক্রিয়া অনুসরনের পক্ষপাতী। বেটি ফ্রিডান (Betty Friedan) প্রণীত বিখ্যাত গ্রন্থ The Feminine Mystique প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। এই গ্রন্থটি নারীবাদী চিন্তাভাবনার পুনর্বিকাশের ক্ষেত্রে সদর্থক ও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। গৃহবধূ ও জননীর ভূমিকার মধ্যে মহিলাদের সীমাবদ্ধ থাকাজনিত হতাশা ও অসন্তোষ বইটিতে সন্তোষজনকভাবে ব্যক্ত হয়। এই প্রসঙ্গে ১৯৭০ সালে প্রকাশিত দুটি গ্রন্থের নাম করা দরকার। একটি হল জারমেইন গ্রীর (Germaine Greer) প্রণীত The Female Eunuch এবং অন্যটি হল মিল্লে (Kate Mallett) প্রণীত Sexual Politics। এই সমস্ত আলোচনায় নারী-নির্যাতনের ব্যক্তিগত, মনস্তাত্ত্বিক ও যৌন সমস্যাদির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
নিজের অধিকারের দাবিতে নারীবাদ একটি মতাদর্শ হিসাবে মর্যাদা পেতে পারে এ বিষয় বিংশ শতাব্দীর টের দশক অবধি অনেকাংশই অস্বীকৃত ছিল। সমকালীন চিন্তাজগতে নারীবাদকে বহুলাংশে উদারনীতিবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের উপ-ধারণা হিসাবে গণ্য করা হত। লিঙ্গভিত্তিক বিষয়াদিতে উদারনীতিবাদ ও সমাজতন্ত্র বাদের মতাদর্শ ও মৌলিক মূল্যবোধের প্রয়োগই নারীবাদী বক্তব্য হিসাবে বিবেচিত হত। র্যাডিক্যাল নারীবাদের (radical feminism) উদ্ভবের ফলে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। র্যাডিক্যাল নারীবাদীরা লিঙ্গগত বিভেদের বিষয়টির কেন্দ্রীয় রাজনীতিক গুরুত্বের কথাটি ঘোষণা করেন। সাবেকি রাজনীতিক মতাদর্শগুলিতে এই বক্তব্যের স্বীকৃতি ছিল না। নারীজাতির সামাজিক ভূমিকাকে অগ্রবর্তী করার ব্যাপারে ঐতিহ্যগত রাজনীতিক মতবাদগুলিকে সহায়ক বা উপযোগী বলে মনে করা হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রেই প্রথাগত রাজনীতিক মতবাদগুলিকে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা ও ধ্যান-ধারণার পরিপোষক বা সহায়ক হিসাবে সমালোচনা করা হয়।
বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষের দিকে এবং সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে নারীবাদী চিন্তা ভাবনা অনেকাংশে র্যাডিক্যাল (radical) হয়ে পড়ে। এই সময় নারীবাদ স্বতন্ত্র একটি মতাদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথাগত রাজনীতিক চিন্তাধারার বিরুদ্ধে নারীবাদী ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধ প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। জনজীবন সম্পর্কিত বিষয়াদিতে সাধারণভাবে লিঙ্গগত সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে নারীবাদ ইতিমধ্যে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে। তা ছাড়া বিভিন্ন বৌদ্ধিক আলোচনার পটভূমি হিসাবে নারীবাদ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিংশ শতাব্দীর শেষের দশকে সকল পশ্চিমী দেশে এবং উন্নতিশীল বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলে নারীবাদী সংগঠনসমূহের সৃষ্টি ও বিকাশ ঘটেছে।
বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে এসে নারীবাদী কার্যকলাপের ক্ষেত্রে দ্বিবিধ প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে নারীবাদ ছিল বহুলাংশে অসমঝোতামূলক ও র্যাডিক্যাল প্রকৃতির। কিন্তু দুটি দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পর নারীবাদী ক্রিয়াকলাপে র্যাডিক্যাল প্রকৃতির অবসান ঘটে। নারীবাদের মধ্যে সমঝোতামূলক প্রক্রিয়া ও প্রবণতার সৃষ্টি হয়। এই প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ‘উত্তর-নারীবাদ’ (post-feminism) সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি হয় এবং তা জনপ্রিয় হতে থাকে। অধুনা এই ধারণা বিশেষভাবে জনপ্রিয় যে, নারীবাদী উদ্দেশ্যসমূহ বহুলাংশে সফল হয়েছে; এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি পরিমণ্ডলে নারী অন্দোলন নারীবাদকে অতিক্রম করে গেছে।
অধুনা নারীবাদী ধারায় দ্বিতীয় একটি প্রক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। এই প্রক্রিয়াটিকে খণ্ডীকরণ প্রক্রিয়া হিসাবে অভিহিত করা যায়। নারীবাদী চিন্তা-ভাবনা ইতিমধ্যে র্যাডিক্যাল বহুরূপায়ণের প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। তারফলে নারীবাদী চিন্তা-ভাবনার ভিতরে অভিন্ন যুক্তিবোধকে চিহ্নিত করা দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারীবাদের মূলগত ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গে নারীবাদী অন্যান্য ধারার সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখযোগ্য হল: উদারনীতিক, সমাজতান্ত্রিক বা মার্কসবাদী ও র্যাডিক্যাল নারীবাদ। এদের সঙ্গে অধুনা সংযুক্ত হয়েছে উত্তর-আধুনিক নারীবাদ, কৃষ্ণ নারীবাদ (black feminism), মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণমূলক নারীবাদ, সমকামী নারীবাদ প্রভৃতি।
Leave a comment