নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি
গ্রীক পণ্ডিত প্লেটো-অ্যারিস্টটলের আমল থেকে অত্যাধুনিক রাষ্ট্রদার্শনিকদের সময় পর্যন্ত পশ্চিমী রাষ্ট্রচিত্তার ইতিহাসের ‘মূলধারাটি’ (main stream) পিতৃতান্ত্রিক বা ‘পুরুষধারা’ (male stream)। নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয় যে মূলস্রোতটি পুরুষস্রোত হওয়ার কারণে সামাজিক ও রাজনীতিক মতবাদ সৃষ্টি করেছে এক ধরনের নির্দিষ্ট প্রকৃতির ব্যবধান। মূলস্রোত বা পুরুষস্রোতের পিতৃতান্ত্রিক তিনটি প্রবণতাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলি হল নারীজাতিকে সামাজিক ও রাজনীতিক জীবনে
-
(ক) উচ্ছেদ করা,
-
(খ) প্রাপ্তবাসী করা এবং
-
(গ) তাদের ভূমিকাকে হেয় করা।
সাধারণভাবে বলা যায় যে, পুরুষ প্রবক্তাদের রাষ্ট্রদর্শনই সর্বাধিক প্রচার পেয়ে থাকে। পুরুষ চিন্তাবিদদের ধ্যান-ধারণা সমৃদ্ধ রচনাসমূহই মুখ্য আলোচ্য বিষয় হিসাবে মূলধারার গবেষণা পত্রিকাসমূহে প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এই সমস্ত পত্র-পত্রিকায় মহিলাদের চিন্তা-ভাবনা ও লেখাকে উপেক্ষা ও অবহেলা করা হয়। রাজনীতির পাঠ বা অনুশীলনের ক্ষেত্রে এই ধারা হল নিছকই নারীবিদ্বেষ। নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এর বিরোধিতা করা হয়। তেমনি আবার মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত গবেষণামূলক পত্রপত্রিকায়ও নারীবাদী আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে মূলধারার পিতৃতান্ত্রিক প্রবণতাপুষ্ট রাষ্ট্রদর্শনও প্রকাশিত হয়। এইভাবে রাষ্ট্রদর্শনের অনুশীলনে নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্যমূলক ধ্যান-ধারণা প্রাধান্য পায়। নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে এর বিরোধিতা করা হয়।
নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হল একটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। এক অভিনব মানবিক দর্শন হল এর বিষয়বস্তু। এই দর্শন মূলধারার সামাজিক ও রাজনীতিক ধ্যান-ধারণার বাইরে অবস্থিত। নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বৈপ্লবিক ও ব্যতিক্রমী প্রকৃতির। নারীবাদী দর্শন রাষ্ট্রনীতির আলোচনায় পিতৃতান্ত্রিক প্রবণতাকে পরিহার করার পক্ষপাতী। নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনুশীলনে লিঙ্গভিত্তিক দৃষ্টিকোণকে তুলে ধরেছে। নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হল সমালোচনামূলক। মূলধারার পুরুষ প্রাধান্য, নারীবিদ্বেষ ও কেন্দ্রিকতার সমালোচনাই হল এর মূল লক্ষ্য। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই নারীবাদে বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনীতিক ধ্যান-ধারণার জগৎটিকে পর্যালোচনা করা হয়। নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী আগেকার দিনে ত’ বটেই, অধুনাও অনেকাংশে সামাজিক-রাজনীতিক মতাদর্শসমূহ পুরুষদের উদ্দেশ্যে, পুরুষদের স্বার্থে এবং পুরুষদের দ্বারাই প্রণীত।
নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মূলধারার সামাজিক-রাজনীতিক চিন্তার ক্ষেত্রে সর্ব বিষয়ে পুরুষের অভিজ্ঞতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং সার্বিক ও সর্বজনীন বলে মনে করা হয়। ভাবা হয় যে, দুনিয়ার সমগ্র মানবজাতির ক্ষেত্রে পুরুষের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা সামগ্রিকভাবে প্রযোজ্য। পশ্চিমী সামাজিক ও রাজনীতিক মতাদর্শসমূহে নারীর অবদানকে উৎসাহ দেওয়া হয়নি বা নারীকে সামাজিক-রাষ্ট্রনীতিক চিন্তার বিষয় করা হয়নি। নারীজাতির চিন্তা-ভাবনা গুরুত্ব পায়নি। রাষ্ট্রনীতিক চিন্তাজগতে মহিলাদের সদর্থক ভূমিকাকে সর্বদাই অগ্রাহ্য করা হয়েছে। যুক্তিপূর্ণ ও স্বতন্ত্র চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে নারীজাতির ক্ষমতাকে স্বীকার করা হয়নি। মূলধারার পশ্চিমী প্রথাগত সামাজিক-রাজনীতিক চিত্তাজগতে নারীকে পুরুষের অধস্তন হিসাবেই দেখা হয়েছে; সামাজিক-রাজনীতিক জীবন ধারায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মহিলাদের অবস্থানকে হীন-হেয় করে দেখান হয়েছে, এবং নারীজাতির অবস্থানগত হীনতা অব্যাহত থেকেছে। নারী-পুরুষের অবস্থানগত বৈষম্যকে মূলধারায় রাষ্ট্রনীতিক তত্ত্বে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হিসাবে স্বীকার বা সমর্থন করা হয়নি।
সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তার মূলধারায় নারীজাতির অধস্তন অবস্থানের বিষয়টি দু’ভাবে ব্যক্ত হয়েছে। এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী পর্টার বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। প্রাচীন গ্রীক দর্শন, খ্রীষ্টান ধর্মে ও জুদাইজমে নারীজাতিকে পুরুষের সাহায্যকারী হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, নারী হল পুরুষের আংশিক সাহায্যকারী। নারীর সামাজিক কর্তব্যকর্মসমূহের মধ্যে মুখ্য হল পুরুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আমোদ-আহ্লাদের চাহিদা পুরণ এবং সন্তান প্রজনন ও প্রতিপালন। অ্যারিস্টটলের অভিমত অনুযায়ী মহিলাদের মধ্যে যুক্তিবাদী ও নৈতিক সত্তা অনুপস্থিত। অগাসটাইনের অভিমত অনুসারে পুরুষের পরিপ্রেক্ষিতে নারীর অবস্থান অধস্তন। পুরুষের প্রকৃতিতে কর্তৃত্ব ও যুক্তিবাদের প্রতিফলন পরিলক্ষিত হয়; নারী জাতির প্রকৃতিতে পরিলক্ষিত হয়। জৈবিক চাহিদার প্রতিফলন। ভগবানের চোখে কেবল পুরুষই বর্তমান। নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা হয়। যে, পরবর্তীকালের পশ্চিমী সামাজিক ও রাষ্ট্রনীতিক ধ্যান-ধারণা এই চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। আবার সামাজিক ও রাজনীতিক চিন্তার মূল ধারায় নারীর ভূমিকাকে পৃথক কিন্তু পরিপূরক (different but complementary) ভাবা হয়েছে। নারী-পুরুষের স্বতন্ত্র অবস্থান আপাতভাবে মেনে নিয়েও কার্যক্ষেত্রে নারীর পৃথক অবস্থানকে বলা হয়েছে পুরুষের বিরোধী। পুরুষ যদি নিয়ম হয়, এই নিয়মের সঙ্গে নারীর সম্পর্ক নঞর্থক। পুরুষ স্বাভাবিক, নারী পুরুষের বাধা; নারী অন্য মানুষ। শ্রমিক হিসাবে পুরুষ স্বাভাবিক মডেল, নারী নয়।
পশ্চিমী প্রথাগত সামাজিক ও রাষ্ট্রনীতিক মতাদর্শের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এই প্রবণতার বিরুদ্ধে নারীবাদী প্রতিক্রিয়া বিবিধ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অভিব্যক্তি লাভ করেছে। এই বিবিধ দৃষ্টিভঙ্গি হল:
-
(এক) অন্তর্ভুক্তিমূলক,
-
(দুই) পরিহার ও নব তত্ত্ব নির্মাণ এবং
-
(তিন) বিনির্মাণ ও পরিবর্তন।
নারীবাদীদের এই বিবিধ দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা আবশ্যক।
(এক) অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নারীবাদীরা পশ্চিমী প্রথাগত সামাজিক ও রাষ্ট্রনীতিক মতাদর্শের মধ্যে নারীবাদী ধারাটিকে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী। মেরী উলস্টোনক্র্যাফট প্রণীত Indication of the Rights *Women (1792) শীর্ষক গ্রন্থটির মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।
(দুই) পরিহার ও নবতত্ত্ব নির্মাণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সাম্প্রতিককালের নারীবাদের বিকাশ ও বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে সাবেকি পশ্চিমী রাষ্ট্রনীতিক মতাদর্শসমূহ প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে। এই অবস্থায় প্রথাগত রাষ্ট্রনীতিক ধ্যান-ধারণাসমূহকে পরিহার করতে হবে এবং নতুনভাবে রাষ্ট্রনীতিক বিষয়াদির অনুশীলনের মাধ্যমে নতুন মতবাদ গড়ে তুলতে হবে।
(তিন) বিনির্মাণ ও পরিবর্তনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি সাবেকি পিতৃতান্ত্রিকপ্রবণ তত্ত্বগত ধারার লিঙ্গমূলক চেহারাটিকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করার পক্ষপাতী। নারীবাদী এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী প্রথাগত তত্ত্বসমূহের অন্তর্ভুক্ত পুরুষ প্রাধান্যের ধারাকে পুরোপুরি পরিহার করা যাবে না। প্রথাগত সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক ধারার মধ্যে লিঙ্গভিত্তিক রাজনীতির প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সম্যকভাবে অনুধাবন করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন ও পরিহার এবং নতুন মতবাদ গড়ে তুলতে হবে।
নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকারভেদ
নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষ একটি একমাত্রিক ধারা নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত ও বহুমাত্রিক। পশ্চিমী প্রথাগত সামাজিক রাষ্ট্রনীতিক নারীর প্রান্তিক ও অবদমিত অবস্থানের নারীবাদ হল এক সোচ্চার প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ। নারীবাদীদের মূল উদ্দেশ্য হল নারীজাতির কেন্দ্রীয় অবস্থান ও প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তত্ত্ব নির্মাণ করা। নারীবাদীরা নতুন আলোকে ও নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক ও রাষ্ট্রনীতিক জীবন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার পক্ষপাতী। সর্বসাধারণের বিষয়াদির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রের উপাদানসমূহকে রাষ্ট্রনীতিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার প্রসঙ্গে নারীবাদীরা সক্রিয়। নারীবাদে মানুষের সনাতন বিশ্ববীক্ষ্যাকে পরিবর্তনের কথা বলা হয়। রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে লিঙ্গগত অবস্থান সম্পর্কিত একটি দৃষ্টিভঙ্গি হল নারীবাদ। কিন্তু নির্দিষ্ট ধারায় বা পথে নারীবাদী ধ্যান-ধারণা কখনই পরিচালিত হয়নি। নারীবাদ কোন সুসংহত মতাদর্শ নয়। নারীবাদের মধ্যে বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী মতামত ও অবস্থান বর্তমান। মহিলাদের অসাম্য বৈষম্য, অবদমিত অবস্থান, নিপীড়ন-নির্যাতন প্রভৃতির প্রকৃতি, কারণসমূহ ও সুরাহার ব্যাপারে ব্যাপক মতপার্থক্য বর্তমান। এই মতানৈক্যের কারণ হল নারীবাদকে সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ একটি মতবাদ হিসাবে প্রতিপন্ন করা যায় না। কারণ নারীবাদের মধ্যে পরস্পর বিরোধী বিভিন্ন সূত্র বা ধারা পরিলক্ষিত হয়। এই সমস্ত ক্ষেত্রে ধারণাগত পার্থক্যসমূহকে উদারনীতিক, সমাজতান্ত্রিক ও মার্কসবাদী, র্যাডিক্যাল প্রভৃতি নামে নারীবাদীদের চিহ্নিত করা হয়। এ ছাড়াও ‘কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদ’ (black feminism), উত্তর আধুনিক নারীবাদ প্রভৃতির কথা বলা হয়। নারীবাদীদের এই শ্রেণীবিভাজন মোটেই সম্পূর্ণ বা সন্তোষজনক নয়। এর থেকে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিসমূহের এক সাধারণ পরিচয় পাওয়া যায়। ভ্যালেরী ব্রাইসন তাঁর Feminism শীর্ষক এক রচনায় এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “This classification provides a useful way of approaching feminist ideas…, it is however, essential to remember that reality is much more complex than such levels can suggest, and that in practice few writers or theories fit exactly into any one slot.”
Leave a comment