ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীরা মনে করেন যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কসমূহ কেবল প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদী সমাজের অংশ হিসাবেই অনুধাবন করা যাবে। এ ধরনের সমাজব্যবস্থাই নারীজাতির অধীনতামূলক অবস্থানের সৃষ্টি করেছে এবং সংশ্লিষ্ট মহিলাদের এই অবস্থানকে তুলে ধরেছেন। এরই ভিত্তিতে অনেকে নারী-পুরুষের মধ্যে আইনগত ও অর্থনীতিক অসাম্য- বৈষম্যের বিরূপ সমালোচনা করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিবাহ ও পরিবার ব্যবস্থা এবং শ্রমের লিঙ্গগত বিভাজন ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। এইভাবে এই শ্রেণীর চিন্তাবিদ্রা আর্থনীতিক ও রাজনীতিক বিষয়াদির সঙ্গে নারী-পুরুষের ভেদাভেদের সংযোগ সম্পর্কের ভিত্তিতে এক বিশ্লেষণ পদ্ধতি সৃষ্টি করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নারীবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের লক্ষ্যসমূহ অপরিহার্যভাবে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। প্রথম দিকের এই সমস্ত সমাজতান্ত্রীরা এও বিশ্বাস করতেন যে, সংস্কার সাধন, যুক্তি-পরামর্শ ও উদাহরণের মাধ্যমে উন্নততর সমাজব্যবস্থা সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীরা হিংসাশ্রয়ী বিপ্লবের পথ বিশ্বাস করতেন না।
পরবর্তীকালে কার্ল মার্কস [Karl Marx (1818-83)] বৈপ্লবিক সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণাসমূহ বিকশিত করেন। কিন্তু নারীবাদ বৈপ্লবিক সমাজতন্ত্রবাদের কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল না। এতদসত্ত্বেও মার্কসের মতবাদ মানব সমাজ ও সভ্যতার ইতিহাসের এক সামগ্রিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হিসাবে তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিপন্ন হয়। পরবর্তীকালের চিন্তাবিদরা মার্কসবাদকে নারীবাদী বিষয়াদির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন। তদনুসারে দেখান হয় যে, অন্যান্য সামাজিক সংগঠনসমূহের মত পরিবার এবং লিঙ্গগত সম্পর্কসমূহের সৃষ্টি হয়েছে আর্থনীতিক বিকাশের একটি বিশেষ পর্যায়ে। স্বভাবতই সহজে এ সবের পরিবর্তন সম্ভব নয়। কেবলমাত্র শ্রেণীসংগ্রাম ও বৈপ্লবিক পথে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এ সবের পরিবর্তন সাধন সম্ভব।
উপরিউক্ত ধারণাকে বিকশিত করেছেন ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস [Frederick Engels (1820-95)]। এ প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের The Origin of the Family, Private Property and the State শীর্ষক গ্রন্থটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই গ্রন্থে এ বিষয়ে তিনি বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ১৮৮৪ সালে। এঙ্গেলস দেখিয়েছেন যে, নারীর উপর নির্যাতন সব সময় ছিল না। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও শ্রেণীবিভক্ত সমাজ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে নারীজাতির উপর অন্যায়-অত্যাচারের সূত্রপাত ঘটেছে। কারণ এই সময় সম্পত্তির অধিকার নিজের উত্তরাধিকারীর কাছে হস্তান্তরিত করার ধারাকে নিশ্চিত ও নিরাপদ করার জন্য পুরুষ নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে। এঙ্গেলসের অভিমত অনুযায়ী পুঁজিবাদের অবসান ঘটলে পুরুষদের মধ্যে এই প্রবণতা আর থাকবে না। কারণ তখন মহিলারা আর আর্থনীতিকভাবে পুরুষের উপর নির্ভরশীল থাকবে না। গৃহকর্ম ও সন্তান প্রতিপালন প্রক্রিয়ার সামাজিকীকরণ ঘটবে। তারফলে ঘর-গৃহস্থলীর কাজকর্মের বন্ধন থেকে মহিলারা মুক্তি পাবে।
প্রথম দিকের নারীবাদীদের অনেকেই সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার উপর আস্থাশীল ছিলেন। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয়েছে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে। উদারনীতিক নারীবাদীদের মত সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা বিশ্বাস করেন না যে, মহিলাদের কেবলমাত্র রাজনীতিক ও আইনগত অসুবিধাসমূহের সম্মুখীন হতে হয় এবং মহিলাদের আইনমূলক অধিকারসমূহ ও সমান সুযোগ-সুবিধাসমূহের স্বীকৃতির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সমস্যাদির সুরাহা সম্ভব। বিপরীতক্রমে সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা মনে করেন যে, আর্থ-সামাজিক কাঠামোর মধ্যেই নরনারীর মধ্যে সম্পর্কের প্রকৃতি নিহিত আছে। মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন বা সামাজিক বিপ্লব ব্যতিরেকে নারীজাতির সম্যক মুক্তি সাধন সম্ভব নয়।
সমাজতান্ত্রিক নারীবাদেও আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয় হল পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা সামাজিক ও অর্থনীতিক উপাদানসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রকৃতি পর্যালোচনার পক্ষপাতী। এঙ্গেলসের The Origin of the Family, Private Property and the State শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায়। এঙ্গেলসের অভিমত অনুযায়ী ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে নারীজাতির অবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। প্রাক্পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পরিবার জীবন ছিল সাম্যবাদী। এই সময় পরিবার ব্যবস্থা ছিল ‘মাতৃ অধিকার’ ভিত্তিক; সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও সামাজিক অবস্থান নির্ধারিত হত মাতৃসূত্রে। পুঁজিবাদ কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হয় পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের উপর ভিত্তি করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়, মাতৃ-অধিকার (mother right) বাতিল হয়ে যায় এবং বিশ্বব্যাপী নারীজাতির ঐতিহাসিক পরাজয় পাকা হয়ে যায়।
পরবর্তী কালের অনেক সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীদের মত এঙ্গেলসও বিশ্বাস করতেন যে, পরিবার ব্যবস্থার মাধ্যমেই নারীজাতির উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হয়। পুরুষমানুষ এটা সুনিশ্চিত করতে চায় যে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি কেবলমাত্র তার পুত্রদের অধিকারেই যাবে। এই কারণে বুর্জোয়া পরিবার হল পিতৃতান্ত্রিক ও পীড়নমূলক। একগামী বিবাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে পুরুষমানুষ পিতৃতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রাখে। গৃহবধূদের উপর একগামিতাকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। এঙ্গেলস বিশ্বাস করতেন যে, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বিবাহ ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ব্যবস্থার অবসান ঘটবে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসানের সঙ্গে সঙ্গে এর পিতৃতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং একগামিতারও অবসান ঘটবে। কিন্তু অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা এ প্রসঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করেন। কুরিয়ার (Fourier) ও ওয়েন (Owen) প্রমুখ প্রথম দিকের কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীদের মত তাঁরা মনে করেন যে, সাবেকি পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের পরিবর্তে সঙ্ঘমূলক বসবাস ও স্বাধীন ভালবাসার ব্যবস্থা কায়েম হবে।
সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীদের মধ্যে অধিকাংশই এই অভিমত পোষণ করেন যে, মাতৃত্বের দায়-দায়িত্ব পালন ও গৃহকর্মের মধ্যে মহিলাদের আবদ্ধ থাকার ব্যবস্থা পুঁজিবাদের আর্থনীতিক স্বার্থ সাধনে সদর্থক ভূমিকা পালন করে। পুঁজিবাদী স্বার্থ সংরক্ষণে মহিলাদের সহায়ক ভূমিকার বিভিন্ন দিক বর্তমান। মহিলারা সন্তান প্রজনন ও প্রতিপালন করে। এইভাবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শ্রমশক্তি সৃষ্টি ও ভবিষ্যতের উৎপাদন ব্যবস্থাকে নিরাপদ করার ক্ষেত্রে নারীজাতির ইতিবাচক ভূমিকা অনস্বীকার্য। লিঙ্গগত শ্রমবিভাজনের ভিত্তিতে পুরুষেরা কলকারখানায় ও অফিস-আদালতে সবেতন কাজ করে এবং মহিলারা অবৈতনিক গৃহকর্ম সম্পাদন করে ও আর্থনীতিক দক্ষতাকে বিকশিত করে। অর্থনীতির স্বার্থ ও সামর্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে মহিলাদের ঘর গৃহস্থলীর কাজকর্মের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সন্তান-সন্ততিদের সামাজিকীকরণ, শিক্ষাদান ও পরিপোষণের মাধ্যমে মহিলারা সুশৃঙ্খল ও অনুগত শ্রমিকবাহিনী গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
অনেকের অভিমত অনুযায়ী নারীজাতি একটি সংরক্ষিত শ্রমিক বাহিনী গঠন করে। উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়োজন দেখা দিল এই বাহিনীকে শ্রমশক্তির সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়। তেমনি আবার মন্দার সময় সহজেই আবার ঘর-গৃহস্থলীর কাজকর্মের মধ্যে আবদ্ধ রাখা যায়। এই প্রক্রিয়ায় নিয়োগকর্তা বা সরকারের উপর কোন রকম বাড়তি দায়িত্ব বর্তায় না। বরং অস্থায়ী শ্রমিক হিসাবে মহিলাদের নিম্নতর কাজে ও কম বেতনে নিয়োগ করা যায় ও হয়। এর ফলে পুরুষদের কাজকর্মের কিছুমাত্র ক্ষতি না করেও কম খরচে শ্রমের যোগান বৃদ্ধি করা যায়। আবার গৃহবধূ হিসাবে মহিলাদের ভূমিকা সন্তান প্রতিপালন ও গৃহকর্ম সম্পাদনের দায়-দায়িত্ব থেকে পুরুষদের মুক্তি দেয়। তারফলে পুরুষেরা সবেতন ও উৎপাদনমূলক কাজকর্মে নিজেদের সময় ও শক্তি-সামর্থ্যকে সম্পূর্ণরূপে নিযুক্ত করতে পারে।
গৃহবধূরাই কর্মক্ষেত্রের জন্য স্বামীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ-সক্ষম রাখে এবং প্রতিদিন কাজের জন্য প্রস্তুত করে পাঠায়। আবার পত্নী ও পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালনের জন্য পরিবারের কর্তা হিসাবে স্বামী কাজেকর্মে অধিকতর উৎসাহ-উদ্দীপনা অনুভব করে। আবার শ্রমের দাসত্বের কারণে শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা বা নৈরাশ্যের সৃষ্টি হতে পারে বা হয়। পরিবারের মধ্যে পত্নীর সাহচর্যে শ্রমিক-কর্মচারীদের মানসিক অবসাদের অপনোদন হয়। অথচ গৃহবধূ মায়েদের গতানুগতিক গুরুত্বহীন গৃহকর্মে উদয়াস্ত অনন্যোপায় হয়ে নিযুক্ত থাকতে হয়।
নারীজাতির অবস্থা সম্পর্কিত বিষয়টিকে আর্থ-সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বিচার-বিবেচনা করা যাবে না। এ বিষয়ে সকল সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী সমমত পোষণ করেন। কিন্তু বিদ্যমান আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে নারীজাতির সম্পর্কের প্রকৃতি প্রসঙ্গে সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীদের মধ্যে মতপার্থক্য বর্তমান। নারী-পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ শ্রেণী-সংঘাতকে অতিক্রম করে যায়। তারফলে সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী বিশ্লেষণের প্রক্রিয়ায় দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। সামাজিক শ্রেণী ও লিঙ্গগত ভেদাভেদের মধ্যে কার আনুপাতিক গুরুত্ব অধিক এ বিষয়েই সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য দেখা দেয়। বিশেষতঃ মার্কসবাদী নারীবাদীদের কাছে বিষয়টি অধিকতর বিতর্কিত প্রতিপন্ন হয়।
গোঁড়া মার্কসবাদীরা লিঙ্গগত রাজনীতির ঊর্ধ্বে শ্রেণীগত রাজনীতির প্রাধান্যকে স্থান দেন। ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস বিশ্বাস করতেন যে, বুর্জোয়া পরিবার ব্যবস্থাই নারীজাতিকে অধস্তন অবস্থানের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের ফলে বুর্জোয়া পরিবারের আবির্ভাব ঘটেছে। সুতরাং বুর্জোয়া পরিবার হল পুঁজিবাদের উপ-উৎপাদন (by product)। সুতরাং এ দিক থেকে বিচার করলে লিঙ্গগত নিপীড়নের থেকে শ্রেণীগত নিপীড়ন অধিক গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। নারীজাতির উপর নিপীড়ন হল ব্যক্তিগত সম্পত্তির প্রাতিষ্ঠানিক নিপীড়ন, পুঁজিবাদের নিপীড়ন, পুরুষজাতির নিপীড়ন নয়। মার্কসবাদীদের মতানুসারে নারীমুক্তির বিষয়টিও সুনিশ্চিত হবে সামাজিক বিপ্লবের একটি উপ-উৎপাদন হিসাবে। এই সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদ অপসারিত হবে এবং পুঁজিবাদের জায়গায় সমাজতন্ত্র কায়েম হবে। সুতরাং নারীমুক্তির স্বার্থে লিঙ্গগত সংগ্রামের ধারণার থেকে শ্রেণীসংগ্রামের ধারণা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। স্বভাবতই মার্কসবাদীদের অভিমত হল নারীমুক্তির স্বার্থে নারীবাদীদের দিক থেকে উচিত হবে বিভেদমূলক নারী-আন্দোলনের পরিবর্তে শ্রমিক আন্দোলনকে মদত দেওয়া।
সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের সমালোচনা
সমাজতান্ত্রিক নারীবাদও বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। নারীবাদের সাবেকি সমাজতান্ত্রিক ভাষ্যের বিরুদ্ধে সমালোচকরা বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করে থাকেন। সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের সীমাবদ্ধতাসমূহকে নিম্নলিখিতভাবে বিন্যস্ত করা যায়।
এক: সমালোচকদের মতানুসারে শুধুমাত্র সমাজতন্ত্রবাদের মাধ্যমে পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্বের অবসান অসম্ভব। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নে পিতৃতান্ত্রিক প্রাধান্যের অবসানের ব্যাপারে অগ্রগতি হতাশাজনক।
দুই : আধুনিক কালের সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীদের কাছে লিঙ্গগত রাজনীতির উপর শ্রেণী-রাজনীতির প্রাধান্যের বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া সহজে সম্ভব হচ্ছে না। আধুনিক সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, শ্রেণীশোষণের মতই লিঙ্গগত পীড়নও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
তিন: আধুনিককালের মার্কসবাদীদের মত সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীদের অনেকে সমাজব্যবস্থায় সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থনীতিক ও রাজনীতিক শক্তিসমূহের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করেন। কিন্তু গোঁড়া মার্কসবাদী বক্তব্য অনুযায়ী বস্তুগত বা আর্থনীতিক উপাদানসমূহ হল মুখ্য নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি। কিন্তু আধুনিক মার্কসবাদীরা বা সমাজতান্ত্রিক নারীবাদীরা এই বক্তব্যকে স্বীকার বা সমর্থন করেন না। এই কারণে তারা কেবলমাত্র আর্থনীতিক প্রেক্ষিতে নারীজাতির অবস্থা পর্যালোচনার পক্ষপাতী নন। তাঁরা পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্বের সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শগত উৎস অনুসন্ধানে অধিকতর আগ্রহী।
চার: গ্রেট ব্রিটেনের সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী জুলিয়েট মিচেল নারীমুক্তির বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন যে, মহিলারা চার ধরনের সামাজিক ভূমিকা পালন করে থাকে। এই ভূমিকাগুলি হল:
-
(ক) মহিলারা শ্রমশক্তির অংশ এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার সদস্য;
-
(খ) মহিলারা সন্তান প্রজনন করে এবং মানবজাতির অস্তিত্বকে অব্যাহত রাখে;
-
(গ) মহিলারা সন্তানের সামাজিকীকরণ সম্পাদন করে; এবং
-
(ঘ) মহিলারা লিঙ্গ লক্ষ্যবস্তু।
সমাজবিজ্ঞানী মিচেলের মতানুসারে পুঁজিবাদী শ্রেণীব্যবস্থার অবসান এবং সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারীজাতির সম্যক স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয়। নারীমুক্তির জন্য আবশ্যক হল উপরিউক্ত চতুর্বিধ ভূমিকায় মহিলাদের শৃঙ্খলমোচনকে সুনিশ্চিত করা।
পাঁচ: র্যাডিক্যাল (radical) নারীবাদের মধ্যে অনেকে মার্কসবাদকে পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শের একটি রকমফের হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী। এই শ্রেণীর নারীবাদী চিন্তাবিদদের মতানুসারে, তথাকথিত কমিউনিষ্ট সমাজসমূহে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো অব্যাহতভাবে বর্তমান। পশ্চিমী মার্কসবাদীদের কাছে, লিঙ্গগত সাম্যের বিষয়টি হল মনোযোগ বিক্ষেপকারী অতি মামুলি একটি গুরুত্বহীন বিষয়। বিষয়টিকে অনির্দিষ্টকাল স্থগিত রাখা যায়। বর্তমানে মার্কসবাদ বহুলাংশে বিশৃঙ্খল অবস্থাপ্রাপ্ত। মার্কসবাদী নারীবাদের অবস্থা অতিমাত্রায় সমালোচিত। তবে আধুনিক নারীবাদী তত্ত্বে মার্কসবাদী বক্তব্যকে অন্যতম উপাদান হিসাবে গুরুত্বসহকারে বিচার-বিবেচনা করা হয়।
ছয়: গোঁড়া অনুগামীদের কাছে মার্কসবাদী যুক্তি হল আর্থনীতিক নিয়তিবাদ। নর-নারীর সম্পর্কের প্রকৃতির মধ্যেই গতিশীল সক্রিয়তা আছে— এ কথা মার্কসবাদীরা স্বীকার করেন না। নারীজাতির মধ্যে অভিন্ন গোষ্ঠী স্বার্থ সম্পর্কে সচেতনতা থাকতে পারে এবং এই সচেতনতা শ্রেণীবিভাজনের ধারণাকেও অতিক্রম করে যেতে পারে— এ কথাও মার্কসবাদীরা স্বীকার করেন না। তবে আধুনিককালের অনেক চিন্তাবিদের লেখায় মার্কসবাদের অপেক্ষাকৃত এক নমনীয় প্রকৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। অনেকে আবার র্যাডিক্যাল নারীবাদী চিন্তাধারার পটভূমিতে পুঁজিবাদ ও পিতৃতন্ত্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক অনুসন্ধানে আগ্রহ দেখিয়েছেন। এই শ্রেণীর চিন্তাবিদরা সমাজতান্ত্রিক নারীবাদী হিসাবে পরিচিত।
উপসংহার: উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয় যে, সমাজতান্ত্রিক ও মার্কসবাদী নারীবাদী চিন্তাধারার মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য বর্তমান। তবে এ বিষয়ে বর্তমানে ব্যাপক ঐকমত্য বর্তমান যে, আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে নর-নারীর সম্পর্ক সম্পর্কিত বিষয়াদিকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। আবার কেবলমাত্র আর্থ-সামাজিক দিক থেকে লিঙ্গগত বিষয়াদির সম্যক বিচার-বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। তেমনি আবার এসব কথাও এখন আর স্বীকার বা সমর্থন করা হয় না যে, শ্রেণীর থেকে লিঙ্গগত বিষয় অধিক গুরুত্বপূর্ণ; বা নারীসমাজ অনির্দিষ্টকাল ধরে ভগিনীত্বের বন্ধনে আবদ্ধ; পুরুষমাত্রেই নারীর শত্রু প্রভৃতি। এই বিশ্বাস অধুনা মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছে যে, সমাজের সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তনের মাধ্যমে নর-নারী উভয়েই লাভবান হবে। কারণ সমাজতান্ত্রিক সমাজে সকল রকম শোষণ-পীড়নের অবসান ঘটবে।
Leave a comment