আধুনিক কালের রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু হেউড (Andrew Heywood) তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে মার্কসবাদের তিনটি রূপ চিহ্নিত করে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। বস্তুত মার্কসবাদ হল একটি গতিশীল মতবাদ। এই মতবাদ নিয়ত বিকশিত হচ্ছে। নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার দ্বারা এই মতবাদ ক্রমশ সমৃদ্ধ হচ্ছে। মার্কসবাদ হল বিশ্বের বিপ্লবী রূপান্তরের বিজ্ঞান। স্বভাবতই সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এবং পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদের চেহারা-চরিত্রে অল্পবিস্তর রূপান্তর ঘটেছে। সাধারণভাবে মার্কসবাদের তিনটি রূপের কথা বলা হয়। মার্কসবাদের এই তিনটি রূপ হল: 

  • (১) ধ্রুপদী মার্কসবাদ (Classical Marxism), 

  • (২) নিয়মনিষ্ঠ মার্কসবাদ (Orthodox Marxism) এবং 

  • (৩) আধুনিক মার্কসবাদ (Modern Marxism)।

(১) ধ্রুপদী মার্কসবাদ: মার্কস-এঙ্গেলস

সনাতন মার্কসবাদী ধ্যান-ধারণাকে তিন দিক থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়। ধ্রুপদী বা সাবেকি মার্কসবাদের আলোচনার এই তিনটি দিক হল: 

  • (ক) দার্শনিক, 

  • (খ) আর্থনীতিক ও 

  • (গ) রাজনীতিক।

(ক) ধ্রুপদী মার্কসবাদের দার্শনিক দিক:

মার্কসের মার্কসবাদ হল ধ্রুপদী মার্কসবাদ। ধ্রুপদী মার্কসবাদের মূল বিষয় হল ইতিহাসের দর্শন। এই ইতিহাসের দর্শনে বলা হয়েছে পুঁজিবাদের অবক্ষয়ের কারণ এবং কেন পুঁজিবাদকে অপসারিত করে সমাজতন্ত্রবাদের প্রতিষ্ঠা অবধারিত। এ হল এক বিশেষ ধরনের দর্শন। মার্কস বিশ্বাস করতেন যে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে মানবসমাজের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানকে সমাজের পরিবর্তনের কাজেও ব্যবহার করা সম্ভব। মার্কসের মতানুসারে এতদিন দার্শনিকরা এই দুনিয়াকে বিভিন্নভাবে কেবল ব্যাখ্যাই করে আসছেন; কিন্তু আসল কথা হল এই পৃথিবীকে পাল্টে দেওয়া (” Philosophers have so far only interpreted the world, in various ways; the point, however, is to change it. “)। সুতরাং মার্কসের মার্কসবাদ হল সমাজের একটি মতবাদ এবং সঙ্গে সঙ্গে একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিক কর্মসূচী।

এই মার্কসবাদ হল একটি প্রায়োগিক মতবাদ। এই মতবাদ পৃথিবীর উপর আর একটি নিছক তত্ত্বের বোঝা হয়ে দাঁড়ায় নি। এই মতবাদে এই পৃথিবীর সমাজব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। মার্কসবাদ অনুযায়ী দর্শনের সঙ্গে তত্ত্বের এবং তত্ত্বের সঙ্গে প্রয়োগের সংযোগ অভিপ্রেত। এর মধ্যেই রাজনীতিক তত্ত্ব চিন্তার গুরুত্ব বর্তমান। তত্ত্ব ও প্রয়োগের বা চিন্তা ও কর্মের এই সংযোগ-সম্পর্ক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মার্কসের অভিমত অনুযায়ী বাইরের জগতকে মানুষ যেমন তার নিজের অভিপ্রায় অনুযায়ী গড়ে তুলতে চায়; এই প্রক্রিয়ায় মানুষ নিজেদেরও পরিবর্তন সাধন করে। হেউড এ বিষয়ে বলেছেন: “…the sophistication and complexity of Marx’s writings derive in part from his unwillingness to separate theory from practice and his belief that as human beings shape their world, in the process, they are also helping to shape themselves.”

মার্কস বিশ্বাস করতেন যে, তাঁর মতবাদ বিজ্ঞানসম্মত। ইতিহাস ও সমাজের অভিজ্ঞতামূলক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের স্বার্থে মার্কস আশাতিরিক্ত পরিশ্রম করেছেন। তিনি আশা করেছিলেন যে এই ভাবে সমাজব্যবস্থার ভবিষ্যৎ বিকাশের প্রকৃতি সম্পর্কে একটা অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করা যাবে। এঙ্গেলস ঘোষণা করেছেন যে, ঐতিহাসিক ও সামাজিক বিকাশের বিধি-নিয়ম সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন কাল মার্কস। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের উদ্যোগ মার্কসের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। তার ফলে মার্কসের মার্কসবাদ বৈজ্ঞানিক সত্যসমূহের সুসংবদ্ধ অভিব্যক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। মার্কসবাদ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পুঁজিবাদের পতনের এবং সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার অনিবার্যতার কথা বলেছে; নতুন সমাজব্যবস্থা বা শোষণ পীড়ন থেকে মানব জাতির মুক্তির পথ বা সাম্যবাদের পথ উদ্ঘাটন করেছে। মার্কসবাদ হল প্রলেতারিয়েতের মৌলিক স্বার্থের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি।

মার্কসীয় দর্শন হল বস্তুবাদী দর্শন। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ মার্কসীয় দর্শনের মৌলিক ও প্রধান সূত্রসমূহের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মার্কস দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে ইতিহাসের ধারা ব্যাখ্যা করেছেন। সামগ্রিকভাবে সমাজের পরিবর্তন ও অগ্রগতির যে নিয়ন্তা শক্তি বা বিধি-বিধান পরিলক্ষিত হয় সে বিষয়ে সাধারণ তত্ত্বই হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। ডারউইন জীবজগতের বিবর্তন সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক ধারাটি আবিষ্কার করেছেন। তেমনি মার্কস আবিষ্কার করেছেন মানব ইতিহাসের বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক মূল সূত্রসমূহ। মানব ইতিহাসের পরিবর্তন পর্যালোচনার ক্ষেত্রে বুর্জোয়া ঐতিহাসিকেরা এযাবৎ কাল রাজনীতিক কারণসমূহের উপর জোর দিয়ে এসেছেন। কিন্তু বিজ্ঞানসম্মতভাবে মার্কসই প্রথম বললেন যে, মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজন হল খাদ্য, পানীয়, আবাসন ও পরিধেয়। রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন প্রভৃতি চর্চার আগে প্রাথমিক প্রয়োজন পুরণের জন্য মানুষকে কাজ করতে হয়। অতএব মানুষের চিন্তাধারা নয়, জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থনীতিক ব্যবস্থাই সমাজ পরিবর্তনের মূলে বর্তমান। মানব সমাজ ও ইতিহাসের পরিবর্তন ও অগ্রগতি সম্পর্কিত মার্কসীয় এই জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গিই হল ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ কেবল সমাজ পরিবর্তনের ইতিহাস ব্যাখ্যা করে না; মানুষ কীভাবে সমাজকে পরিবর্তন করতে পারে তার পথও নির্দেশ করে।

জার্মান দার্শনিক হেগেলের আদর্শবাদকে মার্কস বাতিল করে দিয়েছেন। মার্কসের মতানুসারে অর্থনীতিই হল মানব সমাজের ভিত। ইতিহাস মূলত আর্থনীতিক অবস্থান দ্বারা আবর্তিত ও বিবর্তিত হয়। ধনোৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার বিধানগুলিই এই বিবর্তনের প্রধান কারণ। মানবসমাজের রাজনীতিক, সামাজিক ও অন্যান্য দিকগুলি আর্থনীতিক ব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ অর্থনীতিক বুনিয়াদ পরিকাঠামোকে প্রভাবিত করে। সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থাই হল সমাজ পরিবর্তন ও শ্রেণী-সম্পর্কের মূল কারণ। মানুষের সামাজিক ও রাজনীতিক জীবনধারা তার আর্থনীতিক জীবনধারারই প্রতিবিম্ব। সমাজবিকাশের সাধারণ বিধান উৎপাদনের সামাজিক পদ্ধতির সঙ্গে সংযুক্ত। মানুষের জীবনধারণের জন্য বস্তুগত উপায় উৎপাদনের পদ্ধতি সামগ্রিকভাবে সামাজিক, রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে প্রভাবিত করে।

মার্কসের মতানুসারে সকল কিছুর মূল হল উৎপাদন পদ্ধতি। প্রধানত উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তন সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন সূচিত করে। মার্কস বলেছেন: “উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষ কেবল প্রকৃতির উপরই কাজ করে না। পরস্পরের উপরও কাজ করে। মানুষ পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতায় উৎপাদন করে।” উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের সমন্বয়ই হল উৎপাদন-পদ্ধতি। উৎপাদন-শক্তি হল শ্রমিক ও তার শ্রমশক্তি এবং আনুষঙ্গিক হাতিয়ার, যন্ত্রপাতি প্রভৃতি। উৎপাদন-সম্পর্ক হল উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে। মানুষের পারস্পরিক সংযোগ-সম্পর্ক। উৎপাদনের উপায় (Means of Production) হল উৎপাদন-শক্তির অন্তর্ভুক্ত বিবিধ উপকরণ, কাঁচামাল, জমিজমা, ঘর প্রভৃতি। সমাজের সম্পত্তি-সম্পর্ক (Property relations) গড়ে উঠে উৎপাদনের উপায়ের মালিকানার ভিত্তিতে। হেউড বলেছেন: “In the preface to A contribu tion to the critique of political Economy, written in 1859, Marx gave this theory its most succinet expression by suggesting that social consciousness and the legal and political superstructure,’ arise from the ‘economic base,’ the real foundation of society. This “base’ consists essentially of the ‘mode of production’ or economic system-feudalism, capitalism, socialism and so on.”

মার্কসের মতানুসারে উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য সমাজব্যবস্থা বদলায়। সমাজের আর্থনীতিক বনিয়াদ, অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র উপরি-কাঠামো, অর্থাৎ বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও ভাবধারার অল্পবিস্তর দ্রুত পরিবর্তন ঘটে। মার্কস বলেছেন: “With the change of the economic foundation the entire immense super-structure is more or less rapidly trans formed.”

মার্কসের মার্কসবাদ হল একটি বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শন। আবার মার্কসবাদ হল একটি দ্বান্দ্বিক বীক্ষণ। মার্কস তাঁর রচনায় ‘দ্বান্দ্বিকতা’ (dialectics) ও ‘বস্তুবাদ’ (materialism) কথা দুটি ব্যবহার করেছেন; কিন্তু একযোগে ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’ (dialectical materialism) কথাটি প্রয়োগ করেন নি। রুশ চিন্তাবিদ্ প্লেখানভ মার্কসীয় দর্শনকে ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। ভাববাদী জার্মান দার্শনিক হেগেল প্রথম দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার কথা বলেন। হেগেলের মতানুসারে সবকিছুর বিকাশ তার অন্তর্নিহিত দ্বান্দ্বিকতার ফলেই ঘটে। মার্কস তাঁর দ্বন্দ্ববাদের ক্ষেত্রে হেগেলকে অনুসরণ করেছেন। কিন্তু মার্কসীয় দ্বন্দ্ববাদ হেগলীয় দ্বন্দ্ববাদ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। হেগলীয় দর্শন ভাববাদ, কিন্তু মার্কসীয় দর্শন সম্পূর্ণ বস্তুবাদী। মার্কসের দ্বন্দ্ববাদ হেগেলীয় দ্বন্দ্ববাদের বিপরীত। Das Capital গ্রন্থের ভূমিকায় মার্কস বলেছেন: “My dialectic is opposite of Hegel’s.” হেগেলীয় দ্বন্দ্ববাদ নেতিবাচক। এই দ্বান্দ্বিক বিকাশের প্রকৃতিটি হল নেতিকরণের মাধ্যমে পরিবর্তন ও উন্নতি। জগৎ ও জীবনের পরিবর্তন ও বিবর্তন বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মার্কস কিন্তু কেবল এই নেতিকরণের পদ্ধতি অনুসরণ করেন নি। হেউড বলেছেন: “Marx thus explaimed histori cal change by reference to internal contradictions within each mode of production arising from the existence of private property. Capitalism is thus doomed because it embodies its own antithesis, the proletariat, seen by marx as the grave digger of capitalism’.” পুঁজিবাদ ও প্রলেতারিয়েতের মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলশ্রুতি হিসাবে উন্নয়নের উন্নততর পর্যায় হিসাবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তারপর কালক্রমে সাম্যবাদী সমাজের সৃষ্টি হবে।

মার্কসীয় দর্শনের মূল ভিত্তি হল দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের প্রেক্ষিত হিসাবে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্ট-সম্ভৃত বস্তুবাদী চিন্তা এবং হেগেলের ভাববাদী দ্বান্দ্বিক মতবাদের সংমিশ্রণের কথা বলা যায়। এঙ্গেলস অ্যান্টি ডুরিং (Anti Duhring)-এ এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ হল মার্কসের উত্তরসূরীদের কাছে বিশ্ববীক্ষা স্বরূপ। এ হল বাস্তবকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। এই পদ্ধতি বহুলাংশে প্রকৃতি-বিজ্ঞানের ন্যায়। প্রকৃতিবিজ্ঞান প্রমাণিত ও সন্দেহাতীত। অনুরূপভাবে মার্কসীয় দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ হল সন্দেহাতীতভাবে ইতিহাসের বিজ্ঞান। সমাজ ইতিহাস প্রকৃতিজগতের ন্যায় অভিন্ন দ্বান্দ্বিক নিয়মের অধীন।

হেগেলকে অনুসরণ করে মার্কস ইতিহাসের সমাপ্তির কথা বলেছেন। অন্তর্নিহিত দ্বান্দ্বিক বিযুক্ত ও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে পরস্পর বিরোধিতা বিযুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে মানব সমাজের দ্বন্দ্বমূলক ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটবে। এ ক্ষেত্রে মার্কস সাম্যবাদ বা সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার কথা বলেছেন। সাম্যবাদী সমাজ হবে শ্রেণীহীন সমাজ। উৎপাদনশীল সম্পদের সমষ্টিগত মালিকানার উপর এই শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। মার্কসের অভিমত অনুযায়ী এইভাবে ‘মানবজাতির প্রাক্ ইতিহাস’ (pre-history of man kind) শেষ হবে। সুতরাং ইতিহাস সম্পর্কিত মার্কসীয় মতবাদ পরমকারণমূলক। কারণ মানব সমাজ সভ্যতার ইতিহাসের উপর বিশেষ উদ্দেশ্য বা অর্থ আরোপ করেছেন। শ্রেণীহীন সাম্যবাদই হল সেই উদ্দেশ্য। হেউড ও বিষয়ে বলেছেন: “Marx’s theory of history is therefore teleological, in the sense that it invests history with meaning or a purpose, reflected in its goal: classless communism.”

(খ) ধ্রুপদী মার্কসবাদের অর্থনীতিক দিক:

চিরায়ত মার্কসবাদের আর্থনীতিক আলোচনায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বর্তমান। মার্কস তাঁর গোড়ার দিককার আলোচনায় পুঁজিবাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রকৃতির উপর জোর দিয়েছেন এবং পুঁজিবাদ সম্পর্কিত অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালের আলোচনায় শ্রেণীসংঘাত ও শ্রেণী-শোষণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক আলোচনায় মার্কস বিচ্ছিন্নতাবাদের কথা বলেছেন। মার্কসের অভিমত অনুযায়ী পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় নানাভাবে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়।

(১) পুঁজিবাদ হল বিনিময়ের জন্য উৎপাদনের ব্যবস্থা। পুঁজিবাদ মানুষকে তার শ্রমের দ্বারা সৃষ্ট সামগ্রী থেকে বিচ্ছিন্ন করে। কারণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষ তার প্রয়োজন বা উপযোগিতার বিচারে দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন করে না; উৎপাদন করে সেই সমস্ত দ্রব্য সামগ্রী যা মুনাফার জন্য বিক্রি হবে। 

(২) পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রম সামাজিক নয়। ব্যক্তিবর্গকে স্বার্থপর হতে উৎসাহিত করা হয়। তার ফলে মানুষ সঙ্গী সাথীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। 

(৩) শ্রমিকরা নিজেদের থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় ‘শ্রম’ নিছক একটি ‘সামগ্রী’ (Commodity) হিসাবে পরিগণিত হয়। কাজকর্ম ব্যক্তিত্ব বিযুক্ত উদ্যোগে পরিণত হয়। কাজকর্ম সৃষ্টিশীল বা সন্তোষজনক কোন বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয় না।

(৪) পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিকরা শ্রমের প্রক্রিয়া থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কারণ এ ধরনের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ শ্রমিক ম্যানেজার বা কর্মী-সর্দারের তত্ত্বাবধানে কাজ করতে বাধ্য থাকে। এ প্রসঙ্গে হেউড মন্তব্য করেছেন: “This suggests that capitalism has separated people from their genuine or essential natures, that is, from their capacity as workers to develop skills, talents and understanding through the experience of free productive labour.”

মার্কসের অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালের রচনাগুলিতে শ্রেণীসংঘাত ও শ্রেণীশোষণের দিক থেকে পুঁজিবাদকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মার্কস এবং পরবর্তী কালের মার্কসবাদীদের কাছে শ্রেণীব্যবস্থার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে পুঁজিবাদের ঐতিহাসিক বিকাশ অনুধাবন করা যায় এবং আগামী দিনে পুঁজিবাদের বিকাশ সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করা যায়। মার্কসের বিশ্বাস অনুযায়ী পুঁজিবাদী সমাজ ক্রমবর্ধমানভাবে পরস্পর বিরোধী দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত। এই দুটি শ্রেণী হল বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত। বুর্জোয়ারা হল পুঁজিবাদী শ্রেণী। এই শ্রেণী উৎপাদনশীল সম্পদের মালিক হিসাবে জীবনধারন করে। প্রলেতারিয়েতরা হল সম্পদহীন মানবগোষ্ঠী। প্রলেতারিয়েতরা জীবনধারণের জন্য তাদের শ্রমশক্তি বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। এ দিক থেকে প্রলেতারিয়েতরা হল ‘মজুরি দাস’ (wage slaves)। বিপরীতমুখী শ্রেণীস্বার্থের অস্তিত্বের জন্য বিত্তবান ও মেহনতী শ্রেণীসমূহের মধ্যে শ্রেণী-সংগ্রাম অবিরাম লেগে থাকে। ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ (Communist Manifesto)-র প্রথম এবং প্রধান বক্তব্য হল, “আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলের ইতিহাস হল শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস” (“The history of all hilterto existing societies is the history of class struggle.”)। মার্কস আর্থনীতিক ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রেণীর ধারণা ব্যাখ্যা করেছেন। উৎপাদনের উপায়সমূহের বা উৎপাদনশীল সম্পদের মালিকানার পরিপ্রেক্ষিতে পরস্পর মুখোমুখি দুটি শ্রেণীর অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মুখ্য পক্ষ হল শ্রেণীসমূহ; ব্যক্তিবর্গ, দল বা অন্যান্য আন্দোলন নয়।

পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হল আর্থনীতিক শোষণ। শিল্পপতি বা নিয়োগকর্তাদের স্বভাব সদাশয় না কি নিষ্ঠুর তা এ ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক। পুঁজিবাদ হল পুরোপুরি মুনাফামুখী। পুঁজিবাদের মুনাফার ক্ষুধা মেটে ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ (surplus value) আত্মসাৎ করার মাধ্যমে। শ্রমিকদের কাছ থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য’ আত্মসাৎ করা হয়। শ্রমিকরা যে মূল্য উৎপাদন করে, তার থেকে তাদের কম দিয়ে উদ্বৃত্ত মূল্য পুঁজিপতিরা নিজেদের পকেটে ভরে। মার্কস মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে শ্রমতত্ত্বের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ বিষয়ে তিনি প্রচলিত আর্থনীতিক বিধিবিধান অনুসরণ করেন নি। মার্কসের মতানুসারে শ্রেণীসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক অনপনেয় বিরোধিতা। শাসকশ্রেণী অধঃস্তন শ্রেণীসমূহকে অপরিহার্যভাবে এবং সুপরিকল্পিতভাবে শোষণ করে। উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাতের মাধ্যমে এই শোষণ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপাদন হল এক অনিবার্য নিয়ম। পুঁজিপতি শ্রেণীর মুনাফার উৎস হল এই উদ্বৃত্ত-মূল্য। পুঁজিপতি মালিক শ্রেণী শ্রমিকের উপর শোষণ অব্যাহত রেখে উদ্বৃত্ত মূল্য বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করতে থাকে।

অন্তর্নিহিত ও অনপনেয় শ্রেণীসংঘাতের অস্তিত্বের কারণে পুঁজিবাদের অস্থায়িত্ব সম্পর্কে মার্কস আলোচনা করেছেন। আবার তিনি পুঁজিবাদের বিকাশ সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। আর্থনীতিক গভীর সংকটের মধ্যে পুঁজিবাদের পতিত হওয়ার প্রবল প্রবণতার প্রতি তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা চক্রাকারে বিবিধ আর্থনীতিক সংকটের সম্মুখীন হয়। অতি উৎপাদনের সংকট সৃষ্টি হয়। এই সংকটের কারণে অর্থনীতি অনড়-অচল অবস্থায় উপনীত হয়। তার ফলে শ্রমিক ছাঁটাই এবং কর্মহীনতার সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। চক্রাকারে আবর্তিত এই সমস্ত সমস্যা পূর্ববর্তী সংশ্লিষ্ট সমস্যার থেকে প্রতিবারই অধিকতর তীব্র রূপ নেয়। এই ভাবে চলতে থাকলে দীর্ঘকালীন অবস্থায় অনিবার্যভাবে মুনাফার হার হ্রাস পেতে থাকে। এই সংকট তীব্রতর হওয়ার আর একটি কারণ সৃষ্টি হয়। কালক্রমে একচেটিয়া কারবার গড়ে উঠতে থাকে। কারণ মুষ্টিমেয় কিছু শিল্পপতির হাতে মূলধন কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। মূলধনের কেন্দ্রীভবনের এই প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সমাজের অন্যান্য সকল শ্রেণী ক্রমান্বয়ে প্রলেতারিয়েতে পরিণত হতে থাকে। অভিন্ন আর্থনীতিক স্বার্থের কারণে শোষিত সর্বহারা শ্রেণী ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় এইভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ এক সর্বহারা শ্রেণী গড়ে উঠে।

(গ) ধ্রুপদী মার্কসবাদের রাজনীতিক দিক:

মার্কসের মতানুসারে শ্রেণীসংঘাত তীব্রতর হলে সর্বহারা শ্রেণী নিজেদের শোষিত অবস্থা সম্পর্কে অধিকতর সচেতন হয়ে উঠবে। কালক্রমে এই সর্বহারা শ্রেণী একটি বিপ্লবী শক্তিতে রূপান্তরিত হবে। অতঃপর বিপ্লব একটি স্বতঃস্ফুর্ত কার্যক্রমে পরিণত হবে। প্রলেতারিয়েত শ্রেণীই এই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে এবং নিজেদের পরিচালিত করবে। উৎপাদন শক্তিসমূহ ক্রমশ অধিকতর বিকশিত ও উন্নত হতে থাকবে। কারণ নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলশ্রুতি হিসাবে উৎপাদনের প্রক্রিয়া ও কলাকৌশলের উন্নতি সাধিত হবে। এ রকম অবস্থায় উৎপাদন-সম্পর্কসমূহ বা শ্রেণীব্যবস্থা উৎপাদন শক্তিসমূহের অধিকতর বিকাশের পথে প্রতিবন্ধক হিসাবে প্রতিপন্ন হবে। মার্কসের অভিমত অনুযায়ী সে রকম পরিস্থিতিতে সামাজিক বিপ্লবের যুগ আরম্ভ হবে।

মার্কসের মতানুসারে কেবলমাত্র বিষয়গত সহায়ক অবস্থার বিকাশের মাধ্যমে বিপ্লব সংঘটিত হবে না। বিষয়ীগত অনুকূল অবস্থাও আবশ্যক। সর্বহারা শ্রেণীর শ্রেণী সচেতনতা বিপ্লবের বিষয়ীগত উপাদান সরবরাহ করবে। বিষয়গত (objective) ও বিষয়ীগত (subjective) উপাদানসমূহের সমন্বিত উপস্থিতির সুবাদে সামাজিক বিপ্লব সংগঠিত হবে। মার্কসের অভিমত অনুযায়ী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিবিধ বাধা-বিপত্তির মধ্যেও যে সমস্ত দেশে উৎপাদন শক্তি সাধ্যমত বিকশিত হয়েছে, সেই সমস্ত দেশে এই সমস্ত বিপ্লব প্রথম সংঘটিত হবে। মার্কসের ভবিষ্যৎবাণী বা অনুমান অনুযায়ী জার্মানী, ব্রিটেন, বেলজিয়াম ও ফ্রান্সে প্রথম বিপ্লব সংঘটিত হবে।

মানবসমাজের ক্রমবিকাশের ধারা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কস বিবিধ ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। এ সবের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল যে, প্রলেতারীয় বিপ্লবের মাধ্যমে পুঁজিবাদের উৎপাটন বা অবসান অনিবার্য। এই প্রলেতারীয় বিপ্লব অবশ্যই একটি রাজনীতিক বিপ্লব। কারণ এই বিপ্লবের মাধ্যমে শাসক এলিটরা অপসারিত হবে, বিদ্যমান রাষ্ট্রযন্ত্র উৎপাটিত হবে। কিন্তু এটাই সব নয়। রাজনীতিক বিপ্লব ছাড়াও এটি একটি সামাজিক বিপ্লবও বটে। কারণ এই বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনের নতুন উপায় প্রতিষ্ঠিত হবে। চূড়ান্ত পরিণতি হিসাবে এই বিপ্লবের মাধ্যমে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।

প্রলেতারীয় বিপ্লব সম্পর্কিত মার্কসের আলোচনায় প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রই কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মার্কসের আলোচনায় রাষ্ট্র সম্পর্কে দুটি মতবাদ পরিলক্ষিত হয়। প্রথম মতবাদটি কমিউনিস্ট ইস্তেহারে অভিব্যক্ত হয়েছে। বলা হয়েছে যে, আধুনিক রাষ্ট্রের সরকার হল একটি কার্যনির্বাহী কমিটি। এর কাজ হল বুর্জোয়াদের সাধারণ কাজকর্ম সম্পাদন করা। অর্থাৎ প্রকৃত প্রস্তানে রাষ্ট্র সমাজের প্রাধান্যকারী শ্রেণীর হাতে শোষণের হাতিয়ার হিসাবে ভূমিকা পালন করে। এই রাষ্ট্র স্পষ্টত সমাজের উপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্র সম্পার্কিত আর একটি মার্কসীয় মতবাদ অভিব্যক্ত হয়েছে The Eighteenth Brumaire of Louis Bonaparte শীর্ষক রচনায়। এই আলোচনায় মার্কস রাষ্ট্রের ‘আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য’ (relative autonomy)-কে স্বীকার করেছেন। শাসক শ্রেণীর কাছ থেকে রাষ্ট্র এই আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র্য পেয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ভূমিকা হল বিবদমান শ্রেণীসমূহের মধ্যে মধ্যস্থতা করা এবং উদ্দেশ্য হল শ্রেণীব্যবস্থার অস্তিত্বকে অব্যাহত রাখা। রাষ্ট্র কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ভূমিকা পালন করে। প্রলেতারীয় বিপ্লবের উদ্দেশ্য হল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান। স্বভাবতই রাষ্ট্রের উৎপাদনও প্রলেতারীয় বিপ্লবের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও সাম্যবাদী ব্যবস্থার মধ্যে একটি অন্তর্বর্তী পর্যায় হিসাবে মার্কস সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলেছেন। মার্কসের অভিমত অনুযায়ী পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে উত্তরণ আচমকা আসতে পারে না। মধ্যবর্তী স্তরে একটি রূপান্তরমূলক পর্যায় থাকে। এই পর্যায়টি হল সমাজতান্ত্রিক পর্যায়। বিবদমান শ্রেণী ও শ্রেণীসংঘাত যতদিন থাকবে, ততদিন পর্যন্ত এই অন্তর্বর্তী সমাজতান্ত্রিক পর্যায়টি থাকবে। এই পর্যায়ে প্রলেতারিয়েতদের বৈপ্লবিক একনায়কতন্ত্র কায়েম হবে। এই সময় রাষ্ট্র থাকবে। কিন্তু সেই রাষ্ট্র হবে প্রলেতারীয় রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র প্রলেতারীয় বিপ্লবের সুফলগুলিকে সংরক্ষণ করবে এবং ক্ষমতাচ্যুত বুর্জোয়াদের প্রতিবিপ্লবী কাজকর্মকে প্রতিহত করবে।

শ্রেণীভেদ ও শ্রেণীবিরোধ ক্রমশ শিথিল হয়ে আসবে। তারপর সমাজে শ্রেণীব্যবস্থার অবসান ঘটবে। সমাজ হবে শ্রেণীহীন। শ্রেণীহীন সমাজে শ্রেণীশোষণের যন্ত্র রাষ্ট্র অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে এবং রাষ্ট্র উরে যাবে। সম্পূর্ণ সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাম্যবাদী সমাজ হবে শ্রেণীহীন ও রাষ্ট্রহীন।

(২) নিয়মনিষ্ঠ বা গোঁড়া মার্কসবাদ: বলশেভিক মডেল

ধ্রুপদী মার্কসবাদের সঙ্গে বিংশ শতাব্দীর মার্কসবাদের তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। মার্কস এঙ্গেলসের ধ্যান-ধারণা ও অভিপ্রায়ের সঙ্গে বিংশ শতাব্দীর মার্কসবাদ সর্বাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অল্পবিস্তর পার্থক্য দেখা দেয়। বিংশ শতাব্দীতে উদ্ভূত কমিউনিস্ট পার্টিগুলি ধ্রুপদী মার্কসবাদী ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু রাজনীতিক ক্ষমতা দখল করার জন্য এবং অর্জিত রাজনীতিক ক্ষমতাকে রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট কমিউনিস্ট পার্টিগুলি কিছু প্রয়োজনীয় ও পরিবর্তিত উপায়-পদ্ধতি বা কর্মসূচী গ্রহণ করে। এই কারণে বিংশ শতাব্দীর মার্কসবাদকে বলা হয় ‘প্রায়োগিক ক্ষেত্রে মার্কসবাদ’ (Marxism in practice)। সোভিয়েত কমিউনিস্ট মতাদর্শই মার্কসবাদের প্রাধান্যমূলক মডেল হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। কমিউনিস্ট দুনিয়ায় মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ধ্যান-ধারণার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিংশ শতাব্দীতে মার্কসবাদের চেহারা-চরিত্র বহুলাংশে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসের রুশ বিপ্লব ও তার ফলাফলের দ্বারা। কমিউনিস্ট বিশ্বে এই বিপ্লবই হল প্রথম সফল কমিউনিস্ট বিপ্লব। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত কমিউনিস্ট দুনিয়ায় বলশেভিক নেতাদের অবি সংবাদিত প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। এই বলশেভিক পার্টি অনতিবিলম্বে কমিউনিস্ট পার্টি নামে পরিচিত হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে গঠিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবেই স্বীকার করে নেয়। ১৯১৯ সালে ‘কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক’ বা ‘কোমিনটার্ন’ (‘Comintern Communist Interna tional) গঠিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি ‘কোমিনটার্ন’ এ যোগ দেয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মডেলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয় এবং কমিউনিস্ট সরকারের শাসন কায়েম হয়। ১৯৪৫ সালের পরবর্তী কালে পূর্ব ইউরোপে, ১৯৪৯ সালে চীনে, এবং ১৯৫৯ সালে কিউবায় কমিউনিস্ট শাসন কায়েম হয়। সফল অক্টোবর বলশেভিক বিপ্লবের পরবর্তী কালে কমিউনিস্ট দুনিয়ায় মার্কসবাদ-লেনিনবাদের অবিসংবাদিত আধিপত্য কায়েম হয়। এ প্রসঙ্গে কতকগুলি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

(১) কালক্রমে সোভিয়েত কমিউনিস্ট মতাদর্শের ভিত্তিতে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিকাশ ও বিস্তার ঘটে। সোভিয়েত কমিউনিস্ট মতবাদের চেহারা-চরিত্র নির্ধারিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে প্রথম দু-জন বলশেভিক নেতার ব্যক্তিগত অবদানের সুবাদে। এই দুজন বলশেভিক নেতা হলেন লেনিন ও স্তালিন।

(২) শ্রেণীসমূহের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট শাসনের স্থায়িত্ব সংরক্ষণ এবং নিজেদের নিরাপত্তাকে নিরাপদ করার জন্য কমিউনিস্ট শক্তিসমূহ বলপ্রয়োগমূলক উপায়-পদ্ধতি প্রয়োগের সঙ্গে সংযুক্ত ও অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। বিংশ শতাব্দীতে কমিউনিস্ট সরকারগুলিকে ভিতরের এবং বাইরের কমিউনিস্ট বিরোধী শক্তিসমূহের মোকাবিলা করতে হয়। রাশিয়ার বলশেভিক সরকারকে সুদীর্ঘ তিন বছর ধরে গৃহযুদ্ধ সামাল দিতে হয়। এই গৃহযুদ্ধে বলশেভিক শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিল জারপন্থী শক্তিসমূহ। বলশেভিক বিরোধী শক্তিসমূহের সমর্থনে সক্রিয়ভাবে সামরিক অভিযানের সামিল হয়েছিল ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স ও জাপান।

(৩) বিংশ শতাব্দীর মার্কসবাদ যতটা না সামাজিক বা ব্যক্তিগত মুক্তির মতবাদ, তার থেকে অধিকতর আধুনিকীকরণের মতবাদ হিসাবে প্রতীয়মান হয়। এর পিছনে অনিবার্য কারণও ছিল। অনগ্রসরতার পটভূমিতেই নতুন কমিউনিস্ট শাসনগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বভাবতই আর্থনীতিক উন্নয়নের গুরুতর দায়িত্ব নিয়ে সমকালীন কমিউনিস্ট শাসকরা বিশেষভাবে ব্যস্ত ছিলেন। উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ ছিল সদ্য প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট শাসকদের মূল দায়িত্ব।

(৪) বিংশ শতাব্দীর কমিউনিস্ট শাসন প্রকৃত প্রস্তাবে কমিউনিস্ট নেতাদের বা কমিউনিস্ট এলিটদের শাসনে পরিণত হয়। এর পিছনেও কারণ আছে। কার্ল মার্কস অনুমান করেছিলেন যে, পশ্চিম ইউরোপের উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহে প্রথম কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। বাস্তবে কিন্তু তা হয় নি। কমিউনিস্টরা প্রথমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছে রাশিয়া ও চীনের মত পশ্চাদপদ এবং বহুলাংশে গ্রামপ্রধান দেশগুলিতে। শহরে প্রলেতারিয়েত ছিল সংখ্যাগত বিচারে নিতান্তই কম এবং প্রকৃতিগত বিচারে অতিমাত্রায় সহজ সরল। স্বভাবতই একটি সফল শ্রেণীবিপ্লব সংগঠিত ও পরিচালিত করার সামর্থ্য এদের হাতে ছিল না। এ রকম পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের পরিপ্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট এলিট এবং নেতাদের হাতেই সরকার পরিচালনার ক্ষমতা চলে আসে। বস্তুত সংশ্লিষ্ট ঐতিহাসিক অবস্থাই কমিউনিস্ট শাসনের চেহারা-চরিত্র নির্ধারণ করেছে।

(৫) মাকসবাদকে বাস্তবে রূপায়িত করার দায়িত্ব পালন মার্কসকে করতে হয় নি। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর কমিউনিস্ট নেতাদের ঘাড়ে সেই দায়িত্ব এসে পড়ে। স্বভাবতই সমকালীন কমিউনিস্ট নেতাদের মার্কসবাদের প্রায়েগিক বিষয়াদিতে বিশেষভাবে আত্মনিয়োগ করতে হয়। রাজনীতিক সংগঠন, আর্থনীতিক উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব প্রদান প্রভৃতি বিষয়ে বিংশ শতাব্দীর কমিউনিস্ট নেতাদের অধিকতর নজর দিতে হয়েছে।

বিংশ শতাব্দীর অন্তত পঞ্চাশের দশক অবধি কমিউনিস্ট দুনিয়ায় সোভিয়েত কমিউনিস্ট মতাদর্শের অবিসংবাদিত কর্তৃত্ব কায়েম ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের বলশেভিক নেতাদের প্রাধান্য কমিউনিস্ট দুনিয়ায় সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। সমকালীন বিশ্বে সোভিয়েত কমিউনিস্ট মতবাদ হিসাবে যা প্রচলিত ছিল তার পিছনে সর্বাধিক ব্যক্তিগত অবদান ছিল লেনিন ও স্তালিন – এই দুই বলশেভিক নেতার। বিংশ শতাব্দীর নিয়মনিষ্ঠ মার্কসবাদের সম্যক পরিচয় পেতে গেলে লেনিনবাদ ও স্তালিনবাদ সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক।

লেনিনবাদ: ভ্লদিমির ইলিচ লেনিন (Vladimir Ilich lenin) হলেন এক বিশ্ববিশ্রুত রুশ মার্কসবাদী তাত্ত্বিক এবং বিপ্লবী নেতা। তিনি ১৯০৩ সালে রাশিয়ায় বলশেভিক পার্টি গঠন করেন। পরবর্তী কালে ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে রাশিয়ায় প্রথম সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করার ক্ষেত্রে লেনিনের ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে বিধৃত আছে। তারপর আজীবন লেনিন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রব্যবস্থায় সিদ্ধান্তমূলক মর্যাদাযুক্ত ভূমিকা পালন করে গেছেন। লেনিন ছিলেন একাধারে একজন সফল রাজনীতিক নেতা এবং শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক চিন্তাবিদ। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং কমিউনিস্ট পার্টিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে লেনিন বিশেষভাবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।

মার্কস ও এঙ্গেলসের পরবর্তী কালে লেনিন পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে মার্কসবাদকে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও যুগোপযোগী করেছেন। মানব সমাজের বিকাশ সম্পর্কিত মার্কস-এঙ্গেলসের মৌলিক সূত্রগুলিকে লেনিন ব্যাখ্যা ও বিকশিত করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি মার্কসবাদ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হন নি। রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদ ও লেনিনবাদ মিলে মিশে গিয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদে রূপান্তরিত হয়। মার্কসবাদের পূর্বানুবর্তন ও অধিকতর বিকশিত রূপ হল লেনিনবাদ। সাম্রাজ্যবাদের যুগে মার্কসীয় মতাদর্শের তাৎপর্য লেনিনবাদের মধ্যে সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করেছে। স্তালিন (J. V. Stalin) তাঁর Founda tions of Leninsm শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন যে, ‘লেনিনবাদ হল সাম্রাজ্যবাদ ও শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবের যুগের মার্কসবাদ’ (Leninism is Marxism of the era of imperialism and proletarian revolution.”)। স্তালিনের মতানুসারে লেনিনবাদ মার্কসবাদকে পুনরুজ্জীবিত করেছে এবং আরও বিকশিত করেছে; পুঁজিবাদ ও শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কসবাদকে পরিবর্ধিত করেছেন। লেনিনের বক্তব্য অনেক ক্ষেত্রে মার্কসীয় মতবাদের পরিপূরক হিসাবে কাজ করেছে।

লেনিন বিশ্বাস করতেন যে, সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে হবে, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধূলিসাৎ (Smash the state) করে দিতে হবে। লেনিন ছিলেন পুরোপুরি বিপ্লববাদী। মার্কসীয় বিপ্লবী মতাদর্শে তাঁর আস্থা ও বিশ্বাস ছিল প্রশ্নাতীত। সংসদীয় রাজনীতিকে তিনি ধোঁকাবাজি ব্যবস্থা‌ হিসাবে অস্বীকার করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী সংসদীয় রাজনীতি হল বুর্জোয়াদের একটি অপকৌশল। এর উদ্দেশ্য হল প্রলেতারিয়েতদের সামনে প্রতিপন্ন করা যে, নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজনীতিক ক্ষমতা ব্যবহৃত হয়। লেনিনের মতানুসারে শ্রেণীশত্রুদের প্রতিবিপ্লবী আশঙ্কার বিরুদ্ধে বিপ্লবকে সংরক্ষণ করতে হবে। কারণ বুর্জোয়ারা ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়েছে। পুঁজিবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার বাসনা তাদের মধ্যে ছিল। তাদের সে বাসনা পূরণ হয় নি। স্বভাবতই বুর্জোয়াদের দিক থেকে প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা আছে। মার্কসকে অনুসরণ করে লেনিনও বলেছেন যে, পুঁজিবাদের অবসান এবং সম্পূর্ণ সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠা—এই দুয়ের অন্তর্বর্তী সময়ে প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব অপরিহার্য। প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব হল একটি অস্থায়ী অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা। এই কারণে লেনিনের মতানুসারে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে পরেই প্রলেতারীয় বা শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্র গঠিত হবে। অ্যান্ড্রু হেউড (Andrew Heywood) তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “Undoubtedly the most influential Marxist theorist of the twentieth century, Lenin was primarily concerned with the issues of organization and revolution.”

লেনিনবাদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মার্কসীয় তত্ত্বের ভিত্তিতে বিপ্লবী দল গঠন এবং তাকে বিপ্লবী সংগঠনের হাতিয়ারে পরিণত করা। মার্কস বিশ্বাস করতেন যে প্রলেতারিয়েতদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বিপ্লবী শ্রেণীচেতনার সৃষ্টি হবে। লেনিন কিন্তু তা বিশ্বাস করতেন না। লেনিনের মতানুসারে শ্রমিকশ্রেণী বুর্জোয়া বিশ্বাস ও ধারণাসমূহের দ্বারা প্রতারিত হয়। মার্কসবাদী বিশ্লেষণ সম্পর্কে অবহিত থাকার কারণে শ্রমিক শ্রেণী পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে প্রকৃত শ্রেণীশত্রু হিসাবে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়। বরং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই শ্রমিক শ্রেণী তাদের অবস্থার উন্নতি সাধনের ব্যাপারে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করে। মজুরী বৃদ্ধি, শ্রম-সময় হ্রাস, কাজের পরিবেশের উন্নতি সাধন প্রভৃতি বিষয়াদি নিয়ে তারা অধিক আগ্রহ ও উদ্যোগ দেখায়। লেনিনই দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরলেন যে একমাত্র একটি বিপ্লবী দল শ্রমিক শ্রেণীকে ‘শ্রমিক সংঘের সচেতনতা’ (Trade union consciousness)-থেকে ‘বিপ্লবী শ্রেণীসচেতনতায়’ (revolutionary class consciousness) পৌঁছে দিতে পারে। লেনিন রাজনীতিক দলকে শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রণী অংশ, সংগঠিত অংশ ও সর্বোচ্চ শ্রেণীবদ্ধ রূপ হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। বিপ্লবী সংগঠনের জন্য তিনি একটি শক্তিশালী দলীয় সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতানুসারে ক্ষমতা দখলের সংগ্রামে দলীয় সংগঠন ছাড়া প্রলেতারিয়েতের আর কোন অস্ত্র নেই। যে দল সর্বাধিক অগ্রগামী মতবাদের দ্বারা পরিচালিত, একমাত্র সেই দল অগ্রণীর ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। কমিউনিস্ট দলই হবে সেই দলীয় সংগঠন। শ্রমিক শ্রেণীর সর্বাপেক্ষা সচেতন ও সক্রিয় অংশকে নিয়ে এই দল গঠিত হবে। দল হল শ্রমিক শ্রেণীর অবিচ্ছেদ্য অংশ, শ্রমিক শ্রেণীর সর্বশ্রেষ্ঠ সংগঠিত রূপ এবং সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের হাতিয়ার। লেনিন প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের জায়গায় পার্টির একনায়কত্ব কায়েম করেন। দল সম্পর্কিত মার্কস-এঙ্গেলসের ধারণাকে লেনিন অধিকতর বিকশিত করেন। What is to be done?’ ‘Left Wing Communism… A Infantile Disorder’, ‘One Step Forward, Two Steps Back’ প্রভৃতি রচনায় রাজনীতিক দল সম্পর্কে লেনিনের অভিমত অভিব্যক্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিক দলের কার্যাবলী সম্পর্কিত মার্কসীয় ধারণা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যায়।

বিপ্লবে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য অভিজ্ঞ লেনিন একটি পেশাদারী বিপ্লবী গোষ্ঠী গড়ে তোলার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বিপ্লব সম্পর্কিত সংগঠনকে দু-ভাগে ভাগ করেছেন। একটি হল শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠন। একে ট্রেড ইউনিয়ন বলা হয়। অন্যটি পেশাদার বিপ্লবীদের নিয়ে সংগঠিত। এই সংগঠনটি ছোট এবং সুসংহত।

মার্কসের মতানুসারে, বিপ্লব সর্বদাই যে হিংসাত্মক হবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু লেনিনের অভিমত অনুযায়ী প্রলেতারিয়েত বিপ্লব অবশ্যই হিংসাত্মক পথ অবলম্বন করবে। তাঁর যুক্তি হল শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য বুর্জোয়ারা সহিংস বলপ্রয়োগের পথ অবলম্বন করবে। স্বভাবতই শ্রমিক শ্রেণীকেও বিপ্লবে বলপ্রয়োগ করতে হবে। তবে বিপ্লব হিংসা বা ধ্বংসের তাণ্ডব নয়, সৃষ্টির মহোৎসব। লেনিন বলেছেন: “Revolutions are the festivals of the oppressed and the exploited” মেহনতী জনগণ বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন সমাজ গঠনের স্বার্থে সক্রিয় ও সৃজনশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।

শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী অগ্রণী বাহিনী হিসাবে রাজনীতিক দল গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ভিত্তিতে কঠোর নিয়ম-শঙ্খলার দ্বারা সুসংহত হবে। গণতান্ত্রিক নীতি ও কেন্দ্রিকতাবাদের সমাহারে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাবাদের সৃষ্টি হয়েছে। দলের সাংগঠনিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নীতির মূল বিষয় হল যে, নির্বাচন ছাড়া পার্টির কোন সংস্থা গঠিত হবে না। পার্টির নেতা নির্বাচিত হবেন এবং পার্টির নীতি নির্ধারিত হবে। কেন্দ্রিকতাবাদের মূল বিষয় হল যে, নিম্নস্তরের সংস্থাসমূহ অতি অবশ্যই উচ্চতর সংস্থাসমূহের নির্দেশ মান্য করে চলবে। কেন্দ্রীয় নির্দেশ অনুসারে সুশৃঙ্খলভাবে পার্টির গৃহীত সিদ্ধাত্তসমূহ কার্যকর করতে হবে। লেনিনের বক্তব্যকে অনুসরণ করে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতির মূল বিষয়গুলি বিন্যস্ত করা যেতে পারে। (ক) স্থানীয় বা শাখা সংগঠনসমূহ পার্টির মূল সাংগঠনিক একক হিসাবে পরিগণিত হবে। (খ) ঊর্ধ্বতন কমিটিসমূহের সদস্যরা নির্বাচিত হবেন। নির্বাচিত সদস্যদের প্রত্যাহার করে নেওয়া যাবে। নির্বাচকদের কাছে নির্বাচিত সদস্যদের দায়িত্বশীল থাকতে হবে। (গ) পার্টির নীতি নির্ধারণ সংক্রান্ত আলোচনায় সকল সদস্যের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে। (ঘ) পার্টির নীতি ও কর্মসূচী সম্পর্কে সর্বসমক্ষে আলোচনা করা যাবে। (ঙ) পার্টির ঐক্য সংরক্ষণ সাপেক্ষে সর্বস্তরের সদস্যগণ সমালোচনা করার সুযোগ পাবেন। (চ) পার্টির ভিতরে সংখ্যালঘু সদস্যরাও নিজেদের বক্তব্য ব্যক্ত করার স্বাধীনতা পাবেন। (ছ) পার্টির নীতি নির্ধারিত এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর সকল সদস্যকে সে সব বাস্তবায়িত করার ব্যাপারে সক্রিয় হতে হবে। হেউড বলেছেন: “Lenin proclaimed that democratic centralism would achieve ‘freedom of discussion and unity of action”. মার্কসের সময় পুঁজিবাদের একচেটিয়া বিকাশ ঘটেনি। লেনিন পুঁজিবাদ সম্পর্কে মার্কসীয় তত্ত্বের বিশ্লেষণ করেছেন এবং বলেছেন যে, সাম্রাজ্যবাদ হল পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর। সাম্রাজ্যবাদকে তিনি পুঁজিবাদের একচেটিয়া স্তর বলে সংক্ষেপে ব্যক্ত করেছেন (“….imperialism is the monopoly stage of capitalism.”)। লেনিনের মতানুসারে পুঁজিবাদের বিকাশের সর্বোচ্চস্তরের নাম হল সাম্রাজ্যবাদ। এই সর্বোচ্চ স্তরে বা শেষ পর্যায়ে কিভাবে পুঁজিবাদ ধ্বংস হবে তা লেনিনই প্রথম বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন।

বিপ্লবের সূত্রপাতের ব্যাপারে লেনিন দেশ ও কাল সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণাকে বিকশিত ও বাস্তবমুখী করেছেন। তাঁর মতানুসারে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যেখানে যত দুর্বল হবে পুঁজিবাদের ভাঙ্গন সেখানে তত ত্বরান্বিত হবে এবং সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবের পথ প্রশস্ত হবে। পুঁজিবাদের ভাঙ্গন প্রকট হলেই শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হবে। সর্বপ্রথম শিল্পোন্নত দেশেই বিপ্লব সংগঠিত হবে, লেনিন মার্কসীয় দর্শনের এই তত্ত্বকে পরিবর্তিত রূপ দিয়েছেন। লেনিনের অভিমত অনুযায়ী কেবল শিল্পোন্নত দেশেই সর্বহারার বিপ্লব সর্বপ্রথম হবে তা বলা যায় না। যেখানে সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খল সব থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছে সেখানেই বিপ্লব ঘটবে।

শ্রমিক বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসাবে লেনিন প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের ধারণাটি তুলে ধরেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব হল শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এই বিপ্লবের হাতিয়ার হল কমিউনিস্ট পার্টি। লেনিনের মতানুসারে বিপ্লবের পর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের বিলোপ ঘটিয়ে যখন শ্রমিক শ্রেণী রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করবে তখনই প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব হল গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ প্রকাশ এবং মেহনতী মানুষের মিত্রস্বরূপ। প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত মানুষের স্বার্থে পরিচালিত। এই একনায়কত্বে জনসাধারণ সমাজতান্ত্রিক মতে উদ্বুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ হয়। সমাজতান্ত্রিক স্বার্থের বিরোধী সকল রকম পুঁজিবাদী প্রতিবিপ্লবকে ধ্বংস করার জন্য জনসাধারণ সংগঠিত হয়। লেনিন বলেছেন: “The transition from capitalism to Communism is certainly bound to yield…a variety of political forms, but the essence will inevitably be the same: the dictatorship of the proletariat.”

শ্রেণীশত্রুসমূহের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সংরক্ষণের জন্য প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বের অপরিহার্যতার কথা বলা হয়। কার্যক্ষেত্রে এর অর্থ হল কমিউনিস্ট পার্টি ব্যতিরেকে অন্য সকল পার্টির অপসারণ। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পর ১৯২০ সালের মধ্যে রাশিয়ায় একদলীয় ব্যবস্থা কায়েম হয়। অর্থাৎ লেনিনবাদে এক দলীয় একচেটিয়া রাজনীতিক ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। একমাত্র স্বীকৃত রাজনীতিক দলটি হবে কমিউনিস্ট দল। এই কমিউনিস্ট দলের দায়িত্ব হবে প্রলেতারিয়েতের স্বার্থসমূহকে বিকশিত করা এবং চূড়ান্ত লক্ষ্যের অভিমুখে বিপ্লবকে পরিচালিত করা। এই চূড়ান্ত লক্ষ্যটি হল সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত করা। তা ছাড়া এই কমিউনিস্ট পার্টিই হবে শাসক পার্টি এবং কমিউনিস্ট রাষ্ট্র—এই দুইয়ের রাজনীতিক কর্তৃত্বের উৎস। সরকার এবং সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই কমিউনিস্ট পার্টিই হবে নেতৃত্ব প্রদানকারী পথপ্রদর্শক।

মার্কস ব্যস্ত ছিলেন তত্ত্ব নিয়ে, কিন্তু লেনিনের ব্যস্ততা তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে। মার্কসীয় তত্ত্বের ভিত্তিতে লেনিন একটি সুসংহত বৈপ্লবিক মতবাদ গঠন করেছেন। ‘মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দর্শনের মূলকথা (The Fundamentals of Marxist-Leninist Philosophy) শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছে: “Lenin devel oped Marxism in the new historical conditions, in the epoch of capitalism’s development into its final imperialist stage, the epoch that was to see the emergence of the new socialist society.” গোঁড়া কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে সংগঠিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সমস্ত কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে কমিউনিস্ট পার্টিই হল একমাত্র স্বীকৃত রাজনীতিক দল এবং শাসক দল। এই কমিউনিস্ট পার্টিই হল যাবতীয় রাজনীতিক ক্ষমতা এবং মতাদর্শগত প্রজ্ঞার একচেটিয়া অধিকারী। অ্যান্ড্রু হেউড এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “Orthodox communist states, modelled on the principles of Marxism-Leninism, should therefore invest their ruling communist parties with entrenched political power and a monopoly of ideological wisdom.”

স্তালিনবাদ (Stalinism): রূশ বিপ্লবী স্তালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের এক ইতিহাসখ্যাত নেতা। লেনিনের জীবনাবসানের পর সোভিয়েত ইউনিয়নে এক ধরনের একনায়কতন্ত্রী কঠোর কঠিন প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করেন। স্তালিনের আমলে ব্যাপক সন্ত্রাস ও ব্যক্তিপূজার রাজত্ব কায়েম হয়। তিনি বই লিখেছেন অনেক। কিন্তু স্তালিনকে মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হিসাবে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া যায় না। স্তালিনবাদ বলতে যা বোঝায় তা যতটা না মতাদর্শগত বিষয়, তার থেকে অধিক স্বাতন্ত্র্যামূলক রাজনীতিক আর্থনীতিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিষয়। ‘একদেশীয় সমাজতন্ত্র’ (Socialism in one Country?) শীর্ষক নীতিটিই হল স্তালিনের মতাদর্শগত ঐতিহ্যের ভিত্তি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পায়ন ও যৌথ মালিকানা ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। এ রকম আর্থ রাজনীতিক ব্যবস্থাকে সমর্থন করার কারণ হিসাবে পুঁজিবাদী বেষ্টনির অস্তিত্ব এবং রাশিয়ার সম্পত্তিবান কৃষকদের (কুলাক) উৎসাদনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। স্তালিনবাদী ধারণায় শ্রেণীযুদ্ধ সম্পর্কিত আধা-মার্কসবাদী ধারণার সঙ্গে রুশ জাতীয়তাবাদের প্রতি আবেদনকে সংযুক্ত করা হয়েছে। যাইহোক লেনিনের মত স্তালিনের শাসনও সোভিয়েত কমিউনিস্ট মতবাদকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। লেনিনের ১৯১৭ সালের ‘অক্টোবর বিপ্লবের’ মত স্তালিনের ১৯৩০-এর দশকের দ্বিতীয় বিপ্লব’ (second revolution) সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট শাসনের ইতিহাসে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

আর্থনীতিক স্তালিনবাদ বলতে বাস্তবে ‘রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র’ (State socialism) বা রাষ্ট্রীয় যৌথ মালিকানা ব্যবস্থাকে বোঝায়। স্তালিনবাদী ব্যবস্থায় পুঁজিবাদী বাজার আর্থনীতিক ব্যবস্থাকে পুরোপুরি অপসারিত করা হয়। তার জায়গায় গ্রহণ করা হয় একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ব্যবস্থা। এই কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ব্যবস্থার জন্য গঠন করা হয় ‘রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা কমিটি’ (State Planning Committee)। এই ‘রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা কমিটি’ ‘গসপ্ল্যান’ (Gosplan) নামে পরিচিত। মস্কোস্থিত প্রভূত শক্তিশালী আর্থনীতিক মন্ত্রকসমূহের হাতে ‘রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা কমিটি’র প্রশাসনিক দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। ১৯২১ সালে লেনিন ‘নতুন আর্থনীতিক নীতি’ (New Economic Policy) গ্রহণ করেন। লেনিনের এই আর্থনীতিক নীতির ভিত্তিতে সোভিয়েত ইউনিয়নে মিশ্র আর্থনীতিক ব্যবস্থা বিকশিত হয়। তদনুসারে কৃষি ও ক্ষুদ্রশিল্পসমূহ ব্যক্তিগত মালিকানাধীনে থাকে। রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন রাখা হয় দেশের উচ্চতর আর্থনীতিক ব্যবস্থাসমূহকে। এই সমস্ত আর্থনীতিক ব্যবস্থাগুলিকে লেনিন ‘commanding heights of the economy’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। স্তালিন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চালু করেন। স্তালিনবাদের পরিকল্পিত অর্থনীতির সুবাদে সোভিয়েত ইউনিয়নে দ্রুত শিল্পায়নের প্রক্রিয়ার সূত্রপাত ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় ব্যক্তিগত আর্থনীতিক উদ্যোগসমূহের সম্পূর্ণ উৎসাদন সম্পাদিত হয়। ১৯২৯ সাল থেকে কৃষিকে যৌথ মালিকানাধীনে নিয়ে আসা হয়। এই কৃষি অর্থনীতিক ব্যবস্থায় কৃষকরা তাদের জমির মালিকানা হারায়। রাষ্ট্রীয় বা যৌথ মালিকানাধীন কৃষিব্যবস্থায় কৃষকদের যোগদানে বাধ্য করা হয়। কৃষি অর্থনীতিতে এই পরিবর্তন প্রক্রিয়া। হাজার হাজার কৃষকের মৃত্যু হয়। হেউড এ বিষয়ে বলেছেন: “After consolidating himself in power….stalin oversaw a dramatic economic and political upheaval, commencing with the announcement of the first Five Year Plan in 1928.”

স্তালিন ও র‍্যাডিক্যাল মার্কসবাদ সম্পর্কে বেটেলহেইম (C. Bettelheim) বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন তাঁর ‘Class Struggles in the USSR, Second Period, 1923-30 শীর্ষক গ্রন্থে। বেটেল হেইম-এর অভিমত অনুযায়ী বলশেভিজম তথা স্তালিনবাদ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতেই প্রকাশ্যে এসেছে। এ কথা ঠিক। কিন্তু এই রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানীর মতানুসারে স্তালিনবাদ হল সোভিয়েত রাষ্ট্রীয় মতবাদ। কিন্তু এই মতবাদ বিপ্লবী মার্কসীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। স্তালিনবাদী বক্তব্যসমূহের মধ্যে বেটেলহেইম বিশেষ কিছু উপস্থাপনাকে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী এই সমস্ত স্তালিনীয় ধ্যান ধারণা ধ্রুপদী মার্কসীয় ঐতিহ্যের অনুসারী নয়। এই সমস্ত স্তালিনীয় ধারণাগত উপস্থাপনা ১৯২৫-‘২৬ সালের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রব্যবস্থায় এবং সমাজতন্ত্র নির্মাণের কর্মকাণ্ডে প্রযুক্ত হতে দেখা যায়।

স্তালিনবাদে ‘এক দেশীয় সমাজতন্ত্র’ (Socialism in One Country)-এর নীতিকে স্বীকার ও সমর্থন করা হয়েছে। একটি দেশে সমাজতন্ত্র নির্মাণের নীতিকে প্রথম বিকশিত করেছেন বুখারিন (Bukharin)। সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই নীতিটি ১৯২৪ সালে ঘোষণা করা হয়। বলা হয় যে, আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়াই একটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হতে পারে এবং সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ কার্য পরিচালিত হতে পারে। কোন একটি দেশে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকার্য সম্পাদনের জন্য আন্তর্জাতিক বিপ্লব অপরিহার্য নয়। এ বিষয়ে স্তালিনের এই তাত্ত্বিক অবস্থান, তার ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী টটস্কি (Tortosky) র মতাদর্শগত অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রকৃত প্রস্তাবে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শগত অবস্থান থেকে স্তালিন এ ক্ষেত্রে অনেকাংশে সরে এসেছেন। ধ্রুপদী মার্কসবাদে এবং লেনিনবাদেও আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রতি অঙ্গীকার সুবিদিত।

আর্থনীতিক স্তালিনবাদের সুবাদে রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রবাদ কায়েম হয়। একে বলা হয় সোভিয়েত রাশিয়ার ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ (Second revolution)। এই দ্বিতীয় বিপ্লব বা আর্থনীতিক স্তালিনবাদের ফলশ্রুতি হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ বিবিধ রাজনীতিক পরিবর্তন সূচিত হয়।

রাজনীতিক স্তালিনবাদ একচ্ছত্রবাদী বা সামগ্রিকতাবাদী একনায়কতন্ত্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। সর্বক্ষমতাসম্পন্ন শাসক পার্টির মাধ্যমে স্তালিনবাদী সর্বাত্মক একনায়কতন্ত্র কার্যকর হয়। সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যাবতীয় সমালোচনা ও বিতর্ককে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। তার ফলে পার্টির বিরুদ্ধেই গৃহযুদ্ধ দেখা দিয়েছিল।

রাজনীতিক স্তালিনবাদের প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার ফলে লেনিনবাদী গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতিতে ব্যাপক ও মৌলিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতায় গণতন্ত্র হ্রাস পেতে থাকে এবং কেন্দ্রিকতাই ক্রমশ বড় হয়ে দেখা দিতে থাকে। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং কেন্দ্রীয়ভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। পার্টির নেতৃবর্গ অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে পড়েন। কারণ পৃষ্টপোষকতা ও পদোন্নতি সম্পর্কিত বিষয়াদির নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা পার্টির নেতাদের হাতেই থাকে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে স্তালিন তাঁর ক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিলেন। এই পথে তিনি পর্যাপ্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। প্রকৃত প্রস্তাবে পার্টির সাধারণ সম্পাদকের ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহারের মাধ্যমে স্তালিন প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হন। পার্টির মধ্যে তিনি তাঁর অন্ধ সমর্থকদের উচ্চপদে এবং প্রভাবশালী কর্তৃত্বমূলক পদে নিযুক্ত করেন। পার্টির বিভিন্ন পর্যায়ের আধিকারিক ও কর্মীদের নিম্নস্তর থেকে নির্বাচিত করা হত না এবং উপরতলা থেকে তাদের নিযুক্ত করা হত। এই নিয়োগ ব্যবস্থা ‘nomenklatura’ নামে পরিচিত ছিল।

বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে প্রবল পরাক্রমশালী স্তালিন নৃশংস-নিষ্ঠুরভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। আনুগত্যের অভাব বা সমালোচনাজনিত কারণে সন্দেহভাজন যে কোন ব্যক্তিকে অপসারিত করার প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে চলতে থাকে। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিতে অবাঞ্ছিত ব্যক্তিবর্গকে বিমুক্ত করার প্রয়াসে • সিক্রেট পুলিশ (NKVD) ক্রমবৰ্দ্ধমানভাবে হিংসাত্মক উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করে। দশ লক্ষাধিক মানুষের জীবনাবসান ঘটে। লেনিনের আমলের পলিটব্যুরোর তখনও জীবিত সকল সদস্যের ভাগ্যেও একই পরিণতি ঘটে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে শ্রমশিবির (Gulags’–Lafbour camp)-এ অন্তরীণ করে রাখা হয়। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যসংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে।

(৩) আধুনিক মার্কসবাদ

ধ্রুপদী মার্কসবাদ বা মার্কস-এঙ্গেলসের মার্কসবাদ কালক্রমে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হিসাবে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। অতঃপর পূর্ব ইউরোপের এবং অন্যত্র কমিউনিস্ট শাসিত দেশগুলিতে নিয়মনিষ্ঠ বা গোঁড়া মার্কসবাদ ধর্মনিরপেক্ষ ধর্মের চেহারায় আত্মপ্রকাশ করে। নিয়মনিষ্ঠ বা গোঁড়া মার্কসবাদ মার্কসবাদের বলশেভিক মডেল হিসাবে পরিচিত। পশ্চিম ইউরোপে অপেক্ষাকৃত অস্পষ্ট এবং জটিল প্রকৃতির মার্কসবাদ বিকশিত হতে দেখা যায়। এই তৃতীয় ধরনের মার্কসবাদ আধুনিক মার্কসবাদ বা নয়া মার্কসবাদ বা পশ্চিমী মার্কসবাদ হিসাবে পরিচিত। এ হল মার্কসবাদের ধ্রুপদী ধারণাসমূহকে পরিশীলিত করার প্রয়াস। মার্কসীয় মতাদর্শের কতকগুলি মৌলিক বিষয়াদির এবং প্রক্রিয়া পদ্ধতির প্রতি আস্থা অব্যাহত রেখে আধুনিক মার্কসবাদে মার্কসীয় সাবেকি ধারণাসমূহকে পুনঃপরীক্ষাপূর্বক সংশোধন বা পুনর্নির্মাণের ব্যাপারে উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করা হয়। মার্কসবাদের আধুনিক ভাষ্যের পিছনে কতকগুলি বিষয় বিশেষভাবে বিবেচনা করা দরকার।

গোঁড়া মার্কসবাদের বলশেভিক মডেল আধুনিক মার্কসবাদীদের সামনে প্রবল প্রতিরোধ হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। আধুনিক মার্কসবাদীরা গোঁড়া মার্কসবাদের কর্তৃত্বমূলক এবং পীড়নমূলক প্রকৃতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। তা ছাড়া বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ হিসাবে প্রতিশ্রুতির অতিঅহঙ্কার এবং অধিযান্ত্রিক প্রকৃতি সম্পর্কিত গোঁড়া মার্কসবাদীদের ভনিতা থেকে আধুনিক মার্কসবাদীরা সরে এসেছেন।

‘ভিত্তি-উপরিসৈাধ’-কে অতিক্রম: গোঁড়া মার্কসবাদী ভাষ্যে ভিত্তি-উপরিসৌধ (base superstructure) সম্পর্কিত ব্যাখ্যা একটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়। সনাতন মার্কসীয় দর্শন হল বস্তুবাদী দর্শন। তদনুসারে বলা হয় যে, আর্থনীতিক ভিত্তি বা বিষয়াদির দ্বারা মানবজীবনের যাবতীয় বিষয় নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। আধুনিক মার্কসবাদীরা বনিয়াদ-উপরিকাঠামো সংক্রান্ত মার্কসীয় ধারণাকে সর্বাংশে স্বীকার বা সমর্থন করেন না। আধুনিক মার্কসবাদে অর্থনীতি ও রাজনীতির পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া (interaction) -এর উপর জোর দেওয়া হয়। জীবনের বস্তুগত পরিস্থিতি-পরিমণ্ডল এবং নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণে মানুষের সামর্থ্য – এই দুয়ের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উপরও আধুনিক মার্কসবাদীরা গুরুত্ব আরোপ করেন। স্বভাবতই তাঁরা বনিয়াদ-উপরিকাঠামোর মার্কসীয় মতবাদকে কঠোরভাবে অনুসরণ করার পক্ষপাতী নন। মানব সমাজের আলোচনায় আধুনিক মার্কসবাদীরা ভিত্তি-উপরিসৌধের সীমানাকে অতিক্রম করে যাওয়ার পক্ষপাতী।

পুঁজিবাদের পতনের অনিবার্যতা নিয়ে সংশয়: সনাতন মার্কসবাদের আর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল পুঁজিবাদের পতনের অনিবার্যতা। মার্কস ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অবসান অনিবার্য। কিন্তু কার্ল মার্কসের এই ভবিষ্যৎবাণী সঠিক প্রমাণিত হয় নি; পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পতন ঘটে নি। এ রকম এক তাত্ত্বিক সংকটের সম্মুখীন হয়ে আধুনিক মার্কসবাদীরা শ্রেণীসম্পর্কিত প্রচলিত মার্কসবাদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পুনরীক্ষণের ব্যাপারে আত্মনিয়োগ করেন। হেগেলীয় ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে আধুনিক মার্কসবাদীরা অধিকতর আগ্রহ প্রদর্শনের পক্ষপাতী। নয়া মার্কসবাদীরা মানুষকে নৈর্ব্যক্তিক বস্তুগত শক্তিসমূহের হাতের পুতুল হিসাবে প্রতিপন্ন করার পক্ষপাতী নন। তাঁরা মানুষকে ইতিহাসের রূপকার ও নিয়ন্তা হিসাবে দেখার পক্ষপাতী। আধুনিক মার্কসবাদী আলোচনায় এ কথাও বলা হয় যে, মার্কসের প্রথম দিক্কার রচনাসমূহে স্রষ্টা হিসাবে মানুষের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠী: বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে এবং সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে নয়া বামপন্থী তাত্ত্বিকদের উত্থান পরিলক্ষিত হয়। এই শ্রেণীর মার্কসবাদী চিন্তাবিদরা সোভিয়েত মডেলের রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রবাদকে বাতিল করে দেন। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পশ্চিমী সামাজিক গণতন্ত্রের সংস্কার বিরোধিতাকেও তাঁরা বাতিল করে দেন। আধুনিক মার্কসবাদীদের উপর বিভিন্ন প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তাঁরা তরুণ মার্কসের রচনাবলীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে নৈরাজ্যবাদ এবং র‍্যাডিক্যাল ‘ফিনোমিনোলজি’ (phenom enology) ও এগজিসটেনসিয়ালিজম (existentialism) -এর দ্বারাও তাঁরা প্রভাবিত হন। তার ফলে আধুনিক মার্কসবাদী আলোচনা বিশেষভাবে পরিব্যাপ্ত এবং অনেকাংশে অসংহ ও বিক্ষিপ্ত। নয়া বামপন্থী মতবাদের কথা বলতে গিয়ে অ্যান্ড্রু হেউড বলেছেন: “Common themes nevertheless included the rejection of conventional society-‘the system’-as oppressive, disillusionment with the working class as the agent of revolution, a commitment to personal autonomy and self-fulfilment in the form of ‘liberation’, and a preference for decentralization and participatory democracy.” ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠী (Frankfurt School) নামে পরিচিত এক দল রাজনীতিক সমাজবিজ্ঞানী খোলাখুলিভাবে হেগেলীয় ধাঁচের মার্কসবাদকে বিকশিত করেছেন। এই শ্রেণীর মার্কসবাদীদের মতবাদ সমালোচনামূলক মতবাদ (critical theory)। ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠীর মার্কসবাদের মধ্যে মার্কসীয় রাজনীতিক অর্থনীতি, হেগেলীয় দর্শন ও ফয়েডীয় মনস্তত্ত্বের এক অভিনব সংমিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়। এই ধারার মার্কসবাদী ধ্যান-ধারণা তথাকথিত নয়া বামপন্থী চিন্তাধারাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠীর আধুনিক মার্কসবাদীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ম্যাক্স হরখেইমার (Max Harkheimer), থিওডোর অ্যাডরনো (Theodor Adorno) এবং হারবার্ট মারকুইজ (Herbert Marcuse)। জার্মান রাজনীতিক দার্শনিক মারকুইজ এক প্রকারের নয়া-মার্কসবাদকে বিকশিত করেন। শীর্ষস্থানীয় নয়া বামপন্থী চিন্তাবিদ এবং সমকালীন ছাত্র আন্দোলনের পথপ্রদর্শক হিসাবে তিনি বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে বিশেষ পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। হেগেলীয় ও ফ্রয়েডীয় ধ্যান-ধারণার উপর মারকুইজ বিশেষভাবে নির্ভর করেছেন। মারকুইজ উন্নত শিল্পসমাজ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। এ ধরনের সমাজ হল এক সর্বাত্মক পীড়নমূলক ব্যবস্থা। এ রকম পীড়নমূলক সমাজব্যবস্থায় যুক্তি ও বিতর্ককে দাবিয়ে দেওয়া হয় এবং সকল রকম বিরোধিতাকে গিলে ফেলা হয়। এই অবস্থাকে মারকুইজ বলেছেন ‘পীড়নমূলক সহিষ্ণুতা’ (repressive tolerance)। এ রকম একমাত্রিক সমাজব্যবস্থায় পীড়নমূলক অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের উপায় হিসাবে মারকুইজ ব্যক্তিগত ও লিঙ্গগত স্বাধীনতার কথা বলেছেন। এ বিষয়ে তিনি বহুলাংশে কল্পনাশ্রয়ী সম্ভাবনার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বৈপ্লবিক শক্তি হিসাবে তিনি শ্রমিক শ্রেণীর উপর ভরসা করেন নি; ভরসা করেছেন বিভিন্ন গোষ্ঠীর উপর। এ রকম গোষ্ঠীর উদাহরণ হিসাবে তিনি ছাত্র, সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী, নারীজাতি, শ্রমিকগোষ্ঠী প্রভৃতির কথা বলেছেন। তৃতীয় বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এ কথা বলেছেন।

পশ্চিম ইউরোপীয় মার্কসবাদী চর্চার মাধ্যমে প্রচলিত মার্কসবাদী অনুশীলনের বিকল্প অবস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ-আয়োজন পরিলক্ষিত হয়। এই ধারার মার্কসবাদী চিন্তাবিদদের মধ্যে -জনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁরা হলেন অ্যন্টোনিয়ো গ্রামশি (Antonio Gramsci) এবং জর্জ লুকাশ (Georg Lukacs)। তাঁরা ঐতিহাসিক বস্তুবাদী পদ্ধতির দৃষ্টবাদী বিজ্ঞান হিসাবে বিকশিত হওয়ার বিরুদ্ধে মার্কসবাদী রাজনীতি অনুশীলনের পৃথক এক তাত্ত্বিক প্রেক্ষিতের সূত্রপাত করেন।

অ্যান্টোনিয়ো গ্রামশি: গ্রামশি তাঁর Prison Notebooks শীর্ষক রচনায় ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সম্পর্কিত বুখারিনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সমালোচনা করেছেন বিস্তারিতভাবে। এই সমালোচনামূলক আলোচনার সুবাদে প্রচলিত মার্কসবাদী অনুশীলনের বিবিধ তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অল্পবিস্তর অবহিত হওয়া যায়। এই সমালোচনামূলক আলোচনা থেকে মার্কসীয় রাজনীতি চর্চা সম্পর্কিত গ্রামশির ব্যক্তিগত ধ্যান-ধারণা ও অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে কিছু কিছু জানা যায়। আবার মার্কসবাদের বলশেভিক মডেলের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও অবহিত হওয়া যায়।

গ্রামশির অভিমত অনুযায়ী বুখারিন ঐতিহ্যসমৃদ্ধ উচ্চমার্গীয় দর্শন চিন্তা নির্বাক-নিরেট সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষজনের দৈনন্দিন জীবনধারার সঙ্গে এই সমস্ত উচ্চ বুদ্ধিচর্চা সম্পর্করহিত। এ রকম উচ্চবুদ্ধিচর্চা বা উচ্চ দর্শন চিন্তার চাপে সাধারণ ব্যক্তিবর্গের বা নিম্নবর্গীয় মানুষজনের একেবারে নিজেদের চিন্তাভাবনার অভিব্যক্তির সুযোগ-সুবিধা অনুপস্থিত। গ্রামশির অভিমত অনুযায়ী নিম্নবর্গীয় মানুষজনের উপর উচ্চমার্গীয় বুদ্ধিচর্চার এ রকম আধিপত্য শাসকগোষ্ঠীর কর্তৃত্বের সামিল। তাঁর মতানুসারে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অনুশীলন হল এক জটিল ও প্রলম্বিত সাংস্কৃতিক সংগ্রামের অনুশীলন। নিম্নবর্গীয় মানুষজনের জীবনধারা, মূল্যবোধ, ধর্মবোধ, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দুনিয়া জটিল ও বিচিত্র প্রকৃতির। এ সবের অনুপুঙ্খ অনুশীলন আবশ্যক। আবার সদর্থক বিরোধী উপাদানসমূহের সঞ্জীবনের সম্ভাবনাও অনুশীলন করা আবশ্যক। এই সমস্ত বিষয়কে নিয়েই বিপ্লবী রাজনীতির উপজীব্য বিষয়াদি গড়ে উঠবে। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া উচ্চমার্গীয় দর্শনচিন্তার অনুশীলন নয়; নিম্নবর্গীয়দের প্রাত্যহিক জীবনধারা, তাদের জীবনধারাগত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান-বুদ্ধি প্রভৃতির পর্যায় থেকেই বিপ্লবী রাজনীতির অনুশীলন আরম্ভ হওয়া আবশ্যক।

সমাজতাত্ত্বিক পদ্ধতি হিসাবে ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে প্রতিপন্ন করার প্রয়াসকে গ্রামশি স্বীকার বা সমর্থন করেন নি। তাঁর অভিযোগ অনুযায়ী বুখারিন যে ঐতিহাসিক বস্তুবাদী সমাজতত্ত্ব তুলে ধরেছেন, তা কার্যত এক প্রকার বিবর্তনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টিতে সাহায্য করে। তার ফলে উচ্চবর্গীয় বুদ্ধিজীবীরাই সামাজিক বিবর্তন সম্পর্কিত ভবিষ্যৎবাণী করার ব্যাপারে অগ্রাধিকার অর্জন করেন। ইতিহাসের বস্তুবাদী বিজ্ঞান প্রকৃতিবিজ্ঞানের মানদণ্ডে সর্বশক্তিমান অমোঘ সত্য হিসাবে প্রতীয়মান হয়। এই তাত্ত্বিক অবস্থানের বিরোধিতা করেছেন গ্রামশি। তাঁর মতানুসারে এই মতবাদ অবক্ষয়মূলক। কারণ এই মতবাদ অনুযায়ী সমগ্র সমাজ ও ইতিহাস অনুশীলনকে একটি যান্ত্রিক সাধারণ সংকেত সূত্রের মধ্যে বেঁধে ফেলা হয়। তার ফলে স্বাভাবিকভাবে সমগ্র সমাজ ও ইতিহাস চর্চা প্রতিভাবান মুষ্টিমেয় ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণাধীনে চলে আসে।

প্রচলিত ধারার মার্কসবাদীরা প্রকৃতি বিজ্ঞানের নিরিখে ইতিহাসের নিয়মানুগ বিজ্ঞান ও কার্যকারণবাদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের উপর বিশেষভাবে আস্থাশীল। কিন্তু এর বিরোধিতা করে গ্রামশি বলেছেন যে, মানুষজনের প্রাত্যহিক জীবনধারার অনুশীলন এবং মানুষের চেতনার জগতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে পূর্ব নির্ধারিত ছক অনুসারে সাজানো যায় না। সাধারণ মানুষজনের বা নিম্নবর্গীয়দের প্রাত্যহিক জীবনধারা ও তাদের ধ্যান ধারণার দুনিয়াটাই মার্কসবাদের ভিত্তি হওয়া আবশ্যক। নিয়মনিষ্ঠ মার্কসবাদী ভাষ্য অনুযায়ী ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সূত্রসমূহ অনড়-অনিবার্য এবং সর্বব্যাপী। এর এদিক-ওদিক হতে পারে না। এই ধারণাকে গ্রামশি ঐতিহাসিক অতীন্দ্রিয়বাদ হিসাবে অভিযুক্ত করেছেন। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ নিষ্ক্রিয় নিয়তিবাদের সহায়ক। এ হল সমাজ-ইতিহাসকে পূর্বনির্দিষ্ট অগ্রগতির সূত্র ধরে গড়ে পিঠে নেওয়ার মতলব। নিয়মনিষ্ঠ মার্কসবাদীরা ‘বিষয়গত বাস্তবতা’ (objective reality)-র উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। কিন্তু গ্রামশির অভিমত অনুযায়ী মানুষের প্রাত্যহিক জীবনধারা, নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও ধ্যান-ধারণা, জীবনবোধ প্রভৃতির বাইরে পৃথকভাবে বিষয়গত বাস্তবতা হতে পারে না। সমাজস্থ ব্যক্তিবর্গের বা মানুষের জীবনচর্চার অভিজ্ঞতাকে আড়াল করে বা বাদ দিয়ে বস্তুগত বাস্তব দুনিয়ার ধারণা অপ্রাসঙ্গিক।

গ্রামশির অভিমত অনুযায়ী শ্রেণীব্যবস্থার পিছনে অসম আর্থনীতিক ও রাজনীতিক কারণ কাজ করে। কিন্তু এটাই সব নয়। অন্যান্য বিষয়ও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। বুর্জোয়া নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব, শাসকশ্রেণীর আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক প্রাধান্য প্রভৃতিও এ ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। বুর্জোয়া মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের বিস্তারের মাধ্যমে বুর্জোয়াদের কর্তৃত্ব ও শাসকশ্রেণীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। গণমাধ্যমসমূহ, যুব আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রভৃতি বুর্জোয়া বা শাসক শ্রেণীর মূল্যবোধের ও বিশ্বাসসমূহের বিকাশ ও বিস্তারে সাহায্য করে। হেউড এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “Antonio Gramsci drew attention to the degree to which the class system is upheld not simply by unequal economic and political power but also by bourgeois ‘hegemony’, the spiritual and cultural supremacy of the ruling class, brought about through the spread of bourgeois values and beliefs via civil society….”

জর্জ লুকাশ: হাঙ্গেরিয়ার মার্কসবাদী চিন্তাবিদ লুকাশ প্রচলিত মার্কসবাদের রাজনীতিক অর্থনীতির আলোচনার উপর অধিক জোর দেন নি। বরং হেগেলীয় মতাদর্শের যে সকল প্রত্যয় মার্কস বিভিন্ন রচনায় বেশী ব্যবহার করেছেন, লুকাশও সেই সমস্ত প্রত্যয়কে প্রয়োগ করেছেন। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে পণ্যপূজা, মতাদর্শ বা আত্মবিচ্যুতি প্রভৃতির কথা বলা যায়। লুকাশ বুখারিনের মত মার্কসীয় পদ্ধতিকে সমাজ্যবিদ্যায় পরিণত করার পক্ষপাতী ছিলেন না। বুখারিনের সমালোচনা করে তিনি বলেছেন মার্কসবাদী আলোচনাকে সমাজবিদ্যামূলক আলোচনায় রূপান্তরিত করার উদ্যোগ প্রকৃতিবিজ্ঞানের অন্ধ অনুকরণের সামিল। এ প্রসঙ্গে লুকাশ এঙ্গেলসের তাত্ত্বিক অবস্থানেরও সমালোচনা করেছেন। এঙ্গেলসের অভিমত অনুযায়ী প্রকৃতি ও সমাজ উভয় ক্ষেত্রেই দ্বন্দ্বতত্ত্ব সমভাবে প্রযোজ্য। স্বভাবতই এঙ্গেলসের কাছে প্রকৃতি ও সমাজের বিকাশের ধারা অভিন্ন। এঙ্গেলসের এই তাত্ত্বিক অবস্থানকে লুকাশ স্বীকার বা সমর্থন করেন নি। লুকাশের মতানুসারে এই ধারণা মার্কসীয় দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লুকাশ বলেছেন যে, প্রকৃতি ও সমাজকে একাকার করে দেখলে মানব ইতিহাস ও তার চৈতন্যের পৃথক গুরুত্বকে অস্বীকার করা হয়। কিন্তু লুকাশ মনে করেন যে, বিষয়-বিষয়ী (subject-object) ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বা মিথষ্ক্রিয়া (Interaction) এবং তত্ত্ব ও প্রয়োগের ঐক্য হল দ্বন্দবাদের মূল ক্ষেত্র। প্রকৃতির দুনিয়ায় এর অস্তিত্ব অমিল। এই তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে লুকাশ তাঁর History and Class Connections শীর্ষক রচনায় এঙ্গেলসের Anti Duhring এর বিরূপ সমালোচনা করেছেন। প্রথমে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে মার্কসীয় দর্শনের অভিব্যক্তি পরিলক্ষিত হয়। তবে পরবর্তী কালে তা সমগ্র শ্রমিক শ্রেণীর চৈতন্যে রূপান্তরিত হয় শ্রমিক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে। ঐতিহাসিকভাবে বিষয়ী-বিষয় (subject-object) প্রতিপন্ন হয় শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যেই। ইতিহাসের রূপান্তর চূড়ান্তভাবে সম্পাদিত হয়। শ্রমিক শ্রেণীর চৈতন্যের বৌদ্ধিক অভিব্যক্তি হল মার্কসবাদ। তবে শ্রমিক শ্রেণীর চৈতন্য একমাত্রিক না হয়ে বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। একমাত্র শ্রমিক শ্রেণীই পারে ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াকে সম্যকভাবে অনুধাবন করতে। স্বভাবতই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণীর অস্তিত্ব ও অবস্থান ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত।

মানবতাবাদী দর্শন হিসবে মার্কসবাদকে প্রতিপন্ন করার ক্ষেত্রে জর্জ লুকাশ একটি বিশিষ্ট নাম। লুকাশের মতানুসারে পুঁজিবাদ শ্রমিকদের বাজারের পণ্যে পরিণত করে এবং এই প্রক্রিয়ায় তাদের মনুষ্যোচিত গুণাবলী থেকে বিচ্যুত করে। মার্কসীয় দৃষ্টবাদের বিরুদ্ধে লুকাশের অবস্থানের পিছনে কাজ করেছে ফেনোমেনোলজি (Phenomenology)। সমসাময়িক কর্শ এবং পরবর্তী কালে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল এ বিষয়ে অনুরূপ অবস্থান গ্রহণ করেছেন। লুকাশ মার্কসের উপর হেগেলীয় প্রভাবের কথা বলেছেন এবং মানব চৈতন্য ও সমাজ-সংস্কৃতির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের উপর জোর দিয়েছেন। এ বিষয়ে অ্যান্ড্রু হেউড বলেছেন: “George Lukacs was one of the first to prevent Marxism as a humanistic philosophy, emphasizing the process of ‘reification’, through which capitalism dehumanizes workers by reducing the to passive objects or marketable commodities.”

লুই অ্যালথুসার: অ্যালথুসার ফরাসী মার্কসবাদী দার্শনিক। তাঁর মার্কসবাদী দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর লেখা বিখ্যাত Montesquieu, Rousseau, Marx শীর্ষক গ্রন্থে। প্রচলিত মার্কসীয় দর্শনের রাজনীতি চর্চা অর্থনীতিসর্বস্ব ও নিয়তিবাদী। অ্যালথুসার তাঁর মার্কসীয় রাজনীতি চর্চায় এই অর্থনীতিসর্বস্বতা ও নিয়তিবাদিতা থেকে অনেকাংশে সরে এসেছেন। তবে তিনি মার্কসীয় রাজনীতি বিজ্ঞান এবং সমাজ বিশ্লেষণের পদ্ধতিগত ক্ষেত্রে এগলস ও স্তালিনের ধ্যান-ধারণার উপর আস্থা অব্যাহত রেখেছেন। ইতিহাসের বিজ্ঞান হিসাবে অ্যালথুসার ঐতিহাসিক বস্তুবাদের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের সংযুক্তিকরণ একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়।

মার্কসীয় দর্শনের ভিত্তি-উপরিশোধ সম্পর্কিত মতবাদকে অ্যালথুসার উপস্থাপিত করেছেন। উৎপাদন ও অর্থনীতির প্রাথমিক গুরুত্বকে তিনি স্বীকার করেছেন। কিন্তু অন্যান্য পূর্বসূরীদের মত উপরিসৌধমূলক উপাদানসমূহের গুরুত্বকে তিনি উপেক্ষা করার পক্ষপাতি নন। যেমন, মতাদর্শ হল একটি উপরিকাঠামোগত উপাদান। কিন্তু মতাদর্শ ভ্রান্ত চৈতন্য নয়, মতাদর্শ হল বাস্তব কর্মকাণ্ড। বাস্তব কর্মকাণ্ডের মধ্যে বর্তমান থাকে বিবিধ ধ্যান-ধারণা, ইমেজ ও মিথ। মতাদর্শ হল এ সবেরই প্রতিরূপ। মতাদর্শের মাধ্যমে মানুষজনের সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতির সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই সম্পর্ক প্রাণময়, বাস্তব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত।

অ্যালথুসার অর্থনীতির নির্ধারক ভূমিকাকে স্বীকার করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি এও বলেছেন যে, অর্থনীতির ভূমিকা সর্বদাই প্রাধান্যমূলক। অনেক সময় উপরিকাঠামোর বিভিন্ন স্তরও নিজস্বভাবে প্রাধান্যমূলক ভূমিকা পালন করে থাকে। অ্যালথুসার মতাদর্শগত রাষ্ট্রীয় কাঠামোর স্বাতথ্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। উপরিকাঠামোর এই স্তরটিকে তিনি নিছক অর্থনীতির প্রতিফল হিসাবে স্বীকার করার পক্ষপাতী নন। মতাদর্শগত রাষ্ট্রকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সরকারী প্রতিষ্ঠান, শ্রমিকসংঘ প্রভৃতি। মতাদর্শগত রাষ্ট্রকাঠামোর মাধ্যমে চলতে থাকে ব্যক্তির নির্মাণ কার্য। ব্যক্তিবর্গ মতাদর্শগত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সদা সতর্ক থাকে। মতাদর্শগত রাষ্ট্রকাঠামোসমূহ পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় পুরোপুরি প্রাধান্যমূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। হেউড বলেছেন: “a form of structural Marxism emerged from the writings of the french communist Louis Althusser (1918-90). This was based on the assumption that Marx viewed individuals as simply bearers of functions that arise from their structural location, in which case Marxism becomes a ‘new science’ essentially concerned with the analysis of the structure of a social totality.”