বাংলা সাহিত্যে নারীর জীবনসমস্যা ও যন্ত্রণা সম্ভবত আদিযুগ থেকেই প্রতিফলিত। চর্যাপদ থেকে শরু করে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্যসমূহ কিংবা বৈয়ব বা শাক্ত পদসাহিত্য—সর্বত্রই নারীর অসহায়তা ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর সমস্যাগুলি কোনো-না-কোনোভাবে উঠে এসেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে বাংলা উপন্যাসের আবির্ভাব। একদিকে সামন্ততন্ত্র, অন্যদিকে নতুন ঔপনিবেশিক সমাজ কাঠামোর মধ্যে নারীর জীবনের সমস্যাগুলি লেখকের দরদি মনের স্পর্শ পেল প্রথম বঙ্কিমচন্দ্রের রচনাতেই। তবে পুরুষের চোখ দিয়ে নারীর বেদনা চেনার এই চেষ্টা কিছুটা করুণাবাহিত বলেও মনে হয়। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই নারীর কলমে নারীর যন্ত্রণার চিহ্নও কম উন্মোচিত হয়নি।…. সাবিত্রী রায়ের সাহিত্য, বিশেষ করে ‘অন্তঃসলিলা’-র মতো গল্প সেই ধারায় একটি উজ্জ্বল সংযোজন সন্দেহ নেই।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজকাঠামোয় নারী যেহেতু পুরুষের সম্ভোগসামগ্রী এবং পণ্য হিসাবেই গণ্য, সেহেতু নারীপীড়নের চিত্রাঙ্কন করতে গিয়ে অধিকাংশ পুরুষ ও নারী সাহিত্যিক তুলে আনেন কৌলীন্য প্রথা তথা বহুবিবাহ, সতীনযন্ত্রণা, পণপ্রথা ইত্যাদি বিষয়কে। কিন্তু ‘অন্তঃসলিলা’ গল্পে সাবিত্রী রায় এই জাতীয় কোনো সমস্যাকে প্রকাশ করেননি। তাঁর গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র শকুন্তলা দেবী শিক্ষিতা গৃহবধূ। তাঁর স্বামী পেশায় অধ্যাপক, অর্থাৎ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নাগরিক। শকুন্তলা গল্প লেখেন এবং তা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিতও হয়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে সাবিত্রী রায়ের ‘অন্তঃসলিলা’ গল্পের নায়িকা ঊনবিংশ বা বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগের নারীদের মতো পুরুষতন্ত্রের খাঁচায় বন্দি নির্যাতিতা নারী নয়। শকুন্তলা দেবী নিজে শুধু শিক্ষিতা নন, সমাজের অগ্রসর সমাজের প্রতিনিধি এক অধ্যাপকের পত্নী। তিনি আপাতভাবে স্বাধীনাও। আত্মপ্রকাশের অধিকার তাঁর আছে। তিনি শিল্পী। কথাসাহিত্য রচনার মধ্য দিয়েই তাঁর সেই স্বাধীনসত্তা প্রকাশিত।

কিন্তু সাবিত্রী রায় আসলে দেখাতে চান, এই শিক্ষিত নাগরিক সমাজের মধ্যে আপাত প্রগতিশীলতার আবহেও কেমনভাবে রয়ে গেছে পুরুষতন্ত্র। আপাতভাবে বাধা না এলেও পুরুষশাসিত এই সমাজে সৃষ্টিশীল নারীর সৃষ্টিবাসনাও কেমনভাবে তীব্র প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। আজও সংসারের যাবতীয় দায়, পরিবারের সদস্যের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দায় সামলাতে হয় নারীকেই। নারীর জীবন যেন শুধু পরিবার-পরিজনের সেবাতেই উৎসর্গীকৃত, তার নিজের কোনো সত্তা নেই, নেই ব্যক্তিত্বের কোনো দাম বা তার সৃষ্টিশীলতার কোনো মূল্য। যদি কোনো নারী আজও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করতে চায়, কিংবা নিজ সৃষ্টিশীলতাকে সজীব রাখতে চায়, তাহলেও তাকে সংসারের দায়টুকু স্বীকার করে নিয়ে তবে অবসর সময়টুকুতে সেই চর্চা করতে হয়। অতএব পুরুষতন্ত্রের নিগড় আজও সমভাবে বহমান আমাদের সমাজে। ‘অন্তঃসলিলা গল্পে সাবিত্রী রায় শকুন্তলার সাহিত্যসাধনার আখ্যানে এই পুরুষতন্ত্রের স্বরুপটিকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন।

একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের এক অসামান্য গৃহবধূর আখ্যান সাবিত্রী রায়ের ‘অন্তঃসলিলা’। প্রফেসর সেনের স্ত্রী শকুন্তলা দেবী বৃহৎ সংসারের প্রাত্যহিক বোঝা ঠেলেও সাহিত্যসাধনা করেন, এখানেই তাঁর অসামান্যতা। কয়েকটি পত্রপত্রিকায় তাঁর গল্প প্রকাশিত ও সাহিত্যরসিকদের প্রশংসা লাভ করেছে। কিন্তু একজন নারীর এই সাহিত্যচর্চাকে তেমন গুরুত্ব দেন না শিবনারায়ণ ব্যানার্জীর মতো লেখকেরা। তাঁদের মতে―”মেয়েদের লেখা আবার উপন্যাস।” সাহিত্যক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পুরুষতন্ত্র কেমনভাবে নারীকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে, শিবনারায়ণের এই মন্তব্য তা উদ্ঘাটিত করে দেয়।

রাধারাণী পাবলিশার্সের দেবব্রত শকুন্তলা দেবীর বাড়ির গলিতে প্রবেশ করেই অনুভব করে এক বিরুদ্ধ আবহ। সরু অপরিচ্ছন্ন এবং অস্বাস্থ্যকর এই গলির ভিতরে শকুন্তলা দেবীর মতো সম্ভাবনাময়ী লেখিকার বাস, তা ভাবতে কষ্ট হয় দেবব্রতর। ৮/৭বি ঠিকানার সেই বাড়িটিতে পৌঁছেও স্পষ্ট হয় একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারেরই ছবি। বাড়িটির মধ্যে একাধিক পরিবারের বসবাস। শকুন্তলা দেবী তথা প্রফেসর সেনের একটিমাত্র ঘর; সে ঘরেই একটি পর্দা টাঙিয়ে অন্তঃপুরকে পৃথক করা হয়েছে। স্তূপীকৃত বালিশ জানিয়ে দিচ্ছে বাড়ির অতিরিক্ত জনসংখ্যা। ঘরে টাঙানো দেবদেবী ও গুরুদেবের ছবি একটি মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের রক্ষণশীলতার পরিচয় বহন করছে। আর স্তূপীকৃত বইপত্র বলে দিচ্ছে পরিবারটির সঙ্গে শিক্ষা সাহিত্যের সংযোগ। গলির পরিবেশ এবং ঘরের অপ্রশস্ততা জানিয়ে দেয় শকুন্তলা দেবীর লেখকজীবনের পক্ষে পরিবেশগত প্রতিকূলতা।

পর্দার ওপার থেকে অন্তঃপুরের প্রাচীনাদের যে সমস্ত কথাবার্তা দেবব্রত শুনতে পায়, সেই সংলাপগুলির মধ্য দিয়েও প্রকাশিত হয় লেখিকা বধূটির প্রতি সংসারের বিরুপতা ও অসহযোগিতা। অন্তঃপুরের সম্ভাব্য শাশুড়িটির বিভিন্ন অনুযোগের আসল লক্ষ্য শকুন্তলা দেবীর সাহিত্যসৃষ্টির আগ্রহ। ঘরের বধূ কেন পুরুষদের মতো লেখাপড়ার কাজে নিয়োজিত হবে, এই বিস্মিত প্রশ্নই যেন ক্ষোভের মতো ঝরে পড়ে প্রাচীনাদের কথোপকথনে। সাবিত্রী রায় দেখিয়ে দেন, নারীর উপর পুরুষতন্ত্রের এই পীড়ন শুধু পুরুষের দ্বারা সংঘটিত হয় না। এই পুরুষতান্ত্রিক পীড়নের অনেকখানি সংঘটিত হয় নারীদের দ্বারাও। অর্থাৎ পুরুষতন্ত্র আসলে একটা বিকারগ্রস্ত মানসিকতা। যার মধ্যে বাসা বেঁধে আছে সামন্ততান্ত্রিক প্রভুত্ববোধ। শাশুড়ি যখন আক্ষেপ করেন এই বয়সেও তাঁকে চাল বাছতে হয় বলে, সংসারের খুঁটিনাটির দিকে মনোযোগ দিতে হয় বলে, কিংবা তিনি যখন শিশুকন্যার কান্না থামাতেও প্রাচীনা বধূকেই ডাক দেন, তখন বোঝা যায় শকুন্তলা দেবীকে সংসারের শতপাকে জড়িয়ে তার সৃষ্টিশীলতাকে থামিয়ে দেওয়াই তাঁর আসল লক্ষ্য। প্রাচীনা শাশুড়ি তীব্র ব্যঙ্গের আঘাত করেন বধূটির সাহিত্য-অনুরাগের প্রতিই—“বিদ্বান ছেলের বিদুষী বৌ।”

কিন্তু নেপথ্যের সেইসব সংলাপের মধ্যে দিয়েই বোঝা যায়, ঘরের নীরব বধূটি রন্ধনকর্মসহ সংসারের যাবতীয় কাজেই ব্যস্ত। দেবব্রতর সামনে কুণ্ঠিত ও লজ্জিতভাবে যখন আত্মপ্রকাশ করেন শকুন্তলা, তখন দেবব্রতও দেখতে পায় তাঁর হাতে মশলা বাটার চিহ্ন। এ ছাড়া ভাতের ফ্যান গালা, অফিসযাত্রী স্বামীর অন্ন পরিবেশন, শিশুর পরিচর্যা ইত্যাদি যাবতীয় কাজই নিঃশব্দে করে যান শকুন্তলা দেবী। তার ওপর শিশুকন্যাটির অসুস্থতার কারণে উদ্‌বেগও যেন বহন করতে হয় তাঁকেই। কেননা অধ্যাপক স্বামী কফি হাউসে কিছু সময় আড্ডার সময় পেলেও ডাক্তারের কাছে যাবার সময় পান না। ফলে বোঝা যায়, একটি নারী হিসাবেই বহু সদস্যবিশিষ্ট এই সংসারে শকুন্তলা আসলে একাকী। এটাও এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক পীড়ন।

এই একাকিত্ব ও সাংসারিক দায়দায়িত্বের বোঝা বহন করেও সাহিত্যচর্চার ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা পান না শকুন্তলা। শিবনারায়ণের মতো স্পষ্ট ভাষায় উপেক্ষা না দেখালেও দেবর বা স্বামীও তাঁকে কোনো সহযোগিতা করেন না। প্রথমত পাণ্ডুলিপি খুঁজতে গিয়ে যে ভয়ংকর আশঙ্কা প্রকাশিত হয় শকুন্তলার কণ্ঠে, তাতে প্রকাশিত হয় তীব্র নিরাপত্তাহীনতা ও প্রতিকূলতা—“পুড়িয়েই ফেলল নাকি ওরা উনুন ধরাতে।” এরপর গল্পের খাতাটি খুঁজে পাওয়া গেলে দেবব্রত দেখতে পায়, লেখবার উপযুক্ত খাতা বা কাগজও পান না শকুন্তলা। ছেলেবেলার লাল হয়ে যাওয়া হাতের লেখা অনুশীলনের পুরোনো খাতাতেই গল্পটি তাই লিখতে হয়েছে শকুন্তলাকে।

সাবিত্রী রায় পাঠককে দেখাতে চান যে, শকুন্তলা দেবী কতখানি পুরুষতান্ত্রিক প্রতিকূলতা ও বিরুদ্ধতার মধ্য দিয়ে নিরন্তর তাঁর সাহিত্যসাধনা চালিয়ে যান। শাশুড়ি ও অন্য প্রাচীনার বিরুদ্ধতা তো আছেই, সেইসঙ্গে শকুন্তলা দেবীর দেবরও তার বৌদির সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্যজগতের অন্যান্য অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে মেলামেশার প্রতি তীব্র শ্লেষাত্মক ও কুৎসিত ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করে—“গল্প লিখতে গিয়ে নিজেই আবার গল্পের নায়িকা হয়ে পড়ো না যেন।” এর থেকেও যন্ত্রণাদায়ক মনে হয় শকুন্তলার সাহিত্যচর্চার প্রতি তাঁর স্বামী অধ্যাপক সেনের নিরুত্তাপ উদাসীনতা। শকুন্তলার নতুন গল্পটি পড়েছেন কি না জানতে চাইলে তাঁর মন্তব্য—“গল্পটল্প পড়ার কি আর ফুরসত আছে।…এককালে ছিল ও সব সাহিত্য-টাহিত্যের উৎসাহ।”

আসলে সাবিত্রী রায় এই গল্পে দেখাতে চান, পুরুষশাসিত এই সমাজে সৃষ্টিশীল নারীর সৃষ্টিবাসনাও কেমনভাবে তীব্র প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। সংসারের যাবতীয় দায়, পরিবারের সদস্যের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দায় সামলানোর পরেও সাহিত্যচর্চার ব্যাপারে কারও কাছে এতটুকু উৎসাহ বা প্রশংসা পান না শকুন্তলা। তবু সার্বিক এই উপেক্ষা, উদাসীনতা ও প্রতিকূলতার মধ্যেই কোনো আশ্চর্য অলৌকিক প্রেরণায় অব্যাহত থাকে তাঁর সাহিত্যচর্চা।