কোনো সাহিত্যবস্তুর শিরোনামটি তেমনভাবে আবশ্যিক না হলেও শিরোনামের গুরুত্বটি সাহিত্য-আলোচকের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কেননা শিরোনামটি আসলে সংশ্লিষ্ট সাহিত্যের মর্মকথাটিকে পাঠকমনে আভাসিত করে। শুধু তা-ই নয়, লেখকের বিশেষ অভিপ্রায়টিও প্রতিফলিত হতে পারে শিরোনামে। সাবিত্রী রায়ের ‘অন্তঃসলিলা’ গল্পটির নামকরণেও একটি গভীর ব্যঞ্জনা লুকিয়ে আছে, যা একই সঙ্গে গল্পের সঙ্গে লগ্ন এবং লেখকের জীবনবোধ ও সামাজিক অভিজ্ঞতার পরিচয়বাহী।
একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের এক অসামান্য গৃহবধূর আখ্যান সাবিত্রী রায়ের ‘অন্তঃসলিলা’। প্রফেসর সেনের স্ত্রী শকুন্তলা দেবী বৃহৎ সংসারের প্রাত্যহিক বোঝা ঠেলেও সাহিত্যসাধনা করেন, এখানেই তাঁর অসামান্যতা। কয়েকটি পত্রপত্রিকায় তাঁর গল্প প্রকাশিত ও সাহিত্যরসিকদের প্রশংসা লাভ করেছে। কিন্তু একজন নারীর এই সাহিত্যচর্চাকে তেমন গুরুত্ব দেন না শিবনারায়ণ ব্যানার্জীর মতো লেখকেরা। তাঁদের মতে—“মেয়েদের লেখা আবার উপন্যাস!”
কিন্তু রাধারাণী পাবলিশার্সের দেবব্রত ব্যক্তিগতভাবে শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে পরিচিত না হলেও তাঁর লেখার একজন একনিষ্ঠ পাঠক ও ভক্ত। রাধারাণী পাবলিশার্স থেকে দেবব্রত শকুন্তলা দেবীর একটি উপন্যাস প্রকাশেরও ব্যবস্থা করেছে। আপাতত দেবব্রত পত্রিকার জন্য শকুন্তলার একটি গল্প সংগ্রহের জন্য তাঁর বাড়িতে এসে এক দুঃসহ ও বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। ‘অন্তঃসলিলা’ গল্পটির মর্মকথাটি প্রকাশ পায় দেবব্রতর এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই।
শকুন্তলা দেবীর বাড়ির গলিতে প্রবেশ করেই দেবব্রত অনুভব করে এক বিরুদ্ধ আবহ। সরু আলোকহীন একটা গলি। অপরিচ্ছন্ন এবং অস্বাস্থ্যকর এই গলির ভিতরে শকুন্তলা দেবীর মতো সম্ভাবনাময়ী লেখিকার বাস, তা ভাবতে কষ্ট হয় দেবব্রতর। ৮/৭বি ঠিকানার সেই বাড়িটিতে পৌঁছেও স্পষ্ট হয় একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারেরই ছবি। বাড়িটির মধ্যে একাধিক পরিবারের বসবাস। শকুন্তলা দেবী তথা প্রফেসর সেনের একটিমাত্র ঘর; সে ঘরেই একটি পর্দা টাঙিয়ে অন্তঃপুরকে পৃথক করা হয়েছে। বাইরের ঘরের একদিকে দুটো তক্তপোশ জোড়া দিয়ে তার ওপর রাজ্যের বিছানা একটা পুরোনো সুজনি দিয়ে ঢাকা দেওয়া। স্তূপীকৃত বালিশ জানিয়ে দিচ্ছে বাড়ির অতিরিক্ত জনসংখ্যা। একটি শিশুর অস্তিত্ব ঘোষণা করছে ছোট্ট বালিশ ও অয়েলক্লথ। ঘরে টাঙানো দেবদেবী ও গুরুদেবের ছবি একটি মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের রক্ষণশীলতার পরিচয় বহন করছে। আর স্তূপীকৃত বইপত্র বলে দিচ্ছে পরিবারটির সঙ্গে শিক্ষা-সাহিত্যের সংযোগ।
পর্দার ওপার থেকে অন্তঃপুরের প্রাচীনাদের যে সমস্ত কথাবার্তা দেবব্রত শুনতে পায়, সেই সংলাপগুলির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয় সাংসারিক ব্যস্ততা, প্রাচীনাদের স্বভাবসুলভ নানান অভিযোগ-অনুযোগ, বিশেষ করে বাড়িটির বধূটির সাহিত্যবিলাসের প্রতি তাঁদের তীব্র বিরাগ ও বিরুদ্ধতা। অন্তঃপুরের সম্ভাব্য শাশুড়িটির বিভিন্ন অনুযোগের মধ্যে অন্যতম এই বয়সেও ঈশ্বরচিন্তা না করে তাঁকে চাল বাছতে হয় বলে, সংসারের খুঁটিনাটির দিকে মনোযোগ দিতে হয় বলে। কিন্তু নেপথ্যের সেইসব সংলাপের মধ্যে দিয়েই বোঝা যায়, ঘরের নীরব বধূটি রন্ধনকর্মে ব্যস্ত। শিশুকন্যার কান্না থামাতেও প্রাচীনা বধূকেই ডাক দেন। শিশুটির প্রতি তার মায়ের অমনোেযাগের কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে সেই প্রাচীনা শাশুড়ি তীব্র ব্যঙ্গের আঘাত করেন বধূটির সাহিত্য-অনুরাগের প্রতিই—“বিদ্বান ছেলের বিদুষী বৌ।”
এই সাংসারিক দায়িত্ব, ব্যস্ততা এবং প্রাচীনাদের বিরুদ্ধতার মধ্য থেকে একসময় শকুন্তলা দেবী অন্তঃপুর থেকে সাক্ষাৎপ্রার্থী দেবব্রতর সামনে কুণ্ঠিত ও সম্ভবত কিছুটা লজ্জিতভাবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর হাতে মশলা বাটার চিহ্ন। বিব্রতভাবেই তিনি জানিয়ে দেন, শিশুকন্যাটির অসুস্থতার কারণে তিনি গল্পটির নকল তৈরি করতে সময় পাননি। কিন্তু গল্পটি দেবব্রতকে পড়াতে গিয়ে দেবব্রতর সামনে উন্মোচিত হয় আরও এক নির্মম সত্য। প্রথমত অগোছালো কাগজপত্রের স্তূপ থেকে নির্দিষ্ট রচনাটিকে খুঁজে পেতেই অনেকটা সময়ক্ষেপ হয় শকুন্তলা দেবীর। এক ভয়ংকর আশঙ্কা প্রকাশিত হয় শকুন্তলার কণ্ঠে—“পুড়িয়েই ফেলল নাকি ওরা উনুন ধরাতে।” দেবব্রতর কাছে প্রকাশিত হয় শকুন্তলা দেবীর সাহিত্যসাধনার প্রতি তাঁর পারিবারিক উপেক্ষা, চূড়ান্ত ঔদাসীন্য ও ধ্বংসাত্মক মনোভাব। এরপর গল্পের খাতাটি খুঁজে পাওয়া গেলে দেবব্রত দেখতে পায়, লেখবার উপযুক্ত খাতা বা কাগজও পান না শকুন্তলা। ছেলেবেলার লাল হয়ে যাওয়া হাতের লেখা অনুশীলনের পুরোনো খাতাতেই গল্পটি তাই লিখতে হয়েছে শকুন্তলাকে।
দেবব্রতর চোখ দিয়ে লেখিকা সাবিত্রী রায় পাঠককে দেখাতে চান যে, শকুন্তলা দেবী কতখানি প্রতিকূলতা ও বিরুদ্ধতার মধ্য দিয়ে নিরন্তর তাঁর সাহিত্যসাধনা চালিয়ে যান। সাহিত্যসাধনার জন্য যে সুস্থ সুন্দর পরিবেশ বাঞ্ছিত, ৮/৭ বি ঠিকানার সেই গলিতে বা বাড়িটিতে সেই পরিবেশের ন্যূনতম অস্তিত্ব অনুপস্থিত। নিম্নবিত্ত পরিবারে সেই আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যও নেই, যা একটি সুস্থ পরিবেশে স্থানান্তরিত হবার সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। ফলে সাহিত্যসাধনার উপযুক্ত ন্যূনতম নির্জনতাও পান না শকুন্তলা, লেখার জন্য আলাদা একটি ঘর তো দূরস্থান। এ ছাড়া রান্নাবান্না, শিশুর পরিচর্যা, বয়স্কদের পরিবেশন, প্রাচীনাদের সেবা ইত্যাদি যাবতীয় সাংসারিক দায়িত্বই মুখ বুজে পালন করেন শকুন্তলা। সেই প্রাত্যহিক কাজের মধ্যে লেখবার অবকাশটুকু শকুন্তলা কীভাবে পান, সেটাই বিস্ময়ের কথা।
কিন্তু এই বাহ্য প্রতিকূলতা ছাড়া শকুন্তলাকে নিরন্তর সহ্য করতে হয় পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধতা। শাশুড়ি ও অন্য প্রাচীনার বিরুদ্ধতা তো আছেই, সেইসঙ্গে শকুন্তলা দেবীর দেবরও তার বৌদির সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্যজগতের অন্যান্য অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে মেলামেশার প্রতি তীব্র শ্লেষাত্মক ও কুৎসিত ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করে—‘গল্প লিখতে গিয়ে নিজেই আবার গল্পের নায়িকা হয়ে পড়ো না যেন।” এর থেকেও যন্ত্রণাদায়ক মনে হয় শকুন্তলার সাহিত্যচর্চার প্রতি তাঁর স্বামী অধ্যাপক সেনের নিরুত্তাপ উদাসীনতা। শকুন্তলার নতুন গল্পটি পড়েছেন কি না জানতে চাইলে তাঁর মন্তব্য—“গল্পটন্স পড়ার কি আর ফুরসত আছে।…এককালে ছিল ওসব সাহিত্য-টাহিত্যের উৎসাহ।”
আসলে সাবিত্রী রায় এই গল্পে দেখাতে চান, পুরুষশাসিত এই সমাজে সৃষ্টিশীল নারীর সৃষ্টিবাসনাও কেমনভাবে তীব্র প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। সংসারের যাবতীয় দায়, পরিবারের সদস্যের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দায় সামলানোর পরেও সাহিত্যচর্চার ব্যাপারে কারও কাছে এতটুকু উৎসাহ বা প্রশংসা পান না শকুন্তলা। তবু সার্বিক এই উপেক্ষা, উদাসীনতা ও প্রতিকূলতার মধ্যেই কোনো আশ্চর্য অলৌকিক প্রেরণায় অব্যাহত থাকে তাঁর সাহিত্যচর্চা।
এই গল্পের একেবারে শেষাংশে আখ্যানের স্রষ্টা দেবব্রতর মাধ্যমে যে বিস্ময়টি প্রকাশ করা হয়েছে, সেখানেই লুকিয়ে আছে গল্পটির নামকরণের তাৎপর্য। অপ্রশস্ত নোংরা গলি দিয়ে ফেরার পথে দেবব্রত ভাবে—“এই মধ্যবিত্ত সংগ্রামের আড়ালেই কি বয়ে চলেছে লেখিকার জীবনের অন্তঃসলিলা প্রাণের প্রবাহ।” আসলে প্রশ্নধর্মী বিস্ময়ের মধ্যেই নিহিত আছে উত্তরও। বাংলার লক্ষ লক্ষ নারীর সম্ভাবনাময় প্রতিভাসম্পদ প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে আর্থসামাজিক প্রতিকূলতায় ও পুরুষতান্ত্রিকতার পেষণে। তবু তারই মধ্যে একজন দুজন নারী সমস্ত বিরুদ্ধতাকে জয় করে সজীব-সতেজ রাখেন তাঁদের শিল্পীসত্তাকে। শকুন্তলা দেবী সেই দুর্লভ নারীদেরই একজন। সার্বিক প্রতিকূলতার সর্বগ্রাসী মরুভূমিতে অসীম স্বৈর্যে তিনি অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো প্রাণময় করে রেখেছেন নিজ শিল্পীসত্তার প্রবাহটিকে। এই দুর্লভ শক্তিতেই তিনি অসামান্যা। পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক এবং অবক্ষয়িত সংস্কৃতির প্রতিকূলতার মরুপথে একটি নারীর অপরাজেয় সাহিত্য প্রতিভার এই অন্তঃসলিলা প্রবাহের আশ্চর্য প্রাণময়তার বিস্ময়ই গল্পটির মর্মকথা এবং সেই বার্তা সার্থকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে গল্পটির শিরোনামে।
Leave a comment