সাবিত্রী রায়ের ‘অন্তঃসলিলা’ গল্পটির প্রধান তথা কেন্দ্রীয় চরিত্র শকুন্তলা সেন। বিংশ শতাব্দীর কলকাতা নগরীর শিক্ষিতা রমণী শকুন্তলা। সমাজের অগ্রসর শ্রেণির প্রতিভূ অধ্যাপক সেনের স্ত্রী সে। অতএব শিক্ষা, স্বামীর শিক্ষাজগতের সঙ্গে সংযোগ, নাগরিক জীবন ইত্যাদি দিক থেকে শকুন্তলার আপাতভাবে একটি আলোকিত প্রগতিশীল অনুকূল পরিবেশই পাবার কথা। সেইসঙ্গে শকুন্তলা দেবী যে সাহিত্যচর্চা করবেন, এটাও যেন অত্যন্ত সংগত ও স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। কিন্তু আপাতভাবে এই নাগরিক জীবন, আধুনিক শিক্ষা বা অগ্রসর সমাজের তলায় তলায় যে সামন্ততন্ত্র তথা পুরুষতন্ত্রের স্রোত বিশ শতকেও তীব্রভাবে বহমান, সেটি স্পষ্ট হয় অধ্যাপক সেনের স্ত্রী শকুন্তলা দেবীর সাহিত্যসাধনার পথে প্রতিকূলতার চেহারাটি দেখলেই। অতএব এ গল্পের প্রতিপাদ্যটিকে গুরুত্ব দিলে শকুন্তলা দেবীই এই গল্পের প্রধান চরিত্র।

গল্পের আরম্ভে কফি হাউসের আড্ডায় সাহিত্যিক-অধ্যাপক-সম্পাদকদের আলোচনার সূত্রে কথাসাহিত্যিক শকুন্তলা দেবী সম্পর্কে পাঠক প্রথম অবহিত হন। রাধারাণী পাবলিশার্স-এর দেবব্রতর মুখেই আমরা শুনতে পাই যে, শীঘ্রই শকুন্তলা দেবীর একটা উপন্যাস ছাপা হচ্ছে রাধারাণী থেকে। কিন্তু মহিলাদের লেখালেখি সম্পর্কে পুরুষ সাহিত্যিকদের তথা বিদগ্ধ পাঠকসমাজের একটা তীব্র উপেক্ষা ও অবজ্ঞাই মূর্ত হতে দেখি শিবনারায়ণ ব্যানার্জীর মন্তব্যে—“মেয়েদের লেখা আবার উপন্যাস!” প্রথমত মেয়েদের লেখা, দ্বিতীয়ত ‘আনকোরা’ লেখিকা, ফলে রাধারাণীর লোকসানের সম্ভাবনাটির দিকে ইঙ্গিত করে শিবনারায়ণ ব্যানার্জী মেয়েদের ভাবনাচিন্তার গভীরতা, তাদের যাবতীয় সারস্বত সাধনার উদ্যোগকেই অর্থহীন প্রতিপন্ন করতে চান। এমনকি শকুন্তলার লেখায় নতুন কোনো টেকনিকেরও একান্ত অভাব আছে বলেও তাঁর অভিমত। শকুন্তলার স্বামী প্রফেসর সেনের দিকে কটাক্ষ করেন রঞ্জন রায়—“তোমার বৌ তো এনতার লিখছে হে। এরকম ঘষতে ঘষতেই হাত পেকে যাবে।” অর্থাৎ, শকুন্তলার হাত যে এখনও পরিণত নয়, যেন সে কথাটাই ইঙ্গিতে বলতে চান রঞ্জন রায়। এইসব কথোপকথনেই আমরা জানতে পারি ইতোমধ্যেই খান দুই গল্পের বইও প্রকাশিত হয়েছে শকুন্তলা দেবীর। তবু তিনি এখনও প্রতিষ্ঠিত নন জনমানসে, তার প্রধান কারণ বোধহয় পুরুষতান্ত্রিক দর্প, এটা গল্পের সূচনাতেই স্পষ্ট হয়।

এরপর শকুন্তলার সাহিত্যচর্চার প্রতিকূল পরিস্থিতিটি পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয় দেবব্রতর অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে। ৮/৭ বি ঠিকানার সেই বাড়িটিতে যখন দেবব্রত পৌঁছোয়, তখন স্পষ্ট হয় একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছবি। বাড়িটির মধ্যে একাধিক পরিবারের বসবাস। শকুন্তলা দেবী তথা প্রফেসর সেনের একটিমাত্র ঘর; সে ঘরেই একটি পর্দা টাঙিয়ে অন্তঃপুরকে পৃথক করা হয়েছে। বাইরের ঘরের একদিকে দুটো তক্তপোশ জোড়া দিয়ে তার ওপর রাজ্যের বিছানা একটা পুরোনো সুজনি দিয়ে ঢাকা দেওয়া। স্তূপীকৃত বালিশ জানিয়ে দিচ্ছে বাড়ির অতিরিক্ত জনসংখ্যা। একটি শিশুর অস্তিত্ব ঘোষণা করছে ছোট্ট বালিশ ও অয়েলক্লথ। ঘরে টাঙানো দেবদেবী ও গুরুদেবের ছবি একটি মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের রক্ষণশীলতার পরিচয় বহন করছে। আর স্তূপীকৃত বইপত্র বলে দিচ্ছে পরিবারটির সঙ্গে শিক্ষা-সাহিত্যের সংযোগ। অর্থাৎ শকুন্তলা চরিত্রটিকে বোঝার প্রয়োজনেই সাবিত্রী রায় প্রথমে শকুন্তলার সাংসারিক পরিবেশ ও অর্থনৈতিক অবস্থাটি আমাদের সামনে মেলে ধরেন। তাতে স্পষ্ট হবে কোন অবস্থার মধ্য থেকে শকুন্তলা তাঁর সারস্বত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। এই প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তাঁর চলাটিই আমাদের কাছে উদঘাটিত করে শকুন্তলার মানসিক দৃঢ়তাকে।

অথচ শকুন্তলা দেবী আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীর মতোই বাহ্যত সংগ্রামী নন। প্রতিনিয়ত পুরুষতন্ত্র বা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষ লড়াইও চালাচ্ছেন না। বরং দেখতে পাই সংসারের যাবতীয় প্রতিকূলতাকে শিরোধার্য করে নিয়েই তাঁর লড়াই আত্মপ্রকাশের সাধনায় নিয়োজিত। পর্দার ওপার থেকে অন্তঃপুরের প্রাচীনাদের যে সমস্ত কথাবার্তা দেবব্রত শুনতে পায়, সেই সংলাপগুলির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয় বাড়ির বধূটির সাহিত্যবিলাসের প্রতি প্রাচীনাদের স্বভাবসুলভ তীব্র বিরাগ ও বিরুদ্ধতা। অন্তঃপুরের সম্ভাব্য শাশুড়িটির বিভিন্ন অনুযোগের মধ্যে অন্যতম এই বয়সেও ঈশ্বরচিন্তা না করে তাঁকে চাল বাছতে হয় বলে, সংসারের খুঁটিনাটির দিকে মনোযোগ দিতে হয় বলে। কিন্তু নেপথ্যের সেইসব সংলাপের মধ্যে দিয়েই বোঝা যায়, ঘরের নীরব বধূটি রন্ধনকর্মে ব্যস্ত। শিশুকন্যার কান্না থামাতেও প্রাচীনা বধূকেই ডাক দেন। শিশুটির প্রতি তার মায়ের অমনোযোগের কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে সেই প্রাচীনা শাশুড়ি তীব্র ব্যঙ্গের আঘাত করেন বধূটির সাহিত্য-অনুরাগের প্রতিই—“বিদ্বান ছেলের বিদুষী বৌ।”

এই সাংসারিক দায়িত্ব, ব্যস্ততা এবং প্রাচীনাদের বিরুদ্ধতার মধ্য থেকে একসময় শকুন্তলা দেবী অন্তঃপুর থেকে সাক্ষাৎপ্রার্থী দেবব্রতর সামনে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর হাতে মশলা বাটার চিহ্ন। চোখে-মুখে অন্তঃপুরের অনভিপ্রেত মন্তব্যগুলির জন্য কুণ্ঠা ও লজ্জা। সেইসঙ্গে শিশুকন্যাটির অসুস্থতার কারণে তীব্র উদ্‌বেগ। আমরা বুঝতে পারি, অন্তঃপুরের প্রাচীনাদের অভিযোগগুলি অন্তঃসারহীন। কেননা, শকুন্তলা দেবী সাংসারিক যাবতীয় দায়িত্বগুলিই নিঃশব্দে পালন করে চলেছেন। রন্ধনকর্ম, পারিবারিক সদস্যদের সেবা ও পরিচর্যা, পরিবেশন, শিশুর পরিচর্যা, কাঁথা কাচা, শাশুড়ির আতপ চাল রান্না—সমস্তই তাঁর নিত্যকর্ম। এ ব্যাপারে কোনো অনুযোগ বা অভিযোগও হয়তো শকুন্তলা দেবীর নেই। কিন্তু তবু তিনি এরই ফাঁকে লেখালেখির চর্চা করেন বলেই বোধহয় প্রতিমুহূর্তে শকুন্তলার প্রতি ছিটকে আসে বিদ্বেষভরা নানা মন্তব্য।

কিন্তু এহেন বিদ্বেষকুটিল পরিবেশেও শকুন্তলার চারিত্রিক স্নিগ্ধতা, সৌজন্যবোধ, সংসারের হাজার ঝামেলায় কর্তব্যবুদ্ধি বা আতিথেয়তা কোনোটিই হারায়নি। আমরা তাঁর ব্যস্ততাটি বুঝি, যখন দেখি অফিসের ভাত রান্নার মাঝেই তাঁকে অসুস্থ মেয়ের কান্না সামলাতে হয়, কাঁথা কাচতে গেলে ডাল পোড়ে। কিন্তু তারই মধ্যে ঠিক বড়োমেয়ের হাতে দেবব্রতর কাছে পৌঁছে যায় চায়ের কাপ। পাণ্ডুলিপি দেবার কথা দিয়েও মেয়ের অসুস্থতার জন্য গল্পের নকল করে রাখতে পারেননি বলে দুঃখপ্রকাশটিও তাঁর সৌজন্যবোধেরই পরিচায়ক।

এরপর দেবব্রতর সামনে উন্মোচিত হয় আরও এক নির্মম সত্য। প্রথমত অগোছালো কাগজপত্রের স্তূপ থেকে নির্দিষ্ট রচনাটিকে খুঁজতে গিয়ে এক ভয়ংকর আশঙ্কা প্রকাশিত হয় শকুন্তলার কণ্ঠে—“পুড়িয়েই ফেলল নাকি ওরা উনুন ধরাতে।” দেবব্রতর কাছে প্রকাশিত হয়, শকুন্তলা দেবীর সাহিত্যসাধনার প্রতি তাঁর পারিবারিক উপেক্ষা, চূড়ান্ত ঔদাসীন্য ও ধ্বংসাত্মক মনোভাব। এরপর গল্পের খাতাটি খুঁজে পাওয়া গেলে দেবব্রত দেখতে পায়, লেখবার উপযুক্ত খাতা বা কাগজও পান না শকুন্তলা। ছেলেবেলার লাল হয়ে যাওয়া হাতের লেখা অনুশীলনের পুরোনো খাতাতেই গল্পটি তাই লিখতে হয়েছে শকুন্তলাকে।

শুধু বাড়ির প্রাচীনারাই নন, শকুন্তলা দেবীর দেবরও তার বৌদির সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্যজগতের অন্যান্য অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে মেলামেশার প্রতি তীব্র শ্লেষাত্মক ও কুৎসিত ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করে—“গল্প লিখতে গিয়ে নিজেই আবার গল্পের নায়িকা হয়ে পড়ো না যেন।” এর থেকেও যন্ত্রণাদায়ক মনে হয় শকুন্তলার সাহিত্যচর্চার প্রতি তাঁর স্বামী অধ্যাপক সেনের নিরুত্তাপ উদাসীনতা। শকুন্তলার নতুন গল্পটি পড়েছেন কি না দেবব্রত জানতে চাইলে অধ্যাপক সেনের মন্তব্য—“গল্পটল্প পড়ার কি আর ফুরসত আছে।…..এককালে ছিল ওসব সাহিত্য-টাহিত্যের উৎসাহ।”

আসলে সাবিত্রী রায় এই গল্পে শকুন্তলা চরিত্রের মধ্য দিয়ে দেখাতে চান, পুরুষশাসিত এই সমাজে সৃষ্টিশীল নারীর সৃষ্টিবাসনাও কেমনভাবে তীব্র পুরুষতান্ত্রিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। সংসারের যাবতীয় দায়, পরিবারের সদস্যের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দায় সামলানোর পরেও সাহিত্যচর্চার ব্যাপারে কারও কাছে এতটুকু উৎসাহ বা প্রশংসা পান না শকুন্তলা। তবু সার্বিক এই উপেক্ষা, উদাসীনতা ও প্রতিকূলতার মধ্যেই কোনো আশ্চর্য অলৌকিক প্রেরণায় অব্যাহত থাকে তাঁর সাহিত্যচর্চা।

তবু সাবিত্রী রায়ের এই গল্পে শুকন্তলা দেবী এই রক্ষণশীল সামন্ততান্ত্রিক এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পরিবারের চাপে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া কোনো নারী নন। অপ্রশস্ত নোংরা গলি দিয়ে ফেরার পথে দেবব্রতর মনে জেগে ওঠে শকুন্তলা দেবীর অপরাহত মানসিকতার প্রতি বিস্মিত শ্রদ্ধাবোধ—“এই মধ্যবিত্ত সংগ্রামের আড়ালেই কি বয়ে চলেছে লেখিকার জীবনের অন্তঃসলিলা প্রাণের প্রবাহ!” বিশ শতকের কলকাতা নগরীর বুকেও একটি উচ্চশিক্ষিত পরিবারে এবং সার্বিক আর্থসামাজিক প্রতিকূলতায় ও পুরুষতান্ত্রিকতার পেষণের মাঝখানেও একজন-দুজন নারী সমস্ত বিরুদ্ধতাকে জয় করে সজীব-সতেজ রাখেন তাঁদের শিল্পীসত্তাকে। সার্বিক প্রতিকূলতার সর্বগ্রাসী মরুভূমিতে অসীম স্থৈর্যে তাঁরা অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো প্রাণময় করে রেখেছেন নিজ শিল্পীসত্তার প্রবাহটিকে। শকুন্তলা দেবী সেই দুর্লভ নারীদেরই একজন। এই দুর্লভ শক্তিতেই শকুন্তলা অসামান্যা।