কোনো সাহিত্যবস্তুর শিরোনামের গুরুত্বটি সাহিত্য-আলোচকের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কেননা শিরোনামটি আসলে সংশ্লিষ্ট সাহিত্যের মর্মকথাটিকে পাঠকমনে আভাসিত করে। শুধু তা-ই নয়, লেখকের বিশেষ অভিপ্রায়টিও প্রতিফলিত হতে পারে শিরোনামে। তপোবিজয় ঘোষের এখন প্রেম’ গল্পটির নামকরণেও একটি গভীর ব্যঞ্জনা লুকিয়ে আছে, যা একই সঙ্গে গল্পের সময়ট এবং লেখকের বিশেষ অভিপ্রায়টিকে চিহ্নিত করে দেয়।

‘এখন প্রেম’ গল্পটির পটভূমি কলকাতা শহর এবং সময়কাল সত্তরের উত্তাল সময়। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এই সাতের দশকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সময়টি নকশাল আন্দোলনের দ্বারা আলোড়িত। কিন্তু এখন প্রেম’ গল্প শুরু হয় এক সাধারণ মধ্যবিত্ত যুবকের তাৎপর্যহীন প্রেমভাবনার মধ্য দিয়ে। সংসারের হাঙরগ্রাস থেকে সামান্য পয়সা বাঁচিয়ে মাসের প্রথম রবিবারে স্কুলশিক্ষিকা প্রেমিকা কৃষ্ণার সঙ্গে সিনেমা দেখার শৌখিনতা সীতেশের—”সদ্য মাইনে পাওয়া পকেট কেরানী সীতেশকে এই শৌখিনতাটুকু ‘পারমিট’ করে।” আগে সে এই অপবায়টুকু নিয়ে হিসেব করত, কিন্তু এখন আর করে না—”সমুদ্রে যে শয়ন করেছে শিশিরে তার কি ভয়-গোছের একটা নির্লিপ্ততা সীতেশকে এখন মরিয়া করেছে। এই অংশে স্পষ্ট হয় লেখক সত্যিই কোনো মধ্যযুগীয় রোমান্টিক প্রেমগাথা আমাদের শোনাচ্ছেন না। বিশ শতকের আর্থিক সামাজিক বিপর্যয়ে প্রেমের সেই বিশুদ্ধ মূর্তি ভেঙে গেছে। এখন সেই প্রেমের ওপর প্রতিনিয়ত ছায়া ফেলছে সময়ের মেঘ। তাই সংসারের ভাবনা, আর্থিক সামর্থ্যের হিসেবনিকেশ করেই এগোতে হয় এই সময়ের প্রেমকেও।

টিকিট কেটে বহুক্ষণ অপেক্ষার পরেও কিন্তু কৃষ্ণা আসেনা। মধ্যবিত্তের প্রেমস্বপ্ন বা শৌখিনতার স্বপ্ন ভেঙে যায়। গল্পের এই প্রাথমিক দৃশ্যরচনায় সীতেশ-কৃষ্ণার, প্রেমসম্পর্কটাই লেখকের অভিনিবেশের কেন্দ্রে থাকে। পাঠক বুঝতে পারে, এ প্রেমে তেমন কোনো চিরকালের রোমান্টিকতার উপাদান নেই। এ প্রেম একান্ত মধ্যবিত্ত দুর্বলতা দিয়েই রচিত। তাই একটা ‘ক্ষিপ্ত বিষণ্ণতা ছাড়া এই সময়ের প্রেম সীতেশের মতো মধ্যবিত্ত কেরানিকে কিছু দেয় না। কিন্তু প্রাথমিক বিষণ্ণতা কাটিয়ে ওঠার পর এই প্রেমাবেগ তার মধ্যে জাগিয়ে তোলে উদ্ভবেগ। কি হয়েছে কৃষ্ণার! কেন এল না।…..অসুস্থ হয়ে পড়ল?” —ইত্যাদি প্রশ্ন ও দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক নিয়মেই সীতেশকে আলোড়িত করে।

এই ভাবনারই ফাঁকে লেখক সীতেশের স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দেন মধ্যবিত্ত সংসারের দৈনন্দিন আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে প্রেম কেমনভাবে লাবণ্যহীন হয়ে পড়ে। কৃষ্ণার মা একদিন অত্যন্ত স্নেহ করতেন সীতেশকে। কিন্তু ইদানীং তিনি যেন কৃষ্ণা-সীতেশের মেলামেশাকে আর ভালো চোখে দেখছেন না। কারণটা যে সংসারের বেহাল দশা, সেটা অনুভব করে সীতেশ। কৃষ্ণা সামান্য স্কুল-মাস্টারনি। কৃষ্ণার বাবা মারা গেছেন। ভাই মন্টু এখনও বেকার। ফলে সংসারের সমস্ত দায় কৃষ্ণারই কাঁধে। কিন্তু স্কুলে চাকরি করলেও তাদের বাকি ডি.এ. বহুকাল বকেয়া পড়ে থাকে। বহুবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, এবার সব বকেয়া মিটিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু প্রতিশ্রুতিভঙ্গের ইতিহাস এত দীর্ঘ যে, সেসব সংবাদে আর আস্থা বা বিশ্বাস নেই কৃষ্ণারও। তার ওপর কৃষ্ণার মা সঙ্গত কারণেই চিন্তা করেন, কৃষ্ণার এই প্রেম সীতেশের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে পূর্ণ হলে তাঁদের সংসারের কি দশা হবে। আর্থিক দুশ্চিন্তাই তাঁকে স্বার্থপর করে তোলে। কন্যার সুখকামনাও যেন ভুলিয়ে দেয় আর্থিক সংকট। এভাবেই প্রেমের সুখস্বর্গরচনার স্বপ্ন ক্রমাগত ব্যাহত হতে থাকে সময়ের আঘাতে।

পরদিন কৃষ্ণার কাছে সীতেশ জানতে পারে টালিগঞ্জে কৃষ্ণাদের পাড়ায় আবার ভয়ংকর গোলমাল শুরু হয়েছে। বোমাবাজি, খুনোখুনি, পুলিশ এবং সেই গোলমালের জন্য বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণেই কৃষ্ণা আসতে পারেনি গতকাল। কৃষ্ণা এটাও জানিয়ে দেয়—”কিন্তু রাতে আবার শুরু হবে।” এই সংবাদের মধ্য দিয়েই গল্পে রচিত হয়ে যায় যুগগত সমস্যার ফ্রেমটি। গল্পের অবশিষ্ট অংশে সেই যুগচিত্রেরই জীবন্ত প্রতিফলন ঘটে। গোলমালের খবর পেয়ে সীতেশ কৃষ্ণার নিষেধ সত্ত্বেও ছুটে যায় টালিগঞ্জে। সাধারণ মানুষের প্রেমের আকর্ষণ এবং মানবিক উদবেগের এ তো স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু ক্রমশ আমরা দেখতে পাব, সাধারণের এই স্বাভাবিক ক্রিয়া বা দৈনন্দিন জীবনপ্রক্রিয়া সমকালীন সময়ের অস্থিরতা কেমনভাবে প্রতিমুহূর্তে তছনছ হয়ে যাচ্ছিল সেই সত্তরের দিনগুলিতে। কৃষ্ণা-সীতেশের প্রেমজীবনের মধ্যবিত্তসুলভ শৌখিনতাটুকুই শুধু এই সময় বিপর্যস্ত করে দেয় না, বিপর্যস্ত করে সমগ্র দিনের কার্যক্রম, স্কুল-কলেজের স্বাভাবিক কার্যধারা, অফিস-আদালতের কাজকর্ম, অফিসযাত্রী বা দিনের শেষে ঘরে ফেরা মানুষদের নিরাপত্তা।

সীতেশ কৃষ্ণাদের বাড়ি পৌঁছোনোর পর কৃষ্ণার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় স্বাভাবিক রোমাঞ্চ বা প্রেমিককে কাছে পেয়ে স্বাভাবিক আনন্দের পরিবর্তে ঝরে পড়তে দেখি উদ্ভবেগ। সেই উদবেগ যেন ঝরে পড়ে ক্রোধের স্বরে—“তুমি কি করতে এলে?” কিংবা “তোমার আসাই উচিত হয়নি।” তার উদ্বেগের কারণ, রাতে গোলমাল হলে সীতেশের ফেরাটা ভয়ংকর বিপজ্জনক হবে। অর্থাৎ সমকালীন সময় প্রেমের স্বাভাবিক প্রকাশ ও প্রতিক্রিয়াকে কেমনভাবে পালটে দেয়, লেখক সেটিই যেন দেখিয়ে দিতে চান ‘এখন প্রেম’ গল্পে।

এরপরেই গল্পে আসে আতঙ্কময় সময়ের চূড়ান্ত দৃশ্য। প্রাইভেট বাস, ট্যাক্সি এবং পথচারীদের মধ্যে দেখা যায় অস্থির ত্রস্ত ভাব। গোলমাল শুরু হয়ে যায়। নিভে যায় রাস্তার সব আলো। কোথাও প্রচণ্ড শব্দে বোমা ফাটে। এবং তার পালটা পুলিশের ফায়ারিং-এর দুমদুম শব্দ হয়। কৃষ্ণা এবং কৃষ্ণার মা এই বিপদের মধ্যে আর যেতে দেয় না তাকে। এরপর লেখক যে বর্ণনাটি দেন, তার মধ্যে স্পষ্ট আঁকা হয়ে যায় সেই সময়ের ভয়ংকর আতঙ্কের ছবি—এ-বাড়ির প্রতিবেশীরা ছুটে এসে যে-যার ঘরে খিল দিতে শুরু করে। তাদের মুখেই শোনা যায়, ব্রিজের কাছে একটু আগেই একজন পুলিশ খুন হয়েছে। থানার উপরেও কারা বোমা ছুঁড়েছে মিলিটারি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলছে। তারা মাইকে কার্ফু জারি করে দিয়েছে। এবার বাড়ি বাড়ি ঢুকে সার্চ হবে। চিরুনি তল্লাশি। সার বেঁধে পুলিশের গাড়ি এগিয়ে আসছে।”

অতএব বাধ্য হয়েই কৃষ্ণাদের বাড়ি রাত্রিবাস করতে হয় সীতেশকে। তারপর গভীর রাত্রে সীতেশ আর কৃষ্ণা এই ভয়াবহ পরিস্থিতির নিস্তব্ধতার মাঝখানে মুখোমুখি বসে যখন যৌবনের স্বাভাবিক ধর্মে প্রেমের অনিবার্য প্রণোদনায় নিবিড় হয়ে আসে সেই মুহূর্তে আবার নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে যায় রাইফেলের শব্দে। একটা গগনভেদী মৃত্যু আর্তনাদ শোনা যায়। থরথর করে কেঁপে ওঠে কৃষ্ণা আর সীতেশ। তাদের প্রেমের নিবিড় মিলনাকাঙ্ক্ষা বিচূর্ণ হয়ে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় –“রাত্রিনৈঃশব্দ চিরে আবার কোথাও পরপর বোমা ফাটে। রাইফেলও গর্জে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে। ভূমিকম্পের মতো ঘরদরজা কেঁপে যায়।” তারই মধ্যে জানলা দিয়ে দেখা যায় জান্তব উল্লাসে হাতে রাইফেল নিয়ে একদল পুলিশ ছুটে আসছে। “তাদের দুজন একটি তরতাজা যুবকের দেহ দু’পা ধরে উঁচিয়ে রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। অরণ্যের হিংস্র প্রাণী অনেক চেষ্টায় ধাবমান কোনো হরিণ নিহত করে ঘাড়ে-গলায় দাঁত বসিয়ে টেনে হিচড়ে যেমন নিজের ডেরায় নিয়ে যায়—ঠিক তেমনি।” আহত যুবকটির রক্তাক্ত শরীর, থেঁতলানো মুখ, মৃত্যুভয়ে বিস্ফারিত চোখ। রাস্তা দিয়ে ছেঁচড়ে টেনে পুলিশদুটো সেই রক্তাক্ত দেহটাকে কালো ভ্যানের দরজা দিয়ে পাটাতনের ওপর আছড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। শেষবারের মতো একটা গোঙানি ভেসে আসে যুবকটির গলা থেকে।

এই ভয়ংকর জান্তব হত্যাদৃশ্য বিমূঢ় স্তব্ধ অসাড় করে দেয় দুটি প্রেমিক-প্রেমিকাকে। তারা আর মিলিত হতে পারে না। তাদের উদ্যত চুম্বনচেষ্টা অসমাপ্ত অবস্থাতেই যেন স্থগিত হয়ে যায়। তারপর সমস্ত রাত্রি তারা দুঃস্বপ্নে বিনিদ্র ভয়ার্ত মানুষের মতো ক্রিয়াহীন, প্রেমহীন, কামনাহীন নিশ্চেষ্টতায় একটি ভোরের প্রতীক্ষা করতে থাকে।

এ গল্পে ‘প্রেম’ আছে, কিন্তু তার থেকেও বড়ো হয়ে উঠেছে বিপর্যস্ত আতঙ্কগ্রস্ত সময়। তাই এখন’ শব্দটি হয়ে উঠেছে এই গল্পে প্রেমের প্রকৃত নির্দেশক। সময়ের অভিঘাতে প্রেমের বিমূঢ়তাই এই গল্পের প্রধান প্রতিপাদ্য হয়ে ওঠে বলে গল্পটির এখন প্রেম’ নামকরণ শিল্পসার্থক হয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস।