পদার্থ বিদ্যায় স্নাতক, বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র, খ্যাতিমান শিক্ষক সাধন টাপাধ্যায় যে ছোটোগল্প রচনায় সিদ্ধ হস্ত ছিলেন একথা তাঁর চারখানি গল্পের গ্রন্থ থেকে সহজেই বুঝতে পারা যায়। কিন্তু বিশেষ কোনো গল্প ছোটগল্প হিসেবে সার্থক হয়েছে কি না সে প্রসঙ্গে আলোচনা করতে হলে, কতকগুলি শর্ত ও যুক্তির নিরিখে বিচার করে দেখা প্রয়োজন।
আমাদের আলোচ্য সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘স্টীলের চঞ্চু’ গল্পটি রচিত হয়েছে এক অভিনব ভঙ্গিমায়। গল্পটি তিনটি স্তরে বিন্যস্ত। প্রথম স্তরে ভূপতির কথা, দ্বিতীয় স্তরে রুনুর কথা এবং অবশেষ স্তরে গল্পকারের বর্ণনা। এই তিনটি স্তরের মধ্যে দিয়ে গল্পকার সমগ্র গল্পটি তুলে ধরেছেন পাঠকের সামনে। ভূপতি এবং রুনুর আত্মকথন থেকে জানতে পারা যায় সমস্ত গল্পের কাহিনি, উভয়ের চরিত্র, সমস্যা, ঘটনাক্রম। এবং গল্পকারের বর্ণনা থেকে জানতে পারা যায় গল্পের পরিণতি।
গল্পের শুরু থেকেই পাঠক জানতে পারে ভূপতির দুঃখের কাহিনি। ভূপতি তার ছেলে রুনুকে নিয়ে ব্যথিত। রুনু – যে কিনা ছিল বাপের নির্ভরস্থল, অবস্থার প্রেক্ষিতে সেই রুনুই হয়েছে বাবার দুঃখের কারণ। শুধু তা-ই নয়, সে রীতিমত বাপকে ইডিয়ট’, ‘নিবোধ’ বলে গালিও দেয়। ভূপতির সেই দুঃখের কথা শুনতে শুনতে পাঠক তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। তাদের মধ্যে কৌতূহল জাগ্রত হয় রুনুর পরিনামের কথা জানতে। এর পর রুনুর কথা শুনতে বসেই বুঝতে পারে, রুনু মানসিক ব্যধির শিকার। তাই কিছুটা যেন মমতা বর্ষিত হয় তার ওপর। কিন্তু, সেই সঙ্গে পাঠকের মনে জেগে ওঠে আফশোষ- রুনুকে ভুল পথে চালিত করছে তার প্রেসিডেন্ট।
রুনুর পলিটব্যুরো এবং প্রেসিডেন্ট যে সুবিধাবাদী রাজনীতি করে, রুনু তা করতে পারে না। কারণ প্রথমত, রুনু ছাত্রাবস্থা থেকেই সীরিয়াস ছাত্র। এবং লোক ঠকানোর শিক্ষা সে ছোটোবেলা থেকে পায়নি। তাই প্রেসিডেন্ট অন্যান্য সদস্যদের দিয়ে নিজের উদরপূর্তির বন্দোবস্ত করতে পারলেও রুনু তার পলিটব্যুরোর মতাদর্শ শিরোধার্য করে অফিস কামাই করতে দ্বিধা করে না। আবার সেই আদর্শে প্রাণিত হয়েই রুনু লক্ষ করে সমাজের মৃত রূপটিকে। সেই সঙ্গে লক্ষ করে তার বাড়ির পাশে একটি গাছে ঝিমকালো একটি কাক সমাজকে খুবলে খাবে বলে তার তীক্ষ্ণ স্টীলের চঞ্চুতে সান দিচ্ছে।
এর পর পাঠকের কৌতূহলের অবসান হয় গল্পের ক্লাইমেক্সে পৌঁছে যেখানে সেই কাককে সংহার করতে গিয়ে রুনু বাড়ির ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে মারা যায়।
আলোচ্য গল্পের মধ্যে দেখা যায়, ছোটোগল্প হিসেবে যে সব শর্তগুলো মেনে চলতে হয় সেগুলি যথাযথ ভাবেই মেনে চলা হয়েছে। গল্পের মধ্যে কোনো অলীক আকাশকুসুম চিন্তা বা পরিণতি দেখা যায় না। ভূপতির জীবনাচরণ, রাজনীতি, রাজনীতি থেকে সরে এসে সংসারজীবন যাপন। সাংসারিক যন্ত্রনা রুনুর অবস্থা, ভুল রাজনৈতিক পদক্ষেপ, এমনকি রুনুর মৃত্যুও রুনুর মতো রোগীর পক্ষে স্বাভাবিক। কাজেই গল্পটি যে বাস্তবতায় পূর্ণ তা বলাই বাহুল্য।
এর পরের বিচার্য বিষয় গল্পের একমুখিনতা। এখানেও গল্পটি সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠক অদম্য কৌতূহলে গল্পের পরিণতির প্রত্যাশা করেছে। গল্পও একমুখী গতিতে এগিয়ে গেছে তার পরিনামের দিকে। এবং পাঠকের সেই কৌতূহলের অবসান হয়েছে একটিমাত্র ক্লাইমেক্সে এসে। তাই সবদিক থেকে বিচার করে সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘স্টীলের চঞ্চু’ গল্পটি যে ছোটোগল্প রূপে সার্থকতা লাভ করেছে এ বিষয়ে দ্বিমতের কোনো অবকাশ থাকে না।
Leave a comment