সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘স্টীলের চঞ্চু’ গল্পটির মধ্যে কেন্দ্রীয় চরিত্র রুনুর বাবা হলেন ভূপতি। আজীবন তিনি সংগ্রাম করে প্রৌঢ়ত্বের সীমায় এসে পৌঁছেছেন। চৌষট্টি বছরের জীবনের মধ্যে তিনি কোথাও নিশ্চিত্তের জীবন ভোগ করতে পারেন নি। এবং সেই সঙ্গে কোথাও তিনি জীবন থেকে পালিয়ে যাবার বা দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার ছলনাও করেন নি। এক অর্থে ভূপতিকে পাঠক দেখেছেন সৎ মধ্যবিত্ত দায়িত্ববান ব্যক্তি রূপে। তাঁর জীবন বৈচিত্র্যে পূর্ণ, নানা পথের পরিক্রমার শেষে ক্লান্ত হয়েও দারিদ্র্য ও অশান্তির কাছে তিনি হার স্বীকার করেন নি।

কৈশোরে স্কুল জীবন শেষ করেই শুরু হয় তাঁর সংগ্রামী জীবনের। কলেজে ভর্তি না হয়ে সংসারের জন্যে তাঁকে সেচ ইঞ্জিনিয়ারের হকারী থেকে শুরু করে ট্রামের কণ্ডাক্টরি পর্যন্ত করতে হয়েছে। তারপর একটু বেশি বয়সে ভর্তি হয়েছেন কলেজে। কলেজ জীবন থেকেই আবেগের বিপুল বাতাসে উড়ে কলেজের পড়া সাঙ্গ করেই ঝাঁপিয়ে ছিলেন দেশের কাজে। কাজের মধ্যে দিয়েই বুঝতে পেরেছিলেন মানুষের মুক্তি মানুষের মধ্যেই তাকে সেবা, রাজনীতি, দায়বদ্ধতা যে নামই দেওয়া হোক না কেন— এই হল কমরেডদের সার কথা। অর্থাৎ সুবিধাবাদী রাজনীতিক তিনি ছিলেন না। গোটা পাঁচের দশক জুড়ে তিনি পায়ে হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল, পরিচিত হয়েছেন অনেক মানুষের সঙ্গে। বুঝেছেন রাজনীতির প্রকৃত অর্থ হল মানুষের সেবা। সেই জন্যেই এলাকার রাজনীতির ইতিহাসে আজও তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।

তারপর যখন বুঝতে পারলেন শুধু রাজনীতি করলেই চলবে না সংসারেও তাঁর প্রয়োজন তখন সুদূর গ্রামাঞ্চলে গিয়ে স্কুলমাস্টারির চাকরি করতে শুরু করলেন। করলেন বিবাহও। এবং বিয়ের পরই শুরু হল জীবনের আর এক সংগ্রাম। স্ত্রীর স্বপ্নভঙ্গের বা ভাগ্যের পরিহাসের দায় বর্তালো তাঁর উপর। স্ত্রীর মনের সেই ব্যথায় প্রলেপ দেবার জন্যে নিজেকে আরো জড়িয়ে ফেললেন কাজে নিজেকে করে তুললেন সংসারের অভাব মেটানোর যন্ত্র।

পুত্র রুনু যখন স্কুল-কলেজ জীবনে ভাল ফল নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে নিজের চেষ্টায় রেল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে রেলের অ্যাকাউন্ট ক্লার্কের চাকরি পেল, তখন তিনি ভাবলেন বুঝি জোয়াল টানার দিনের অবসান হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পরেই দেখলেন রুনু মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে। সে আর অফিসে যায় না। তার খাওয়া-পরা ওষুধ সহ সমস্ত চাপ আবার এসে পড়ল বিস্তৃতির কাঁধে। সেই সঙ্গে বাড়তি পাওনা হল রুনুর কাছে থেকে অকথ্য গালিগালাজ ও অবজ্ঞাসূচক মন্তব্য। বন্ধুদের কাছে মনের দুঃখের কথা জানাতে গেলে তাঁরা ভাবতেন বাড়িয়ে বলছে। ডাক্তারের কাছে বলতে গেলে ডাক্তার তাকেই জেনারেশন গ্যাপটা মেনে নিয়ে সহ্য করার ও রুনুর কথার প্রতিবাদ না করার পরামর্শ দিতেন। এই অবস্থায় পড়ে তিনি নিঃসহায় দুঃখী হয়ে হৃদরোগের শিকার হলেন। লক্ষ করলেন, রোগগ্রস্থ অবস্থাতেও পুত্রের কাছে কোনো সেবা তো দূরে থাক সহানুভূতিও পেলেন না। বিস্তৃতি অসুস্থ হলে রুনু প্রথমেই গ্রীলের গেটে তালা দিয়ে দিল। ভূপতির সঙ্গে দেখা করতে কেউ দেখা করতে এলে তাকে ফিরিয়ে দিতে লাগল রুনু। এমনকি অ্যাম্বুলেন্সও ফিরিয়ে দিল সে। ভূপতি রুনুর সেই গর্হিত আচরণও মেনে নিল। তবু গল্পের পরিণতিতে পুত্রশোক পেতে হল ভূপতিকে।

ভূপতি বাঁড়ুজ্জের মতো মধ্যবিত্ত মানুষের চরিত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক এই যে, জীবনের কোনো সংগ্রামেই তিনি পিছপা হন নি। দারিদ্র্য তার জীবনকে কুরে কুরে খেয়েছে। জীবনে অবহেলা, অসম্মান সবই জুটেছে দারিদ্র্যের সঙ্গী হিসেবে। আত্মীয় পরিজনের কাছে বিশেষ করে রুনুর মাসীদের কাছে তাঁর দ্বার কতকাংশে রুদ্ধ হয়ে গেছে। তবু সংগ্রামী মানসিকতায় চিড় ধরে নি। রাজনীতির আঙিনায় এসে সুযোগের সদব্যবহার করে নিজের আখের গোছানোর চেষ্টা করেন ভূপতি, তিনি মানুষের সেবাকেই মূল তত্ত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। পরিশেষে চিররুখ কন্যা ও মানসিক রোগাক্রান্ত পুত্রের সুখ আরোগ্যের জন্যে আপ্রাণ প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। সব মিলিয়ে ভূপতি চরিত্রটি একটি বলিষ্ট সংগ্রামী চরিত্র রূপে প্রতিভাত হয়েছে আলোচ্য গল্পের মধ্যে।