ফণীশ্বরনাথ রেণুর ‘দাহ’ গল্পের আখ্যানবস্তুতে আসলে বর্ণিত হয়েছে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে অশুভশক্তির মতো মিশে থাকা সাম্প্রদায়িকতার হিংস্রতার চিত্র। এই গল্পের যিনি কেন্দ্রীয় চরিত্র, সেই ফতিমাদির মধ্যে দেখানো হয়েছে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের এক অনমনীয়তা দৃঢ়তা। এই শক্তিশালী সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে তাঁর জীবন বিপন্ন হয়েছে বহুবার। শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রমত্ত মানুষেরা তাঁর মুখ দগ্ধ করে দিয়েছে। ‘দাহ’ তাই একটি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের গল্প।
গল্পের কথক অর্জিত পটনা শহরে আকস্মিকভাবে ফতিমাদির দেখা পায় বোরখা ঢাকা এক মহিলা হিসাবে। অথচ যে ফতিমাদিকে অজিত চিনত, তিনি এক গান্ধি-অনুগামী অহিংস জাতীয়তাবাদী নারী। ১৯৩০-এ স্কুল মাঠের এক সভায় ফতিমাদিকে প্রথম দেখেছিল অজিত। গান্ধিটুপিপরা মানুষের মধ্যে পাঁড়িয়ে দশ-এগারো বছরের মেয়ে ফতিমাদি কাঁধে তেরঙ্গা ঝান্ডা নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিল। গান্ধিজি আদর্শে অনুপ্রাণিত খাদি-আন্দোলনের ধারক সোনারপুরের মৌলবি সাহেবের মেয়ে ফতিমা। ১৯৩৪-এ ভূমিকম্পের পর ফতিমাদিকে দ্বিতীয়বার দেখে অজিত। ভূমিকম্পপীড়িত অঞ্চলে পরিক্রমারত গান্ধিজির সভায় তাঁর পাশেই দাঁড়িয়েছিল সে। গান্ধির প্রার্থনা সভায় কোরানশরিফের আয়াতগুলি সুর করে পড়ছিল ফতিমাদি। এই বয়সেই পুলিশের লাঠির ঘায়ে আহত হয়ে দু’বছরের কারাদণ্ডও নাকি ভোগ করে সম্প্রতি বেরিয়েছে।
১৯৩৭-এ কংগ্রেসি মিনিস্ট্রির সময় রাজনৈতিক জেলা সম্মেলনে তৃতীয়বার দেখা ফতিমাদির সঙ্গে। এই সভায় মুসলিম নেতারা যখন গোলযোগের চেষ্টা করে, তখন ফতিমাদি লাফ দিয়ে মঞ্চে উঠে সেই আন্দোলন বিনষ্টকারীদের তীব্রভাবে ভৎসনা করেছিল। এ তাঁর দুর্দমনীয় সাহসের পরিচয়। ১৯৪৩-এ স্বাধীন সেনার বৈপ্লবিক কর্মসূচি নিয়ে অজিত দীর্ঘ পাঁচমাস বেনারস-লখনউ-এলাহাবাদ-গোরখপুরে প্রচারের সময় পুলিশ সার্জেন্টের অকথ্য গালিগালাজের উত্তরে তাঁর বিদ্রোহী সত্তাকে ঝলসে উঠতে দেখেছিল অজিত। ১৯৪৭-এও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়েও তিনি দুর্বৃত্তদের সঙ্গে অসীম দৃঢ়তা ও সাহসিকতায় মোকাবিলা করতেন। সেই ফতিমাদির মুখ বোরখায় ঢাকা দেখে বিস্মিত হয় অজিত।
দানিশ মঞ্ঝিলে ফতিমাদির সঙ্গে দেখা করার পরেও অজিত সেই নির্ভয় দৃঢ়চিত্ত নারীর এই বোরখার আবরণ টেনে নেবার রহস্য উন্মোচন করতে পারে না। ফেরার সময় অজিত দেখতে পায় ন্যাশনালিস্ট মুসলিম কনভেনশনের বিরুদ্ধে পোস্টার। তারা ভারতের অখণ্ড জাতীয়তাবাদের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে একদিন ফতিমাদিই অজিতের বাড়িতে এসে তার স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করেন। সেদিন অজিত জানতে পারে ফতিমাদির মনে জমে থাকা ক্ষোভের পরিচয়। সেই সমস্ত তথাকথিত কংগ্রেসিদের ওপর তাঁর ক্ষোভ, যাঁরা বগলের নীচে লুকিয়ে রেখেছেন ছুরি।
একদিন যারা গান্ধি-প্যাটেলকে গাল দিয়েছে, জাতীয় পতাকা পুড়িয়েছে, তারাই যখন কংগ্রেসে মর্যাদা লাভ করে, তখন ফতিমাদির শুল্ক হবারই কথা। আর যারা একদিন দেশের অখণ্ডতার জন্য প্রাণপাত করেছে, তাদের উপেক্ষা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত ফতিমাদি জানান তাঁর ওপর পাষণ্ডরা কী ভয়ংকর উৎপীড়ন চালিয়েছে। কারও কাছে তিনি প্রতিবিধান পাননি। সবার কেবল গদির চিন্তা। ফতিমাদি জানান, যেসব কবি-গায়ক একদিন সম্প্রীতির কথা বলত, তারা আজাদির পর নীরব হয়ে গেছে। বিভেদকামী মানুষেরাই সর্বেসর্বা হয়ে উঠে গোটা দেশটাকে গিলে খাচ্ছে বলে ফতিমাদির আক্ষেপ ও ক্ষোভ।
টাউনহলে ন্যাশনালিস্ট মুসলিম কনফারেন্সের দিন লিগপন্থী বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীদের গালাগালি, ইট-পাথরের বর্ষণে প্রবল উত্তেজনার আবহ তৈরি হয়। বিক্ষোভে শামিল বড়ো মুসলিম নেতা ও আমলাদের পুত্র ও সমর্থনপুষ্টরা। ন্যাশনালিস্ট প্রতিনিধিদের এক-একজনের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বর্ষিত হয় অশ্লীল গালি। তারপর তারা প্রতিনিধিদের মারতে শুরু করলে হঠাৎ দেখা যায় ‘মহাত্মা গান্ধি কী জয়’ ধ্বনি দিয়ে হলের প্রবেশদ্বারে দেখা দিলেন ফতিমাদি এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের ধিক্কার দিলেন ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে। বিক্ষোভকারীরা এবার ঝাঁপিয়ে পড়ল ফতিমাদির উপর। তাঁকে বিবস্ত্র করে মুখে ঢেলে দিল অ্যাসিড। ভাঙা হাত, দগ্ধ মুখ নিয়ে হাসপাতালে ভরতি হয়েও ফতিমাদি যন্ত্রণা লুকিয়ে রেখে হাসেন।
সমগ্র গল্পের এই হল বিষয়বস্তু। এই গল্পে প্রত্যক্ষভাবে আমার দেখি সাম্প্রদায়িকবাদীদের হাতে ফতিমাদির নিগৃহীত হবার বা দগ্ধ হবার ঘটনা। ফতিমাদির মুখের এই দাহ নিতান্তই বাহ্যিক। আসলে ফতিমাদির অন্তরের প্রতিকারহীন প্রদাহই এই গল্পের প্রধান অন্বিষ্ট। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মুষ্টিমেয় একটি অংশ গান্ধিজির আদর্শে এবং সম্প্রীতির মন্ত্রে উজ্জীবিত ছিল। তারা চায়নি মুসলিম লিগ প্রস্তাবিত পৃথক রাষ্ট্র। তারা ক্ষুদ্র সীমাবদ্ধ শক্তি নিয়েই অখণ্ড জাতীয়তাবাদের পক্ষে অহিংস লড়াই চালিয়েছিল। ফতিমাদি ছিলেন তাদেরই একজন ন্যাশনালিস্ট মুসলিম কনফারেন্স বা জাতীয়তাবাদী মুসলিম সমাবেশে তাই বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে মুসলমানদের বোঝানোর কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। স্বভাবতই তা পছন্দ হয়নি রক্ষণশীল লিগবাদীদের। তারা হিংস্রভাবে উদারপন্থী আদর্শবাদী অসাম্প্রদায়িক মুসলমানদের প্রচেষ্টাকে বানচাল করতে চেয়েছিল। কিন্তু ফতিমাদি অহিংস হলেও তাঁর সাহস ও দৃঢ়তা এই আক্রমণকে তীব্র উচ্চকণ্ঠে ধিক্কার দিয়ে প্রতিরোধ করতে তৎপর হতেই নেমে এসেছিল বর্বর নির্মম হিংসা। সেই নির্মম সাম্প্রদায়িকতার আগুনে দগ্ধ হতে হয়েছিল ফতিমাদির মতো আদর্শবাদী গান্ধিবাদী রমণীকে। এই দাহই গল্পে একটি মানবিক আবেগঘন মূর্তি নিয়েছে।
আসলে ফতিমাদিও এই গল্পে উপলক্ষ্য মাত্র। তাঁর বলিষ্ঠ অথচ নির্মল মুখের দাহও তাই নিছক একটি ব্যক্তিগত ঘটনা। আসলে ফতিমাদির মতো ব্যক্তিকে আশ্রয় করে লেখক তুলে ধরতে চেয়েছেন সমগ্র দেশ ও অখণ্ড ভারতীয় জাতিসত্তার ট্রাজিক দহনকেই। সেই বৃহত্তর ব্যঞ্জনাতেই গল্পটির ‘দাহ’ নামকরণ সার্থক।
Leave a comment