ফণীশ্বরনাথ রেণুর ‘দাহ’ গল্পটির রচনাকাল ১৯৬৬। গল্পের প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিককাল হিসাবে যে সময়টিকে পাই, সেটি রচনাকালেরই সময়। কেননা ১৯৩০ সালটির স্মৃতি গল্পে বর্ণিত হচ্ছে ‘আজ থেকে ছত্রিশ বছর আগে’ বলে। ১৯৩০-এর সঙ্গে ছত্রিশ বছর যোগ করলে ১৯৬৬ সালই পাই। অর্থাৎ গল্পটির প্রেক্ষাপট ১৯৩০ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত বিস্তৃত। অতএব ‘দাহ’ গল্পের পটভূমিতে রয়েছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ তথা রাজনীতির এক দীর্ঘ অস্থির সময়। জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লিগ, হিন্দু মহাসভা, ভারত-বিভাজনের প্রেক্ষিতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, দাঙ্গা, হিংসা ইত্যাদি প্রায় প্রত্যেকটি সমকালীন ঘটনাপরই ক্রমান্বয়ে ছুঁয়ে গেছে এই গল্প।
‘দাহ’ গল্পের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটি বুঝতে গেলে ইতিহাসের আশ্রয় গ্রহণ আবশ্যিক। বিশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিল প্রধানত কংগ্রেস পরিচালনাধীন। ১৯০৫-এ লর্ড কার্জন ঘোষিত বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব এই জাতীয় আন্দোলনেক এক নির্মম ঝস্তবতার মুখোমুখি করেছিল। দ্বিজাতিতত্ত্বের এই ধারণা যেন বুঝিয়ে দিল, অখণ্ড ভারতের কংগ্রেসি জাতীয়তাবাদ প্রধানত হিন্দু জাতি-ধর্মকেন্দ্রিক। দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের সম্পর্কে কোনো চিন্তা বা আবেগ এই কংগ্রেসি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে তখনও অন্বিত হতে পারেনি। কংগ্রেস দেশের বৃহৎ মুসলমান শ্রেণির ধর্মচেতনা, সমাজবিধি, নিরাপত্তা, মর্যাদা, সুখদুঃখের প্রতি কোনো মনোযোগই দেয়নি।
যাই হোক, ১৯১৫-তে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরলেন মহাত্মা গান্ধি। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এরপর গান্ধিজির নেতৃত্বেই বৃহত্তর জনআন্দোলনে পরিণত হয়। ১৯১৬-তে লোকমান্য তিলকের উদ্যোগে লখনউ চুক্তির মধ্য দিয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে আপসের পথ সুগম হয়। সেই সঙ্গে ১৯১৯-এ ভারতীয় মুসলমানগণ ইংরেজ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করায় কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের সহযোগিতার সূত্র দৃঢ় হয়। কেননা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের সুলতান জার্মানির পক্ষ নেওয়ায় ব্রিটিশেরা তাঁর প্রতি বিরূপ হয় ও তুরস্ক ব্যবচ্ছেদ করে প্রতিহিংসা গ্রহণ করে। তুরস্কের সুলতানকে মুসলমানগণ খলিফার মর্যাদায় মান্য করতেন। ফলে ইসলাম ধর্মের মর্যাদা রক্ষার দাবিতে ১৯১৯-এ শুরু হয় মুসলমানদের খেলাফত আন্দোলন। গান্ধিজি খেলাফত আন্দোলন সমর্থন করে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকে দৃঢ়তর করে তোলেন। এই বছরেই মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন বা ভারত শাসন আইন, রাওলাট আইন ও জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে তীব্রতা দেয়।
১৯২১-এ গান্ধিজির নেতৃত্বে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। বিদ্যালয়, কলেজ, আদালত ও সরকারি অফিস থেকে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে গান্ধিজির ডাকে বেরিয়ে এসে ইংরেজ সরকারের সঙ্গে সার্বিক অসহযোগিতা শুরু হয়। গান্ধিজি সেই সঙ্গে জোর দেন আত্মনির্ভরতার উপর। তারই সূত্রে চরখা, খাদি ব্যবহার ও বিদেশি বস্ত্র পোড়ানোর কর্মসূচি এক তীব্র জাতীয়তাবাদী আবেগের সৃষ্টি করে। কিন্তু চৌরিচৌরায় আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে উঠলে ১৯২২-এ গান্ধিজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে ক্রমে হিন্দু-মুসলিম সহযোগিতার বিষয়টিও স্তিমিত হয়ে যায়। ১৯২৫ থেকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আবার নানাভাবে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে অন্যদিকে তীব্র হতে থাকে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন।
১৯২৮ থেকে গান্ধিজি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে অস্পৃশ্যতা নিবারণ, চরখা ব্রত, সবরমতী আশ্রমে প্রকৃত সত্যাগ্রহী গড়ে তোলা ইত্যাদি কাজে ব্রতী হন। কংগ্রেসের বাইরে বৃহত্তর জনসমাজকে নিয়ে ১৯২৮-এ গান্ধিজি শুরু করেন গুজরাতের সুরাত জেলার বারদোলিতে সত্যাগ্রহ আন্দোলন। ১৯৩০-এ গান্ধিজি ১১ দফার এক চরমপত্র ঘোষণা করেন। দাবিগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ইংরেজের লবণকরের বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে ভারতবাসীর লবণ উৎপাদনের অধিকার সম্পৃক্ত। ফলে এক বৃহৎ জনসমাজ সেই পর্বে গান্ধিজির সত্যাগ্রহ, অহিংসা, নীতিপরায়ণতা, সত্যবাদিতা, আভিজাত্যহীন আচরণের সহজতা এবং তাঁর সম্প্রদায়বুদ্ধিহীন আন্দোলনের অনুগামী হয়ে উঠেছিলেন। ফণীশরনাথ রেণুর ‘দাহ’ গল্পের প্রথমাংশে ১৯৩০-এ গান্ধিজির প্রতি সাধারণ হিন্দু-মুসলিম সমাজের এই সশ্রদ্ধ আনুগত্যের আভাস আছে। এবং ইতিহাসে দেখছি, এই পর্বে তাঁর আইন অমান্য বা ডাক্তি অভিযান কিংবা যে-কোনো সভাতে ও কর্মসূচিতে উল্লেখযোগ্যভাবে নারীদেরও অংশগ্রহণ।
১৯৩১-এ গান্ধি-আরউইন চুক্তির মাধ্যমে আন্দোলন তুলে নেওয়া হলে এবং লন্ডনের গোল টেবিল বৈঠক থেকে গান্ধিজি শূন্য হাতে ফিরে এলে গান্দিবাদী আন্দোলনের প্রতি কিছুসংখ্যক মানুষের মোহভঙ্গ হতে থাকে। ইতোমধ্যে ১৯৩৫ ও ১৯৩৭-এ প্রাদেশিক ক্ষেত্রে নির্বাচনে কংগ্রেস জয়লাভ করে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করায় মুসলমানদের আশঙ্কা বেড়েছিল। কংগ্রেসের এই জয় তাঁদের কাছে হিন্দু প্রাধান্যেরই নামান্তর বলে মনে হয়েছিল। ১৯৩০ নাগাদ মুসলমানরা তেমনভাবে রাজনৈতিক সম্প্রদায় হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ১৯৩৭-এর পর কংগ্রেসের বিপুল জয়ের প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম লিগ পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এই পুনরুজ্জীবনের মন্ত্রদাতার ভূমিকা নেন মহম্মদ আলি জিন্না। গল্পে ১৯৩৭-এ কংগ্রেসি মিনিস্ট্রির সময় রাজনৈতিক জেলা সম্মেলনে মুসলিম নেতাদের গোলযোগ পাকানোর প্রসঙ্গটি তৎকালীন রাজনৈতিক উত্তাপটিকে ধরিয়ে দেয়। ১৯৪০-এ মুসলিম লিগের লাহোর প্রস্তাবে মুসলমানদের পৃথক জাতি হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয়। এই লাহোর কংগ্রেস তাই অবশ্যম্ভাবীভাবে ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে এক তীব্র সাম্প্রদায়িক ও বিচ্ছিন্নতাকামী আবেগ তৈরি করেছিল। গান্ধিজি ভারতকে এক অখণ্ড সত্তা বলেই মনে করতেন। তিনি বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় দিতে চাননি। ফলে বিচ্ছিন্নতাবাদী লিগপন্থীদের কাছে গান্ধিজি ও গান্ধি-অনুগামী অখণ্ডতাকামী কংগ্রেস শত্রুপক্ষে পরিণত হয়েছিলেন। এই সাম্প্রদায়িক বিষই শেষ পর্যন্ত ভারতভাগ ও ভয়ংকর দাঙ্গা ঘটিয়েছিল।
মুসলিম লিগের তীব্র প্রচারের ফলে সাম্প্রদায়িক চিন্তার বিষ দ্রুত মুসলিমদের প্রভাবত করলেও কিছু সংখ্যক উদারপন্থী মুসলিম তখনও গান্ধিজির অহিংসা ও অখণ্ড জাতীয়তার আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তাঁরা ন্যাশনালিস্ট মুসলিম হিসাবে ছিলেন বৃহত্তর লিগপন্থীদের কাছে ঘৃণার পাত্র। আলোচ্য গল্পের ফতিমাদি ছিলেন সোনারপুরের মৌলবিসাহেবের মেয়ে। সোনারপুরের মৌলবিসাহেব গান্ধিজির আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং চরখা-খাদি আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ শরিক। অতএব ফতিমাও বাবার অনুসরণে হয়ে উঠেছিলেন গান্ধিজির অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের এক সক্রিয় সদস্যা। ১৯৩৭ এ কংগ্রেসের জেলা সম্মেলনে লিগপন্থীদের ষড়যন্ত্রকে প্রতিরোধ করতে সক্রিয় হতে দেখি ফতিমাকে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট পাকিস্তানের জন্য ‘সরাসরি লড়াইয়ের দিন’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ওই দিনেই কলকাতায় শুরু হয়ে যায় দাঙ্গা। ১৯৪৭-এর মার্চ থেকে বীভৎস দাঙ্গায় বিধ্বস্ত হয় পঞ্জাব। এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে তাখণ্ড ভারতের স্বপ্ন আর যথেষ্ট দৃঢ়তা রক্ষা করতে পারেনি। ১৯৪৭-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রসঙ্গও অবধারিতভাবে এসেছে ‘দাহ’ গল্পে। গল্পের ফতিমা ধর্মে মুসলমান হয়েও সাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়েই দাঙ্গাবিধ্বস্ত এলাকায় দুর্গত আর্তদের সেবা করেছে।
১৯৪৭-এর আগস্টে স্বভাবতই আমরা পেলাম এক রক্তাক্ত বেদনাদায়ক দ্বিখণ্ডিত স্বাধীনতা। কিন্তু যে পারস্পরিক সন্দেহ, স্বার্থপরতা, ক্ষমতালিপ্সা, অবিশ্বাস থেকে এই সাম্প্রদায়িক হিংসার জন্ম, দেশভাগের ফলে তা কার্যত নিরসন হল না। স্বাধীন ভারতেও সেই সাম্প্রদায়িক বিষযন্ত্রণা রয়েই গেল নানাভাবে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সেই ভয়ংকর রাজনৈতিক আবর্তকেও ফণীশ্বরনাথ রূপায়িত করেছেন কয়েকটি সংক্ষিপ্ত আঁচড়ে। ফতিমার প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে আত্মগোপন ও বোরখার অবগুণ্ঠন টেনে নেবার পিছনে যে ক্ষোভটি প্রকাশিত, সেখানেই নিহিত রয়েছে তৎকালীন রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত। ফতিমা ক্ষুব্ধ’ কারণ স্বাধীন ভারতে একশ্রেণির কংগ্রেস নেতা বগলের নীচে বিভেদের ছুরি লুকিয়ে রেখে কেবল ক্ষমতা ও গতির লোভে মত্ত হয়ে আছে। একদিন যারা গান্ধি-প্যাটলেকে অহিংসা নীতি ও অখণ্ড ভারতসাধনার জন্য গাল দিয়েছে, জাতীয় পতাকা পুড়িয়েছে, তারাই স্বাধীন দেশের সরকারে মর্যাদা লাভ করেছে। যারা একদিন দেশের অখণ্ডতার জন্য প্রাণপাত করেছে, তাদের উপেক্ষা করা হয়েছে স্বাধীন দেশে। যেসব কবি-গায়ক একদিন সম্প্রীতির কথা বলত, তারা আজাদির পর নীরব হয়ে গেছে। অতএব স্বাধীন ভারতে গান্ধিজির অহিংসা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা স্বার্থ ও ক্ষমতার মত্ততায় উপেক্ষিত। ফতিমার ক্ষোভের মধ্যে প্রকাশিত সেই ক্ষমতান্ধ রাজনীতির ভয়ংকরতা। জাতীয়তাবাদী ভাবনা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন মুসলমানরা কেমনভাবে আক্রান্ত হয়েছেন স্বাধীন ভারতেও, তা গল্পে উঠে এসেছে ১৯৬৬-র ন্যাশনালিস্ট মুসলিম কনফারেন্সে লিগপন্থীদের তাণ্ডব ও ফতিমার উপর কদর্য নির্মম আক্রমণের ঘটনায়। বিভেদকামী মানুষেরাই সর্বেসর্বা হয়ে উঠে গোটা দেশটাকে গিলে খাওয়ায় প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে আক্ষেপে ও ক্ষোভে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন ফতিমা।
গল্পের বিভিন্ন ঘটনাধারা ও ফতিমার সংলাপে জীবন্ত হয়ে উঠেছে সেই উত্তাল জটিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। তবে একটি ছোটোগল্পের সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই দীর্ঘ জটিল বিভিন্ন স্বার্থের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে প্রকাশ সহজ বিষয় নয়। স্বাভাবিকভাবেই তাই ‘দাহ’ গল্প ইতিহাস-অনভিজ্ঞ পাঠকের কাছে কিছুটা অস্বচ্ছ থেকে যায়। তবু তৎকালীন ইতিহাসটুকু জানা থাকলে ‘দাহ’ গল্পকে যথার্থই সে যুগের একটি শিল্পিত দলিল বলে গণ্য করতে হয়।
Leave a comment