বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে এমন সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন যা কমলাকান্তের দপ্তরের অন্তর্ভুক্ত রচনাগুলিরও উপজীব্য বিষয়। তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘সাম্য’ ও দপ্তরের ‘বিড়াল’ রচনাটির বিষয়বস্তু বা প্রতিপাদ্য এক। বঙ্কিম অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর যে সমস্ত ইয়োরোপীয় মনীষীদের চিন্তাভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অষ্টাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত ফরাসি চিন্তাবিদ রুশো অন্যতম। তিনি যে সমানাধিকারের তত্ত্ব বা দর্শন প্রচার করেছিলেন সেটি আধুনিক সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রবাদের উৎস। রুশো বলেছিলেন, মানুষ স্বাধীন হয়েই জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু সমস্ত ক্ষেত্রেই তাকে বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে দেখা যায়। মানুষ যেহেতু স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে তখন স্বল্প সংখ্যক প্রতিনিধি বা বিশেষ অধিকার প্রাপ্ত শাসক শ্রেণির জনসাধারণকে শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখার কোনো অধিকার নেই—রুশোর বিখ্যাত ‘সোশ্যাল কনট্যাকট্’ বা সামাজিক চুক্তি মতবাদ এই নীতির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। বিড়াল রচনাটিতে বিড়াল ও কমলাকান্তের বাদ-প্রতিবাদে সাম্যের এই চিন্তা প্রত্যয়কেই উপস্থাপিত হতে দেখি।
বিড়াল শোষিত, সর্বহারা, দরিদ্র সমাজের প্রবক্তা রূপে এই বক্তব্য উপস্থাপিত করেছে : এই সংসারের ক্ষীর, সর, দুগ্ধ, দধি, মৎস্য, মাংস ইত্যাদি সবই কমলাকান্তের অর্থাৎ ধনীরা খাবে; তারা বিড়ালেরা, অর্থাৎ দরিদ্ররা কিছু পাবে না কেন, কোন যুক্তিতে তারা এই সমস্ত খাদ্যবস্তু থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকবে। ধনী ও দরিদ্র শুধু এই শ্রেণিগত পার্থক্যের জন্যই? কিন্তু ধনীদের মতো সত্যিই দরিদ্ররাও তো মানুষ, প্রকৃত প্রভেদ সত্যিই কিছু আছে কি? ধনীদের যেমন ক্ষুধা তৃষ্ণা আছে, তেমনি দরিদ্রেরও আছে। কোনো দরিদ্রই সাধ করে চোর হয় না, খেতে পেলে কে চোর হয়। সমাজের উঁচুতলার যে সব মানুষ বড়ো বড়ো সাধু সেজে বসে আছেন এবং চোরের নামে শিউরে ওঠেন তাঁদের অনেকেই চোর অপেক্ষাও অধার্মিক, চুরি করার প্রয়োজন নেই বলেই তাঁরা চুরি করেন না। কিন্তু প্রয়োজনাতীত ধন থাকা সত্ত্বেও তাঁরা যে চোরের দিকে মুখ তুলে চেয়ে দেখেন না, তার জন্যই চোর চুরি করে। অধর্ম চোরের নয়, চোর যে চুরি করে সে অধর্ম কৃপণ ধনীর, চোর দোষী, কিন্তু কৃপণ ধনী তার থেকে শতগুণে দোষী। চোরকে দণ্ড দেওয়া হয়, কিন্তু চুরির মূল যে কৃপণ ধনী তার দণ্ড হয় না কেন? দরিদ্রের আহার সংগ্রহের দণ্ড আছে, ধনীর কৃপণতার দণ্ড নেই কী কারণে? ধনীর দোষেই কি দরিদ্র চোরে পরিণত হয় না। পাঁচশ জন দরিদ্রকে বঞ্চিত করে একজন তাদের আহার্য সংগ্রহ করবে কেন, যদি করল তবে সে তার আহারের পর যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তা দরিদ্রকে কেন দেবে না? যদি না দেয় তবে দরিদ্র অবশ্য তার থেকে চুরি করবে, কারণ না খেতে পেয়ে মরবার জন্য কেউ এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেনি।
বিড়ালের এই বক্তব্য খণ্ডন করার জন্য ধনতন্ত্রের প্রতিনিধিরূপে কমলাকান্ত তার সমর্থনে সেই সনাতন যুক্তি উপস্থাপিত করেছে : এই কথাগুলো অত্যন্ত সোশিয়ালিস্টিক, সমাজ বিশৃঙ্খলার মূল। যার যত ক্ষমতা সে যদি তত ধন সঞ্চয় করতে না পারে, অথবা সঞ্চয়ের পরে চোরের জ্বালায় ভোগ না করতে পারে, তবে কেউ আর ধন সঞ্চয়ে যত্নবান হবে না, তাতে সমাজের ধন বৃদ্ধি হবে না। আর সামাজিক ধন বৃদ্ধি ছাড়া সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়। ধনতন্ত্রের সমর্থনে কমলাকান্তের এই যুক্তি বা বক্তব্যের প্রতিবাদে বিড়াল বলেছে, সে যদি খেতেই না পেল তার সমাজের উন্নতি নিয়ে কি করবে। এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের খেয়ে পরে বাঁচার অধিকার আছে, এই অধিকার জন্মগত। কিন্তু মুষ্টিমেয় ধনী শ্রেণি তাদের শোষণ করে, তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলে। ধনতন্ত্রের প্রবক্তারা ভেবে দেখেন না, সমাজের উন্নতি তথা ধনীদের সমৃদ্ধি অসংখ্য দরিদ্র নিরন্ন মানুষদের কাছে অর্থহীন নির্মম পরিহাস। ক্ষুধার জ্বালা যে কী ভয়ঙ্কর, অসহনীয়, ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বোঝে না। সমাজতন্ত্রের প্রবক্তারূপে বিড়াল যথার্থই বলেছে, সমাজের ধন বৃদ্ধির অর্থ ধনীর ধন বৃদ্ধি, ধনীর ধন বৃদ্ধি না হলে দরিদ্রের কী ক্ষতি সে যদি খেতেই না পেল তবে সমাজের উন্নতি দিয়ে সে কী করবে। ক্ষুধার জ্বালায় যে মানুষ ছটফট করছে, দুচোখে অন্ধকার দেখছে, যার কর্ণদ্বয় রুদ্ধ হয়ে আসছে, তার কাছে এই সামাজিক উন্নতির তো কোনো অর্থই নেই। এভাবেই বঙ্কিমচন্দ্ৰ ‘বিড়াল’ প্রবন্ধে সাম্যবাদের আদর্শকে বাণীরূপ দিয়েছেন।
বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন মানব প্রীতির আজীবন পূজারী। বিড়ালে তার রূপায়ণ সত্যই প্রাণবন্ত, হৃদয়স্পর্শী। বিড়ালের ক্ষুধার জ্বালার এই বর্ণনায় সমাজের দরিদ্র নিরন্ন মানুষদের ক্ষুধার জ্বালা যন্ত্রণাকেই বাস্তব, জীবন্ত ও তীব্ররূপ পেতে দেখি “দেখ, আমি প্রাচীরে প্রাচীরে মেও মেও করিয়া বেড়াই, কেহ আমাকে মাছের কাঁটাখানাও ফেলিয়া দেয় না। মাছের কাঁটা, পাতের ভাত নরদমায় ফেলিয়া দেয়, জলে ফেলিয়া দেয়, তথাপি আমাকে ডাকিয়া দেয় না। তোমাদের পেটভরা, আমাদের পেটের ক্ষুধা কি প্রকারে জানিবে। হায়! দরিদ্রের জন্য ব্যথিত হইলে তোমাদের কি কিছু অগৌরব আছে? …তেলা মাথায় তেল দেওয়া মনুষ্যজাতির রোগ দরিদ্রের ক্ষুধা কেহ বুঝে না।” আমরা এই অংশে সমাজের দরিদ্র সর্বহারা মানুষদের প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের ঐকান্তিক সহানুভূতি তথা তাঁর মানব প্রীতিই আবেগ স্পন্দিত বাণীরূপ লাভ করতে দেখি।
‘বিড়াল’ রচনায় বঙ্কিমচন্দ্রের মননের গভীরতা যে অসাধারণ বাণীরূপ লাভ করেছে, সেটিও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারে না। সমাজতন্ত্রের বা সর্বহারা দরিদ্র শ্রেণির প্রবক্তারূপে বিড়ালের সমাজের শোষিত ও বঞ্চিত দরিদ্রদের মানুষের মতো খেয়ে পরে বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার তথা সমাজতন্ত্রের সত্যতা ও প্রয়োজনীয়তা প্রতিষ্ঠায় যুক্তি তর্কের বলিষ্ঠ উপস্থাপনা এবং তার খণ্ডনে ধনতন্ত্রের প্রতিনিধি কমলাকান্তের ধনতন্ত্রের তথ্য ধনী শ্রেণির দরিদ্রদের বঞ্চিত করে ঐশ্বর্য সংগ্রহের অধিকারের সপক্ষে দুর্বল, অন্তঃসারশূন্য যুক্তি প্রদর্শন এবং অবশেষে এই তর্ক-বিতর্কে বিড়ালের বক্তব্যের সারবত্তার কাছে তার পরাজয়—কাল্পনিক দৃশ্যের মধ্য দিয়েই সমাজতন্ত্রের মানবিক আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনে বঙ্কিমচন্দ্রের মননের গভীরতার পরিচয় মেলে। কমলাকান্ত বিড়ালের বক্তব্যের খণ্ডনে বলেছে, ধনীর কৃপণতার জন্যই দরিদ্র চোরে পরিণত হয়, পাঁচশ জন দরিদ্রকে বঞ্চিত করে একজন তাদের আহার্য সংগ্রহ করবে কেন, যদি করল তবে সে তার আহারের পর যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তা দরিদ্রকে কেন দেবে না? যদি না দেয় তবে দরিদ্র অবশ্য তার থেকে চুরি করবে, কারণ না খেতে পেয়ে মরবার জন্য কেউ এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেনি–বিড়ালের এই কথাগুলো অত্যন্ত সোশিয়ালিস্টিক, সমাজ বিশৃঙ্খলার মূল। যার যত ক্ষমতা সে যদি তত ধন সঞ্চয় করতে না পারে, অথবা সঞ্চয়ের পর চোরের জ্বালায় ভোগ না করতে পারে তবে কেউ আর ধন সঞ্চয়ে যত্নবান হবে না, তাতে সমাজের ধন বৃদ্ধি হবে না। আর সামাজিক ধন বৃদ্ধি ছাড়া সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়। কমলাকান্তের এই উক্তি অষ্টাদশ শতাব্দীর অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো প্রমুখ অর্থনীতিবিদদের ধনতন্ত্রের মতবাদেরই প্রতিধ্বনি। তাঁরা বলেছিলেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে একজন ব্যক্তি অর্থ তথা মূলধন সঞ্চয় ও সংগ্রহ করে কলকারখানায় তথ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ করে, উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য রপ্তানিতে শুধু মূলধন বিনিয়োগকারীরাই নয়, তার দেশেরও অর্থনৈতিক লাভ হয়। ধনতন্ত্রের সমর্থনে কমলাকান্তের এই যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে বিড়াল যথার্থই বলেছে, সে যদি খেতেই না পেল তবে সমাজের উন্নতি নিয়ে কী করবে। সমাজের ধন বৃদ্ধির অর্থ ধনীর ধন বৃদ্ধি, ধনীর ধন বৃদ্ধি না হলে দরিদ্রের কী ক্ষতি। এই অকাট্য যুক্তির কাছে কমলাকান্তকে হার মানতে হয়েছে। এইভাবেই দুটি মতবাদের যুক্তি বিচার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রতিষ্ঠায় বঙ্কিমচন্দ্রের মননের গভীরতা রূপ পেয়েছে।
‘বিড়াল’ দপ্তরটির আঙ্গিক রচনায় বঙ্কিমচন্দ্রের অসাধারণ শিল্প-কৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের সাম্যের মতো বিড়ালেও সমাজতন্ত্রবাদের যৌক্তিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, কিন্তু তার এই বক্তব্যকে পাণ্ডিত্যপূর্ণ, তথ্যনিষ্ঠ যুক্তি সমাবেশের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি। অর্ধোন্মাদ, আফিমের নেশাখোর, ভবঘুরে কমলাকান্তের বিচিত্র আদতে উদ্ভট খেয়ালী কল্পনার তরঙ্গলীলায়, বিচার বিশ্লেষণপটু মননের গাম্ভীর্য বুদ্ধিদীপ্ত, হাস্যরস, কৌতুক-পরিহাস আবেগ প্রভৃতির সমন্বয়ে সমাজতন্ত্রের চিন্তাকে এক আশ্চর্য রকমের প্রাণবন্ত, মনোজ্ঞ রূপ পেতে দেখি। রচনাটির সূচনায় বঙ্কিম কমলাকান্তকে এই দৃশ্যে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করেছেন : সে তার শয়নকক্ষে খাটিয়ার ওপর বসে হুঁকো হাতে উপবিষ্ট, আফিমের নেশায় তন্দ্রাচ্ছন্ন, মিট মিট করে প্রদীপের আলো জ্বলছে, দেওয়ালের ওপর চঞ্চল ছায়া প্রেতাবৎ নৃত্যরত। আহার প্রস্তুত হয়নি, সেইজন্য হুঁকো হাতে নির্মীলিত লোচনে কমলাকান্ত ভাবছিল, সে যদি নেপোলিয়ন হত তবে ওয়ার্টালুর যুদ্ধে জয়ী হতে পারত কিনা। কোথায় ইয়োরোপের বিশ্ববিখ্যাত রণক্ষেত্র ওয়াটার্ল, রণকুশলী ফরাসি সৈন্যবাহিনীর পৃথিবী বিখ্যাত মহানায়ক বীর নেপোলিয়ন, তাঁর বিপক্ষে ডিউক অব ওয়েলিংটন ও মিত্রপক্ষবাহিনী, আর কোথায় খাটিয়ায় হুঁকো হাতে উপবিষ্ট নসীরামবাবুর আশ্রিত বঙ্গ সন্তান কমলাকান্ত এবং তার নেপোলিয়নরূপে ওয়াটার্লুর যুদ্ধ জয়ের আত্মপ্রসাদক্ষীত কল্পনা। এই অসংগতির কৌতুকরস আমাদের কাছে অত্যন্ত উপভোগ্য হয়ে ওঠে। এই সময় ছোট্টো করে একটি মেও শব্দ হতেই কমলাকান্ত তাকিয়ে দেখে, হঠাৎ কিছু বুঝতে পারে না তার মনে হয়, ওয়েলিংটন হঠাৎ বিড়ালত্ব প্রাপ্ত হয়ে তার কাছে আফিম ভিক্ষা করতে এসেছে। এই অংশে কমলাকান্তের কল্পনা উদ্ভটতা ও অসংগতির চরম মাত্রায় পৌঁছেছে—আমাদের হাস্যবেগ উচ্ছলিত ও অসংবরণীয় হয়ে ওঠে; তদুপরি মানবপ্রেম ও মননের গভীরতা এক বিমূর্ত রূপ লাভ করে আমাদের মনকে উজ্জ্বলভাবে আলোকিত করে তোলে।
আবার মেও শব্দ হতেই কমলাকান্ত ভালো করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে ওয়েলিংটন নয়, একটি ক্ষুদ্র মার্জার প্রসন্ন তার জন্য যে দুধ রেখে গিয়েছিল নিঃশেষে উদরসাৎ করেছে, সে ওয়াটালুর প্রান্তরে ব্যূহ রচনায় ব্যস্ত থেকে লক্ষ্য করেনি। মার্জারসুন্দরী নির্জল দুগ্ধপানে পরিতৃপ্ত হয়ে নিজের মনের সুখ এ জগতে প্রকটিত করবার অভিপ্রায়ে অতি মধুর স্বরে মেও ধ্বনি তুলেছে। এই বর্ণনায়ও আমরা বিশুদ্ধ হাস্যরসের স্পর্শ পাই। কমলাকান্ত বলেছে, ‘বলিতে পারি না, বুঝি তাহার ভিতর একটু ব্যঙ্গ ছিল; বুঝি মার্জার মনে মনে হাসিয়া আমার পানে চাহিয়া ভাবিতেছিল, “কেহ মরে বিল ছেঁচে কেহ খায় কই।” বুঝি সে ‘মেও’ শব্দে একটু মন বুঝিবার অভিপ্রায় ছিল। বুঝি বিড়ালের মনের ভাব – ‘তোমার দুধ ত খাইয়া বসিয়া আছি—এখন বল কি?” কমলাকান্ত কী বলবে ঠিক করতে পারল না, দুধ তার বাপেরও নয়, দুধ মঙ্গলার, দুইয়েছে প্রসন্ন; সুতরাং সে দুখে তার যে অধিকার, বিড়ালেরও তাই সুতরাং সে রাগ করতে পারে না। তবে চিরাচরিত একটা প্রথা আছে, যে বিড়ালে দুধ খেয়ে গেল তাকে মারতে যেতে হয়, কমলাকান্ত তার অবমাননা করে মনুষ্য সমাজে কুলাঙ্গাররূপে পরিচিত হবে এটা বাঞ্ছনীয় নয়, এই মার্জারীও হয়ত তার স্বজাতিমগুলে তাকে কাপুরুষ বলে উপহাস করতে পারে। সুতরাং পুরুষের ন্যায় আচরণ করাই বিধেয়; ইহা স্থির করিয়া সকাতরচিত্তে, হস্ত হইতে হুঁকা নামাইয়া, অনেক অনুসন্ধানে একটি ভগ্ন যষ্টি আবিষ্কার করিয়া সগর্বে মার্জারী প্রতি ধাবমান হইলাম। কমলাকান্তের পৌরুষের এই আস্ফালনও অত্যন্ত হাস্যকর ও উপভোগ্য।
কমলাকান্ত অতঃপর দিব্যকর্ণ প্রাপ্ত হয়ে বিড়ালের মুখে দরিদ্র নিরন্ন শ্রেণির মানুষদের বেঁচে থাকার জন্মগত অধিকার তথা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আলোচনা শুনেছে। এই আলোচনার সুর গভীর, কিন্তু প্রস্তাবনা অংশের হাস্যরসের পর এই আলোচনা যুক্তিতর্ক-বিশ্লেষণের মনন-গাম্ভীর্যে এসে আমরা কোনো অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না, কারণ সমস্ত অংশই এসেছে ভবঘুরে, অর্ধোন্মাদ ও অহিফেনসেরী কমলাকান্তের বিচিত্র কল্পনা-তরঙ্গে। তাছাড়া, সর্বহারা দরিদ্র শ্রেণির মানুষ ও সমাজতন্ত্রের প্রতিনিধির বিড়ালের ক্ষুধার তীব্র জ্বালার বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং তাদের মানুষের মতো খেয়ে পরে বেঁচে থাকার অধিকারের দৃপ্ত নৈতিকতায় বলিষ্ঠ ঘোষণার বিপরীতে ধনতন্ত্রের প্রবক্তা কমলাকান্তের ধনতন্ত্রের তথা দরিদ্রদের শোষণ ও অনাহারের বিনিময়ে ধনীদের ধন সঞ্চয়কে সমাজের শ্রীবৃদ্ধি রূপে উপস্থাপনা এবং বিড়ালের বক্তব্যের কাছে পরাজিত হয়ে তাকে জ্ঞানীর অহংকারে জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দানের অন্তঃসারশূন্যতা ইংগিতময় রঙ্গব্যঙ্গাত্মক পটভূমি রূপেও এই অংশটির গভীর সার্থকতা আছে। কমলাকান্ত তাকে মারার জন্য লাঠি তুলেছিল সে আজ থেকে যেন তিনদিন উপবাস করে, যদি সে এর মধ্যে নসীরামবাবুর ভাঁড়ার ঘরে ধরা না পড়ে, তবে সে যেন তাকে ঠেঙ্গিয়ে মারে, সে আপত্তি করবে না–কমলাকান্ত বিড়ালের সমাজতন্ত্রের এই মূলভিত্তি সম্পর্কিত বক্তব্যের কোন উত্তর দিতে পারেনি। তুমি যখন বিচারে পরাজিত হবে তখন গম্ভীরভাবে উপদেশ দান করবে—বিজ্ঞ লোকের এই মত শিরোধার্য করে কমলাকান্ত বিড়ালকে বলেছে : এসমস্ত অত্যন্ত নীতিবিরুদ্ধ কথা, তাদের আন্দোলনেও পাপ আছে, সে যেন এই সমস্ত দুশ্চিন্তা ত্যাগ করে ধর্মাচরণে মন দেয়। বিড়াল যদি চায় তবে সে তাকে নিউম্যান ও পার্কারের ধর্মগ্রন্থ দিতে পারে, ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ পড়লেও তার কিছু উপকার হতে পারে, আর কিছু হোক, বা না হোক আফিমের অসীম মহিমা বুঝতে পারবে। প্রসন্ন কাল কিছু ছানা দেবে বলেছে, জলযোগের সময় বিড়াল যদি আসে, দুজনে মিলে ভাগ করে খাবে। সে আজ যেন কারো হাঁড়ি না খায়; ক্ষুধায় নিতান্ত অস্থির হলে আবার যেন আসে, কমলাকান্ত তাকে এক সরিষাভোর আফিম দেবে। আফিমের বিশেষ প্রয়োজন নেই, হাঁড়ি খাওয়ার কথা ক্ষুধা অনুসারে বিবেচনা করা যাবে, একথা বলার পর বিড়াল বিদায় গ্রহণ করলে কমলাকান্ত ‘আত্মপ্রসাদে স্ফীত হয়—একটি পতিত আত্মাকে অন্ধকার হইতে আলোকে আনিয়াছি, ভাবিয়া কমলাকান্তের বড় আনন্দ হইল।’ বিজ্ঞজনোচিত গাম্ভীর্যে ও আত্মপ্রসাদে কমলাকান্তের বিড়ালকে এই উপদেশ দান কিংবা এক সরিষাভোর আফিম দানের প্রস্তাবও হাস্যরসের প্লাবনে আমাদের আপ্লুত করে। অহিফেনসেবী কমলাকান্তের বিচিত্র চরিত্রের সূত্রেই হাস্যরসাত্মক রমণীয় কল্পনায় বঙ্কিমচন্দ্র ‘বিড়াল’ রচনায় সমাজতন্ত্রবাদের মূল সত্যকে যে অতুলনীয় চিত্তাকর্ষক রূপ দিয়েছেন, গতানুগতিক প্রবন্ধের যুক্তিশৃঙ্খলায় তা কখনই সম্ভব হত না। বিড়ালে লেখকের আঙ্গিক রচনায় অসাধারণ উদ্ভাবন শক্তি বাণীমূর্তি লাভ করেছে সন্দেহ নেই। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের অন্যতম বিশিষ্ট রচনা ‘বিড়াল’ দপ্তরটি—চিরন্তন সত্যের মহিমায় উজ্জ্বল ও ভাস্বর।
Leave a comment