বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তর-এর কথক কমলাকান্তের চরিত্রটির পরিকল্পনার এই বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করে আমরা সংশয়াতীতভাবে উপলব্ধি করি যে, বঙ্কিমচন্দ্রের মানসিকতা ও সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গির পূর্ণ পরিচয় যদি তাঁর কোনো রচনায় প্রোজ্জ্বল মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে থাকে, তবে সেটি কমলাকান্তের দপ্তর। স্বদেশপ্রেমিক বঙ্কিম তাঁর পরাধীন মাতৃভূমির দুঃখ-দৈন্য, বিশেষত তথাকথিত ইংরেজি শিক্ষাভিমানী নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের মিথ্যাচার ও দাসত্ববোধে যে তীব্র মর্মবেদনা অনুভব করেছিলেন সেটি তাঁর মানসিকতার অন্যতম প্রধান দিক— কমলাকান্তের দপ্তরের কমলাকান্তের আবেগ-অনুভূতিতে, ক্ষোভে-বেদনায়, কখনও বা মননের গাম্ভীর্যে জীবন্ত রূপ লাভ করেছে। আমার মন’ রচনাটিতে কমলাকান্তের উক্তির মাধ্যমে বঙ্কিম তাঁর সমকালীন বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের দেশের সর্বসাধারণের কল্যাণকে উপেক্ষা করে ইংরেজি শিক্ষার মোহে ইয়োরোপের উপযোগবাদীদের ভোগবাদের অন্ধ আরাধনাকে কখনও বা তীব্র ব্যঙ্গে ধিক্কার দিয়েছেন, কখনও বা সেই মোহান্ধতায় গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ‘আমার দুর্গোৎসব’ কমলাকান্তের দেশজননীর আরাধনায় আমরা তার স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্রের দেশাত্মবোধের আবেগকম্পিত কণ্ঠস্বরটিকেই ধ্বনিত হতে শুনি।

মানব প্রীতি বঙ্কিমচন্দ্রের মানসিকতার আর একটি প্রধান দিক। ‘একা-কে গায় ঐ’, ‘আমার মন’, ও ‘বিড়াল’-এ বঙ্কিমচন্দ্র ব্যক্তিগত জীবন, স্বার্থ ও ভোগ সুখ নিয়ে দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্নতায় নয়, বিশ্বের সকল মানুষের সঙ্গে একাত্মতায়, সহমর্মিতায় মহাদেশের মতো ব্যাপ্তিতেই যে মনুষ্য জীবনের পরম চরিতার্থতা – কমলাকান্তের চরিত্র পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্যের জন্যই তাঁর সেই মানব জীবনের সত্যোপলব্ধিকে যে প্রাণবন্ত রূপ দিয়েছেন তা তাঁর অন্য কোনো রচনায়ই দেখা যায় না। তার কারণ, কমলাকান্ত বঙ্কিমের মানসের পূর্ণ প্রতিচ্ছবি, তার স্বতঃস্ফূর্ত, অবাধ প্রকাশের এক আশ্চর্য রকমের স্বচ্ছ দর্পণ।

মননশীল, তীক্ষ্ণ বিচার বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ, রঙ্গব্যঙ্গাত্মক নকশা, তাদের মধ্যে কোনো কোনোটি সংলাপ নির্ভর নাট্য দৃশ্য ধাঁচের, এই জাতীয় রচনায় একই সঙ্গে কৌতুক পরিহাস ও ক্ষুরধার বিদ্রূপের সমাবেশ, উপন্যাস ইত্যাদি গদ্য সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বঙ্কিমচন্দ্র স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন। তাঁর শিল্পনৈপুণ্যে গদ্য লেখক হয়েও তিনি তাঁর উপন্যাসগুলিতে যে কবিসুলভ উচ্চাঙ্গের কল্পনাশক্তি ও অপূর্ণ চিত্রসৌন্দর্য ও গীতি কবিতার সুরঝংকার সৃষ্টির শিল্পকলা-নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন, আজও আমাদের বিস্মিত ও মুগ্ধ করে। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা প্রয়োজন, বঙ্কিমচন্দ্র নিছক সৌন্দর্য সৃষ্টির বিচিত্র বর্ণচ্ছটায় পাঠকদের মোহিত করে তাদের আনন্দদানের উদ্দেশ্যে লেখনী ধারণ করেননি। তাদের মানব জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য ও সার্থকতা সম্বন্ধে সচেতন করে তোলার জন্যই নিজের জীবনদর্শন অনুযায়ী তাদের সামনে সত্যের রসোজ্জ্বল রূপ রচনার প্রবল আকুলতা অনুভব করেছেন, সেইজন্যই শুধু প্রবন্ধের যুক্তি ও চিন্তার বিন্যাসে পাঠকদের বিবেক ও বুদ্ধিকে জাগ্রত করেই ক্ষান্ত হতে চাননি, যুক্তি-বিচার-বিতর্ক বিশ্লেষণের গণ্ডি ত্যাগ করে রঙ্গরসাত্মক নকশা ও উপন্যাসের মধ্য দিয়ে পাঠকদের হৃদয় মনকে আলোড়িত করতে চেয়েছেন। কিন্তু বাংলা ভাষায় প্রথম যথার্থ উচ্চ শ্রেণির উপন্যাস রচনায় অভূতপূর্ব সাফল্য ও সম্মান লাভ করা সত্ত্বেও বঙ্কিম তাতে তৃপ্ত থাকতে পারেননি, কারণ উপন্যাসে নকশা জাতীয় রচনায়ও পাত্র পাত্রী, ঘটনা, দৃশ্য, সংলাপ প্রভৃতির পশ্চাদপটে লেখককে আত্মগোপন করতে হয়। নিজের বিস্ময়কর নব নব সৃষ্টির বৈচিত্র্যে ও প্রাচুর্যে আত্মপ্রকাশে সক্ষম ও উন্মুখ শিল্প প্রতিভার প্রেরণায়ই শুধু নয় তাঁর জীবন দর্শন বা আদর্শ ও নীতিবোধে অনুপ্রাণিত সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্যও বঙ্কিমচন্দ্র এমন একটি সাহিত্যিক রূপের উদ্ভাবন করতে চেয়েছিলেন যার মধ্যে প্রবন্ধের মননশীলতা ও তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ নকশার কৌতুক পরিহাস ব্যঙ্গবিদ্রূপ এবং উপন্যাসের চরিত্র, সংলাপ, দৃশ্য ও কল্পনার বর্ণাঢ্য প্রকাশ ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকাশভঙ্গি ও সুরের সমাবেশে সমন্বয়ে পাঠকচিত্তের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযোগ সেতু রচনা করতে, স্বদেশের কল্যাণসাধন ও মানব প্রীতির আদর্শে তাদের উদ্দীপিত করে তুলতে পারেন। মানব জীবনের চরিতার্থতার আদর্শের চিন্তায় পাঠকদের বিবেক বুদ্ধি জাগ্রত করার সঙ্গে সঙ্গে তার উপলব্ধির ধ্যান-কল্পনায়-আবেগে অনুভূতিতে তাদের হৃদয়কে গভীরভাবে আলোড়িত করার লক্ষ্যে তিনি কমলাকান্তের দপ্তরে পূরণ করতে পেরেছেন কমলাকান্তের অর্ধোন্মাদ, আফিমের নেশাখোর, ভবঘুরে সমাজ সংসারের বন্ধনহীন এবং সেই কারণেই জীবনের সত্যদ্রষ্টা চরিত্রের বিচিত্ররূপ পরিকল্পনায় এবং সেই সূত্রে সাহিত্যের বিভিন্ন প্রকাশ ভঙ্গির একটি আশ্চর্য রকমের প্রাণবন্ত সমন্বয়ে, সুরসঙ্গতিতে।