“পটুয়া ছবি দানা বেঁধেছিল একটা পুরাণের উপর।”- কোন্ প্রসঙ্গে এই উক্তি করা হয়েছে? এই উক্তিটির তাৎপর্য কী?
পটুয়া শিল্প বাংলাদেশের প্রাচীন শিল্পীদের কারুসৃষ্টি। রূপসৃষ্টির ইতিহাসে এই শিল্পের বৈশিষ্ট্য আলোচনা প্রসঙ্গে লেখক এই উক্তি করেছেন। পটুয়া শিল্পের স্বরূপ-বৈশিষ্ট্য আলোচনা প্রসঙ্গে লেখক যে প্রধান লক্ষণগুলো ব্যাখা করেছেন, পুরাণভিত্তি তার মধ্যে অন্যতম। তাই এই সূত্রকে লেখক এখানে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন।
পটুয়া শিল্পীরা ছিলেন গ্রামের শিল্পী। তাঁরা অশিক্ষিত, কিন্তু সেখানে গ্রাম-সংস্কৃতির ইতিহাসে যে পুরাণ ও ইতিহাস মানুষকে শিক্ষিত করে তুলেছিল, পটুয়া শিল্পীরা সেই উত্তরাধিকার বহন করে তাঁদের শিল্প সৃষ্টি করেছেন। প্রাগৈতিহাসিক ছবিও প্রাচীন কালের মানুষের অঙ্কিত চিত্র। কিন্তু এই ছবির সঙ্গে পটুয়া ছবির পার্থক্য যথেষ্ট। পটুয়া ছবি প্রতিষ্ঠিত ছিল পুরাণের ওপর। এই ‘পুরাণ’ কথাটা বলতে নৃতত্ত্ববিদরা ‘myth’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এই ‘myth’ নির্ভরতার ফলে পটুয়া শিল্পে একটা স্বতন্ত্র ভাবাবহ সৃষ্টি হয়েছে।
পুরাণের ওপর ভিত্তি করে পটুয়া শিল্প যে গড়ে উঠেছে, তার ফলে একটা সংহত জগৎ তার মধ্যে ধরা পড়েছে। প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের জগৎ যেমন খাপছাড়া, টুকরো টুকরো, তা একটা গোটা জগৎ নয়। কিন্তু পটুয়ারা এমন একটা জগতের সন্ধান পেয়েছিল, যে জগৎ ছিল আগাগোড়া সামান্যলক্ষণের জগৎ, তবু সংহত জগৎ। সংহত পুরাণের ওপর এই শিল্পের স্থিতি।
পৌরাণিক জগতে বিশ্বাসের ফলে পটুয়া শিল্পীদের বৈচিত্র্য দেখা দিয়েছিল, এসেছিল শিল্পজগতের সংহতি। এই পুরাণে বিশ্বাসই ছিল এদের প্রাণ। পৌরাণিক জগতে বিশ্বাস করবার অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা ছিল। অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল ইউরোপে। সেখানে সংস্কৃত-শিল্প বা শিষ্ট শিল্প খ্রিস্টীয় পুরাণে বিশ্বাস যতদিন অটুট রাখতে পেরেছিল, ততদিন শিল্পে কোনো অশান্তি আসেনি। শিল্পী রেমব্রান্টের কর্মজীবনের পরবর্তী পর্যায়ে দেখা গেল যে সামাজিক অবস্থার প্রভাবে পুরাণে বিশ্বাস আর অটুট রাখা গেল না। শিল্প পুরাণ থেকে ভ্রষ্ট হল। ফলে শিল্পে নানা অশান্তি দেখা দিল। গঁগা ও ভ্যানগগ গ্রামীণ সারল্য ও খ্রিস্টীয় পুরাণে বিশ্বাস আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেখানে তাঁরা বিশেষ সার্থকতা পাননি। এর ফলে তারা শিল্পে কোনো শাস্তি খুঁজে পায়নি। পশ্চিম ইউরোপের সাম্প্রতিক শিল্পে এই পৌরাণিক বিশ্বাসের সন্ধান ছিল তাদের মধ্যে সুপ্রচুর। কিন্তু আধুনিক মনন ও জীবন কোনো পুরাণকে আর ধরে রাখতে পারছে না। এই ইতিহাস থেকে জানা যায় পটুয়া শিল্পীদের পুরাণ নির্ভরতা অধিকতর উল্লেখযোগ্য। লেখক বলেছেন—“মূল পটুয়াছবির পুরাণ-নির্ভরতা তাই লক্ষ করবার।” পটুয়া শিল্পীদের পুরাণ মগ্নতা এই দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। এই জন্য পটুয়া ছবি সম্পূর্ণভাবে মরেনি। কিন্তু পুরাণ সাহায্য ছাড়া প্রাগৈতিহাসিক ছবি অকালে লুপ্ত হয়ে গেল। এই কারণে পুরাণকে নির্ভর করার জন্য পটুয়া ছবির প্রাণশক্তি অক্ষুণ্ণ ছিল। জটায়ু বা বানর এই পৃথিবীর জীব। কিন্তু ছবিতে যখন তারা রূপ পেল তখন তারা পুরোপুরি মর্তলোকের জীব নয়। যদিও জটায়ু পাখি বা বানরকে চিনতে ভুল হয় না। তবু তাদের মূল কথা, বা শিল্পের সত্য এর মধ্যে ধরা পড়েছে। বানর, জটায়ু, রাক্ষসের মধ্যে আশ্চর্য সংহতি লক্ষ করা যায়। পটুয়া শিল্পীদের বিশ্বাস এই জগতেই দানা বেঁধেছিল। এই পুরাণের জগতের ওপরই তাই পটুয়া শিল্পের প্রতিষ্ঠা। পুরাণে বিশ্বাস বা নির্ভরতা না থাকলে শিল্পসত্য এমনভাবে ধরা পড়ত না। পৌরাণিক জগতে স্থিতি না থাকার দরুন প্রাগৈতিহাসিক শিল্পী টিকে থাকতে পারল না। কিন্তু পটুয়া শিল্প বেঁচে রইল অম্লানবদনে। পটুয়া শিল্পের প্রাণশক্তি তাকে এগিয়ে নিয়ে গেল। সহজ-সরল বা ঘরোয়া ভাষা এইভাবেই শেষ পর্যন্ত জয়ী হল।
“পটুয়া শিল্প বলতে দেশে কয়েকটা কুসংস্কার আছে”—এই উক্তির অর্থ কী? এই উক্তির তাৎপর্য বিচার করো।
পটুয়া শিল্প এদেশের গ্রামীণ মানুষের উ। পটের বুকে রং-তুলির এই কাজ দেখে ঠিক কালীঘাটের ছবি বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু লেখকের মতে এই ধারণা একটি কুসংস্কার। ‘কুসংস্কার’ বা বন্ধ গোঁড়া ধারণা কোনো বস্তুর সত্যকে স্পষ্ট করে না। তা যুক্তির অন্ধ বিশ্বাসের মতো। তাই লেখক মনে করেন যাঁরা পটুয়া শিল্পকে কালীঘাটের শিল্প বলে মনে করেন, তাঁদের মধ্যে কুসংস্কারই বেশি। এই সাদৃশ্য কিন্তু বাস্তব সত্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত নয়, এটা কাকতালীয়। কারণ গ্রামের শিল্পীরা কালীঘাটে এসে বাসা বাঁধে। কালিঘাটে বাসকালে তারা ছবি আঁকতে শুরু করে। এই থেকেই তাদের পটশিল্পকে কালীঘাটের পটুয়া শিল্প বলা হত।
পটুয়া শিল্পীরা যখন উদীয়মান কলকাতায় এসে বাসা বাঁধল এবং শিল্প সৃষ্টি করতে শুরু করল, তখন তাদের শিল্পের অকৃত্রিমতা ও শুদ্ধিও ভ্রষ্ট হল। কারণ তাদের মধ্যে নগর সভ্যতার স্পর্শ লেগেছিল নগরজীবনের সংস্পর্শে এসে। নগরজীবনকে অবলম্বন করে শিল্পীরা আঁকতে শুরু করল। এদের এই সৃষ্টির পেছনে ছিল শহরের চাহিদা মেটানোর প্রয়োজন। এই ছবির বাজার ছিল শহরে বা শহরতলিতে। শহর বা শহরতলিতে যে মেলা বসত, সেই মেলায় ছবি নিয়ে ওরা বিক্রি করত। এদের শিল্পে শহরজীবনের ছাপ পড়তে শুরু করল বলে এগুলি আর পটুয়া শিল্প রইল না।—“এর ভাষা হয়ে গেল গ্রাম্য। বক্তব্যে এল শহরের লক্ষণ।” ছবিতে বিষয় আর আঙ্গিকের মিলন সম্পূর্ণ হয়নি বলে এই ছবির কিছুটা ত্রুটি রয়ে গেল। পটুয়ার ছবি আদর্শবিচ্যুত হল। অর্থাৎ এর দেশজ ভাব তার শুদ্ধি নিয়ে আর প্রচলিত রইল না।
বিদেশি সমলোচকরা ছবি সংগ্রহ করেছেন প্রধানত কালীঘাট থেকে। নানা কারণে এর বেশি তারা করে উঠতে পারেনি। এই কারণেই বিদেশি সমালোচকরা কালীঘাটের ছবিকে পটের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছেন। কিন্তু দুঃখের কথা কিছু দেশি সমালোচকও বিদেশিদের এই ভুলের প্রতিধ্বনি করেন। এই কারণে দেশি সমালোচকদের একটা কুসংস্কার ছিল। সেই কুসংস্কারের ফলেই তারা পটের ছবিকে কালীঘাটের ছবি বলে মনে করেছে।
Leave a comment