মানবজীবনে ও মানবমনে রূপকথার প্রভাব অসামান্য। রূপকথার আকর্ষণ কেবল শিশুমনের ওপর বিস্তৃত হয় না, বয়স্ক মানুষও রূপকথার আকর্ষণে বার বার তাঁদের কৌতূহলের পরিচয় দেন। রূপকথার এই আকর্ষণের কারণ হিসেবে লেখক বলেছেন যে কল্পনার প্রতি মানুষের আকর্ষণ তীব্র ও শাশ্বত। কল্পনা মানুষের আদিতম সম্পদ। মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতি, মানুষের শিল্প ও সৃষ্টি সবই কল্পনার সৃষ্টি। কল্পনা সৌন্দর্যকে সৃষ্টি করে, কল্পনা শিল্প সৃষ্টি করে। ব্লেক কল্পনাকে বলেছেন, ‘Divine wisdom’। মধ্যযুগের রোমান্সে এই কল্পনার পরিচয় বহুলভাবে পাওয়া যায়। প্রাত্যহিক জীবনের নীরস কর্মচক্র, যান্ত্রিক কাজের একঘেয়েমি, নীরস দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে মানুষ যখন ক্লান্ত হয়ে যায়, তখন সে কল্পলোকের আশ্রয় নেয়। কল্পনার দুর্গে ক্ষণিক আশ্রয় গ্রহণ করে মানুষ আনন্দ পায়। এই ‘Lake Isles of Innisfree-তে বসেই মানুষ আকাশকুসুম চয়ন করে ও শূন্যে প্রাসাদ-নির্মাণ করে, তার উপকরণ সংগ্রহ করে। কল্পনার দিব্যদৃষ্টিতে মানুষ অনেক অতীন্দ্রিয় জগৎকে দেখে। অনেক অনির্দেশ সৌন্দর্যকে অনুসরণ করে, জীবনে বৈচিত্র্য আসে, জীবনের বর্ণসুষমা আসে। রূপকথা এই কল্পনার আকার। এই কারণে রূপকথার রসাস্বাদে মানুষ কল্পনার অশ্বকে বল্গাহারা করে দেয় তেপান্তরের মাঠে তাঁরা ছুটে চলেন। দিকদিগন্ত অতিক্রম করে কল্পনার পাখায় উড়ে মানুষ যেখানে যায়, সেখানে কত মণিমাণিক্যের ছড়াছড়ি। কত সুপ্ত সৌন্দর্যের পরিচয়। এইসব ভাব ও ভাবনা মানুষের অন্তরের সুপ্ত কবিত্বকে জাগিয়ে তোলে। সে দেখে জীবনযাত্রায় দুঃসাহসিকতা নেই, নেই কোন আলোড়ন বা সংঘাত। যে দেশের মানুষ শুধু প্রাণধারণের গ্লানি নিয়ে ব্যস্ত সে দেশের মানুষ রূপকথার ‘খোলা জানালা’ দিয়েই বিচিত্র কল্পলোকের সাক্ষাৎ পায়। রূপকথার কাছ থেকে ‘কল্পনার উন্মেষ’–এর ব্যাপারে সহায়তা পায়। যাঁরা কবি, তাঁরা তাই রূপকথাকে প্রণিধান করেই, চর্চা করেই তার মধ্যে কল্পলোকের যে উপকরণ পান তাই দিয়ে কাব্যশক্তিকে সমৃদ্ধ ও শক্তিতে পূর্ণ করে তোলেন। ইংরেজি সাহিত্যে রোমান্টিক যুগে কোলরিজ বা ওয়ার্ডসওয়ার্থ তাঁদের কল্পনাশক্তিকে জাগ্রত করার জন্য রূপকথার আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই কারণে সমালোচক ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন: “আমাদের মধ্যে যাহারা কবি-প্রতিভার অধিকারী তাঁহারা অনেক সময় এই রূপকথার নিকট তাঁহাদের কল্পনার উন্মেষ সম্বন্ধে প্রথম সাহায্য লাভ করেন। রূপকথার দিগন্ত বিস্তৃত তেপান্তরের মাঠ দিয়াই তাঁহারা প্রথম কল্পনার অশ্ব ছুটাইয়া দেন ও প্রাত্যহিক জীবনের সংকীর্ণ সীমা ছাড়াইয়া অজ্ঞাতের রাজত্বে প্রথম পদক্ষেপ করিতে শিখেন।”—এই অজ্ঞাত রাজত্বের প্রতি আকর্ষণ মানবমনে চিরন্তন।
মানুষ যতই জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশিষ্ট হয়ে উঠুন, ততই তিনি উপলব্ধি করেন মানুষের অন্তরে একটা “কুহেলিকাময় প্রদেশ” আছে, “যাহা হইতে তাহার সমস্ত রঙীন, অসম্ভব কল্পনার আলোক বিচ্ছুরিত হয়, যাহা সমস্ত তর্ক যুক্তি বাস্তবতার প্রভাব অতিক্রম করিয়া তাহার মনে একটি ছায়াস্নিগ্ধ স্থায়ী কল্পনালোক রচনা করে।” এই মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ দ্বারা এই সত্য জানা যায়। মানুষের অন্তরের স্থায়ী কল্পনালোক রচনা করতে রূপকথার প্রভাব অসামান্য।
মানুষের জীবনের ট্র্যাজেডি তার অপ্রাপ্যনীয়ের দিকে যাত্রা। “We look before and after / We pine for what is not”—শেলীর এই অসামান্য চরণে “What is not”-এর প্রতি আকর্ষণকে মানুষের জীবনের নিষ্ফল কামনা হিসেবে দেখা হয়েছে। যা কিছু দুষ্প্রাপ্য, অপ্রাপ্যনীয়, যা কিছু দুর্বোধ্য ও রহস্যময় তার প্রতি উন্মুক্ত হয় আমাদের মন ‘পতংগবৎ বহ্নিমুখং বিবিক্ষুঃ’-র মতো ধাবিত হয়। মনের এই যাত্রায় শক্তি জোগায় রূপকথা। এইজন্য লেখক বলেছেন, “আমাদের জীবনে যাহা কিছু অপ্রাপ্য, যাকে কিছু দুর্বোধ ও রহস্যময়, যাহাই আমাদের উন্মুখ আশাকে ‘পতংগবৎ বহ্নিমুখং বিবিক্ষুঃ’ আকর্ষণ করে এই সকলই আমাদের অন্তরের কল্পলোক রচনায় সহায়তা করিয়াছে। কিন্তু ইহার প্রথম ভিত্তি স্থাপনের প্রশংসা রূপকথারই প্রাপ্য। রূপকথারাজ্যের যে মেঘখণ্ড আমাদের শিশু-অন্তরের গোপন স্তরে প্রথম সঞ্চারিত হয়, তাহাই পরবর্তী জীবনের রহস্যবোধকে, তাহার সমস্ত আলো-ছায়া ঘেরা বিচিত্রতাকে আমাদের অন্তরের অন্তঃপুরে বরণ করিয়া আনে; এবং সেই সঞ্চিত মেঘরাশির চতুর্দিকেই আমাদের কল্পনার বিদ্যুৎবিলাস স্ফূরিত হয়।”—“কল্পনার বিদ্যুৎবিলাস”-কথাটি এখানে উল্লেখযোগ্য। রূপকথার মধ্যে মানুষের যে জয়েচ্ছার কাহিনী প্রতিভাত হয় তা কিন্তু “কল্পনার বিদ্যুৎবিলাসের” সৃষ্টি। এইজন্য পাশ্চাত্য সমালোচকগণ একে মধ্যযুগীয় রোমান্স নামে অভিহিত করেন। আদিম মানুষের দুর্মতি দুর্ভাগ্যের পটভূমিতে রূপকথার স্রষ্টার উৎকল্পনা অনেক সময় হয়তো এক স্বপ্নরাজ্য বা ‘Elfin world’-এ নিয়ে যায় তা রূপকথার যাত্রার অনিবার্য ফসল। “His journey again, might be across cloudless skies or amid alternations of storm or calm, his light might break fitfully through the cloud or be hidden for many a weary hour” (Talks of Ancient Greece George W. Cox)। মেঘলোকে উদ্দাম যাত্রার এই বিবরণ রূপকথায় পাওয়া যায়। এই কারণে শেলি, কোলরিজ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ বা ব্লেক বা এদেশে রবীন্দ্রনাথ রূপকথাকে গ্রহণ করে তাঁদের অনবদ্য শিল্পসৃষ্টি করেছেন। রূপকথার কাছে কবিমন, মানবমন চিরঋণী।
Leave a comment