শেক্সপিয়রের নাটক আলোচনায় তাঁর নাটকের শ্রেণিবিভাগ করতে গিয়ে সমালোচকগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর নাটককে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। যেমন—ঐতিহাসিক, রোমান্স, ক্লাসিক্যাল, প্রব্লেম প্লে, প্রথম যুগ, মধ্যযুগ, তৃতীয় যুগ, চতুর্থ যুগ ইত্যাদি। এইভাবে বা আরও ঘনিষ্ঠভাবে দেখলে শেক্সপিয়রের নাটককে আরও নানাভাবে ভাগ করা যায়। কোনো কোনো সমালোচক শেক্সপিয়রের নাটককে তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন— কমেডি, ট্র্যাজেডি ও ঐতিহাসিক নাটক। আবার নাটকের ভাব পরিণতির দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দুটো মোটা দাগে শেক্সপিয়রের সমস্ত নাট্যকর্মকে বিভক্ত করতে পারি—ট্র্যাজেডি ও কমেডি।
জীবনচক্রের মতোই যেমন সুখ ও দুঃখ আবর্তিত হয় তেমনি শেক্সপিয়রের লেখনীতেও সুখের দীপ্তকরোজ্জ্বল হাসি এবং দুঃখের কালো মেঘ বারে বারেই আবর্তিত হয়েছে। তিনি সুখ-পরিণামী কমেডি নাটকও লিখেছেন, আবার দুঃখের বেহাগও তাঁর কাব্যতন্ত্রীতে ব্যথার মূর্ছনা সৃষ্টি করেছে। ‘টাইটাস্ অ্যান্ড্রোনিকাস’ (Titus Andronicus) একটি ট্র্যাজিক নাটক। ক্লাসিক্যাল যুগের রোমের একটি কাহিনী নিয়ে নাটকটি রচিত। তাঁর ঐতিহাসিক অভিধাযুক্ত নাটকগুলিরও অধিকাংশ ট্র্যাজিক পরিণামী। জীবনে আবর্তিত সুখ-দুঃখের মতো শেক্সপিয়রের কমেডি ও ট্র্যাজেডি উভয় নাটকের মধ্যেই হাসি ও কান্নার দুই বিপরীত ধারা বিমিশ্রিত হয়ে আছে এবং তারই ফলে জীবনের মতোই শেক্সপিয়রের জীবনধর্মী নাটক বৈচিত্র্যযোগে স্বাদু হয়ে উঠেছে। অনুপুঙ্খরূপে দেখলে জীবনের গভীর সুর তো ব্যথারই সুর। কবি যতীন্দ্রনাথের কথায়—
‘অতল দুঃখ সিধু,
হাল্কা সুখের তরঙ্গ তাহে নাচিয়া ভাঙিছে ইন্দু।’
শুধু জীবনের উপরিতলের হাল্কা সুখের তরঙ্গ নয়, অতলস্পর্শী গভীর জীবনের বোধই শেক্সপিয়রকে ট্র্যাজেডি নাটক রচনার দিকে টেনে নিয়ে এসেছে। তাঁর নাটকের অধিকাংশই ট্র্যাজেডি। জীবন সম্পর্কে কবির গভীর ও ব্যাপক বোধ এবং বাল্যকাল থেকেই প্রতিকূল পরিবেশ ও সেই পরিবেশ জয় করার জন্য কঠিন সংগ্রাম তাঁকে ট্র্যাজেডি নাটক রচনায় দীক্ষিত করেছে।
শেক্সপিয়রের নাট্যজীবনের তৃতীয় পর্বে রচিত নাটক ‘হ্যামলেট’, ‘ওথেলো’, ‘কিং লিয়ার’, ‘ম্যাকবেথ’— এই চারটি নাটককেই তাঁর শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজেডি (great tragedies) নাটক বলা হয়। এ ছাড়া ‘টিমন অব এথেন্স’ এবং ‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপাট্রা’-ও এই পর্বে রচিত। এই সময় রচিত কমেডি নাটকেও নাট্যকারের বিষাদাচ্ছন্ন মনের ছায়া পড়েছে। এই কারণেই শেক্সপিয়রের নাটকের এই তৃতীয় পর্বকে (১৬০১-১৬০৮ খ্রিঃ) বলা হয় ‘ডার্ক পিরিয়ড’ (dark period)।
কিন্তু এই কয়টিই তাঁর একমাত্র ট্র্যাজেডি নাটক নয়। তাঁর প্রথম পর্বের (১৫৯১-১৫৯৬ খ্রিঃ) নাটক ‘টিটাস অ্যান্ড্রোনিকাস’, ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ এবং ঐতিহাসিক নাটক ‘হেনরী দ্য সিক্থ’ (তিন খণ্ড), রিচার্ড দ্য থার্ড’, ‘রিচার্ড দ্য সেকেণ্ড’, ‘কিং জন’-এর মধ্যেও ট্র্যাজিক নাটকের গুণ বর্তমান। দ্বিতীয় পর্বে (১৫৯৭-১৬০০ খ্রিঃ), ‘হেনরী দ্য ফোর্থ (দুই খণ্ড), ‘জুলিয়াস সীজার’, ‘ট্রয়লাস অ্যান্ড ক্রেসিডা’ এবং ‘হেনরী দ্য ফিফথ’ নাটক কয়টিকে আমরা নিশ্চয়ই স্মরণ করতে পারি। তৃতীয় পর্ব (১৬০১-১৬০৮ খ্রিঃ) তাঁর শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজেডিগুলির সঙ্গে সঙ্গে আমরা ‘কোরিওলেনাস’ নাটকটিকেও নিশ্চয়ই ট্র্যাজেডি নাটকের তালিকাভুক্ত করব। চতুর্থ পর্ব (১৬০৯ ১৬১১ খ্রিঃ) যদিও প্রৌঢ় নাট্যকার স্থিতধী তবু এই শেষ পর্বেও তাঁর সিম্বোলিন’ নাটক এই ট্র্যাজিক সুর নিয়ে এসেছে এবং নাটকটি ট্র্যাজেডির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডির পরিবেশনাগত বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য করলে কয়েকটি সাধারণীকৃত বিষয় চোখে পড়ে। ঘটনাটি কি ঘটতে চলেছে তার একটা আভাস নাটকে প্রোলোগের (Prologue) মধ্য দিয়ে বা চরিত্রের প্রাথমিক কথোপকথনের মধ্য দিয়ে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে নাট্যকার দেন, দর্শক-মনে এই আভাস ধরা পড়ে। নাটকে থাকে ‘জনতা’ চরিত্র, সাধারণ নাগরিকগণ সবাই মিলে একত্রে একটা যূথবদ্ধ চরিত্র। ঘটনার মধ্যে যূথবদ্ধভাবেই এরা গতি সঞ্চার করে। নাট্যকারের রোমান নাটকগুলিতে (‘জুলিয়াস সীজার’, ‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপাট্টা এবং ‘কোরিওলেনাস”) এদের উপস্থিতির প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। শেক্সপিয়রের ট্র্যাজেডি নাটকে প্রেম একটা কেন্দ্রীভূত বিষয়। ঈর্ষা, ক্ষমতার লিপ্সা বা অন্ধ পিতৃস্নেহ থেকে জাত ঘনীভূত আবেগ নাটককে ট্র্যাজিক পরিণামের দিকে অলঙ্ঘ্য নিয়তির মতো তাড়িয়ে নিয়ে যায়। এ ছাড়া রয়েছে ষড়যন্ত্র বা চক্রান্ত (conspiracy) ঘন গভীর ট্র্যাজিক কাহিনীর মধ্যে দু’একটি comic scene বুনে দিয়ে comic relief সৃষ্টি করে শেক্সপিয়র কাহিনীকে আরও উপভোগ্য করে তোলেন। তাঁর নাটকের ট্র্যাজেডি শুধু ঘটনাগত বা পরিবেশগত ট্র্যাজেডি নয় আবেগতাড়িত দ্বন্দ্বদীর্ণ চরিত্রে ট্র্যাজেডি হয়ে ওঠার ফলে মানবজীবনের মহাবিস্ময়ই এর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে এবং এইখানেই শেক্সপিয়র স্বরাট। চারশ বছরের দীর্ঘকাল পেরিয়ে বিশ্বের নাট্যজগতে আজও তিনি সম্রাট।
Leave a comment