রোমান্টিক যুগের কবি হিসাবে কীটসের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। শেলির সঙ্গে তাঁর কী পার্থক্য দৃষ্ট হয়? বাংলায় কোন্ কবির সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য দৃষ্ট হয়?

রোমান্টিক যুগের কবি হিসেবে ওয়ার্ডওয়ার্থের সঙ্গে কোলরিজের (S. T. Coleridge, ১৭৭২ ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দ) নাম প্রায় একসঙ্গে উচ্চারিত হয়। ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে উভয়ে যুগ্মভাবে প্রকাশিত ‘লিরিক্যাল ব্যালাড্স’ (Lyrical Ballads) যেন ইংরেজি সাহিত্যে নতুন কালের শঙ্খনিনাদ ধ্বনিত করল, তেমনি ইংরেজি সাহিত্যে প্রায় সমোচ্চারিত নাম শেলি এবং কীটস।

শেলি এবং কীটস রোমান্টিক যুগের দ্বিতীয় পর্যায়ের কবি। উভয়েই প্রায় সমসাময়িক। কীটসের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পোয়েমস’ প্রকাশের পিছনে শেলির সহায়তা ছিল এবং উভয়ের বন্ধুত্ব জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। কীটস্-এর যক্ষ্মারোগ শুনে শেলি তাঁকে ইতালি এসে তাঁদের বাড়িতে থাকবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কীটসের অবশ্য তাঁর বাড়িতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। কীটসের মৃত্যুতে ব্যথাহত শেলির রচিত শোককবিতা ‘অ্যাডোনেইস্স্‌’ (Adonais) স্মরণসূত্রে উভয় কবিকে একত্রে বেঁধে রেখেছে। কীটসের মৃত্যুর এক বছর পরে শেলিও এক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। দেহ সমাধিস্থ হল কবিবন্ধু কীটসের সমাধির পাশেই, রোমে। অভিন্নহৃদয় এই দুই বন্ধুর স্মরণে রোম শহরে তৈরি হয়েছে ‘কীটস-শেলি মেমোরিয়াল হাউস’।

উভয়ই সমসাময়িক, অভিন্নহৃদয় বন্ধু এবং রোমান্টিক কবিগোষ্ঠীর দুই শ্রেষ্ঠ নায়ক হলেও মানসিকতার দিক থেকে উভয়ের মধ্যে বিভিন্নতাও ছিল এবং এই বিভিন্নতা উভয়ের কাব্যে দুই পৃথক স্বাদ নিয়ে এসেছে। শুধু শেলি বা কীটসই নয়, এই যুগের ওয়ার্ডওয়ার্থ প্রমুখ পুরোধা কবিরাও একই সুরে কথা বলেননি। এই রোমান্টিক যুগে যদিও মানুষ ও প্রকৃতির কবিদের কাব্যে প্রধান স্থান গ্রহণ করেছিল, তবু কবিকুলের মানসিক প্রবণতা অনুযায়ী তাঁরা এই মানুষ ও প্রকৃতিকে দেখেছেন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। ফলে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলি, কীটস প্রমুখ কবিগণ একটি গোষ্ঠীভুক্ত কবি হয়েও এদের প্রত্যেকের হাতে এই মানুষ ও প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বৈচিত্র্যময় ও আস্বাদ্য হয়ে উঠেছে। রোমান্টিক যুগের একতারাতে নতুন নতুন তার যুক্ত করে তাকে বহুতন্ত্রীবিশিষ্ট বীণায় রূপান্তরিত করেছেন।

নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ভাবনায় সিদ্ধ কবি ওয়ার্ডওয়ার্থ তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনার দীপ্তিতে প্রকৃতিকে করে তুলেছেন দীপ্তিময়, তাঁর প্রকৃতি বর্ণনায় এসেছে এক প্রশান্তি। কিন্তু শেলির বর্ণনায় প্রকৃতি তাঁর চিৎকর্ষ, তাঁর মননের রঙে হয়ে উঠেছে রঙিন। সমাজসচেতনতা, মানবপ্রেম, মানবমুক্তির দায়িকা শক্তি পুরাতনকে চিতায় চাপিয়ে আগামী দিনের মন্ত্রপাঠ করছে। শেলির প্রকৃতি বিদ্রোহী, কীটসের প্রকৃতি আশাবাদী; অনুভূতিগ্রাহ্য ষড়-ইন্দ্ৰিয় দিয়েই প্রকৃতিকে আপ্যায়িত ও বরণ করেছেন। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপলোকের মধ্যে, শব্দ-স্পর্শ-গন্ধ-বর্ণময় প্রকৃতির মধ্যেই তিনি শুনেছেন প্রকৃতির সঙ্গীত। নিবিড় উপলব্ধির এই আনন্দই তাঁর কবিতায় ব্যঞ্জিত।

শেলির নায়ক অ্যাডোনেইস জন কীটস মানসিকতার দিক দিয়ে শেলির বিপরীত কোটির কবি। ফরাসী বিপ্লবের সুতিকাগারে জাত বিপ্লবী শেলি হচ্ছেন দুরন্তগতি ও প্রচণ্ড শক্তিবিশিষ্ট কবি যিনি চান সমাজের সমূহ পরিবর্তন, যিনি স্বপ্নদ্রষ্টা ও কল্পনাপ্রবণ। এই কারণেই তাঁর সম্বন্ধে ম্যাথু আর্নল্ড বলেছেন, “সুন্দর অথচ ব্যর্থ এক দেবদূত, শূন্যে ঝাপটাচ্ছেন তাঁর উজ্জ্বল ডানা।” পশ্চিমা ঝড় (Ode to the West Wind) যা ঝরা পাতাগুলিকে ঝেঁটিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যায়, সেই পশ্চিমা ঝড়ই হচ্ছে তাঁর কাব্যের প্রতীক। ভরতপক্ষী (To a Skylark) যা গান গাইতে গাইতে আকাশের উত্তুঙ্গ সীমা স্পর্শ করে তা হচ্ছে তাঁর কল্পলোকবিহারী মানসিকতার প্রতীক। তাঁর কাব্যের বিষয়বস্তুতে রয়েছে আদর্শবাদের আতিশয্য, রয়েছে উচ্ছ্বাসের বাহুল্য, তাঁর কল্পনা অশরীরী, তাঁর চিত্রকল্প বিমূর্তক এবং ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। শেলির শব্দ ও ছন্দ স্বতোৎসারিত, সচেষ্ট প্রয়াসের কোনো চিহ্ন চোখে পড়ে না। তাঁর এক অনুপ্রাণিত গীতিকবিতায় (lyrics) কবি হচ্ছেন শেলি।

কিন্তু কীটস হচ্ছেন প্রশস্তিমূলক গীতিকবিতা ‘ওড’-এর কবি। সৌন্দর্য চেতনার কবি। প্রাণ ও প্রকৃতিতে বিলসিত সে সৌন্দর্য তাই কবির দু’চোখ ভরে রয়েছে। এ জগতের অতীত বর্তমান উভয়ই তাঁর কাছে সমান সুন্দর। তাঁর মতে ‘সুন্দরের মধ্যেই রয়েছে চিরকালীন আনন্দ’, তাঁর কাছে ‘সত্যই সুন্দর, সুন্দরই সত্য’। গ্রিসের পৌরাণিক কাহিনী, মধ্যযুগীয় গল্পকাহিনী, মহৎ কাব্য—এ সবের মধ্যে ছড়ানো সৌন্দর্যের জগৎ তাঁকে নিত্য আকৃষ্ট করত। মর্ত্য পৃথিবীর গানই কীটসের কবিতায় ভাষারূপ পেয়েছে। নিশ্চিতরূপেই তিনি পৃথিবীর কবি। তিনি তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে এই পৃথিবীর রূপসুধা পান করেছেন। তাঁর রচিত চিত্রকল্প ছিল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, মূর্ত বা বাস্তব এবং অকৃত্রিম বা যথাযথ। কবির প্রকাশভঙ্গি বা অভিব্যক্তি ছিল ধরা-ছোঁয়া যায় এমন শরীরী এবং জাগতিক। কীটসের কবিতা প্রধানত মৃন্ময় জাগতিক বৃত্তে আবর্তিত হয়েও চিন্ময় চেতনায় পাঠক মনে প্রতিবিম্বিত হয়। একদিকে দুঃখ-দীর্ণ জগতের কষ্ট ও হতাশা এবং অপরদিকে আদর্শ সৌন্দর্য ও প্রেমের কল্পনার জগৎ এই দুই বিপরীতমুখী ভাবনাই তার কল্পনায় দ্যোতিত হয়েছে।

দারিদ্র্যের জন্য বাল্যকালে কীটসের পড়াশুনো খুব বেশিদুর এগোয়নি। ক্লাসিক্যাল ডিক্সনারিতে বিবৃত গ্রিক পৌরাণিক কাহিনী এবং ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত গ্রিক ভাস্কর্য থেকেই তিনি প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেন। কীটসের প্রকাশিত কাব্য ‘পোয়েমস’ (১৮১৭ খ্রিঃ) এবং তাঁর ‘এণ্ডাইমিয়ন’ (১৮১৮ খ্রিঃ) কাব্যে কবির চিত্রকল্প ও পৌরাণিক উপকথার মধ্যে অসঙ্গতির সূত্র ধরে ‘কোয়ার্টার্লি রিভিয়্যু’ পত্রিকা তাঁর কঠোর সমালোচনা করে। কিন্তু তারপর পরিশীলিত মননে ও ভাব প্রকাশ ক্ষমতায় কবি-প্রতিভা দ্রুত প্রৌঢ় পরিণতি লাভ করে। এই পরিণতির স্বাক্ষর আমরা পাই তাঁর ‘ল্যামিয়া এণ্ড আদার পোয়েমস্’ (১৮২০ খ্রিঃ) কবিতা সংগ্রহে। এই কাব্যগ্রন্থেই প্রকাশিত হয় ‘লামিয়া’, ‘ইসাবেলা’, ‘দ্য ইভ অব সেণ্ট অ্যাগ্নিস’ প্রভৃতি দীর্ঘ কাহিনী কবিতা, ছোটো কবিতা ‘লা বেল ড্যাম সান্স মার্সি’। এই সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত ‘ওড’ সমূহ—’ওড টু এ নাইটিঙ্গেল’, ‘ওড় টু অটাম’ তাঁর কাব্য-প্রতিভার উজ্জ্বল অবদান। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই রূপময় জগৎকে কেন্দ্র করে অন্তহীন গভীরতা, সুদূর ব্যাপ্তি ও মানব চৈতন্যের বিস্তৃত জগতে কবিতার শিল্পজনিত অভিক্ষেপ–কবি-প্রতিভার ক্রমপ্রসারণ আমরা তার এই শেষ কাব্যে লক্ষ্য করব। ‘হাইপেরিয়ন’ যদিও অসমাপ্ত রচনা তবু কীটসের সৌন্দর্য-চেতনার পরিণততর প্রকাশ তৎকালীন সমালোচকবৃন্দ এবং শেলি প্রমুখ কবিগণের বিস্মিত প্রশংসা লাভ করেছিল। যারা কবিতার মধ্যে কোনো তত্ত্ব নয় বিশুদ্ধ কবিতাই আস্বাদ করতে চান তাঁদের কাছে কীটস হচ্ছেন এক অপরিহার্য নাম। আর এই জোরেই আপন স্বকীয়তা নিয়ে ওয়ার্ডওয়ার্থ, কোলরিজ, বায়রন, শেলি প্রমুখ উজ্জ্বল নক্ষত্র শোভিত রোমান্টিক আকাশে আপন উজ্জ্বলতা নিয়ে চিরবিদ্যমান।

বাংলা সাহিত্যে কীটসের প্রভাব:

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বিশেষত মধুসূদন, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্রের কর্ষিত মহাকাব্যের যুগ-অন্তে যে আধুনিক গীতিকবিতার যুগ শুরু হল, সেই আধুনিক গীতি কবিদের ওপর ইংল্যান্ডের রোমান্টিক যুগের কবিদের প্রভাব অনেকখানি। এক্ষেত্রে প্রথমেই যাঁর কথা মনে আসে তিনি হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। অবশ্য শুধু কীটস নন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু কবির কল্পনারশ্মিই রবীন্দ্রনাথে সংহত হয়েছিল এবং রবিপ্রতিভার আতসকাচে কেন্দ্রীভূত এই রশ্মিজালই রবীন্দ্র-কল্পনাকে বহ্নিমান করে স্বীকরণের দ্বারা রবীন্দ্রনাথকে করেছিল ভাস্বর। তাঁর কাব্যসমিধরূপে কবি কীটসকেও তিনি গ্রহণ করেছিলেন। কীটসের সৌন্দর্য-চেতনা এবং প্রকৃতির ইন্দ্রিয়গ্রাহা রূপারতিতে রবীন্দ্রনাথও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। কবির প্রথম দিকের রচনায় এর প্রভাব সুস্পষ্ট। ‘চিত্রা’ কাব্যে তাঁর সৌন্দর্য আরতিতে কীটসের সৌন্দর্য-চেতনার কথা মনে করিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি ভিন্নরূপ হলেও ‘চৈতালী’র কবিতায় ‘আজি মোর দ্রাক্ষাকুঞ্জবনে/গুচ্ছ গুচ্ছ ধরিয়াছে ফল’ এবং ‘কল্পনা’ কাব্যগ্রন্থের ‘স্বপ্ন’ কবিতায় কীটসের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপচেতনা এবং ভাষার ভাস্কর নৈপুণ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এ ছাড়াও গীতিকবি দেবেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ কবিদের ওপরেও কীটসের প্রভাব বিশেষভাবে চোখে পড়ে। রবীন্দ্র যুগের কবি সত্যেন্দ্রনাথ ও করুণানিধানে অবশ্য তাঁর স্বপ্নবিহুলতা আছে কিন্তু মণ্ডন নৈপুণ্য নেই।

অবশ্য কীটস এই পার্থিব রূপজগতের সৌন্দর্য, প্রকৃতির ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপারতির কবি হলেও রূপজগতের ক্ষণভঙ্গুরতা, জাগতিক সৌন্দর্যের নশ্বরতা, দু’দিনের জীবনের তৃপ্ত উপভোগ কবিকে যথেষ্ট বেদনা দিয়েছে, তিনি এক চিরস্থায়ী সৌন্দর্যলোকে প্রবেশ করে এই নশ্বরতার হাত থেকে মুক্তি পাবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন। তিনি ‘ওড টু নাইটিঙ্গেল’-এর চিরস্থায়ী সৌন্দর্যলোকে প্রবেশ করতে চেয়েছেন। কিন্তু ঔপনিষদিক ভাবে স্নাত রবীন্দ্রনাথের কাছে এই রূপজগতের খণ্ড সৌন্দর্য আদি, অনন্ত সৌন্দর্যেরও অংশ, তাই তিনি খণ্ডকে অখণ্ডের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছেন। দৃষ্টিভঙ্গিগত এই পার্থক্য সত্ত্বেও কীটস প্রসঙ্গে বাংলা সাহিত্যে প্রধান রূপে রবীন্দ্রনাথের কথাই আমাদের সর্বাগ্রে মনে হয়।