“নিবিড় জীবনৰীক্ষণ, গভীর সহানুভূতি আর প্রবল আবেগময়তার সমন্বয়ে ডিকেন্সের উপন্যাসগুলি চিরায়ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।”—লেখকের দুটি উপন্যাস অবলম্বনে এই উক্তির যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করো। এদিক থেকে বাঙালী কোন ঔপন্যাসিককে তার সঙ্গে তুলনীয় মনে করা যায় কী?

উনিশ শতকে ইংরেজী সাহিত্যে উপন্যাস নতুন করে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। এ সময়ে সাময়িক পত্রিকাসমূহের প্রকাশ খুব বেড়ে গেল, এই সঙ্গে সঙ্গে সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠতে আরম্ভ করল। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে রিফর্ম বিল অনুমোদন ও কলকারখানা প্রসারের মধ্য দিয়ে সাধারণ মধ্যবিত্ত সমাজের উত্থান ও পতন ঘটল। এর সঙ্গে শিক্ষার বিস্তার ঘটল। এর ফলে সমাজে দ্রুত সাধারণ পাঠক সমাজ গড়ে উঠল। এই সাধরণ পাঠক সমাজের ক্ষুধা মেটাতে সাময়িক পত্র-পত্রিকা ছাড়াও উপন্যাসও একটা বড়ো অংশগ্রহণ করল। যুগের চাহিদা মেটাতে এলিজাবেথীয় যুগে যেমন নাটক, আধুনিক যুগে যেমন সিনেমা, তেমনি ভিক্টোরীয় যুগে উপন্যাস সেই স্থান গ্রহণ করেছিল। ভিক্টোরীয়যুগে নবজাগ্রত মধ্যবিত্ত সমাজসাহিত্যের আয়নায় তাদের নিজেদের মুখ, নিজেদের আচার-আচরণের প্রতিচ্ছবিই দেখতে চাইত। সাহিত্যে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাদের জীবন সংগ্রামের চিত্ররুপই তাদের বেশী আকৃষ্ট করত। এর ফলে লোকপ্রিয় উপন্যাস সৃষ্টিতে তৎকালে অনেক ঔপন্যাসিকই এগিয়ে এসেছিলেন। এঁদের মধ্যে চার্লস ডিকেন্স ছিলেন সর্বাধিক জনপ্রিয়। কোনো কোনো সমালোচকের মতে ইংরেজী সাহিত্যেও শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হলেন চার্লস ডিকেন্স।

ডিকেন্স (Charles Dickens) জন্মগ্রহণ করেছিলেন পোর্টসমাউথ-এ ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে। জীবনে শৈশবকাল কেটেছিল অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যে। বাবা ছিলেন ডকের সামান্য কেরানী। তাঁর পক্ষে আটটি সন্তানের ভরণপোষণ ছিল যথেষ্ট কষ্টকর। দেনার দায়ে ডিকেন্সের বাবাকে জেলেও যেতে হয়েছিল। এই দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে ঐ বাল্যবয়সেই ডিকেন্সকে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। কিছুদিন এক রঙের কারখানায় কাজ করেছিলেন। সামান্য মাইনে যা জুটতো উপরি পাওনা কুব্যবহার। অনাথদের বিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়েছিলেন। সেখানেও বিদ্যার চেয়ে মার জুটতো বেশী। ডিকেন্সের ‘নিকোলাস নিলবি’ উপন্যাসে ওই বিদ্যালয়ের অযোগ্য নিষ্ঠুর প্রধান শিক্ষকের চিত্রটা কিছুটা ফুটেছে। কাজেই বিদ্যালয়ের শিক্ষালাভ তাঁর ভাগ্যে বেশীদূর এগোল না। পনের বছর বয়সে বিদ্যালয় ছেড়ে দিয়ে এক উকিলের কেরাণী হলেন। বিশ বছর বয়সে হলেন খবরের কাগজের সংবাদদাতা। অবশ্য এই শেষের কাজটা বেশ কিছুদিন টিকে ছিল। জীবনের নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে তাঁর দিনগুলো কাটার ফলে সমাজের একেবারে তৃণমূল থেকে জীবনকে দেখার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল। জীবন সম্বন্ধে এই প্রত্যক্ষ ও ব্যাপক অভিজ্ঞতার সঙ্গে তিনটি গুণের সমন্বয় হয়েছিল। সেই গুণ তিনটি হচ্ছে তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি, কল্পনা আর অনুভূতি, এরই ফলে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাধারণীকরণ হয়েছে, সাহিত্যে তা চিরন্তন রূপ লাভ করেছে। খবরের কাগজের সংবাদদাতা চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবি ‘স্কেচেস বাই বজ’ (Sketches by Boz) এই নামে সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয়। সেই ছবি অবলম্বন করে পরিচিতিমূলক কাহিনী লেখার ভার পেলেন ডিকেন্স।

এই কাহিনী লেখার মধ্য দিয়ে ডিকেন্সের সাহিত্যিক সম্ভাবনা অঙ্কুরিত হল। ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে সাময়িক পত্রের জন্য ধারাবাহিকভাবে তিনি লিখলেন ‘পিকউইক পেপার্স’ (Pickwick Papers)। পিক্‌উইক ক্লাবের সভাপতি ও সদস্যদের নানা অভিজ্ঞতার চিত্র নিয়ে রচিত এই উপন্যাস। এর বিচ্ছিন্ন ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে সমাজের সঠিক ছবিটি ফুটে উঠেছে। গ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সাধারণের কাছে অভূতপূর্ব সমাদর লাভ করে। ফলে অনেক প্রকাশকই তাঁকে সাদর আহ্বান জানালেন। তাঁর ভাগ্যে যশ এবং জনপ্রিয়তা এলো। আমেরিকায় আমন্ত্রিত হলেন। এলো অর্থ ও খ্যাতি, এলো প্রচুর পরিমাণেই। এর পর তিনি সাংবাদিকতা করেছেন দৈনিকপত্রের সম্পাদনা। বেরিয়েছেন ইউরোপ ও আমেরিকা সফরে। একসময়ে নাট্যশালার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েছিলেন। জীবন-যাত্রার অস্থির উদ্দামতার প্রতীক হঠাৎ একদিনের স্ট্রোক-এ মারা গেলেন, ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুন। সমাধিস্থ করা হল ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে ‘পোয়েটস্ কর্নার’-এ।

‘পিকউইক পেপার্স’ প্রকাশের পর একে একে প্রকাশিত হয় “অলিভার টুইস্ট’ (Oliver Twist), ‘নিকোলাস নিকবি’ (Nicholas Nickleby), ‘দ্য ওল্ড কিউরিয়াসিটি শপ’ (The Old Curiosity Shop), ‘বার্নাবি রাজ’ ( Barnaby Rudge); ‘মার্টিন চাউইট’ (Martin Chuzzlewit), ‘এ ক্রিমা ক্যারল’ (A Chrismas Carol), ‘দ্য ক্রিকেট অন দ্য আর্থ’ (The Cricket on the Earth), ‘ডম্বি অ্যান্ড সন’ (Dombey and Son). ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ (David Copperfild), ‘ব্লীক হাউস’ (Bleak House), ‘হার্ড টাইমস্’ (Hard Times), লিটল্ ডরিট্’ (Little Dorrit), ‘এ টেল অব টু সিটিজ’ (A Tale of Two Cities), ‘গ্রেট এক্সপেকটেশন্স’ (Great Expectations), ‘আওয়ার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড’ (Our Mutual Friend), এডুইন ড্রুড’ (Edwin Drood)। এই উপন্যাসগুলি সব সময় উল্লেখ্য নয়, কিন্তু তৎকালে পাঠকসমাজে অভিনন্দন লাভে সবগুলিই ধন্য হয়েছিল এবং ইংরেজী সাহিত্যের ইতিহাসে ডিকেন্স হয়ে উঠেছিল এক স্মরণীয় নাম।

‘পিক্‌উকি পেপারস্’-এর কাহিনীগুলি অসংবদ্ধ ও খন্ড খন্ড। এর পর থেকে ডিকেন্সের উপন্যাসগুলি প্লট বাধা উপন্যাস। এই সব উপন্যাসে তাঁর জীবন অভিজ্ঞতার সঙ্গে পাঠক মনোরঞ্জনকারী নিত্যনতুন কাহিনী সৃষ্টিতে তিনি লোকপ্রিয়তার শীর্ষে উন্নীত হলেন।

‘অলিভার টুইস্ট’ (১৮৩৮), ‘নিকোলাস নিকলবি’ (১৮৩৮-৩৯), ‘দ্য ওল্ড কিউরিয়াসিটি শপ’ (১৮৪১) প্রভৃতি উপন্যাসে ডিকেন্স সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন।

‘অলিভার টুইস্ট’-এ আছে এক অজ্ঞাতকুলশীল দুর্ভাগা বালকের কথা। অনাথ আশ্রমের অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, ছেলেটি পালাল লণ্ডনে। কিন্তু পড়ল চোরদের আড্ডার। চোরের দল তাকে বাধ্য করল চুরিবিদ্যা শিখতে। চুরি করতে গিয়ে সে আহত হ’ল। ঐ দলেরই এক মেয়ে ন্যান্সির চেষ্টায় জানা গেল তার প্রকৃত পরিচয়। শেষ পর্যন্ত সে আশ্রয় পেল দয়ালু বার্ডনলের কাছে। চোরেরা পেল শাস্তি। উপন্যাসে তৎকালীন লন্ডনের সামাজিক জীবন, বিশেষ করে নিচুতলার বাসিন্দাদের বাস্তব জীবন পরিচয় যেমন রয়েছে, সেই সঙ্গে রয়েছে লেখকের গভীর সহানুভূতি। ফলে অলিভারের দুঃখ পাঠককে নাড়াচাড়া দেয় এবং চরিত্রগুলিও এই সহানুভূতি লাভে সজীব হয়ে ওঠে।

‘অলিভার টুইস্টে’ যেমন রয়েছে অনাথ আশ্রমের অত্যাচারের চিত্র, তেমনি ‘নিকোলাস নিকলবি’ তে রয়েছে স্কুলের কথা। এই কাহিনীও ডিকেন্সের জীবন থেকে নেওয়া। ভাগ্যবিড়ম্বিত নিকোলাস পিতার মৃত্যুর পর তার মা ও বোনকে নিয়ে একেবারে অথৈ সমুদ্রে পড়ল। দ্বারস্থ হ’ল অহংকারী, স্বার্থপর কাকার। কাকা নিকোলাসকে পাঠিয়ে দিল এক অনাথ বিদ্যালয়ে। সেখানে অমানুষিক অত্যাচারের হাত থেকে উদ্ধার পেতে ওখানকার এক বোকা ছেলে স্পাইক সহ নিকোলাস পালাল। রোগে ও আতঙ্কে স্পাইক মারা গেল। অক্লান্ত অধ্যাবসায়ের মধ্য দিয়ে অবশেষে ভাগ্যের আর্শীবাদ সে লাভ করল এবং দুঃখ ও দুর্দশার হাত থেকে মা বোনকে উদ্ধার করল। ডিকেন্সের শৈশব জীবনের দারিদ্র ও অনাথ বিদ্যালয়ের শিক্ষার নামে লাঞ্ছনা ও অত্যাচারের চিত্র উপন্যাসটিতে উপস্থিত।

‘দ্য ওল্ড কিউরিয়সিটি শপ’ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে আর এক দুর্ভাগা জীবনের ইতিকথা। বালিকা নেল ও তার ঠাকুরদার জীবনের করুণ ছবি। নেল তার দাদুর সঙ্গে পুরোনো জিনিসের দোকান দেখাশুনা করত। দারিদ্রের জন্য দাদু ডানিয়েল কুইলপ নামে এক দুর্বৃত্ত ধনীর কাছে ঋণ করলেন। দেনার দায়ে দোকান হল বাজেয়াপ্ত। বৃদ্ধসহ নাতনি আশ্রয় নিল গ্রামের গীর্জায়। শেষ পর্যন্ত অভাবের তাড়নায় মারা গেল। কিছুদিন পর দাদুও তাকে অনুসরণ করলেন। সুখ ও দুঃখ, স্বপ্ন ও কল্পনা নিয়ে বালিকা নেল মনোজ্ঞ হয়ে উঠেছে। নেলের দুঃখ ও মৃত্যু পাঠক হৃদয় মথিত করে। সমাজের শুধু ‘কু’ নয়, ‘সু’ ও ‘কু’ মিলিয়ে সকল মানুষের কথাই তিনি বলেছেন।

এর পরের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ (১৮৫০-৫১ খ্রিঃ) স্মরণীয়। উপন্যাসটি অনেকটা আত্মজীবনীমূলক। অবশ্য ডিকেন্সের বেশিরভাগ উপন্যাসের মধ্যেই তিনি নিজেকে ভেঙে ভেঙে দেখিয়েছেন। আপন জীবনের অতীত অধ্যায়সমূহ থকেই নিয়েছেন উপন্যাসের ঘটনা ও চরিত্র। পিতার মৃত্যুর পরই ডেভিড কপারফিল্ডের জন্ম। দুঃখ ও কষ্ট নিত্যসঙ্গী. মা দ্বিতীয়বার বিবাহ করলেন এক দুষ্ট লোককে, নাম মার্ডস্টোন। ডেভিড ও তার মা দুজনেই এর লাঞ্ছনার শিকার হলেন। অল্পদিন পরেই মা মারা গেলেন। ডেভিডকে পাঠান হল এক বেতমারা স্কুলে। শিক্ষার নামে এই অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে ডেভিড পালাল লন্ডনে। দীর্ঘ সংগ্রামের শেষে এল প্রতিষ্ঠা। স্বীকৃতি এল লেখকরূপে। জীবনে এই দুঃখের চিত্রের পাশাপাশি স্নেহময়ী ধাত্রী পেগটি, সদাপ্রফুল্ল, মিকবার মধুরস্বভাব আগ্নিস ডেভিডের জীবনে যেন স্বর্গীয় সান্ত্বনা।

‘ব্লীক হাউস’ (Bleak House) উপন্যাসটিতে সেকালের (সম্ভবত সর্বকালের) আদালতের বিচিত্র বিচার ব্যবস্থার প্রতি রয়েছে তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং বিচার-প্রত্যাশী বাদী-বিবাদীর সাধ্যাতিরিক্ত অর্থব্যয় যে বিচার প্রত্যাশীর জীবনে কষ্ট ও হতাশাই নিয়ে আসে, দীর্ঘসূত্র বিচার যে অবিচারেরই সামিল সেই কথাই এখানে লেখক বলেছেন। ভালমন্দ নানা চরিত্রের মধ্য দিয়ে সমাজের বাস্তবচিত্র এই উপন্যাসটিতেও ফুটে উঠেছে। রিচার্ড কারসূটোন নামে এক সাধারণ যুবক ও তার মধুর স্বভাব জ্ঞাতিবোন ক্লেয়ার এই দুজনে ‘জারডাইস এণ্ড জারনডাইস’ প্রতিষ্ঠানের এক সম্পত্তির বিলি-ব্যবস্থা নিয়ে মামলায় বিবাদী পক্ষ। এই মামলা এত দীর্ঘদিন ধরে চলছিল যে তা এদের কাছে ভাগ্যের নিষ্ঠুর কৌতুকের ব্যাপার হয়ে উঠল। লাভ হল এর সঙ্গে জড়িত পেশাদারী মানুষগুলোর—উকিল, মুহুরীদের। মামলা মিটলে এই সম্পত্তি পাবে একথা ভাবতে ভাবতেই রিচার্ড অসুস্থ হয়ে পড়ল, মারা গেল। আকস্মিকভাবে যখন মামলা একদিন শেষ হল, জানা গেল সেই মামলার খরচ মেটাতেই ঐ বিতর্কিত সম্পত্তি বিকিয়ে গেছে।

‘এ টেল অব টু সিটিজ’ (১৮৫৯) ডিকেন্সের জীবনের শেষ পর্যায়ে রচিত আর একটি বহুখ্যাত উপন্যাস। এই দুই নগরীর কথা, লন্ডন ও প্যারিস, ডোভারের দুই পাশের এই দুই নগরের ঘটনা পর্যায় অবলম্বনে রচিত। পটভূমিতে রয়েছে ফরাসী বিপ্লব। এটি ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়, কিন্তু ঐতিহাসিক যুগের আবহাওয়া এখানে রয়েছে। ফরাসী চিকিৎসক ডাঃ মেনেট এক রুগ্ন কৃষক ও তার বোনকে দেখতে গিয়ে জানতে পারলেন যে ঐ বোনটি এক ফরাসী অভিজাত মার্কুইস ও তার ভাই কর্তৃক ধর্ষিতা হয়েছে। ডাক্তারের মুখ বন্ধ করতে তাঁকে আঠার বছরের জন বাষ্টিলের কারাগারে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। অষ্টাদশ বছর পর মুক্তি পাওয়া ও মানসিক দিক দিয়ে বিধ্বস্ত ডাক্তার লন্ডনে এসে আশ্রয় নিলেন এবং ধীরে ধীরে মানসিক দিক থেকে সুস্থ হয়ে উঠতে আরম্ভ করলেন। গল্পের শুরু এখান থেকেই। তৎকালীন ফরাসী অভিজাত সমাজের দুর্নীতির চিত্র এখানে স্পষ্ট রূপায়িত।

‘গ্রেট এক্সপেক্‌টেশন্স’ (১৮৬০-৬১) উপন্যাসটিতে আশা ভাল কিন্তু আশা যে নিরাশারই কারণ হয় লেখক কি সেইকথাই বলতে চেয়েছেন? উপন্যাসের নায়ক গ্রাম্য যুবক ফিলিপ পিরিপ বা পিপ্ তার কুদুলে বোনের কাছে থাকত। বোনের স্বামী ছিল কামার, কিন্তু ভদ্র, কৌতুকপ্রিয়, মেজাজী। পিপের সঙ্গে আলাপ হল এক আধ-পাগলী মিস্ হ্যাভিশ্যামের সঙ্গে। বিয়ের রাতেই মেয়েটির প্রেমিক তাকে ফেলে চলে যায়। ফলে পুরুষ জাতের উপরও শোধ তোলার জন্য মেয়েটি স্টেলা নামে আর এক সুন্দরী মেয়েকে নিজের কাছে রেখে তাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে ফাঁদে পড়া পুরুষদের হেনস্তার চরম করত। পিপ্‌ও পড়ল এই প্রেমের ফাঁদে। রীতিমত অর্থ আদায় করে স্টেলকে নিয়ে রীতিমত ভদ্র জীবনযাপনের কল্পনা তাকে মশগুল করে তুলল। কিছু টাকাও এর মধ্যেই সে পেল। আরো বেশি টাকা উপার্জনের জন্য সে চলে এল লন্ডনে। তার নতুন জীবনধারায় সে গ্রামের এতদিনকার আশ্রয়দাতা কামার ভগ্নীপতির সঙ্গে সম্পর্ক স্বীকারে লজ্জাবোধ করল। কিন্তু দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে এল। সে হয়ে পড়ল কপর্দকহীন। জানা গেল, লণ্ডনের অপরিচিত উৎসাহদাতাটি হচ্ছে এক জেলপালানো বাস্তু-ঘুঘু। এইভাবেই পিপের ‘অতি বড়’ হওয়ার আশা শূন্যে মিলিয়ে গেল। এদিকে স্টেলাও বিয়ে করল পিপের প্রতিপক্ষ এক গোমড়ামুখোকে। বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে শিক্ষালাভ করেই পিপ আবার ফিরে এল তার কামার ভগ্নীপতির কাছে, তার কাজেই সে হাত মেলাল। ইতিমধ্যে গোমড়ামুখোর সঙ্গে স্টেলার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। স্টেলারেরও শিক্ষা হয়েছে জীবনে। পরিণামে পিপের সঙ্গে স্টেলার হল পুনর্মিলন। উপন্যাসটিতে ডিকেন্স তাঁর স্বভাবসিদ্ধ পথেই ভাল-মন্দ মানুষদের নিয়ে সমাজের সাদাকালো দুটো রঙই তুলে ধরেছেন আর তার সঙ্গে যেন বলতে চেয়েছেন ‘অতি বড়ো বা অতি ভাল’র বিপদের কথা।

ঔপন্যাসিক হিসাবে ডিকেন্সের কৃতিত্বের কথা আলোচনা প্রসঙ্গে বলা যায় যে তাঁর উপন্যাসে কিঞ্চিৎ ভাবপ্রবণতা এবং অতিরঞ্জন রয়েছে, তবু গল্প বলার গুণে তা অস্বাভাবিক মনে হয় না। তাঁর উপন্যাস চরিত্রগুলির পুঙ্খানুপুঙষ মনো-বিশ্লেষণও তিনি করেন নি। ‘পিক্‌উইক পেপারস’ প্রভৃতিতে তাঁর যে হাস্যরস তা গ্রাম্যতাযুক্ত ও স্থূল উপাদানে পুষ্ট। এই বৈশিষ্ট্যসমূহ ডিকেন্সের উপন্যাসের নেতিবাদী দিক, কিন্তু জাত-কবি যেমন কহিলে বিরস কথা সরস বাখানে’ তেমনি প্রতিভাবান ঔপন্যাসিকের হাতেও তাঁর দোষগুলিই তাঁর গুণ হয়ে উঠেছে। অতি রুচিশীল, অতিবিদগ্ধ পাঠকের বিচারবুদ্ধিতে ডিকেন্স খুব গ্রহণীয় না হলেও, সেই সীমাবদ্ধ গণ্ডী ছাড়িয়ে এই মোটাদাগের চরিত্র আঁকার জন্যই ডিকেন্স সর্বজনপ্রিয় ঔপন্যাসিক, ভিক্টোরীয় যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। সর্বসাধারণ ও তৎকালীন মধ্যবিত্ত সমাজের লোকপ্রিয় ঔপন্যাসিক।

আজকাল সমালোচনার নিরিখে দুটি কথা প্রায়ই শোনা যায়; এক সমাজমুখী বাস্তবতা, দুই জীবনমুখী শিল্প। এই দু’টি ব্যাপারেই ডিকেন্স ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী। তিনি যে সমস্ত উপন্যাস রচনা করেছিলেন তার কোনোটাতেই তিনি নিজের জীবনের বাইরে যান নি। তাঁর ‘ডেভিড কপারফিল্ড’কে বলা হয় আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। মোট কথা আমরা তাঁর রচিত সমস্ত উপন্যাসের দর্পণেই ডিকেন্সের মুখ দেখতে পাই। তাঁর প্রায় সমস্ত উপন্যাসেই তাঁর জীবনের এক একটা অধ্যায়ের ছায়া এসে পড়েছে। এই প্রসঙ্গে বিশেষ করে তাঁর ‘অলিভার টুইস্ট’, ‘নিকোলাস নিক্‌ক্লবি’, ‘দ্য ওল্ড কিউরিওসিটি শপ’ প্রভৃতির কথা মনে পড়বে।

আপন অভিজ্ঞতার রঙে রাঙান বলেই উপন্যাসে তিনি যাদের কথা বলেছেন তাদের সুখ ও দুঃখ আপন অকৃত্রিমতা নিয়ে আমাদের অন্তর স্পর্শ করে, নির্মমতা ব্যথিত করে আমাদের অন্তরকে। সাহিত্যিকের প্রতিভায় প্রাণ পেয়ে উপন্যাসের পাতায় চরিত্রগুলি হয়ে ওঠে জীবন্ত। তৎকালীন সমাজের প্রেক্ষাপটে তাঁর বর্ণিত ঘটনা ও চরিত্রগুলি সমাজমুখী ও বাস্তব।

হাসি আর অশ্রু—উভয়েরই তিনি নিপুণ চিত্রকর। শরতের মেঘমুক্তকাশের উজ্জ্বল সোনালী রৌদ্র এবং প্রদোষবেলার ছায়াঘন অন্ধকার, humour এবং pathos এর এমন সুসঙ্গত মিশ্রণ সাহিত্যে খুব বেশী নেই। মানুষের স্বভাবে অনেক অসঙ্গতি আছে, আছে অনেক অদ্ভুত খেয়াল। সেগুলিকে নিয়ে যেমন হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন, আবার দুর্ভাগ্য ও দুঃখ যাদের নিত্যসঙ্গী, সেইসব ভাগ্যপীড়িত মানুষের কথাও বলেছেন গভীর মহানুভূতির সঙ্গে। লেখকের এই সর্বব্যাপী সহানুভূতি পাঠকের নয়নকেও অশ্রুসজল করে তোলে।

মানুষের স্বার্থপরতা ও শয়তানির বহু চিত্র আছে তাঁর উপন্যাসে। কিন্তু তাই তাঁর উপন্যাসের শেষ কথা নয়। অন্ধকরের পাশেই রয়েছে আলো, শীতের পরে বসন্ত, হীনতার পাশেই মহনীয়তা সে কথা তিনি ভোলেন নি, তিনি আশাবাদী। তাই এই চারিত্রিক ক্ষুদ্রতা ও মহত্ত্ব দুই রকমের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চরিত্রেই সমাহার রয়েছে তার উপন্যাসে।

তাঁর চরিত্রগুলিকে মাঝে মাঝে টাইপ চরিত্র বলে মনে হয়, কিন্তু বৈচিত্র্যে ও বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এত অজস্র মানুষ তাঁর উপন্যাসে এসেছে যে বিচিত্র চরিত্রসৃষ্টিতে প্রায় শেকসপীয়রের কথাই মনে পড়ে। সে মানুষ উদ্ভট হোক, উৎকেন্দ্রিক হোক, ক্ষ্যাপা হোক, পাগল হোক, হোক না জেল-পালান বাস্তঘুঘু—সবাই বিশিষ্ট, জীবন্ত। লেখকের মমতা, ভালবাসা ও সর্বব্যাপী সহানুভূতি থেকে এরা কেউই বঞ্চিত হয়নি।

কাহিনী ও চরিত্র বর্ণনার দিক দিয়েও ডিকেন্সের শিল্প নৈপুণ্য লক্ষ্যণীয়। যা নগণ্য, যা তুচ্ছ এবং উপেক্ষিত তারও সৌন্দর্য তাঁর চোখে পড়েছে। অবশ্য সাধারণের মধ্যে অসাধারণকে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে রয়েছে রোমান্টিক যুগের উত্তরাধিকার। বর্ণনার গুণ বাইরের কুয়াশা, দোকান-পাট, রাস্তা প্রভৃতির দৃশ্য ছবির মতন পাঠকের মনের দর্পণে প্রতিভাত হয়। তাঁর সৃজনীমূলক কল্পনার স্পর্শে গল্প কাহিনী নতুন করে প্রাণলাভ করে। তাঁর উপন্যাসের বেশির ভাগ অংশই জুড়ে আছে অনাথ আশ্রম, কারখানা, জেলখানা, আইন-আদালত, সমাজের নিচুতলার অন্ধকার জগতের পাপ, অপরাধ, যন্ত্রণাবোধ। এই সবের মধ্যে দিয়ে ব্রিটেনের জনগণের বিবেককে তিনি জাগরিত করতে চেয়েছিলেন। লেখকের বাস্তববোধের সমাজমনস্কতা এখানে যুক্ত হয়েছে।

ডিকেন্সের দ্রুত ও জীবন্ত বর্ণনা, ভাষার ক্ষেত্রে জ্বালাময়ী শব্দ প্রয়োগ এবং ঘটনা ও চরিত্রের প্রয়োজন অনুযায়ী উপযুক্ত ভাষার ব্যবহার তাঁর উপন্যাসকে আকর্ষণীয় করেছে। চরিত্র অনুযায়ী চরিত্রের মুখে তিনি ভাষা জুগিয়ে দিয়েছেন।

ভিক্টোরীয় যুগের পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী তাঁর উপন্যাসে অতিনাটক, করুণ রস, রোমাঞ্চকর বা উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা, ভাবপ্রণতা, রোমান্স প্রভৃতি সব বৈশিষ্ট্যই ছিল আর সেই সঙ্গে ছিল তরতরে গল্প বলার ক্ষমতা। এই গুণেই ডিকেন্স তৎকালীন এবং সর্বকালীন সাধারণ পাঠকের প্রিয় ঔপন্যাসিক হয়ে উঠেছিলেন এবং তাঁর খ্যাতি ও প্রভাব তাঁর দেশের সীমা ছাড়িয়ে দেশের বাইরেও বিস্তৃত হয়ে পড়েছিল। তাঁর লোকপ্রিয়তায় আজও ভাটার টান শুরু হয় নি।