কবিতা ছিল এলিয়টের (Thomas Stearns Eliot) স্বক্ষেত্র। কিন্তু সাহিত্যের অন্য অঙ্গনেও আমরা তাঁকে খুঁজে পাব। পাব নাটকের ক্ষেত্রেও। তবে এই নাটক কবির হাতে নাট্যকাব্য এবং এই নাট্যকাব্যের ক্ষেত্রে এলিয়টের অবদান অনস্বীকার্য।

‘মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রেল’ (Murder in the Cathedral) ১৯৩৫ সালে রচিত। এই গীর্জায় হত্যা-বিষয়কে নিয়ে লেখা নাটকটি এলিয়টের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাটক। মধ্যযুগে রাজা বনাম চার্চ-এর মধ্যেকার ক্ষমতার লড়াই এবং লড়াই শেষে চার্চের পুরোহিতের মৃত্যু ঘটানোর বিষয়। কিন্তু ব্যঞ্জনায় মৃত্যুর মধ্য দিয়েও পুরোহিতের আত্মিক জয়ই বিঘোষিত হয়েছে। নাটকটি ট্র্যাজেডি। কবিতার ভাষাকে নাটকে রূপান্তরিত করে নাট্যকাব্যের ভাষা সম্পর্কে সাধারণের অনীহাবোধকে তিনি সার্থকভাবেই দূর করেছিলেন। কোরাস-এর সফল প্রয়োগ, উচ্চ-আধ্যাত্মিক বোধ, বাস্তবের সঙ্গে অতীন্দ্রিয়তার মিশ্রণ প্রভৃতির দ্বারা শুধু ইংলণ্ডের নাট্যসমাজ নয়, বিশ্বের নাট্যমোদীরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ফলে কবিতার মতো নাটকের ক্ষেত্রেও তিনি হলেন একটি স্মরণীয় নাম।

এরপরের নাটক ‘দ্য ফ্যামিলি রি-ইউনিয়ন’ (The Family Re-union) ১৯৩৯ সালে রচিত। নাটকটিতে নাট্যকার আরও সাহসী পদক্ষেপ নিলেও নাটকটি লোকপ্রিয় হয়নি। ভয়ঙ্কর অপরাধ, তার জন্য অনুতাপ ও আত্মশুদ্ধি নিয়ে এই নাটকের কাহিনী গড়ে উঠেছে। গ্রিক ট্র্যাজেডির ধরনে রোষ, প্রতিহিংসা প্রভৃতি নাটকীয় চরিত্রে রূপ ধরে মঞ্চে প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে উপস্থিত হয়েছে। ফলে বিপরীতধর্মী চরিত্রে সংঘাত এবং কল্পনা আতঙ্ক ট্র্যাজেডিকে বস্তুজগতের সীমায় নিয়ে এসে নাটকীয় দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা হয়েছে।

‘দ্য ককটেল পার্টি’ (The Cocktail Party) ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয়। নাটকে বিভিন্ন অংশ দ্বারা গোটা কাহিনী গঠন ও সমন্বয় পূর্বের নাটকের মতোই। কাহিনীর পরিণাম সুখকর। এলিয়টের দার্শনিক বোধ, তাঁর দুঃখবাদ, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষা এবং আবেগের কাছে আবেদন বিদগ্ধ দর্শক মনে সাড়া জাগিয়েছিল।

‘দ্য কনফিডেনসিয়াল ক্লার্ক’ (The Confidential Clerk) প্রকাশকাল ১৯৫৩। এলিটয়ের চিন্তা বা ভাবনা এখানেও পূর্ববর্তী নাটক দু’টির মতো একই খাতে বয়ে চলেছে। মানুষের আবেগঘন মুহূর্তগুলি ব্যর্থ হয়ে যায়। নায়ক যখন তার সমস্যাগুলো সমাধান করে নিয়ে এসেছে, দেখতে পায় স্টেজের ওপর সে একাই দাঁড়িয়ে আছে। মহাজীবনের ডাকে মানুষকে এমন নিঃসঙ্গই পথ চলতে হয়।

এলিয়টের নাটকাবলীর মধ্যে এই চারটি নাটকই বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে ‘মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রেল’ সর্বশ্রেষ্ঠ। অনেকে তাঁর নাটকে ঘটনা-বিন্যাস, চরিত্রের সংঘাত—যা নাটকের অবশ্যম্ভাবী শর্ত—বিশেষ খুঁজে পান নি বলে দুঃখ করেছেন। কিন্তু নাট্যকার হলেও তিনি মূলতঃ কবি এবং কবির দৃষ্টি থেকেই, বিশেষ একটি কেন্দ্রীয় ভাবনা থেকে সঞ্জাত একটি আইডিয়াকে রূপ দেবার জন্যই তিনি নাটকে কাব্যভাষার বা নাটকীয় কাব্যভাষার (dramatic poetry) আশ্রয় নিয়েছিলেন। ফলে ‘মার্ডার ইন দ্য ক্যাথিড্রেল’-এর কথা বাদ দিলে, অপর নাটকগুলি অনেকাংশে ভাবের বাহন (Vehicle of Ideas) হয়ে উঠেছে। আর নাটক হয়েছে নাট্যকাব্য। তবে নাট্যকাব্য হিসেবেও নাটকগুলি বিশ্বে বিদগ্ধজনের সপ্রশংস দৃষ্টিই আকৃষ্ট করেছে।

সমালোচক এলিয়ট : কবিতা ও নাটক রচনার ক্ষেত্রে এলিয়ট যেমন আপন স্বকীয়তার পরিচয় দিয়ে ইংরেজি সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছেন, তেমনি সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রেও এলিয়টের চেয়ে বড়ো প্রাবন্ধিক ইংরেজি সাহিত্যের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণে খুব বেশি জন্মাননি। যখন যে লেখক বা যে রচনা সম্পর্কেই তিনি মুখ খুলেছেন, তিনি তা এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করেছেন। অন্য কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তির দ্বারা প্রভাবান্বিত হন নি।

বিশ শতকের প্রথমার্ধে কবি ও সমালোচক হিসেবে ইংরেজি সাহিত্যের অঙ্গনে এলিয়টই ছিলেন এক নম্বর ব্যক্তি। তাঁর সমালোচনামূলক লেখাগুলি ছিল প্রধানত প্রবন্ধ, বক্তৃতা ও গ্রন্থ সমালোচনা। সংখ্যার দিক দিয়ে এর সর্বমোট সংখ্যা হবে প্রায় পাঁচশ’ এর মতো। এর থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধগুলি সঙ্কলিত করে ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয় ‘দ্য সেন্ড্ েউড’ (The Sacred Wood)। ‘দ্য সিলেকটেড এসেজ’ (The Selected Essays) প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ সালে। ‘এসেজ ইন ক্রিটিসিজম’ (Essays in Criticism) এবং ‘দ্য ইউজ অব পোয়েট্রি এন্ড দ্য ইউজ অব ক্রিটিসিজম’ (The Use of Poetry and the Use of Criticism) এর প্রকাশকাল ১৯৩৩। গ্রন্থগুলিতে সমালোচক এলিয়টের মানসিকতার দোষ-গুণ উভয়েরই ছাপ পড়েছে। এই কবি সমালোচকের মনের তিনটি স্তরের পরিচয় এর মধ্যে ধরা পড়েছে। এলিয়ট-ভক্ত গবেষক জর্জ ওয়াটসন এই তিনটি স্তরকে এইভাবে চিহ্নিত করেছেন—১৯২০ থেকে ১৯২৯, ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আরম্ভকাল থেকে পরবর্তী অংশ। এইভাবে এলিয়টের সমালোচনাকে তিনটি স্তরে বিভক্ত করলেও এই কবি সমালোচকের মতের কোনো বিবর্তন প্রবন্ধগুলিতে লক্ষ্য করা যায় না। সমালোচনার ক্ষেত্রে সাহিত্য সম্পর্কিত মূল প্রশ্নে তিনি প্রথম দুই দশক ধরে যে অভিমত পোষণ করেছেন, পরের দিকেও সেই অভিমতের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

এলিয়ট তাঁর সাহিত্য সমালোচনাকে বলতেন সমালোচনা কর্মশালা (workshop criticism)। কবির দৃষ্টি নিয়েই যেমন তিনি নাটক রচনা করেছেন, তেমনি কবির দৃষ্টি নিয়েই তিনি সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। ফলে কবি এলিয়টের ছাপ সমালোচনার ক্ষেত্রেও পড়েছে। তাঁর সমালোচনার তত্ত্বকে মোটামুটি তিনটে ভাগে বিভক্ত করা যায়। প্রথম কাব্যজগতের যে বাইরের রূপ তা’ গড়ে ওঠে ইন্দ্রিয়ের লব্ধ জ্ঞান বা সংবেদন (Sensation), অনুভূতি বা ভারপ্রবণতা (Feeling), মানসিক আবেগ (Emotions) এবং চিন্তা বা ভাবনা (Thought)-র মধ্য দিয়ে। কবির সৃজনশীল অভিজ্ঞতার সমগ্রতায় একে বিধৃত হতে হবে। দ্বিতীয়, আঙ্গিকের দিক থেকে কবিতাতে বা রচনায় সমন্বয়ের ঐক্যতান সৃষ্টি হবে এবং তা হবে কবির অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে। তৃতীয়, ভাব পরিবেশনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক সৎ কবির রচনাতেই যথোপযুক্ত বাধারা, ছন্দ এবং কবিতায় সুশ্রাব্য সঙ্গীতধর্মিতার সমন্বয় থাকবে। এই তিনটি বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করেই এলিয়টের সমালোচনা সাহিত্য গড়ে উঠেছে।

আপন স্বকীয়তার ছাপ নিয়ে বিশ শতকের কাব্য, নাটক ও সমালোচনা–সাহিত্যের এই প্রধান তিনটে অঙ্গনেই এলিয়ট বিদগ্ধমণ্ডলীতে একজন সর্বজনস্বীকৃত প্রতিভা।