কালিদাস রচিত মহাকাব্যগুলির পরিচয় দাও এবং ঐগুলির কবিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো।

কালিদাসের আবির্ভাবকাল সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা-সহ কালিদাস মহাকাব্যগুলির সংক্ষেপে পরিচয় দাও।

কালিদাসের ‘কুমারসম্ভবে’র শিব-পার্বতী-পরিণয় পর্যন্ত কাহিনী এবং কবির বর্ণনাসৌন্দর্য আলোকপাত করো।

‘মেঘদূত’ ও ‘কুমারসম্ভব’— অবলম্বনে কবি কালিদাসের প্রতিভা বিষয়ক আলোচনা করো।

আবির্ভাব কাল: আবির্ভাবকাল-সন্বন্ধে সংক্ষেপে বলা যায়, মহাকবি কালিদাস তাঁর কাব্যসমূহে নিজস্ব ব্যক্তিপরিচয়ের কোনো চিহ্নই রাখেন নি, ফলত পারিপার্শ্বিক প্রমাণ এবং অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই পণ্ডিতমণ্ডলী তাঁর জীবনকাল বিষয়ে গবেষণায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। এ বিষয়ে বহু মত প্রচলিত হলেও তিনটি অভিমতই বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে, (১) ভারতীয় গবেষকগণ এবং উইলিয়ম জোন্স আদির মতে খ্রিস্টীয় ৫৭ অব্দে উজ্জয়িনী-রাজ বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় তিনি বর্তমান ছিলেন; (২) ম্যাক্সমূলার, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ পন্ডিতগণ মনে করেন, পূর্বোক্ত রাজা ৫৪৪ খ্রিস্টাব্দে শক বিতাড়ন করেছিলেন, কালিদাস তাঁর রাজসভার শোভা বর্ধন করতেন; (৩) ম্যাকডোনাল্ড, কীথ প্রমুখ বহু ঐতিহাসিকই মনে করেন যে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের ও পঞ্চম শতকের প্রথম দিকে গুপ্তবংশীয় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তই ‘বিক্রমাদিত্য’ নাম গ্রহণ করেছিলেন, কালিদাস তাঁর সভাকবি ছিলেন। এই তৃতীয় অভিমতটিই মোটামুটি সর্বজনমান্যতা লাভ করেছে।

কাব্য সম্পর্কে সাধারণ কথা : সংস্কৃত কাব্যের অর্থাৎ সাহিত্যের দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়—শ্রব্যকাব্য ও দৃশ্যকাব্য। শ্রব্যকাব্যের আবার তিনটি ধারা—পদ্যকাব্য, গদ্যকাব্য এবং চম্পু কাব্য, আর দৃশ্যকাব্য বলতে বোঝায় রূপক তথা নাটককে। পদ্যকাব্যের তিনটি শাখা—মহাকাব্য, খণ্ডকাব্য এবং কোষকাব্য। এদের মধ্যে কোষকাব্য বলতে বোঝায়—সাধারণত প্রকীর্ণ অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন শ্লোক সমষ্টিকে। খণ্ডকাব্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয় গীতিকবিতা, নীতিকবিতা, শতক কাব্য প্রভৃতিকে। কালিদাস ‘নাটক’ বা দৃশ্যকাব্য ছাড়া যে সকল ‘শ্রব্যকাব্য’ রচনা করেছিলেন। বলে নিঃসন্দিগ্ধভাবে জানা যায়, তাদের মধ্যে আছে দু’টি মহাকাব্য – ‘কুমারসম্ভব’, ‘রঘুবংশ’ এবং দু’টি গীতিকাব্য— ‘মেঘদূত’ ও ‘ঋতুসংহার’-এর গ্রন্থকর্তৃত্ব বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এছাড়াও অসংখ্য গ্রন্থের রচয়িতারূপে কালিদাসের নাম প্রচলিত থাকলেও সুধীসমালোচকগণ এদের একটিকেও কালিদাসের রচনা বলে গ্রহণ করেন নি।

মহাকাব্য ও খণ্ডকাব্য : অতএব কালিদাসের রচিত কাব্য বলে আমরা গ্রহণ করতে পারি ‘কুমারসম্ভব’ ও ‘রঘুবংশ’—এই দু’খানি মহাকাব্যকে এবং ‘মেঘদূত’ ও ‘ঋতুসংহার’ গীতিকাব্য দুটিকে। কালিদাসের তথা সংস্কৃত ভাষায় রচিত কাব্যকে মহাকাব্য এবং গীতিকাব্য যথা খণ্ডকাব্য-রূপে বিভক্ত করা হলেও এই দু’য়ের মধ্যে খুব একটা গুণগত পার্থক্য নেই। সংস্কৃত আলঙ্কারিকগণ যেভাবে মহাকাব্য এবং খণ্ডকাব্যের লক্ষণাদি বর্ণনা করে তাদের শ্রেণীবিন্যাস করেন, তাতে এতদুভয়ের মধ্যে যা পার্থক্য দাঁড়ায় তা’ মূলত আকারগত এবং কিছুটা বিষয়গত। লালমোহন বিদ্যানিধি বলেন, “কোন এক বিষয়ের উপর লিখিত অনতিদীর্ঘ যে কাব্য, আলঙ্কারিকেরা তাহাকে ‘খণ্ডকাব্য’ বলেন। খণ্ডকাব্য মহাকাব্যের প্রণালীতে রচিত; কিন্তু মহাকাব্যের সম্পূর্ণ লক্ষণাক্রান্ত নহে। কোনো কোনো খণ্ডকাব্য মহাকাব্যের ন্যায় সর্গবন্ধে বিভক্ত নয়। আর যে সকল খণ্ডকাব্য সর্গবন্ধে বিভক্ত, তাহাতে সর্গসংখ্যা আটের অধিক দেখা যায় না। মেঘদূত ও ঋতুসংহার প্রভৃতির ন্যায় কাব্য খণ্ডকাব্য।” অতএব মহাকবি কালিদাস রচিত মহাকাব্য এবং খণ্ডকাব্য তথা গীতিকাব্য রচনায় মূলত যে প্রক্রিয়াগত ঐক্য আছে সেই কারণে মোটামুটি একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এদের বিচার-বিবেচনা সম্ভবপর।

১। ‘কুমারসম্ভব’ : সম্ভবত কালিদাসের প্রথম মহাকাব্য। কোনো কোনো অর্বাচীন পাণ্ডুলিপিতে এর ২২টি সর্গ পাওয়া গেলেও প্রাচীনতর পাণ্ডুলিপিগুলিতে ৮টি মাত্র সর্গ পাওয়া যায় এবং কালিদাস কাব্যের মুখ্য টীকাকার আচার্য মল্লিনাথও মাত্র প্রথম ৮টি সর্গের টীকা রচনা করেছেন। এ কাব্যের অধিকাংশ স্বদেশীয় এবং বিদেশীয় রসজ্ঞ সমালোচক ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যের প্রথম আটটি সর্গকেই কালিদাসের নিজস্ব রচনা বলে স্বীকার করেছেন, পরবর্তী সর্গগুলিকে মনে করেন স্বল্প প্রতিভাসম্পন্ন কবির প্রক্ষেপ।

নামকরণ এবং কুমারসম্ভব কি সম্পূর্ণ? : গ্রন্থের নাম ‘কুমারসম্ভব কাব্য’–এর সহজ অর্থ, এই কাব্যে কুমারের অর্থাৎ কার্ত্তিকেয়ের জন্মের কথা বলা হয়েছে। আবার ‘সম্ভব’ কথাটি দ্বারা যেমনি ‘জন্ম’ বোঝায় তেমনি সম্ভাবনার ভাবটিও পরিস্ফুট, অতএব সমগ্রভাবে আমরা ধরে নিতে পারি যে, কবি কালিদাস এই গ্রন্থে শুধু কুমার কার্তিকেয়ের জন্ম সম্ভাবনা পর্যন্তই উপস্থাপিত, গ্রন্থের অষ্টম সর্গের মধ্যেই এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। গ্রন্থের দ্বিতীয় সর্গে ইঙ্গিত আছে যে তারকাসুর-বধের নিমিত্তই পার্বতীমহেশ্বরের পুত্ররূপে কুমার কার্ত্তিকেয়ের জন্মের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। গ্রন্থের ৮ম সর্গের মধ্যে কুমারের জন্ম কিংবা তারকাসুরবধ নেই–দশম সর্গে কুমারের জন্ম এবং শেষতম পর্যায়ের তারকাসুর বধ বর্ণিত হয়েছে। এই যুক্তিতে যাঁরা ২২ সর্গ-যুক্ত কাব্যকেই কালিদাসের কাব্য বলে স্বীকৃতি জানাতে চান, তাদের বিরুদ্ধে বলা হয় যে, কাব্যের নাম ‘তারকাসুরবধ’ নয়, ‘কুমারসম্ভব’ এবং গ্রন্থের অষ্টম সর্গে কুমারের জন্ম সম্ভাবনা সূচিত হয়েছে; অতএব এর অধিক অগ্রসর হওয়া নিষ্প্রয়োজন। বিশেষত অষ্টম সর্গের পরবর্তী রচনা এত অপরিপক্ক যে তাকে মহাকবি কালিদাসের রচনা বলে মেনে নেওয়া চলে না। উভয় পক্ষে এবং বিপক্ষে আরও বহুতর যুক্তি এবং প্রতিযুক্তি প্রদর্শিত হয়ে থাকে, কিন্তু মহাজনগণ অষ্টমসর্গযুক্ত ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যের স্বীকৃতিতে অটল রয়েছেন। এই প্রসঙ্গে অর্থাৎ গ্রন্থনাম প্রসঙ্গে আর একটি সম্ভাবনাকেও অনেকে গণনীয় বিবেচনা করে থাকেন। অনুমান করা হয়, গুপ্তবংশীয় সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ‘বিক্রমাদিত্য’ উপাধি ধারণ করে রাজধানী পাটলীপুত্র থেকে উজ্জয়িনীতে সরিয়ে নিয়েছিলেন। কবি কালিদাস হয়তো তাঁরই রাজসভা অলঙ্কৃত করেছিলেন। বিক্রমাদিত্যের পর রাজা হয়েছিলেন কুমারগুপ্ত। কালিদাস হয়তো কৃতজ্ঞতাবশে তাঁর প্রভুদের নাম স্মরণীয় করে রাখবার জন্যই ‘বিক্রমোবশী’ এবং ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যদ্বয়ের এতাদৃশ নামকরণ করেছিলেন।

কাহিনী বিশ্লেষণ – পার্বতী পরিণয় : পিতা দক্ষের মুখে স্বামী শিবের নিন্দা শুনে দক্ষ-কৃত সভাস্থলেই সতী দেহত্যাগ করেন এবং পরজন্মে পর্বতরাজ হিমালয়-গৃহিণী মেনকার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন, তাঁর নাম উমা-পার্বতী। কালে তিনি যখন যৌবনবতী হয়ে উঠলেন, তখন একদিন দেবর্ষি নারদ এসে হিমালয়কে জানিয়ে দিলেন যে কন্যা পার্বতী এই জন্মেও মহাদেবকেই পতিরূপে লাভ করবেন। এদিকে মহাদেবও নিভৃতে তপস্যার প্রয়োজনে হিমালয়ে উপনীত হয়েছেন জানতে পেরে পর্বতরাজ কন্যা পার্বতীকে তাঁর পরিচর্যার ভার গ্রহণ করবার নির্দেশ দিলেন, সেই সঙ্গে রইলো দুই সখী। ওদিকে স্বর্গরাজ্যে তারকাসুরের উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে দেবতারা তার প্রতিকারের জন্য এলেন ব্রহ্মার কাছে। ব্রহ্মা জানালেন, হিমালয়ে তপস্যারত মহাদেব যাতে সেবারতা পার্বতীর প্রতি আকৃষ্ট হন, তার ব্যবস্থা করতে হবে, কারণ পার্বতীর গর্ভজাত শিবপুত্রই দেবসেনাপতিরূপে তারকাসুরের নিধনে সক্ষম। অতএব তপোমগ্ন মহাদেবকে পার্বতীর প্রতি আকৃষ্ট করবার উপায় সন্ধানে ব্রতী হলেন দেবরাজ ইন্দ্র। মহাদেবের তপোভঙ্গ করবার জন্য তিনি আহ্বান জানালেন প্রেমের দেবতা মদনকে, মদন সঙ্গে নিয়ে এলেন সথা বসন্তকে। তপোবনে অকালবসন্তের উদ্বোধনে প্রকৃতিতে সাড়া জাগলো, সাড়া জাগলো তির্যক প্রাণীদের দেহে-মনেও। ধ্যানমগ্ন শিবের চরণপার্শ্বে উপবিষ্ট পার্বতী— অকালবসন্তের আগমনে অকস্মাৎ চঞ্চল হয়ে উঠলো মহাদেবের মন। তিনি তার কারণ অনুসন্ধানের জন্য সামনের দিকে তাকাতেই লতাকুঞ্জের আড়ালে দেখতে পেলেন পুষ্পধম্বা মদনকে। মুহূর্তের মধ্যে মহাদেবের তৃতীয় নয়নের অগ্নিতে ভস্ম হলেন মদন। তপস্যার বিঘ্ন বিবেচনায় নারীসান্নিধ্য ত্যাগ করে মহাদেব স্থানান্তরে চলে গেলেন। লজ্জিতা অপমানাহতা পার্বতীও স্বগৃহে ফিরে এলেন। মদন ভস্মীভূত হওয়াতে মদন-পত্নী রতি দীর্ঘ বিলাপের পর স্বামীর অনুগামিনী হবার জন্য চিতাসজ্জা করলে দৈববাণী হল—মদন আবার প্রাণ ফিরে পাবেন, অতএব রতি যেন দেহত্যাগ না করেন। অতএব রতির প্রতীক্ষা আরম্ভ হল। মহাদেবের দ্বারা প্রত্যাখ্যাতা হয়ে দেবী পার্বতী স্বীয় রূপের নিন্দা করে কঠোর তপস্যায় ব্রতী হলেন; আত্মীয়-স্বজনদের আপত্তি থাকলেও শেষ পর্যন্ত মাতা পিতার অনুমতি নিয়ে পার্বতী চলে এলেন এক নিভৃত গিরিশিখরে। প্রবল শীতের রাত্রে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে, প্রচণ্ড গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে চারিপার্শ্বে অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে তিনি তপস্যা করতে লাগলেন। ক্রমে তিনি আহার ত্যাগ করলেন, এমনকি বৃক্ষের গলিত পত্রও গ্রহণ না করে ‘অপর্ণা’ হলেন। এমন সময় একদিন এক ব্রহ্মচারী এসে তাঁর কাছে শিবনিন্দা করে যোগ্য স্বামীর সন্ধান করতে বললেন, বিরক্ত হয়ে পার্বতী যখন স্থানান্তরে যেতে উদ্যতা হলেন, তখন ব্রহ্মচারী স্বমূর্তি ধারণ করে পার্বতীকে দুই বাহু দ্বারা আলিঙ্গন করলেন— পার্বতীর অবস্থা তখন ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’— কারণ ইনিই তাঁর চির আরাধ্য মহাদেব শঙ্কর। অতঃপর একদিন পার্বতীর অভিপ্রায় জানতে পেরে মহাদেব সপ্তর্ষিকে আহ্বান করে তাঁদের ঘটকরূপে পর্বতরাজের কাছে পাঠালেন। হিমালয় সন্তুষ্টচিত্তে মহাদেবের সঙ্গে পার্বতীর বিবাহে সম্মতি জানালেন। এরপর যথাসময়ে বরযাত্রিগণসহ শিব এসে উপনীত হলেন ‘ওষধিপ্রস্থ’ নগরে। সপ্তর্ষির পৌরোহিত্যে শিব-পার্বতীর বিবাহ সম্পন্ন হল – শঙ্কর পার্বতীকে ধ্রুব নক্ষত্র দর্শন করালেন। বিবাহের পর এক মাস ওষুধিগ্রস্থ নগরে অবস্থান করে শিব-পার্বতী বিভিন্ন পাহাড়ে-পর্বতে ‘মধুচন্দ্রিমা’ যাপন করে বেড়াতে লাগলেন।

কাব্য-বিচার : ‘কুমারসম্ভব’ সম্ভবত কালিদাসের প্রথম রচনা, তাই এতে পরিণত প্রতিভার পরিচয় তত সুস্পষ্ট নয়। কিন্তু তৎসত্ত্বেও কালিদাসীয় মহিমা থেকে একেবারে বঞ্চিতও নয় কাব্যটি। কাব্যটির উৎসরূপে বহু পুরাণের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করা চলে, কিন্তু পুরাণগুলির প্রামাণিকতা-বিষয়ে নিশ্চয়তা কোথায়? তবু মনে হয়, প্রাচীনতর কোনো ‘শিবপুরাণ’ কি ‘স্কন্দপুরাণ’ থেকেই তিনি মূল কাহিনীটি গ্রহণ করে থাকতে পারেন। কিন্তু যে শাশ্বত ভারতীয়ত্ব এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যে বিদ্যমান, যার পরিচয় তাঁর পরিণত কাব্য ‘মেঘদূত’ কিংবা ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলে’ও বর্তমান, সেই মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি কালিদাসের নিজস্ব। একালের আরেক ভারতাত্মা কবি রবীন্দ্রনাথের ভাবদৃষ্টিতে সেই বিশেষ তাৎপর্যটি যথাযথভাবেই ধরা পড়েছে, তিনি লিখেছেন, “যে প্রেমের কোনো বন্ধন নাই কোনো নিয়ম নাই, যাহা অকস্মাৎ নরনারীকে অভিভূত করিয়া সংযম দুর্গের ভগ্নপ্রাকারের ওপর আপনার জয়ধ্বজা নিখাত করে, কালিদাস তাহার শক্তি স্বীকার করিয়াছেন, কিন্তু তাহার কাছে আত্মসমর্পণ করেন নাই। তিনি দেখাইয়াছেন, যে অন্ধ প্রেম-সম্ভোগ আমাদিগকে স্বাধিকার প্রমত্ত করে তাহা ভর্তুশাপের দ্বারা খণ্ডিত, ঋষিশাপের দ্বারা প্রতিহত ও দেবরোষের দ্বারা ভস্মসাৎ হইয়া থাকে।” তাই ‘নিনিন্দ রূপং হৃদয়েন পার্বতী’—নিজের রূপকে হৃদয় দ্বারা নিন্দা করে পার্বতী কঠোর তপশ্চর্যায় আপনার অন্তর-সৌন্দর্য দ্বারা প্রিয়তমকে লাভ করতে চেষ্টাবতী হয়েছিলেন। কালিদাসের অপরাপর রচনার মতো প্রকৃতি প্রীতির পরিচয় ‘কুমারসম্ভবে ও বর্তমান, তবে এখানকার বর্ণনা অনেকটা বস্তুনিষ্ঠ, কবিপ্রাণের সঙ্গে তা ওতপ্রোত হয়ে নেই। গ্রন্থের তৃতীয় সর্গে ‘অকাল বসন্তে’র বর্ণনায়, চতুর্থ সর্গে ‘রতিবিলাপে’ এবং পঞ্চম সর্গে ‘পার্বতীর তপশ্চর্যা’য় কালিদাস যে সকল চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, এই কাব্যের প্রধান সৌন্দর্য এগুলিকে অবলম্বন করেই। ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে কবি সমকালীন গার্হস্থ্য জীবনের যে পরিচয় দিয়েছেন, তেমনটি সংস্কৃত সাহিত্যে খুব কমই পাওয়া যায়। ড. সুকুমার সেন এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন, “….কাব্যটির বিষয় domestic অর্থাৎ সংসারী মানুষঘটিত; কন্যার জন্ম, তাহার শৈশবচেষ্টা তাহার যৌবনোদ্‌গম, বিবাহ-ব্যবস্থায় মাতাপিতার কর্তব্য, বিবাহ সমারোহের বিবরণ ইত্যাদি ঘরোয়া ব্যাপার—মেয়েদের তরফে কুমারসম্ভবে আমরা পাই। কোনো সংস্কৃত, প্রাকৃত অথবা ভাষাকাব্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে এমন খুঁটিনাটি সমেত গার্হস্থ্য চিত্র পাই না। বিবাহের পূর্বে সঞ্জাত প্রেমের, অর্থাৎ অনুরাগের, এমন নিখুঁত বিশ্লেষণ এবং দাম্পত্য প্রেমের এমন আদর্শ আর কোথাও নাই। কুমারসম্ভব কাব্যে কালিদাস একালের গল্প-উপন্যাস লেখকের কাছাকাছি আসিয়াছেন।”

২। রঘুবংশ : মহাকবি কালিদাস রচিত ‘রঘুবংশ’ নামক মহাকাব্যটি রঘুবংশীয় আটাশজন নৃপতির ধারাবাহিক কাহিনী অবলম্বনে লিখিত কবির পরিণততম এবং সম্ভবত শেষতম কাব্য। এতে দিলীপ, রঘু, অজ, দশরথ এবং রামচন্দ্রই বিশেষভাবে এবং বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছেন। ড. সুকুমার সেন ‘রঘুবংশ’কেই কালিদাস রচিত একমাত্র আখ্যায়িকা কাব্য এবং একালের উপন্যাসের সমধর্মী বলে মনে করেন।

কাহিনী : “সূর্যবংশে বৈবস্বতমনুর গোত্রে দিলীপ নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন অপুত্রক, পুত্র কামনায় তিনি পত্নী সুদক্ষিণাকে নিয়ে কুলগুরু বশিষ্ঠের আশ্রমে উপনীত হলে মুনিবর তাঁকে নন্দিনী নাম্মী গাভীর সেবায় নিযুক্ত করেন। সেবায় পরিতুষ্ট নন্দিনীর বরে রাজদম্পতি ‘রঘু’ নামক এক অমিতবীর্য পুত্র লাভ করেন। রঘুর যৌবরাজ্যে অভিষেক-কালে ‘শতাশ্বমেধ যজ্ঞ’ অনুষ্ঠানে নিরত রঘুর যজ্ঞাশ্ব অপহরণ করেন ইন্দ্র। যুদ্ধে ইন্দ্ৰকে তুষ্ট করলেন রঘু, ফলে পিতা দিলীপ যজ্ঞফল প্রাপ্ত হয়ে পুত্রের হস্তে রাজ্যভার তুলে দিয়ে বানপ্রস্থ অবলম্বন করেন (১-৩ সর্গ)। অতঃপর রঘু দিগ্বিজয়ে বহির্গত হয়ে পূর্বদিকে অগ্রসর হলেন। তিনি সুহ্ম, বঙ্গ-আদি দেশ জয় করে দিগ্বিজয়ে বহির্গত হয়ে দিগ্বিজয়ী সম্রাট রূপে ‘বিশ্বজিৎ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে নিঃস্ব হলেন। রঘু কৌৎস মুনির বরে আত্মগুণানুরূপ পুত্র লাভ করেন—এই পুত্রের নাম অজ (৪র্থ সর্গ)। অজ-উপাখ্যানে ইন্দুমতীর স্বয়ম্বর সভা বর্ণনায় সমকালীন ভারতের জীবন্ত চিত্র উদ্ঘাটিত হয়েছে। ইন্দুমতী অজের গলায় বরমাল্য অর্পণ করেন। অতঃপর অজের রাজ্যশাসন, রাজদম্পতির ‘দশরথ’ নামক পুত্রের জন্ম, ইন্দুমতীর আকস্মিক মৃত্যু এবং সে কারণে অজ বিলাপাদি বর্ণনার পর পুত্র দশরথের হস্তে রাজ্যসভার সমাপনান্তে অজের দেহত্যাগ (৫-৮ সর্গ)। অতঃপর নবম সর্গ থেকে পঞ্চদশ সর্গ পর্যন্ত প্রচলিত রামায়ণ-কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। দশরথের রাজত্ব, অন্ধমুনির পুত্রকামনায় পুত্রেষ্টি যজ্ঞ, রামাদি ভ্রাতৃগণের জন্ম, অহল্যা উদ্ধার, হরধনুর্ভঙ্গ ও সীতাবিবাহ এবং যথাক্রমে রামের বনবাস, সীতাহরণ, লঙ্কাযুদ্ধ, রাবণবধ ও সীতা উদ্ধার প্রভৃতি বর্ণিত হয়েছে (৯-১২ সর্গ)। ত্রয়োদশ সর্গে বিমানে রামচন্দ্রের অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন ও যাত্রাপথের বর্ণনা এবং চতুর্দশ সর্গে রামচন্দ্রের রাজ্য শাসনই প্রধান বর্ণনীয় বিষয়। পঞ্চদশ সর্গে সীতার বনবাস, লবকুশের কাহিনী, লক্ষ্মণবর্জন ও রামচন্দ্রের মহাপ্রস্থান বর্ণনার মধ্য দিয়ে রামায়ণ-কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটেছে (১৩-১৫ সর্গ)। অতঃপর ষোড়শ সর্গে রামের বংশধর কুশের রাজ্যশাসন এবং তং কর্তৃক পূর্বশ্রী ফিরিয়ে আনবার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। সপ্তদশ সর্গে কুশপুত্র অতিথির সগৌরবে রাজ্যশাসন বৃত্তান্ত এবং অষ্টাদশ সর্গে ঐ বংশের পুত্র পরম্পরাক্রমে একুশ জন নরপতির কথা অতি সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে। ঊনবিংশ সর্গে রঘুবংশের চরম অবনতির দৃশ্যের একটি বিষাদময় আলেখ্য অঙ্কন করা হয়েছে রাজা অগ্নিমিত্রকে অবলম্বন করে। রাজাদের কামোন্মত্ত জীবন, উদ্দাম বিলাস বিহার, সচিব-অমাত্যগণের ওপর একান্ত নির্ভরশীলতা প্রভৃতি কারণে যে রাজ্যশ্রী বিনষ্ট হয় তারই নিদর্শন রাজা অগ্নিমিত্র। তিনি দুরারোগ্য রাজযক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করলে তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী রাজ্যশাসনভার গ্রহণ করেন (১৬-১৯ সর্গ)”। (অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য)।

সংস্কৃত ভাষায় রচিত মহাকাব্যসমূহের মধ্যে কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ যে শ্রেষ্ঠ— এই অভিমত প্রকাশ করেছেন। পণ্ডিতকুলশিরোমণি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অপরেরাও মোটামুটি এ বিষয়ে অভিন্নতম হলেও এতে একনায়কত্ব এবং রসৈকসিদ্ধির নিয়ম লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। সামগ্রিকভাবে ঐক্যবোধ বিনষ্ট হলেও বিচ্ছিন্নভাবে যে এর প্রতিটি সর্গ অথবা কাহিনী কিংবা বিবরণ রসাঢ্যতা লাভ করেছে, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবসর নেই। ড. সুশীলকুমার দে তাই বলেন, It is rather a gallery of pictures than a unified poem; and yet out of these pictures, which put the uncertain mass of old narrative and traditions into a vivid poetical form, Kalidasa succeeds in evolving one of the finest specimen of the Indian Mahakavya which exhibits both the diversity and plentitude of his powers.” ‘রঘুবংশে’র যে সমস্ত বিচ্ছিন্ন কাহিনী বিশেষভাবে পাঠকদের মনোহরণে সমর্থ হয়েছে, তাদের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য—’দিলীপ ও সিংহের কথোপকথন’, ‘রঘু ও ইন্দ্রের কথোপকথন’, ‘ইন্দুমতীর স্বয়ম্বরসভা’, ‘অজবিলাপ’, ‘রঘুর দিগ্বিজয়’, ‘বিমানযোগে সীতাসহ রামচন্দ্রের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন’ প্রভৃতি। ‘রঘুবংশে’র চল্লিশটির অধিক টীকা রচিত হয়েছিল—এই তথ্যটিই কী কাব্যটির সমুৎকর্ষের যথেষ্ট পরিচায়ক নয়?