আধুনিক ভারতীয় হিন্দী নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্রের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত। হিন্দী নাটক রচনায় তার কৃতিত্ব ও অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। তিনি মৌলিক ও অনুবাদ নাটক রচনায় তিনি সমান কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। ভারতেন্দুর পিতা গিরিধর ব্যাস (প্রকৃতনাম বাবু গোপাল চন্দ্র) ‘নহুষ নাটক’ রচনা করেন। এইটি সম্ভবত প্রথম হিন্দি নাটক। ভারতেন্দুর পূর্বে লেখা নাটকে ব্রজভাষার প্রাধান্য ছিল। ভারতেন্দুই প্রথম খড়িবোলী ভাষায় নাটক রচনার সূচনা করেন। প্রথম দিকে তিনি বাংলা নাটক পাঠ করে। উৎসাহিত হন ও অনুবাদ কর্মে হাত দেন। জগন্নাথপুরী যাত্রাকালে বর্ধমানে এসে তিনি বাংলা নাটকের সঙ্গে পরিচিত হন। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর রচিত বাংলা নাটক ‘বিদ্যাসুন্দর’ অবলম্বনে তিনি ‘বিদ্যাসুন্দর’ রচনা করেন।

‘বিদ্যাসুন্দর’ তিন অঙ্কে রচিত। প্রথম অঙ্কে চারটি ও অন্যগুলিতে তিনটি করে দৃশ্য আছে। বর্ধমানের মহারাজ বীরসিংহের কন্যা বিদ্যা প্রতিজ্ঞা করেছিল, যে তাকে শাস্ত্রার্থে পরাজিত করতে পারবে তাকেই সে বিবাহ করবে। অনেক রাজকুমার এসে বিদ্যার প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে যায়। অবশেষে কাঞ্চীর গুণসিন্ধু রাজার পুত্র সুন্দর বর্ধমানে আসে। এক মালির সাহায্যে গুপ্ত সুড়ঙ্গ দিয়ে সে রাজবাড়িতে প্রবেশ করে ও তর্কে বিদ্যাকে পরাস্ত করে। সুন্দর চোর সন্দেহে ধরা পড়ে এবং তাকে কারাগারে পাঠানো হয়, পরে রাজা নিজের ভুল বুঝতে পেরে সুন্দরের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেন।

প্রথম অঙ্কে কন্যার বিবাহ ও প্রতিজ্ঞা বিষয়ে রাজার আক্ষেপ প্রকাশ পেয়েছে। মন্ত্রী রাজাকে গুণসিন্ধু রাজার ছেলে সুন্দরের কথা বললে রাজা কবিরাজ গঙ্গাভাটকে কাঙ্খী রাজার কাছে প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত করেন। ইতিমধ্যে সুন্দর নিজেই এসে উপস্থিত হয়। দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কে তার বর্ধমান আগমনের সুন্দর বর্ণনা আছে। বর্ধমান নগরের বর্ণনা সে নিজেই করেছে। সে বলেছে যে তার পিতার রাজধানী সুন্দর, কিন্তু এইরকম সুন্দরস্থান পৃথিবীতে সে আর দেখেনি।

প্রথম অঙ্কে সুন্দরের আগমন দ্বিতীয় অঙ্কে সুড়ঙ্গ পথে বিদ্যার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও গোপন বিবাহ এবং তৃতীয় অঙ্কে চোররূপে ধৃত হওয়া ও পরে রাজাদেশে মুক্তি প্রভৃতি ঘটনাক্রমে বাংলা নাটকের ছায়া অবলম্বনে লেখা হলেও তাই বিদ্যাসুন্দর নাটকটি ভারতেন্দুর নাট্যপ্রতিভার মৌলিকত্বের পরিচয় বহন করেছে।

১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয় ‘পাষণ্ডপীড়ন’। নাটকটি কৃষ্ণ মিত্রের বিখ্যাত সংস্কৃত নাটক ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়ের তৃতীয় অঙ্কের অনুবাদ। শ্রদ্ধাযুক্ত ধর্ম পালন ও ঈশ্বর ভক্তির কথাই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। করালরূপী দিগম্বর সিদ্ধান্ত করালরূপ ধারণ করে উপস্থিত হয় ও করুণাকে তিরস্কার করে। একে একে গেরুয়াধারী ভিক্ষুক মদ্যপান করায়। কাপালিক হতাশ হয় কিন্তু মহামোহ রাজার বন্দী না হয়ে ঈশ্বরের কার্যসাধনে ব্রতী হয়। শান্তি ও করুণা দুই সখী এই সব পাপীদের কথা দেবী বিষ্বভক্তির কাছে বলতে চলে যায়।

১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতেন্দু ‘বৈদিকী হিংসা হিংসা ন ভবতি’ নামে একটি মৌলিক প্রহসন প্রকাশ করেন। মদ্যপান যে অহিতকর এবং বৈদিক শাস্ত্রবিরোধী নাট্যকার তা দেখাতে চেয়েছেন।

প্রথম অঙ্কের ঘটনাস্থল হল রক্তে রাঙা রাজভবন। রাজা জানতে চান, যে মাছ কীভাবে খাদ্য হয়ে উঠল। পুরোহিত তাকে বলেছেন যে মাছই অমৃত। পুরোহিত “ন মাস ভক্ষণে দোষো ন মদ্যে ন চ মৈথুনে” ইত্যাদি শ্লোকোদ্ধার করে মদ্যমাংসাহারের শাস্ত্রীয় সমর্থন উপস্থিত করে।

এই প্রহসনটিতে মদ্যপানাসন্তির বিরোধিতার স্থলে বিধবা বিবাহকেও ব্যঙ্গ করা হয়েছে। ভারতেন্দু যে সব সংস্কৃত নাটক অনুবাদ করেছিলেন তার মধ্যে কবি কান কৃত ‘ধনঞ্জয় বিজয়’ ‘অন্যতম। বিরাট রাজ্যে পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময় কৌরবরা বিরাট রাজ্য আক্রমণ করেছিল অর্জুন রাজকুমারের সারথি রূপে কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে নাটকটি প্রথম প্রকাশিত হয়।

ভারতেন্দুর বন্ধু বালেশ্বর প্রসাদ ভারতেন্দুকে একটি বালপাঠোপযোগী নাটক লিখতে অনুরোধ করেন। বন্ধুর অনুরোধ রক্ষার্থে শৃঙ্গার রসহীন ‘সত্য হরিশ্চন্দ্র’ নাটকটি রচিত হয়। হরিশ্চন্দ্রচন্দ্রিকা পত্রিকায় ক্রমশ প্রকাশিত হয়। লেখক নিজেই উপক্রম অংশে জানিয়েছেন যে বন্ধুর অনুরোধে তিনি এই রূপক লিখেছেন। চারটি অঙ্কে রূপকটি সম্পূর্ণ। প্রথম অঙ্কের ঘটনা স্থান ইন্দ্রসভা। দেবসভায় হরিশ্চন্দ্রের প্রশংসা কীর্তন বিশ্বামিত্রের ক্রোধের কারণ। হরিশ্চন্দ্র কীভাবে সত্যবাদী আর দানধ্যানী থাকতে পারে তার কাছে একটা বিরাট পরীক্ষা।

দ্বিতীয় অঙ্কের ঘটনাস্থল রাজা হরিশ্চন্দ্রের রাজভবন। সেখানে বিশ্বামিত্র দান প্রার্থনা করে। রাজা বিশ্বামিত্রের মিথ্যা ক্রোধের শিকার হয়ে কপর্দক শূন্য হয়ে পড়ে। বিশ্বামিত্রকে সারা পৃথিবী দান করার পরে দক্ষিণা দেবার জন্য রাজা নিজের শরীর বিক্র করে অর্থোপার্জন করতে যায়।

তৃতীয় অঙ্কে কাশীর ঘাটে মহারাজা হরিশ্চন্দ্রকে ঘুরতে ফিরতে দেখা যায়। হরিশ্চন্দ্রের মধ্যে বিচিত্র ভাবনার দ্বন্দ্ব দেখানো হয়েছে। বিশ্বামিত্র হরিশ্চন্দ্রকে সত্যভ্রষ্ট করতে উদ্যত হয়েও ব্যর্থ হয়। দক্ষিণা আদায়ের জন্য ব্রাহ্মণ বিশ্বামিত্র ভিক্ষুকের মত আচরণ করেছে। অন্যদিকে ডোমসর্দার রূপী ধর্ম তাকে সহায়তা করেছে। বস্তুত ডোমসর্দারের কাছে নিজেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিক্রি করে বিশ্বামিত্রের দক্ষিণা ঋণ শোধ করেছে। চতুর্থ অঙ্কে দক্ষিণ শ্মশান দৃশ্যে সে পত্নী শৈব্যার সঙ্গে পুনমিলিত হয়। পত্নী শৈব্যার পতিব্রাত্য এই নাটকে চমৎকার ফুটেছে। চতুর্থ অঙ্কে শ্মশানের অধিবাসীরা শুধু নয়, স্বয়ং বিশ্বামিত্র এসে হরিশ্চন্দ্রকে ধন্য মেনেছে।

‘কর্পূর মঞ্জুরী’ কবিবচনসুধা পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। সম্বৎসর ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৯ এর মধ্যে রচনাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। মোট চারটি অঙ্কে নাটকটি সম্পূর্ণ। ভারতেন্দু রচিত ‘কপুরমঞ্জুরী’ রাজশেখরের রচনা অবলম্বনে রচিত। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

‘কপুরমারী’ শৃঙ্গাররস প্রধান নাটক। ভাষা অত্যন্ত সরল এবং মনোহর। প্রথম অঙ্কে রাজা রানি বিদূষক এবং সখী বিচক্ষণার কথোপকথন সরস ও রসোপলব্ধির সহায়ক। এই অঙ্কে অদ্ভুতরসের সূচনা ঘটে যখন রাজার ইচ্ছানুসারে ভৈরবানন্দ যোগবলে কুণ্ডল দেশের রাজার কন্যাকে রাজার সামনে হাজির করে। এই কন্যাই কর্পূরমঞ্জুরী। শেষপর্যন্ত রাজা ও কর্পূরমজুরীর মিলন এই নাটকে বর্ণিত। নেপথ্যে বৈতালিকের গান পরিবেশ রচনার সহায়ক হয়ে ওঠে।

১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতেন্দু ‘শ্রীচন্দ্রাবলী’ নাটিকা রচনা করেন। রাধাকৃষ্ণের প্রেম ও মিলনই এই নাটিকার বিষয়। শৃঙ্গার রসের পরিবর্তে ভক্তিরসের প্রাচুর্য দেখা যায় এই নাটিকায়। নাটকটি ব্রজভাষায় অনূদিত হয়। পরে পণ্ডিত গোপাল শাস্ত্ৰীকৃত সংস্কৃত অনুবাদও প্রকাশিত হয়।

ভারতেন্দুর কবিকল্পনায় সৃষ্ট’ভারতের দুর্দশা’ একটি নাট্যরাসক বা লাস্যরূপক। সমকালীন ভারতবর্ষের‌ দুরবস্থাকে কবি হাস্যপরিহাসের ভঙ্গিতে প্রদর্শন করেছেন। নাটকটি দেখে দর্শক-মনে করুণা সঞ্চার হয়। নাট্যকারের উদ্দেশ্যেও সাধিত হয়। প্রথম দৃশ্যে এক যোগী ব্রজভাষায় লিখিত ভারতবর্ষের দুঃখদুর্দশার চিত্রমূলক একটি গান গায়। গানটির ধ্রুবপদটি এইরকম—

রোঅহু সব মিলিকৈ অবহু ভারত ভাই।

হাহা ভারতদুর্দশা ন দেখি জাই।। ধ্রুব ।।

এই ধ্রুবপদই নাটকটিতে নানাভাবে ও ভাষায় বার বার ফিরে এসেছে। নাটকটি ছয়টি দৃশ্যে রচিত। প্রথম দৃশ্যে লাওনী গানের পরেই দ্বিতীয় অঙ্কের সূচনা। স্থান শ্মশান ও ভাঙাচোরা মন্দির। কাক, কুকুর এদিকে ওদিকে ঘুরছে। ইতঃস্তত দেহাস্থি ছড়িয়ে আছে। এই রকম স্থানে ভারতমাতা প্রবেশ করে। ছেড়া কাপড় পরা, মাথায় অর্ধ মুকুট, হাতে একটা ছড়ি, অঙ্গ শিথিল। দৈবাহত ভারত ক্রন্দনরুতা। কোথায় সেই যোগ্যতা, বিদ্যা, সভ্যতা, উদ্যোগ, উদারতা ধন, বল, মান, দৃঢ়চিত্ততা আর সত্য? ইংরেজ শাসনে ভারতের দুঃখদশা এবং উদ্ধার প্রার্থনা এই দৃশ্যে অনুরণিত হয়। গান গাইতে গাইতে মূর্ছা যায় ভারত। তাকে তুলে নিয়ে যায় নির্লজ্জতা ও আশাবেশী মেয়ে।

তৃতীয় অঙ্কে ময়দান দৃশ্য। ফৌজী আস্তানা দেখা যায়। ভারত দুদৈর্ব এসে চিৎকার করে ভারতের খোঁজ করে। দুর্দান্ত প্রতাপ রাক্ষস ভারত দুর্দৈব নাচে গায় আর চিৎকার করে। তার আজ্ঞাবাহী সত্যনাশ ফৌজ তার হুকুম তামিল করতে হাজির হয়। ভারতের সর্বনাশ করার চেষ্টা করে। চতুর্থ অঙ্কে ইংরেজি কায়দায় চেয়ারে সাজানো ঘরে ভারতদুর্দৈব বসে থাকে আর সেখানে একে একে রোগ, আলস্য, মদিরা, অহংকার প্রভৃতি চরিত্র প্রবেশ করে ও গান গায়।

পঞ্চম অঙ্কে দৃশ্যসজ্জা অন্যরকম। এই দৃশ্যে ঘটনাস্থল একটি লাইব্রেরি বা কিতাবখানা, উপস্থিত চরিত্রের মধ্যে এক বাঙালি, মরাঠি, একজন সম্পাদক, একজন কবি, দুই দেশীয় মহাশয় ও সভাধিপতি। এই সভার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে সভাপতি ভারতদুদৈবের বিরুদ্ধে মিলিত সংঘশক্তির জাগরণ বিষয়ে সবাইকে উদীপ্ত করে। এ বিষয়ে উদ্দীপক বক্তৃতা দেয় বাঙালি চরিত্রটি। সবাই যখন ভারতদুর্দৈবের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার উপায় ভাবে তখন কবি চরিত্রটি সাহেব বা ইউরোপীয়ান সাজে বসার কথা ভাবে যাতে তাদের ভারতীয় রূপে চেনা না যায়। কিন্তু দেশীয় চরিত্রটি প্রশ্ন করে, ভারতীয়দের রঙ বদলানো যাবে কিভাবে? তখন বাঙালি চরিত্রটি ভারত-উদ্ধার নাটকে প্রদত্ত ইংরেজ বিতাড়নের উপায়ের উল্লেখ করে।

ষষ্ঠ দৃশ্য গহন বনের মধ্যভাগে ভারত এক বৃক্ষের নীচে অচেতন পড়ে থাকে। চৈতি গৌরী রাগে গান গাইতে গাইতে ভারতভাগ্য প্রবেশ করে—“জাগো জাগো ভাই”। গান শুনে ভারত কিন্তু জাগে না।

‘ভারতদুর্দশা’ কবিবচন সুধা পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয়। প্রয়াগ, কানপুর, কাশী প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে এই নাটকের অভিনয় জনপ্রিয় হয়। ভারতেন্দু ‘ভারত জননী’ একটি অপেরা রচনা করেন। দেশপ্রেমমূলক এই রচনাটি কিরণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভারত মাতা’ নাটকের অনুবাদ। ময়লা শাড়ি পরা অবিন্যস্ত কেশ (মৈলী শাড়ি পহিনে বাল খোলে) ভারত জননী ঘুমন্ত বসে আছে। ভারত সন্তান ইতঃস্তত শুয়ে আছে। ভারতসরস্বতী প্রবেশ করলে ভারতসন্তান ভারতমাতার দুঃখকর অবস্থা বিষয়ে ঠুমরি গায়—ভারত জননী জাগে কিন্তু কাঁদতে কাঁদতে ভারতসরস্বতী প্রস্থান করে। ভারতদুর্গার গান ও প্রস্থানের পর ভারতলক্ষ্মীর। “ভারতলক্ষ্মী মলিনমুখ ভারতমাতা তেরী” গান গায় সোরঠ রাগে। ভারতলক্ষ্মীর প্রস্থানের পর ভারত মাতা জেগে উঠে লক্ষ্মীর অন্তর্ধানে নিজেকে পাপিনী বলে ধিক্কার দেয়। তারপর ক্ষুধার্ত সন্তানদের জন্য তার মনস্তাপ জাগে—“হামারি ঔর হামারে সন্ততি কী লক্ষ্মী বিনা কা গতি হোগী?’ ভারতমাতার সন্তানেরা “বড়ী নন্দ আতী হৈ” বলে ঘুমাতে চায়। ভারতমাতার প্রশ্ন, “বৎস, কব তক ইস প্রকার সে তুম সব নিদ্রিত রহগে?” এই প্রকার মাতাপুত্রদের কথোপকথনের পর দুজন সাহেব প্রবেশ করে। একজন দুরাত্মা, অন্যজন সহৃদয় ও ভারতমাতার দুঃখে দুঃখী। অবশেষে ধৈর্য এসে বলে, জননী কাঁদে কেন, ধৈর্যকে ধারণ করো ও দুঃখকে দূর করা। সন্তানদের প্রতি উপদেশ প্রদানের পর যবনিকা পড়ে।

ঐতিহাসিক গীতিরূপক ‘নীলদেবী’ দশটি দৃশ্যে রচিত। পঞ্জাবের সর্দার সূর্যদেব সিংহকে এক মুসলমান সেনা-নায়ক গোপনে রাতের অন্ধকারে বন্দী করে। সর্দার পত্নী নীলদেবী ও পুত্র সোমদের কিভাবে প্রতিশোধ নেয় এ নাটকে তা বর্ণিত। এই নাটকে ঘটনা সংলাপ ও চরিত্র নির্মাণে লেখকের অখণ্ড মনোযোগ লক্ষ করা যায়।

ভারতেন্দু শেক্সপীয়রের ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিশ’ অবলম্বনে পাঁচ অঙ্কে ‘দুর্লভবন্ধু’ রচনা করেন। তবে নাটকটি অনুবাদ নয় স্বাধীন রচনা। পাত্রী পাত্রী, ঘটনা স্থান সবই এই নাটকে বদলে গেছে। এই ভাবানুবাদটি প্রথম ছাপা হয় হরিশ্চন্দ্র মৈগজিনে।

ভারতেন্দুর লেখা প্রহসনগুলির মধ্যে ‘অন্ধের নগরী’ সর্বোত্তম বলা যায়। এটি তাঁর পরিণত বয়সের রচনা। ‘অন্ধের নগরী’ নৌটঙ্কী শৈলীতে রচিত। প্রহসনটি একটি প্রবাদনির্ভর শিরোনাম যুক্ত—অন্ধের নগরী চৌপট্ট রাজা টকে সের ভাজী টকে সের খাজা। সম্বৎসর ১৯৩৮ সালে নাটকটি রচিত।

বেনারসের দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে বাঙালিরা নেশনল থিয়েটার স্থাপন করলে ভারতেন্দু তাদের বিশেষ সহায়তা করেন। এই নাট্যোৎসাহীরা একবার ‘অন্ধের নগরী’ নাট্যাভিনয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করলে ভারতেন্দু এই নাটকটি মাত্র একদিনে লিখেছেন। ছয়টি অঙ্ক বা দৃশ্যে প্রহসনটি রচিত। প্রথম অঙ্ক–এক মহন্ত তাঁর দুই চেলা নারায়ণ দাস আর গোবর্ধন দাসকে যথাক্রমে পূর্ব ও পশ্চিম দিকে শালগ্রামজীর বালভোগের সামগ্রী সন্ধানে পাঠায়।

দ্বিতীয় অঙ্কে বাজার দৃশ্য। কাবাবওয়ালা, কমলালেবুওয়ালী, মছলীবালী প্রভৃতি দোকানি। সঙ্গে জাতওয়াল (ব্রাহ্মণ) ও টাকায় সের মাল (জাত) বিক্রি করে। এ রাজ্যে সবই টাকায় একসের পাওয়া যায় দেখে গোবর্ধন দাস বড় খুশি হয়, চাল ডাল দুধ সব এক দাম। তার আনন্দ আর ধরে না। তৃতীয় অঙ্কে সে জঙ্গলে গুরুর কাছে ফিরে আসে। যে সাত পয়সা ভিক্ষে করে সে অনেক মিঠাই কিনে এনেছে।

চতুর্থ অঙ্কে রাজসভার দৃশ্য। কোেতায়াল এমন গাড়ি চালিয়েছে যে মন্ত্রীর ছাগল মারা গেছে। তখন রাজা কোতোয়ালকে ফাঁসী দেওয়ার হুকুম দেন। পঞ্চম অঙ্কে ঘটনাস্থল অরণ্য যেখানে গোবর্ধন মহানন্দে মিঠাই খায় সেখানেই রাজার পেয়াদারা তাকে বন্দী করে। তাকে ফাঁসী দেবে শুনে ঘাবড়ে যায় গোবর্ধন। তখন জানা যায় যে বকরি মারার অপরাধে যার ফাঁসি হবার কথা সে এতই পাতলা যে ফাঁসির দড়ি লাগছে না, তাই রাজা হুকুম দিয়েছেন যে সবচেয়ে মোটা তাকে ফাঁসি দাও। আর গোবর্ধন তো মিষ্টি খেয়ে খেয়ে ততদিন ভীষণ মোটা হয়েছে। ফাঁদে পড়ে গোবর্ধন ছেঁচায় ‘গুরুজী মেরে প্রাণ বাঁচাও।

ষষ্ঠ ও শেষ অঙ্কে শ্মশানে ফাঁসির দৃশ্য। গোবর্ধন দাসকে যখন ফাঁসি দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে তখন মহত্ত প্রবেশ করে। তখন অভিমদশায় গুরু শিষ্যের কানে কানে কি যেন বলেন। তার গুরু চেঁচাতে থাকে “তব তো গুরুজী হম অভী ফাঁসী চড়েঙ্গে” গুরুজী প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘নহী বাচ্চা মুঝকো চড়নে দে’ এসব শুনে রাজা জিজ্ঞাসা করেন কী ব্যাপার। কাহে কো আপ ফাঁসি চড়তে হৈঁ? উত্তরে গুরু বলেন”, ইস সময় ঐসী সইত হৈ কি জো মরেগা সীধা বৈকুণ্ঠ জায়েগা” তখন মন্ত্রী বলে, “তব তো হয়ে ফাঁসি চড়েঙ্গে” তাকে থামিয়ে রাজা বলেন চুপ রহো সব লোগ!…. হাম কো ফাঁসি চড়াও জলদি, জলদি”।

সাতটি দৃশ্যে রচিত ‘সতী প্রতাপ’ নাটকটিও ভারতেন্দুর নাট্য প্রতিভার পরিচয়বাহী। নাটকটি অসম্পূর্ণ। সামাজিক নাটক ‘প্রেমযোগিনী’ অসম্পূর্ণ হলেও নাট্যকারের প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করেছিল।

ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্র মৌলিক ও অনুবাদ নাটকের বিশেষ কৃতি নাট্যকার। সর্বত্রই তাঁর নাট্য প্রতিভার পরিচয় মুদ্রিত। সমাজ ভাবনায় ভাবিত নাট্যকার রূপে তিনি সমসাময়িক জীবন ও সমাজকে তুলে ধরেন। আবার পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক নাট্য রচনার ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য অনস্বীকার্য।